কানাঘুষো চলতেই থাকে। রহস্যের জবাব তো পাওয়া যায়ই না, বরং অ্যালিসিয়াকে ঘিরে উদ্ভব ঘটে নিত্য নতুন প্রশ্নের। বিশেষ করে তার চুপ থাকা নিয়ে। কেন মুখে কুলুপ এঁটেছে সে? কিছু লুকোচ্ছে? কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে? যদি তাই হয় তাহলে কাকে বাঁচাতে চাচ্ছে সে? কেন?
মনে আছে, সেসময় আমি ভাবতাম, অ্যালিসিয়াকে নিয়ে এসব জল্পনা কল্পনা, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের কেন্দ্রে আছে এক অপার শূন্যতা। মৌনতা।
শুনানিতে বিচারক সাহেবও অ্যালিসিয়ার মুখ না খোলাকে ভালো চোখে দেখেননি। বিচারক অ্যালভারসটোন যুক্তি দেখান, নির্দোষ লোকেরা সাধারণত চড়া গলায় নিজেদের নির্দোষিতা দাবি করে। অ্যালিসিয়া মুখে তো কুলুপ এঁটেছিলই, হাবভাবেও অনুতাপের কোন চিহ্ন ছিল না। শুনানি চলাকালীন সময়ে একবারের জন্যেও চোখের জল ফেলেনি সে-গণমাধ্যম কর্মীদের জন্যে মুখরোচক আরেকটা তথ্য। পুরোটা সময় চেহারা ছিল অভিব্যক্তিহীন, শীতল।
আসামী পক্ষ তাই বাধ্য হয় সাজা কমানোর চেষ্টা করতে। তারা বলে, ছোটবেলা থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছে অ্যালিসিয়া। বিচারক প্রথমে খোঁড়া অজুহাত হিসেবে নাকচ করে দেন এই দাবি। কিন্তু পরবর্তীতে ইম্পেরিয়াল কলেজের ফরেনসিক সাইকিয়াট্রি বিষয়ের অধ্যাপক ল্যাজারুস ডায়োমেডেসের বক্তব্য শুনে সিদ্ধান্ত বদলান তিনি। মি. ডায়োমেডেস অধ্যাপনার পাশাপাশি উত্তর লন্ডনের মানসিক হাসপাতাল গ্রোভ’-এ ক্লিনিকাল ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত। সাধারণত সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের রাখা হয় সুরক্ষিত এই ফরেনসিক ইউনিটে। তিনি বলেন, অ্যালিসিয়ার কথা বলতে না চাওয়া তার মানসিক অস্থিতির দিকেই নির্দেশ করছে, তাই রায় ঘোষণার সময় সেটাও বিবেচনা করা উচিৎ।
সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে ডায়োমেডেসের কথার মানে দাঁড়ায়-অ্যালিসিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে সাইকিয়াট্রিস্টরা সাধারণত কারো মুখের ওপর একথা বলেন না।
একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে এই ব্যাখ্যাটাই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হবে। যদি আসলেও অ্যালিসিয়ার কোন সমস্যা না থেকে থাকে, তাহলে ভালোবাসার মানুষটাকে কেন চেয়ারে বেঁধে একদম কাছ থেকে মুখে গুলি করবে সে? কেনই বা ঘটনার পর তার চেহারায় ফুটে উঠবে না অনুতাপ? কারো সাথে কোন কথাও তো বলেনি। সমস্যা আলবত আছে। সোজা বাংলায় অ্যালিসিয়া বদ্ধ উন্মাদ।
অন্যথা হবার সম্ভাবনাই নেই।
শেষ পর্যন্ত আসামী পক্ষের দাবি মেনে নেন বিচারক অ্যালভারস্টোন। জুরিদেরও সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুরোধ করেন তিনি। অ্যালিসিয়াকে অধ্যাপক ডায়োমেডেসের তত্ত্ববধায়নে ভর্তি করা হয় গ্রোভে। সেই ডায়োমেডেস, যিনি হস্তক্ষেপ না করলে বিচারক আসামীপক্ষের দাবি গ্রাহ্যই করতেন না।
অ্যালিসিয়ার যদি আসলেও কোন মানসিক সমস্যা না থেকে থাকে, তাহলে বলতে হবে যে অভিনয়ের দরুণ এযাত্রা পার পেয়ে গেছে সে। লম্বা কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে না তাকে। পুরোপুরি সুস্থ হলে কয়েক বছরের মধ্যেই ছাড়া পাবে। তাহলে তো এতদিনে একটু একটু করে সুস্থ হবার অভিনয় শুরু করার কথা তার, তাই না? এক-আধটা কথা বলবে; কৃতকর্ম নিয়ে অনুশোচনায় ভোগা শুরু করবে। কিন্তু না, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যায়-অ্যালিসিয়া কথা বলে না।
মৌনতাই তার একমাত্র পাথেয়।
আর তাই ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে গণমাধ্যমের উন্মাদনা মিইয়ে আসে, ভাটা পড়ে উৎসাহে। আপাত চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামীদের তালিকায় নাম উঠে যায় তার, কালের পরিক্রমায় যাদের পরিচয় ভুলে যাই আমরা সবাই।
তবে সবার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়। অ্যালিসিয়া বেরেনসনের রহস্য নিয়ে আমার মতন হাতে গোণা কয়েকজন এখনও আগ্রহী। জানতে চাই তার এরকম মুখে কুলুপ এঁটে থাকার আসল কারণটা কি। একজন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে আমার মনে হয়েছিল যে, গ্যাব্রিয়েলের মৃত্যুতে মানসিক আঘাত পেয়েছে সে। তার চুপ থাকা সেই মানসিক আঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। কৃতকর্ম কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি অ্যালিসিয়া, তাই থমকে গেছে চিরতরে। কিন্তু তাকে সাহায্য করতে চাই আমি চাই যে সে সুস্থ হয়ে উঠে নিজের মুখে সব খুলে বলুক। তাকে সাড়িয়ে তুলতে চাই।
এটা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে অ্যালিসিয়া বেরেনসনকে সাহায্য করার যোগ্যতা আমার আছে। একজন ফরেনসিক সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে সমাজের সবচেয়ে ভঙ্গুর মানসিকতার রোগিদের নিয়ে কাজ করেছি। তাছাড়া অ্যালিসিয়ার গল্পটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুরণিত করেছে। আমাকে, শুরু থেকেই কেমন যেন একটা সংযোগ অনুভব করছিলাম ওর প্রতি।
দুর্ভাগ্যবশত তখনও ব্রডমুরে কর্মরত ছিলাম আমি বিধায় ওকে সাহায্য করাটা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু ভাগ্যদেবীর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন।
অ্যালিসিয়া বেরেনসন ভর্তি হবার ছয় বছর পর অবশেষে দ্য গ্রোভে ফরেনসিক সাইকোথেরাপিস্টের পদ খালি হয়। বিজ্ঞপ্তিটা দেখামাত্র বুঝে গিয়েছিলাম, মনে মনে এতদিন এরকম কিছুই চেয়ে এসেছি। তাই চোখ বুজে আবেদন করে ফেলি।
.
১.৩
আমার নাম থিও ফেবার, বয়স বেয়াল্লিশে। সাইকোথেরাপিস্ট হয়েছি কারণ আমার নিজের মানসিক অবস্থাও একসময় আমার রোগিদের মতনই ছিল। তবে ইন্টারভিউতে যখন আমাকে যখন প্রশ্নটা করা হলো, তখন সত্যটা চেপে গেছি।