হয়তো কথাগুলো আংশিক সত্য। অ্যালিসিয়া বেরেনসন খুনি হতেও পারে, আবার না-ও পারে। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে সে একজন শিল্পী। তাই নিজের অনুভূতিগুলো ভেতরে জোর করে দমিয়ে না রেখে এভাবে ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে প্রকাশ করার ব্যাপারটা আমার কাছে তাই অস্বাভাবিক ঠেকেনি। জীবনে হয়তো প্রথমবারের মতন ছবি আঁকার মধ্যে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে তার চিত্ত। কিন্তু এরকম বেদনার্ত সময়ে প্রশান্তি অনুভব করা কি আদৌ সম্ভব?
ছবিটা একটা আত্মপ্রতিকৃতি। ক্যানভাসের বামদিকে একদম নিচে হালকা নীল গ্রিক অক্ষরে ছবিটার নামও লিখে দেয় সে।
একটা শব্দ : অ্যালসেস্টিস।
.
১.২
অ্যালসেস্টিস গ্রিক পুরাণের এক চরিত্র। তার ভালোবাসার গল্পটা যেকোন করুণ কিংবদন্তিকে হার মানাবে। স্বামী অ্যাডমেতাসের জন্যে স্বেচ্ছায় নিজের জীবনাবসানের শর্ত মেনে নেয় সে। রাজি হয় ইহজগতের মায়া তুচ্ছ প্রতিপন্ন করে নিজে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে। সে বাদে অন্য কেউ কিন্তু এগিয়ে আসেনি অ্যাডমেতাসকে রক্ষা করতে। স্বেচ্ছা-বলিদানের এই কাহিনীর সাথে অ্যালিসিয়ার সার্বিক পরিস্থিতির মিল ঠিক কোথায়, তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। লম্বা একটা সময় ভেবেছি ব্যাপারটা নিয়ে। অবশেষে সত্যটা একদিন সামনে আসলে
নাহ, এভাবে তাড়াহুড়ো করে বললে গোটা চিত্রটা বুঝতে অসুবিধে হবে। এর চেয়ে বরং একদম গোড়া থেকে শুরু করি। ঘটনাগুলো আপনা থেকেই প্রকাশ পাবে সেক্ষেত্রে। অযথা রঙ চড়িয়ে অথবা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু বলার সুযোগ আমার নেই। ধীরে সুস্থে, সতর্কভাবে ধাপে ধাপে এগোনোটাই শ্রেয়। কিন্তু শুরু করবোটা কোথা থেকে? নিজের পরিচয় দেয়া উচিৎ, কিন্তু এ মুহূর্তে না দিলেও অসুবিধে নেই; আমি তো আর এই গল্পের মূল চরিত্র নই। কাহিনীটা মূলত অ্যালিসিয়া বেরেনসনের, সুতরাং তাকে এবং তার আঁকা ‘অ্যালসেস্টিস’ দিয়েই শুরু করছি।
ছবিটা একটা আত্মপ্রতিকৃতি। ক্যানভাসে দেখা যাবে অ্যালিসিয়া তার স্টুডিওতে নগ্ন দেহে ইজেলের সামনে তুলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দেহাবয়বের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লালচে চুলগুলো কঙ্কালসার কাঁধ বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নিচের দিকে। ফ্যাকাসে ত্বক ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে নীলচে শিরা-উপশিরা। দুই হাতের কব্জিতে না শুকানো তাজা ক্ষত। আঙুলের ফাঁকে নিপুণভাবে তুলিটা ধরা। লাল রঙ চুঁইয়ে পড়ছে ওটা থেকে-নাকি রক্ত? আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যে ছবি আঁকায় মত্ত অ্যালিসিয়া, কিন্তু তার সামনের ক্যানভাসটা একদম খালি। তেমনি তার চেহারাও অভিব্যক্তিহীন। কাঁধের ওপর দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটটা ঈষৎ ফাঁকা। মুক।
মামলার শুনানি চলাকালীন সময়েই ছবিটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে জিন ফিলিক্স মার্টিন। সোহোতে অবস্থিত তার ছোট্ট গ্যালারিটাই অ্যালিসিয়ার যাবতীয় চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে এসেছে সবসময়। স্বাভাবিকভাবেই তার এই সিদ্ধান্ত বিতর্কের ঝড় তোলে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, স্বামীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবিটা দেখার জন্যে আর্ট গ্যালারির বাইরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতন বিশাল লাইন।
