ভুলবেন না, আমি একজন সাইকোথেরাপিস্ট। অ্যালিসিয়ার সাহায্যের দরকার ছিল, আর একমাত্র আমিই জানতাম, কী করে তাকে সাহায্য করতে হবে।
প্রথমদিকে এই ভেবে কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম, সে চিনে ফেলবে আমাকে। যদিও সেদিন মাস্ক পরে গিয়েছিলাম তার বাসায়, তবুও বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কণ্ঠস্বর ইচ্ছে করে পাল্টে ফেলি। কিন্তু অ্যালিসিয়া চিনতে পারে না আমাকে, তাই তার জীবনের নতুন একটা ভূমিকা পালনের সুযোগ পাই। এরপর পলের সাথে তাদের ক্যামব্রিজের বাসার ছাদে কথা বলার বুঝতে পারি আসলে ঐ দিনটাতে কি করেছিলাম আমি।
অ্যালিসিয়ার বাবার মত গ্যাব্রিয়েলও অ্যালিসিয়াকে হত্যা করেছিল সেদিন, কথার মাধ্যমে। সেজন্যেই প্রতিশোধের নেশা চেপে বসে তার মধ্যে। কিন্তু ভার্নন রোজ নয়, তার প্রতিশোধের অনলে ছাই হয় গ্যাব্রিয়েল বেরেনসন। যেরকমটা আমি সন্দেহ করেছিলাম, খুনের ঘটনাটা আসলে অ্যালিসিয়ার বহুদিনের চেপে রাখা ক্ষোভ আর হতাশার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
কিন্তু অ্যালিসিয়া যখন সেদিন থেরাপি রুমে গ্যাব্রিয়েলের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মিথ্যে বলল, বুঝে যাই যে আমাকে চিনে ফেলেছে সে। আর তাই বাধ্য হয়েই সারাজীবনের জন্যে তার মুখটা বন্ধ করে দিতে হলো।
সব দোষ ক্রিস্টিয়ানের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছি-একেই বোধহয় বলে পোয়েটিক জাস্টিস। তবে ওকে ফাঁসানোর জন্যে কোন প্রকার অনুশোচনাবোধ নেই আমার। অ্যালিসিয়ার যখন তাকে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, সেই মুহূর্তে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছে সে। শাস্তি তার প্রাপ্য।
অ্যালিসিয়ার মুখ বন্ধ করা অতটা সহজ ছিল না। ওর শরীরে মাত্রাতিরিক্ত মরফিন ইনজেক্ট করা আমার জীবনে সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। সে যে মারা যায়নি, এতে ভালোই হয়েছে। এখন ইচ্ছে করলে প্রতিদিন তার পাশে গিয়ে হাত ধরে বসে থাকতে পারবে। তাকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলিনি অন্তত।
“আমাদের কাজ তো শেষ?” ইন্দিরার কথায় চিন্তার বাঁধন ছিঁড়ে গেল আমার।
“হ্যাঁ।”
“বেশ। আমার যেতে হবে, বারোটার সময় একজন রোগির সাথে দেখা করার কথা।”
“আপনি চলে যান বরং,” বললাম।
“লাঞ্চে দেখা হচ্ছে তাহলে?”
“হ্যাঁ।”
আমার হাতে আলতো করে একবার চাপ দিয়ে বেরিয়ে গেল ইন্দিরা।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার ইচ্ছা আমার। বড় বেশি ক্লান্ত লাগছে। বাতি নিভিয়ে রুমটা থেকে বের হতে যাবো, এ সময় হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় আসলো আমার। ওখানেই জমে গেলাম।
ডায়েরিটা কোথায়?
ঘরের চারদিকে তাকালাম। সবকিছু খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছি আমি। অ্যালিসিয়ার ব্যক্তিগত সব জিনিস হাতিয়ে দেখেছি।
কিন্তু ডায়েরিটা কোথাও নেই।
এতটা বেখেয়ালী হলাম কী করে? ইন্দিরার প্যাচালের কারণে আসলে বারবার মনোযোগ ছুটে গেছে।
কোথায় ওটা? নিশ্চয়ই এখানেই কোথাও আছে। ডায়েরি ছাড়া ক্রিস্টিয়ানের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করা যাবে না। ওটা লাগবেই আমার।
আবারো তল্লাশি চালালাম ঘরটায়, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দুশ্চিন্তা। সবগুলো কার্ডবোর্ডের বাক্স উল্টেপাল্টে দেখলাম। সব খাম ছিঁড়ে ফেলে স্কেচগুলো মাটিতে ফেলে দিলাম। ওগুলোর মধ্যে লুকোনো নেই জিনিসটা। আবারো সবগুলো ড্রয়ার একটা একটা করে দেখলাম ধৈৰ্য্য সহকারে।
কিন্তু কোথাও পেলাম না ডায়েরিটা।
.
৫.৩
রিসিপশনে ট্রাস্টের জুলিয়ান ম্যাকমেহন অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। হৃষ্টপুষ্ট শরীরের বিশালদেহী একজন মানুষ, লালচে কোঁকড়ানো চুল। কথোপকথনের সময় আপনার আমার মধ্যে থাক ব্যাপারটা, ‘সব কথার শেষ কথা বা বুঝতেই তো পারছেন এই জাতীয় কথা বলে অভ্যস্ত। ট্রাস্টের খুব অল্প সংখ্যক সদস্যই গ্রোভের প্রতি সদয়, জুলিয়ান তাদের মধ্যে একজন। বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে সে।
“প্রফেসর ডায়োমেডেসের সাথে কেবলই কথা হলো। একটা বিষয় আপনার জানা উচিৎ-তিনি কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।”
“ওহ আচ্ছা।”।
“আসলে ওনার চাকরির আরো কয়েক বছর বাকি ছিল। কিন্তু অনুসন্ধান কমিটিকে এড়াতে নিজে থেকেই সরে গেলেন। আপনার আর আমার মধ্যেই থাক কথাটা, কাঁধ নাচালো জুলিয়ান। “বেচারার জন্যে খারাপই লাগছে। এত সুন্দর একটা ক্যারিয়ারের এরকম সমাপ্তি। তবে মিডিয়ার হৈ-হট্টগোলের মধ্যে জড়াতে হবে না। যাইহোক, আপনার কথা বলছিলেন প্রফেসর।”
“আমার কথা?”
“হ্যাঁ। নিজের পদটা আপনাকে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন,” বলে একবার চোখ টিপলো জুলিয়ান। “আপনি নাকি কাজটার জন্যে একদম আদর্শ ব্যক্তি।”
হাসলাম আমি। “সবসময়ই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন প্রফেসর।”
“দুর্ভাগ্যবশত, গত কয়েক দিনের ঘটনার কারণে ট্রাস্টের পক্ষে আর গ্রোভ চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে ক্রিস্টিয়ানের গ্রেফতার এই সিদ্ধান্ত নিতে একপ্রকার বাধ্যই করেছে আমাদের। চিরদিনের জন্যে গ্রোভ বন্ধ করে দিচ্ছি আমরা।”
“খুব বেশি অবাক হলাম না শুনে। অর্থাৎ আমার কোন চাকরি নেই আপাতত?”
“আসলে, সব কথার শেষ কথা-কয়েক মাসের মধ্যে আমরা নতুন। সাইকিয়াট্রিক সার্ভিস চালু করার কথা ভাবছি। যেখানে ট্রাস্টের খরচ আগের তুলনায় অনেক কম হবে। আর আপনি যদি সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে যোগ দেন, তাহলে আমরা খুশি হবো, থিও।”