গ্যাব্রিয়েল বেরেসন খুন হয় ছয় বছর আগে, চুয়াল্লিশ বছর বয়সে। অগাস্টের পঁচিশ তারিখে (সে বছর বড় বেশি গরম পড়েছিল, আপনাদের মনে আছে বোধহয়) হত্যা করা হয় তাকে। তাপমাত্রার পারদ রেকর্ড ছুঁয়েছিল সেবার। যেদিন সে মারা যায় সেদিন তাপমাত্রা ছিল বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
জীবনের শেষ দিনটায় ভোরে ঘুম ভাঙে গ্যাব্রিয়েলের। হ্যাম্পস্টেড হিথের একদম কিনারা ঘেঁষে গ্যাব্রিয়েল আর অ্যালিসিয়ার বাড়ি। সোয়া পাঁচটায় নর্থওয়েস্ট লন্ডনের বাড়িটা থেকে তুলে তাকে শারডিচে পৌঁছে দেয় একটা গাড়ি। দিনের বাকিটা সময় ছাদে ভোগ ম্যাগাজিনের জন্যে মডেলদের ছবি তুলে কাটায় সে।
অ্যালিসিয়া সেদিন কি করছিল সেসম্পর্কে অবশ্য বেশি কিছু জানা যায়নি। আসন্ন প্রদর্শনীর জন্যে কাজে বেশ পিছিয়ে ছিল সে। সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা। হয়তো বাগানের ধারে সামারহাউজটায় ছবি এঁকেছে সারাদিন, কিছুদিন আগেই ওটাকে নিজের স্টুডিও বানিয়ে নেয়ে সে। গ্যাব্রিয়েলের ছবি তুলতে তুলতে দেরি হয়ে যায়, বাসায় ফেরে এগারোটার দিকে।
আধঘন্টা পর তাদের প্রতিবেশী বার্বি হেলমান গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। সাথে সাথে পুলিশে ফোন দেয় সে। ১১:৩৫-এ হেভারস্টক হিল স্টেশন থেকে রওনা হয়ে যায় একটা গাড়ি। ঘটনাস্থলে পৌঁছুতে সময় লাগে তিন মিনিট।
সামনের দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে কালিগোলা অন্ধকার; একটা বাতিও কাজ করছিল না। সন্তর্পণে হলওয়ে পার হয়ে লিভিংরুমে পৌঁছে যায় পুলিশ অফিসারদের দলটা। টর্চের আলোয় সব দেখতে হচ্ছিলো। সেই আলোতেই ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় অ্যালিসিয়াকে। পুলিশের উপস্থিতিতে কোন বিকারই ছিল না তার। যেন বরফ কুঁদে বানানো শীতল একটা মূর্তি, চেহারায় স্পষ্ট আতংকের ছাপ।
মেঝেতে একটা বন্দুক খুঁজে পায় পুলিশ। আর তার পাশেই চেয়ারে হাত পা বাঁধা গ্যাব্রিয়েল। প্রথমে অফিসারদের দলটা ভেবেছিল বেঁচে আছে সে। মাথাটা অবশ্য একপাশে মৃদু হেলে ছিল, সাধারণত জ্ঞান হারালে এরকম হয়। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের চেহারায় টর্চের আলো পড়তেই পরিস্কার হয়ে যায় সবকিছু। গুলির উপযুপরি আঘাতে পুরোপুরি বিকৃত তার সুদর্শন চেহারা। পেছনের দেয়ালে ছিটকে লেগেছে খুলির টুকরো, ঘিলু আর রক্ত।
রক্তের ব্যাপারে বিশেষ করে বলতেই হয়। চারদিকে চাপ-চাপ রক্ত। পেছনের দেয়াল, মেঝে, চেয়ার-কোথাও বাদ নেই। অফিসাররা প্রথমে ভাবে সবটুকুই বুঝি গ্যাব্রিয়েলের রক্ত। কিন্তু পরিমাণটা বড্ড বেশি হওয়াতে সন্দেহ জাগে। আর তখনই টর্চের আলোয় মেঝেতে ঝিকিয়ে ওঠে একটা ছুরি, অ্যালিসিয়ার পায়ের কাছে। এবারে কয়েকটা টর্চ তার দিকে ঘুরে গেলে দেখা যায় সাদা ড্রেসটা রক্তে ভিজে গেছে। দ্রুত একজন অফিসার অ্যালিসিয়ার কব্জিতে আলো ফেলতেই অতিরিক্ত রক্তের রহস্যটাও বোঝ যায়। অঝোরে রক্ত ঝরছে সেখানকার ক্ষত থেকে। ইচ্ছেকৃতভাবে পোচ দেয়া হয়েছে, এটাও পরিস্কার।
