রুথের মনে আমার জন্যে বিতৃষ্ণা জন্মাবে, এই ভাবনাটার চাইতে আমার জন্যে কষ্ট পাবে সে-এই ভাবনাটাই বেশি পোড়ায়। তার হয়তো মনে হতে পারে যে আমাকে সাহায্য করতে অক্ষম হয়েছে সে। একদম অল্প বয়সি একটা ছেলে, যে তার কাছে সাহায্যের আশায় গিয়েছিল-সযোগ পেয়েও তার সমস্যা দূর করতে পারেনি সে। তার আত্মাটাকে বাঁচাতে পারেনি। ঘন্টার পর ঘন্টা সাইকোথেরাপির কোন মূল্য থাকবে না। কিন্তু ধারণাটা ভুল, কারণ সব দোষ আমার।
কলিংবেল বেজে উঠলো এসময়। কল্পনা থেকে বাস্তবতায় ফিরে এলাম। সন্ধ্যা বেলায় আমাদের বাসায় কেউ আসে না। বিশেষ করে লন্ডন থেকে সারেতে চলে আসার পর কেউ এসময় বেল বাজায়নি। আর শেষ কবে আমাদের বাসায় কাউকে দাওয়াত দিয়েছিলাম, সেটাও ভুলতে বসেছি।
“কারো আসার কথা নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু ক্যাথি জবাব দিল না। টেলিভিশনের শব্দ ছাপিয়ে বোধহয় আমার কথা শুনতেই পায়নি।
আমিই উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। চিফ ইন্সপেক্টর অ্যালেন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। একটু অবাকই হলাম তাকে দেখে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে গাল দুটো একদম লাল হয়ে আছে বেচারার। গলায় মাফলার জড়ানো।
“শুভ সন্ধ্যা, মি. ফেবার।”
“ইন্সপেক্টর অ্যালেন? আপনি এখানে?”
“এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই। তাছাড়া কেসের ব্যাপারে কিছু নতুন তথ্য জানতে পেরেছি। এখন কথা বলতে পারবেন?”
ইতস্তত করতে লাগলাম আমি। “আসলে এখন তো রান্না করবো ভাবছিলাম, তাই
“খুব বেশি সময় লাগবে না।”
হাসল অ্যালেন। না করলেও যে শুনবে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে, অগত্যা একপাশে সরে তাকে ভেতরে আসার সুযোগ করে দিলাম আমি। ভেতরে ঢুকে হাসি আরো চওড়া হলো তার। হাতমোজা আর কোট খুলে ফেলল। “এত ঠাণ্ডা পড়েছে। কিছুক্ষণ পর তুষার ঝরতে শুরু করবে নিশ্চয়ই।” তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে গেলে রুমাল দিয়ে সেগুলো পরিস্কার করে নিল।
“আমাদের বাসায় একটু বেশিই গরম।”
“আরে নাহ, আমার তো এরকম গরমই পছন্দ।”
“আমার স্ত্রী-ও আপনার মতনই।”
ঠিক এই সময় ক্যাথি হলওয়েতে বেরিয়ে এসে আমার আর ইন্সপেক্টর অ্যালেনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। “কি হয়েছে?”
“ক্যাথি, ইনি চিফ ইন্সপেক্টর অ্যালেন। একটু আগে আমার যে রোগির ব্যাপারে কথা বলছিলাম, তার কেসটা তিনিই দেখছেন।”
“শুভ সন্ধ্যা, মিসেস ফেবার।”
“কিছু ব্যাপারে আলাপ আছে আমাদের। খুব বেশিক্ষণ লাগবে না। তুমি গিয়ে গোসল সেরে ফেল। আমি খাবার রেডি করে তোমাকে ডাক দেব,” বলে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে ইঙ্গিত করলাম। “চলুন তাহলে।”
ক্যাথির দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলো ইন্সপেক্টর অ্যালেন। তার পেছন পেছন গেলাম আমি। ক্যাথি তখনও হলওয়েতেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর তার পদশব্দ ওপর তলায় মিলিয়ে গেল।
“কিছু খাবেন?”
“ধন্যবাদ। এক কাপ চা পেলে বর্তে যেতাম।” ভদকার বোতলটার দিকে তাকিয়ে বলল ইন্সপেক্টর।
হাসলাম আমি। “নাকি আরো শক্ত কিছু?”
“নাহ, আপাতত চা-ই দিন।”
“কিরকম চা পছন্দ করেন আপনি?”
“একটু কড়া। খুব বেশি দুধ না দিলেও চলবে। চিনি ছাড়া। চেষ্টা করছি মিষ্টি সবকিছু এড়িয়ে চলার।”
কেতলিতে পানি চাপিয়ে তার মুখোমুখি বসলাম।
“কী যেন বলবেন বলেছিলেন?”
“আসলে মি. মার্টিনের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
“জিন-ফিলিক্স?” বিস্মিত কণ্ঠে বললাম। “তার ব্যাপারে আবার কি কথা?”
“তিনি গ্রোভে এসেছিলেন অ্যালিসিয়ার আঁকা ছবি আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যেতে। তখন বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে আলাপ হয়। চমৎকার একজন মানুষ। অ্যালিসিয়ার ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করার কথা ভাবছেন। তার মতে এখনই মোক্ষম সময়, যেহেতু মিডিয়াতেও অ্যালিসিয়াকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আমার দিকে সমীহের দৃষ্টিতে তাকালো অ্যালেন। “আপনি কিন্তু তাকে নিয়ে একটা বই লিখতে পারেন।”
“আসলে এ বিষয়ে এখনও কিছু ভাবিনি। মাফ করবেন, জিন ফিলিক্সের সাথে আমার সম্পর্কটা এখনও বুঝতে পারছি না, ইন্সপেক্টর।”
“নতুন ছবিটা নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন মি. মার্টিন। এলিফ যে ছবিটায় দাগ দিয়েছে, এটা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই তার। বরং এতে নাকি ছবিটার শিল্পমূল্য বেড়ে গেছে। আমি নিজে আসলে এসব শিল্প-টিল্প নিয়ে অত বেশি বুঝি না, মি. ফেবার। আপনি বোঝেন?”
“নাহ্।” মূল কথায় আসতে তার কতক্ষণ লাগবে কে জানে। কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে আমার।
“যাইহোক, ছবিটার অনেক প্রশংসা করছিলেন মি. মার্টিন। এক পর্যায়ে ভালো করে দেখার জন্যে হাতে তুলে নেন। আর সেখানেই ছিল জিনিসটা।”
“কোন জিনিসটা?”
“এটা।”
জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা চারকোণা জিনিস বের করলো প্রফেসর। দেখামাত্র সেটা চিনতে পারলাম আমি।
অ্যালিসিয়ার ডায়েরি।
এসময় কেতলিটা পানি গরম হয়ে যাওয়ার সংকেত দিলে সেখান থেকে ফুটন্ত পানি নিয়ে একটা মগে ঢালোম আমি। চামচ দিয়ে দুধ মেশানোর সময় খেয়াল করলাম যে হাত কিছুটা কাঁপছে।
“ওহ। আমিও ভাবছিলাম যে কোথায় ডায়েরিটা।”
“ফ্রেমের উল্টোদিকে বামপাশে আটকে ছিল। ওখানে গেল কী করে কে জানে।”
এ কারণেই তাহলে চোখে পড়েনি। ছবিটা এতই অপছন্দ আমার যে একবার উল্টিয়েও দেখিনি। দেখলে…