“অ্যালিসিয়া? তুমি বেঁচে আছো! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! তুমি-”
যদি বলতে পারতাম, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার, পরাজিত সব মানুষের পক্ষ থেকে গ্যাব্রিয়েলের ওপরে প্রতিশোধ নিয়েছিলাম কিংবা গ্যাব্রিয়েলের মধ্যে আমার বাবার ছায়া খুঁজে পেয়েছিলাম সেদিন-তাহলে কিছুটা হলেও শান্তি লাগতো। কিন্তু এখানে মিথ্যে কিছু লিখবো না। সত্যটা হচ্ছে, আমার আর গ্যাব্রিয়েলের চোখের দৃষ্টি হঠাই একে অপরের সাথে পাল্টে যায়। নিজেকে ওর জায়গায় আবিষ্কার করি আমি।
এখন পরিস্কার বুঝতে পারছি সবকিছু। শান্তি বলে জীবনে কখনো কিছু বরাদ্দ ছিল না আমার জন্যে। কেউ ভালোবাসতো না। আমার সব স্বপ্ন, আশা আকাঙ্ক্ষা ভেঙে হয়ে গিয়েছিল। মা মারা যাবার পরদিন বাবা আসলে ঠিক কথাটাই বলে-মায়ের জায়গায় আমি মরলেই ভালো হতো। বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই আমার। আমার জীবনের কোন মূল্য নেই। শেষ হয়ে গেছে সবকিছু। আর গ্যাব্রিয়েলই করেছে কাজটা।
এটাই সত্য।
আমি গ্যাব্রিয়েলকে হত্যা করিনি।
বরং ও আমাকে খুন করেছে।
আমি শুধু বন্দুকের ট্রিগারটা টেনেছিলাম।
.
৫.২
“এই দৃশ্যটা দেখলে সবসময়ই খুব খারাপ লাগে আমার,” ইন্দিরা বলল। “কার্ডবোর্ডের বাক্সে বন্দী করে ফেলা হচ্ছে একজনের জীবনের সবকিছু।”
মাথা নেড়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ঘরটার চারপাশে তাকালাম।
‘কিন্তু একটা বিষয় অবাক করেছে আমাকে,” আজকে কথা বলার রোগে পেয়েছে ইন্দিরাকে। “অ্যালিসিয়ার জিনিসপত্র অনেক কম। অন্য রোগিদের তো হাবিজাবি কত কিছু থাকে। কিন্তু এখানে কয়েকটা বই, কিছু ছবি আর ওর কাপড়-চোপড় ছাড়া কিছুই নেই।”
স্টেফানির কথামতো অ্যালিসিয়ার ঘর খালি করতে এসেছি আমি আর ইন্দিরা। “সে আর কখনো জেগে উঠবে বলে মনে হয় না, স্টেফানি বলেছিল আমাদের উদ্দেশ্যে। তাছাড়া একটা ঘর ফেলে রাখা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে।”
চুপচাপ কাজ করে গেলাম আমরা। কোন জিনিসগুলো সংরক্ষণ করা হবে আর কোনগুলো ফেলে দেয়া হবে এগুলো নিয়ে কয়েকবার কথা বললাম শুধু। মনোযোগ দিয়ে অ্যালিসিয়ার সব জিনিস লক্ষ্য করলাম আমি। তবে আমাকে বিপদে ফেলার মত কিছু নেই বলে মনে হছে।
অ্যালিসিয়া ডায়েরিটা এতদিন কিভাবে লুকিয়ে রেখেছে সেটাই ভাবছিলাম। ভর্তির সময় সঙ্গে করে সব রোগি অল্প কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসে। অ্যালিসিয়া এনেছিল খামভৰ্তি স্কেচ। ওগুলোরই কোন একটায় ডায়েরিটা ছিল নিশ্চয়ই। খামগুলো খুলে ভেতরে উঁকি দিলাম। বেশিরভাগই অসমাপ্ত স্কেচ আর খসড়া। এখানে সেখানে কয়েকটা সুন্দর ছবিও আছে, অ্যালিসিয়ার প্রতিভার ব্যাপারে কোন সন্দেহ পোষণ করা চলবে না।
একটা স্কেচ ইন্দিরাকে দেখিয়ে বললাম, “এটা আপনি।”
“কি? নাহ।”
“হা, দেখুন খেয়াল করে।”
“আসলেই?” বলে খুশিমনে স্কেচটা হাতে নিল ইন্দিরা। “আসলেই এটা আমি? কবে আঁকলো! আমি তো কিছু জানিই না। সুন্দর না?”