অন্যান্য শিল্প-প্রেমীদের সাথে সেদিন লাইনে আমিও ছিলাম। লম্বা একটা সময় অপেক্ষা করেছি পাশের সেক্স-শপটার সামনে দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে এগোতে থাকে লাইন। ভেতরে ঢোকার পর আমাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই আরাধ্য ছবিটার সামনে। যেন মেলার মূল আকর্ষন ‘ভুতুড়ে বাড়ি’ দেখতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একদল মানুষকে। অবশেষে নিজেকে ‘অ্যালসেস্টিস’-এর মুখোমুখি আবিষ্কার করি।
দীর্ঘ একটা সময় অ্যালিসিয়ার চেহারার দিকে তাকিয়ে তার চোখের দৃষ্টিটা বোঝার চেষ্টা করি, কিন্তু কোন লাভ হয় না। ছবিটা আমার বোধগম্যতার বাইরে। সেই নির্বিকার, অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অ্যালিসিয়া। অপাপবিদ্ধতা বলুন কিংবা অনুশোচনা-কোনটারই ছোঁয়া নেই অভিব্যক্তিতে।
অন্যদের অবশ্য তাকে বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।
“দেখেই মনে হয় শয়তান,” আমার পেছনে ফিসফিসিয়ে বলে এক মহিলা।
“তাই না?” তার সঙ্গিও একমত পোষণ করে এই বিষয়ে। “ঠাণ্ডা মাথার খুনি।”
অ্যালিসিয়ার দোষ প্রমাণিত হবার আগেই এরকম মন্তব্য করাটা উচিৎ নয় বলেই মনে হয় আমার কাছে। কিন্তু তাই বলে বাস্তবতা অস্বীকারের সুযোগ নেই। সকলে ধরেই নিয়েছে সে দোষি। ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো শুরু থেকেই গল্পের ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে তাকে।
অবশ্য ঘটনাস্থলের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে সাধারণ কারো পক্ষে এরকমটা ভাবাই স্বাভাবিক। গ্যাব্রিয়েলের মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। একা। বন্দুকের গায়ে প্রাপ্ত আঙুলের ছাপও তার। গ্যাব্রিয়েলকে যে সে-ই হত্যা করেছে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কখনোই ছিল না। কিন্তু খুনটা কেন করেছে সে, এটা রহস্য থেকে যায়।
এই ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে আলাপ আলোচনা হয়েছে বিস্তর। নানাধরণের তত্ত্ব ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। উত্তাপ ছড়িয়েছে রেডিও চ্যানেলগুলোর সকালবেলার শো-তে। অভিজ্ঞ আলোচকেরা চেষ্টা করেছে অ্যালিসিয়ার এহেন কৃতকর্মের উদ্দেশ্য উদ্ঘাটনের। কেউ তার পক্ষে কথা বলেছে আবার কেউ কেউ সরাসরি তাকেই দোষারোপ করেছে। একটা তত্ত্ব অনুযায়ী গোটা ব্যাপারটাই একটা দুর্ঘটনা। হয়তো কোন সেক্স গেমে মত্ত ছিল দু’জনে, গ্যাব্রিয়েলের হাত পা বাঁধা ছিল সেজন্যেই। আবার অনেকে আঙুল তোলে সেই পুরনো পাপীর দিকেই-ঈর্ষা। হয়তো অন্য কোন নারীর সাথে স্বামীর সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি অ্যালিসিয়া। কিন্তু শুনানিতে গ্যাব্রিয়েলের ভাই দাবি করে যে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা বা বিশ্বস্ততার কোন কমতি ছিল না তার। তাহলে কি টাকাপয়সার কোন ব্যাপার? স্বামীর মৃত্যতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল না অ্যালিসিয়ার। বরং দু’জনের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তার সম্পত্তির পরিমাণই বেশি।