উত্তেজনা চেপে রাখা কষ্টকর হলো আমার জন্যে। হাসিমুখেই হ্যাঁ বলে দিলাম। “আপনার আর আমার মধ্যেই একটা কথা বলি,” তার মত করেই বললাম, “এরকম সুযোগের স্বপ্নই দেখে এসেছি এতদিন।”
বানিয়ে বলিনি কথাটা। আমি যদি কোন সাইকিয়াট্রিক পরিচালনার সুযোগ পাই, তাহলে সত্যিকার অর্থেই অনেকে লাভবান হবে সেখান থেকে। যেমনটা রুথের কাছ থেকে আমি লাভবান হয়েছি। অ্যালিসিয়াকে যেভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।
আমার জন্যে এখানে আসার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল না, এটা স্বীকার করতেই হবে।
যা চেয়েছিলাম তার সবটুকুই পেয়েছি। প্রায় সবটুকু।
***
গত বছর সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে সারেতে চলে যাই আমি আর ক্যাথি, যেখানটায় বড় হয়েছি আমি। বাবা মারা যাবার সময় বাড়িটা আমার নামে দিয়ে যান। তবে মা যতদিন বেঁচে আছেন, মালিকানা তারই থাকবে। কিন্তু মা অত জটিলতার মধ্যে যেতে চাননি। আমাকে আর ক্যাথিকেই বাড়িটা পুরোপুরি লিখে দিয়ে তিনি একটা বৃদ্ধাশ্রমে উঠে পড়েন।
জায়গাটা লন্ডন থেকে একটু দূরে, এটা ঠিক। কিন্তু ওখানে এরকম খোলামেলা বড় বাসা কখনো পেতাম না। আমরা ঠিক করেছিলাম, সারেতে আসার পরপরই সবকিছু একদম নতুন করে সাজাবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর করা হয়ে ওঠেনি। বাড়ি সাজানোর জন্যে পোর্তোবেল্লো মার্কেট থেকে কেনা জিনিসগুলো এখনও আগের মতনই প্যাকেট করে রাখা আছে। তাই বাড়িটার চেহারা খুব একটা বদলায়নি। বরং ছেলেবেলায় যেমনটা দেখেছি, এখনও সেরকমই আছে।
বাড়িতে পৌঁছে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। যত দ্রুত সম্ভব কোট খুলে ফেললাম, ভেতরটা গ্রিনহাউজের মতন গরম। হলওয়েতে থার্মোস্ট্যাটের তাপমাত্রা কিছুটা কমিয়ে দিলাম। ক্যাথির এরকম গরমে থাকতে ভালো লাগলেও আমার তুলনামূলক ঠাণ্ডাই পছন্দ। এটা নিয়ে প্রায়ই খুনসুটি হয় আমাদের। টিভির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি হলওয়ে থেকে। ইদানীং টিভি দেখার পরিমাণ বেড়ে গেছে ক্যাথির। সবসময় চালুই থাকে চারকোনা জিনিসটা।
লিভিংরুমে উঁকি দিয়ে দেখি সোফায় পা তুলে বসে আছে সে। হাতে বড় একটা চিপসের প্যাকেট। সবসময় এসব হাবিজাবি খেতেই থাকে; এ কারণেই গত কয়েক বছরে ওজন এ রকম বেড়ে গিয়েছে। এখন আর আগের মতন ব্যায়ামের ধার ধারে না। অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে আগের তুলনায়, অবসাদগ্রস্তও বলা যায়। ওর ডাক্তার অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট খাওয়ার কথা বললেও, আমি মানা করে দিয়েছি। বরং একজন থেরাপিস্টের কাছে মনের সব কথা বলে হালকা হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যাথি খব সম্ভবত কারো সাথেই কথা বলতে চায় না।
প্রায়ই খেয়াল করি যে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। তখন ওর মাথায় কি চলে কে জানে। হয়তো গ্যাব্রিয়েলের ব্যাপারে আমাকে বলবে কি না সেসব নিয়ে ভাবে। কিন্তু শেষমেষ কিছুই বলে না। চুপচাপ বসে থাকে, অনেকটা অ্যালিসিয়ার মতন। ওকে সাহায্য করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না কিছুতেই।
মাঝে মাঝে সবকিছু অর্থহীন মনে হয় আমার কাছে। এত কিছু তো ক্যাথিকে কাছে রাখার জন্যেই করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকেও হারাতে হলো।
সোফার হাতলে বসে ওকে কিছুক্ষণ দেখলাম। “আমার এক রোগি প্রায় মরতে বসেছিল ওভারডোজের কারণে। এখন কোমায়।”ক্যাথি নির্বিকার। “খুব সম্ভবত আমার এক সহকর্মীই ইচ্ছেকৃতভাবে কাজটা ঘটিয়েছে। এবারেও কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আমার কথা শুনতে পাচ্ছো তুমি?”
কাঁধ ঝাঁকালো ক্যাথি। “হ্যাঁ, কিন্তু বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।”
“সমবেদনা জানিয়েও কিছু একটা বলতে পারতে।”
“কার জন্যে সমবেদনা? তোমার জন্যে?”
“না, আমার রোগির জন্যে। লম্বা একটা সময় ধরেই তার থেরাপিস্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলাম। অ্যালিসিয়া বেরেসন।” নামটা বলার সময় মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলাম ক্যাথিকে।
মনে হলো যেন আমার কথা কানেই যায়নি তার। এক মুহূর্তের জন্যেও অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না।
“বেশ বিখ্যাত কিন্তু সে, কুখ্যাতও বলতে পারো। কয়েক বছর আসে স্বামীকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে, মনে আছে তোমার?”
“নাহ,” আবারো কাধ ঝাঁকিয়ে চ্যানেল বদলায় ক্যাথি।
হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে নাটকটা এখনও চালু আছে।
আমার অভিনয়ের মাত্রাও আগের তুলনায় আরো বেড়েছে। অনেকের সাথেই এরকম নাটক করতে হয় এখন। এমনকি নিজের সাথেও অভিনয় করি। সেজন্যেই এসব লিখে রাখছি বোধহয়। আত্মহংকারের জন্যে সত্যটা মেনে নিতে কষ্ট হলেও, এখানে বাস্তবতাটুকু জমা থাক।
একটা ড্রিঙ্ক দরকার আমার এখন। রান্নাঘরে গিয়ে ফিজার থেকে ভদকার বোতল বের করলাম। গ্লাসে একটু ঢেলে নিয়ে একবারে গিলে ফেললাম পুরোটা। আরেক শট ঢালোম।
রুথের সাথে যদি এখন আবারো দেখা করি, তাহলে কি বলবে সে? ছয় বছর আগে তার কাছেই তো খুলে বলেছিলাম সবকিছু। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়, তা ভালো করেই জানি। আমি আর আগের থিও নেই। আমার ভেতরের সতোর লেশমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না। রুথের মত বয়স্ক একজনের মানুষের সামনে বসে কি করে অকপটে মিথ্যে বলবো? আমার জীবনে তার অবদান অন্য যে কারো চাইতে বেশি। কি করে তাকে বলবো যে তিনটা জীবন পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছি? আর সেজন্যে বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই আমার ভেতরে। শিষ্টাচার, দয়া, সতোর জায়গা দখল করে নিয়েছে শঠতা, হিংসা আর বিকৃত মানসিকতা। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবি না আমি।