অ্যালিসিয়া প্রাণপণে বাধা দেয়, যাতে তাকে কেউ বাঁচাতে না পারে। শেষমেষ তিনজন অফিসার একসাথে ধরে নিরস্ত করে। দ্রুত নিকটস্থ রয়াল ফি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। পথেই জ্ঞান হারায় অ্যালিসিয়া। প্রচুর রক্তক্ষরণ হলেও বেঁচে যায় সেযাত্রা।
পরদিন হাসপাতালের একটা প্রাইভেট রুমে আইনজীবীর উপস্থিতিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। গোটা সময় একদম নিশ্চুপ থাকে অ্যালিসিয়া। ফ্যাকাসে ঠোঁটজোড়া মাঝে মাঝে কেঁপে উঠলেও কোন কথা বেরোয়নি। কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে সে; কিংবা চেষ্টা সত্ত্বেও বলতে পারছে না। তার বিরুদ্ধে গ্যাব্রিয়েলকে হত্যার অভিযোগ আনার সময়েও কিছু বলেনি। যখন বলা হয় যে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে তখনও মুখে রা সরেনি। কিছু স্বীকারও করে না, আবার অস্বীকারও করে না সে।
অ্যালিসিয়া আর কোনদিন কথা বলেনি।
তার এই নীরবতা তাই স্বাভাবিকভাবেই জন্ম দেয় নানারকম গুজবের। ঘটনার পেছনে নিগুঢ়, হঠকারী কোন রহস্য খুঁজতে শুরু করে অনেকে। পরবর্তী কয়েকমাস পত্রিকার শিরোনামে বারবার দেখা যায় অ্যালিসিয়া বেরেনসনের নাম।
সে মুখে কুলুপ আঁটলেও একটা বার্তা অবশ্য ঠিকই দেয়। নিজের পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে। ছবিটা অ্যালিসিয়া আঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর। শুনানির আগ পর্যন্ত হাউজ-অ্যারেস্টে থাকতে হয় তাকে। আদালত থেকে তার দেখভালের জন্যে যে নার্সকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, সেই ভদ্রমহিলার মতে বাসায় পুরোটা সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছবিই আঁকতো অ্যালিসিয়া।
সাধারণত একটা ছবি আঁকার আগে কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে প্রস্তুতি নিত অ্যালিসিয়া। খসড়া স্কেচ, রঙ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট-এসব চলতো লম্বা একটা সময়। পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলে তবেই তুলির ছোঁয়া দিত। কিন্তু এবারে আর প্রস্তুতির ধার ধারেনি সে, অনেকটা স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই স্বামী মারা যাওয়ার ক’দিনের মধ্যে এঁকে ফেলে ছবিটা।
এই তথ্যটা যেন আগুনে ঢিলে দেয়। স্বামী মারা যাবার পর অনুতপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, বরং স্টুডিওতে ঢুকে রঙ নিয়ে রীতিমত খেলাধুলা জুড়ে দিয়েছে-এমনটাই বলেছে অনেকে। কোন বোধ-বিচার নেই! একদম ঠাণ্ডা মাথার খুনিদের মতন।