“সাইকোথেরাপির প্রতি আপনার আগ্রহী হবার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে কি বলবেন?” জানতে চাইলেন ইন্দিরা শর্মা। চোখের বিশাল চশমাটার কারণে তার দিকে তাকালে পেঁচার কথা মনে হচ্ছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
ইন্দিরা গ্রোভের কনসাল্ট্যান্ট সাইকোথেরাপিস্ট। বয়স ষাটের কাছকাছি হলেও চেহারার কমনীয় ভাবটা কমেনি। গোলাকার মুখের সাথে কাঁচা-পাকা চুলগুলো বেশ মানিয়ে গেছে। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে মিষ্টি করে হাসলেন একবার, যেন বোঝাতে চাইছেন যে এই প্রশ্নটা নিতান্তই জড়তা কাটানোর প্রেক্ষিতে করা। আগামী প্রশ্নগুলো হয়তো আরেকটু কৌশলী হবে।
ইতস্তত করতে লাগলাম। প্যানেলের বাকি সবাই যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা স্পষ্ট টের পাচ্ছি। বললাম যে হাইস্কুলে পড়ার সময় একটা কেয়ার হোমে পার্ট-টাইম চাকরি করেছি আমি, সেখান থেকেই সাইকোলজির প্রতি আগ্রহ জন্মে। আর সেই আগ্রহের দরুণই একসময় সাইকোথেরাপির ওপরে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করি। জানতাম যে এরকম কিছুই শুনতে চাইছে ইন্টারভিউ প্যানেলের সদস্যরা। কথা বলার সময় সবার চোখের দিকেই তাকিয়েছি, যাতে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে এরকমটা না ভেবে বসে কেউ।
“বোধহয় মানুষকে সাহায্য করতে চাওয়াটাই মূল কারণ,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম। “আসলেই।”
যত্তসব ফালতু কথা।
মানে, মানুষকে সাহায্য করার ইচ্ছে আছে আমার, তবে সেটা মুখ্য কারণ নয় এই পেশায় আসার। প্রশিক্ষণ শুরু হবার পর এই কারণটা মাথায় আসে। মূল উদ্দেশ্যটা শুনলে অনেকে হয়তো আমাকে স্বার্থপর ভাববে। আসলে নিজেকে সাহায্য করার জন্যে এই পথ বেছে নিয়েছি আমি। যারা অন্যদের মানসিক সুস্থতা রক্ষায় কাজ করে তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই এই কথাটা প্রযোজ্য বলে আমার বিশ্বাস। সাইকোথেরাপির প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই কারণ আমরা প্রত্যেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অথবা একসময় বিপর্যস্ত ছিলাম। তবে সেটা স্বীকার করে নেবার মানসিকতা সবার আছে কি না, তা ভাববার বিষয়।
মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়ার পর ছোটবেলায় বেশ লম্বা একটা সময় কিন্তু আমরা কিছু মনে রাখতে পারি না। মস্তিষ্কের স্মৃতি-ধারণ ক্ষমতা পুরোপুরি বিকশিত হতে কিছুটা সময় লাগে। অনেকে আবার ভাবে যে ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি যেরকম সমুদ্রের ফেনা থেকে একদম নিখুঁত হয়ে জন্মেছিলেন, আমরাও হয়তো পূর্ণ বিকশিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সেই স্মৃতিহীন দশা থেকে পরবর্তী দশায় পদার্পণ করি। কিন্তু মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ে চলমান গবেষণার কারণে আমরা এখন জানি যে ধারণাটা ভুল। জন্মের সময় আমাদের মস্তিষ্কের অবস্থার সাথে কাদামাটির তুলনা করা যায়। আর সেটা কোন অবস্থাতেই দৈবচরিত্রের মত নিখুঁত নয়। যেমনটা। সাইকোঅ্যানালিস্ট ডোনাল্ড উইনিকট বলেন, “শিশু বলে আদতে কিছুর অস্তিত্ব নেই।“ আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশের ওপর পারিপার্শ্বিকতা আর সাহচর্যের প্রভাব প্রবল; আর সেই প্রভাব নিখুঁত চরিত্রের জন্ম দেয় না। কাদামাটিকে নির্দিষ্ট একটা রূপ দেয়ার পেছনে কুমারের যেরকম ভূমিকা থাকে, তেমনি আমাদের চরিত্রের রূপায়নের কারিগর হিসেবে মা-বাবা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।
সংগত কারণেই এই চিন্তাটা কিছুটা ভীতিকর। কে জানে সেই স্মৃতিহীন দশায় আমাদের কিরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে! হয়তো সহ্য করতে হয়েছে নানারকম যন্ত্রনা আর ভোগান্তি। ঠিকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের চারিত্রিক গঠনপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বড় হবার সময় আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গি ছিল ভয়, অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তা। মাঝে মাঝে মনে হতো যে আমার অস্তিত্ব না থাকলেও দুশ্চিন্তাটুকুর অস্তিত্ব ঠিকই থাকবে।
আর এরকমটা অনুভূত হবার পেছনের কারণ যে বাবা, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই এখন।
বাবা কখন কোন পরিস্থিতিতে রেগে যাবেন বা কি করবেন সেটা আগে থেকে বোঝার কোন উপায় ছিল না। একদম সাধারণ কোন মন্তব্য বা। সামান্য ভিন্নমত পোষণও হুটহাট রাগিয়ে তুলতে তাকে। এরপর যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটতো সেটা থেকে রেহাইয়ের কোন উপায় ছিল না। তার চিৎকার চেঁচামেচির তোড়ে পুরো বাসা কাঁপতো। কখনো কখনো ভয়ে ছুট দিলে পেছন পেছন তাড়া করে আসতেন। অগত্যা বিছানার নিচে বা দেয়ালের পাশে লুকোনোর চেষ্টা করতাম। মনে মনে প্রার্থনা চলতো যাতে কোন এক অদৃশ্য শক্তিবলে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যাই। তবে শেষরক্ষা হতো না, তার হাতজোড়া ঠিকই টেনে বের করে আনতো আমাকে। এরপর বাতাসে শিষ কেটে এসে আমার শরীরে নানারকম নকশা আঁকতো তার কোমরের বেল্ট। প্রতিটা আঘাতে জ্বলে উঠতে শরীর। একসময় যেভাবে হুট করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই হঠাৎ থেমে যেত অত্যাচার। বাচ্চারা যেভাবে রেগেমেগে খেলার পুতুল ছুঁড়ে মারে, ঠিক সেভাবে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলা হতো আমাকে। নিশ্চল পড়ে থাকতাম সেখানে।
বাবার ওরকম রেগে ওঠার কারণ কখনো বুঝিনি। শাস্তিটুকু আসলেও প্রাপ্য ছিল কি না, এ প্রশ্ন নিজেকে হাজারবার করেছি। মা’র কাছে যখন জানতে চাইতাম যে বাবা আমার ওপর সবসময় রেগে থাকে কেন, তখন জবাবে হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাতো সে। “আমি কিভাবে বলবো? তোমার বাবা একটা আস্ত উন্মাদ।”