“হ্যাঁ। আপনি রেখে দিন এটা।”
মুখ বাঁকিয়ে স্কেচটা আমাকে ফিরিয়ে দিল ইন্দিরা। “সেটা তো সম্ভব না।”
“অবশ্যই সম্ভব। অ্যালিসিয়া নিশ্চয়ই কিছু মনে করতো না আপনি ছবিটা নিলে,” হেসে বললাম। “তাছাড়া কেউ কিছু জানবেও না।”
“বলা যায় না।” দেয়ালে ঠেস দেয়া বড় পেইন্টিংটার দিয়ে চোখ গেল তার। আমাকে আর অ্যালিসিয়াকে দেখা যাচ্ছে সেখানে। এলিফ এই ছবিটাই নষ্ট করেছিল।
“এটা কি তুমি নিয়ে যাবে?” ইন্দিরা জিজ্ঞেস করলো।
“না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম। “জিন-ফিলিক্সকে ফোন দিয়েছি। সে-ই এসবের একটা বন্দোবস্ত করবে।”
“তুমি রাখতে পারলেই ভালো হতো,” মাথা নাড়লো ইন্দিরা।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম পেইন্টিংটার দিকে। আসলে এটা খুব একটা পছন্দ নয় আমার। কিন্তু অ্যালিসিয়ার অন্য ছবিগুলো ঠিকই ভালো লাগে। একটু অদ্ভুতই ব্যাপারটা, কারণ ছবিটাতে আমি নিজেও আছি।
একটা কথা পরিস্কার করে বলে দিতে চাই-আমি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করিনি যে অ্যালিসিয়া সেদিন গ্যাব্রিয়েলকে গুলি করবে। আর আমারো কাউকে খুন করার কোন ইচ্ছে ছিল না। আমি শুধু অ্যালিসিয়া সত্যিটা জানাতে চেয়েছিলাম। যেমন আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে জেনেছি। বোঝাতে চাইছিলাম, গ্যাব্রিয়েল তাকে ভালোবাসেনা। ভুলের স্বর্গে বাস করছে সে। তাদের বিয়ে একটা নাটক বৈ কিছু নয়। কেবলমাত্র এসব জানলেই জীবনকে নতুন করে সাজাতে পারবে সে। মিথ্যে নয়, সত্যের ভিতে গড়া একটা জীবন।
অ্যালিসিয়ার মানসিক সমস্যার ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই জানা ছিল না আমার। যদি জানতাম তাহলে ওরকমটা কখনোই করতাম না।
মিডিয়ায় যখন খুনের ঘটনাটা নিয়ে তোলপাড় শুরু হলো, মনে মনে একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করি আমি। বারবার মনে হচ্ছিল প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে সবাইকে বোঝাই যে এসবের জন্যে আমি কোনভাবেই দায়ি নই। সেজন্যেই গ্রোভের চাকরিটার জন্যে আবেদন করেছিলাম।
অ্যালিসিয়াকে খুনের পরবর্তী জীবনের সাথে মানিয়ে নেয়াটাই উদ্দেশ্যে ছিল আমার। তাকে যদি ঠিকভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করতে পারি, তাহলে সত্যটা বুঝবে সে-এমনটাই আশা করেছিলাম।
হ্যাঁ, অনেকে বলতে পারে, সব সূত্র চিরতরে গোপন করার জন্যে অ্যালিসিয়ার জীবনে ফিরে এসেছি। কিন্তু এটা সত্য নয়। এই কাজটা যে আমার জন্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ তা শুরু থেকেই জানা ছিল আমার। ধরা পড়ে যেতে পারি, গোটা পরিকল্পনা যে কোন সময় ভেস্তে যেতে পারে-এতসব ঝুঁকি সত্ত্বেও কাজটা করি কারণ…কি বলবো? আমি এমনই।