বুঝতে পারি, ফাঁকা বুলি আউড়াচ্ছে না থিও। আর সামলাতে পারি না নিজেকে, দু’চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরতে শুরু করে। আপনি যা চান, সেটাই করবো আমি। ওকে ছেড়ে দিন, প্লিজ। ওর মত মানুষ হয় না। ওকে ভালোবাসি আমি। অনেক বেশি-”
“একটা কথা বলুন, অ্যালিসিয়া। আপনার কি মনে হয়? সে ভালোবাসে আপনাকে?”
“হ্যাঁ, সবার চাইতে অনেক বেশি ভালোবাসে।”
ঘড়ির কাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। অনন্তকাল পর কথা বলল থিও। “সেটা দেখা যাবে।”শীতল দৃষ্টিটার দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। থিওর মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কিছু ছিল না সেই মুহূর্তে। যেন নরক থেকে সাক্ষাৎ শয়তান উঠে এসেছে।
আমার চেয়ারের সামনে থেকে সরে গ্যাব্রিয়েলের উল্টোদিকে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ঘাড় ঘোরানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না, দেখতে পাচ্ছি না কিছু। এরপরেই ভোতা একটা শব্দ কানে আসে। গ্যাব্রিয়েলকে সর্বশক্তিকে থাপ্পড় দিয়েছে সে। যতক্ষণ অবধি জ্ঞান না ফেরে ততক্ষণ মারতেই থাকলো থিও। কিছুক্ষণ পর মুখে বুলি ফোটে গ্যাব্রিয়েলের।
“কি-কি-”
“হ্যালো, গ্যাব্রিয়েল।”
“কে-কে আপনি?”
“খুবই সাধারণ একজন মানুষ। বিবাহিত। তাই জানি ভালোবাসার মূল্য কি। আর এটাও জানি যে ভালোবাসার মানুষটা বিশ্বাসঘাতকতা করলে কেমন লাগে।”
“কি আবোল তাবোল বলছেন।”
“কাপুরুষেরাই তাদের ভালোবাসার মানুষকে ধোঁকা দেয়। তুই কি কাপুরুষ, গ্যাব্রিয়েল?।”
“জাহান্নামে যা।”
“তোকে মেরেই ফেলতাম। কিন্তু অ্যালিসিয়া তোর প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। তাই তোকে এখন একটা সুযোগ দিব। হয় তুই মরবি, নাহলে তোর জায়গায় অ্যালিসিয়া মরবে। সিদ্ধান্ত তোর।”
একদম ঠাণ্ডা স্বরে কথাগুলো বলে থিও। শুনে মনে হবে যেন এই কথাগুলো নিজের সাথেই হাজারবার বলেছে। কোন অনুভূতি নেই কণ্ঠে। একদম শান্ত। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলল না গ্যাব্রিয়েল। হাঁপানোর শব্দ শুনে মনে হচ্ছে তার পেটে সজোরে ঘুষি বসিয়েছে কেউ।
“না”
“হ্যাঁ। হয় অ্যালিসিয়া মরবে, নাহলে তুই মরবি। সিদ্ধান্ত তোর, গ্যাব্রিয়েল। দেখা যাক কত ভালোবাসিস ওকে। ওর জন্যে নিজের জান দিতে পারবি? দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি তোকে। দশ…নয়-”
“ওর কথা বিশ্বাস কোরো না,” বলি আমি। “আমাদের দু’জনকেই মেরে ফেলবে। আই লাভ ইউ”
-আট, সাত-”
“আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো, গ্যাব্রিয়েল-”
“-ছয়…পাঁচ-”
“আমাকে ভালোবাসো তুমি-”
“-চার…তিন-”
“গ্যাব্রিয়েল, একবার বলো যে আমাকে ভালোবাসো তুমি-”
“দুই”
আর তখনই কথা বলে ওঠে গ্যাব্রিয়েল। প্রথমে ওর কণ্ঠস্বর চিনতেই পারিনি। মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। বাচ্চারা কোন অপরাধ করলে এই সুরে কথা বলে। কিন্তু আমাদের জীবন-মরণ নির্ভর করছিল গ্যাব্রিয়েলের কথাগুলোর ওপরে।
“মরতে চাই না আমি,” বলে সে।
এরপর সব থেমে যায়। অসহ্য একটা নীরবতা নেমে আসে চারপাশে { মনে হচ্ছিলো আমার শরীরের প্রতিটা কোষ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে; জুই গাছ থেকে যেভাবে ফুলগুলো ঝরে পড়ে, ঠিক সেভাবে মৃত কোষগুলো ঝরে পড়ছে। জুঁইয়ের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম? হ্যাঁ, মিষ্টি একটা ঘ্রাণ…
গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে সরে এসে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করে থিও। তবে তার কথা ঠিকমতো আমার কানে ঢুকছিল না। “শুনলেন তো, অ্যালিসিয়া? আমি জানতাম গ্যাব্রিয়েল একটা আস্ত কাপুরুষ। নাহলে নিজের স্ত্রীকে রেখে আমার স্ত্রীর সাথে শোয় কি করে? আমার জীবনের একমাত্র সুখটা কেড়ে নিয়েছে। সামনে এগিয়ে আসে থিও, আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে, “কাজটা করতে খারাপ লাগছে আমার। কিন্তু সত্যটা জানার পর আপনারও নিশ্চয়ই বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা চলে গেছে?”
আমার মাথা বরাবর বন্দুক তাক করলো সে। চোখ বন্ধ করে ফেলি। গ্যাব্রিয়েলের চিৎকার কানে আসছে-”গুলি করবেন না! গুলি করবেন না!”
একটা ক্লিক শব্দ। এরপর কানফাটানো গুলির আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে সব নীরব হয়ে যায়। ভেবেছিলাম মরেই গেছি বুঝি।
কিন্তু আমার ভাগ্য কখনোই অতটা ভালো ছিল না।
চোখ খুলে দেখি সিলিংয়ের দিকে বন্দুক তাক করে আছে থিও। মুখে হাসি। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে আমাকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় সে।
“অ্যালিসিয়া?” গ্যাব্রিয়েল ডাকে আমার নাম ধরে। “অ্যালিসিয়া?”
টের পাচ্ছি যে গ্যাব্রিয়েল ওর চেয়ারে বসেই মোচড়া-মুচড়ি করছে। ঘরে দেখার চেষ্টা করছে কি হয়েছে।
“কি করেছিস তুই? বেজন্মা কোথাকার! ঈশ্বর-”
আমার হাতের বাঁধন খুলে দেয় থিও। এরপর বন্দুকটা মেঝেতে নামিয়ে রাখে। আলতো করে আমার গালে একবার চুমু খেয়ে বেরিয়ে যায়। সামনের দরজা দিয়ে।
গ্যাব্রিয়েল আর আমি বাড়িতে তখন একা। শব্দ করে কাঁদছিল ও, কোন কথাই বলতে পারছিল না। শুধু চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। “অ্যালিসিয়া, অ্যালিসিয়া-”
আমি নীরবই থাকি। কেন যেন অ্যালসেস্টিসের কথা মনে হচ্ছিল বারবার। কিন্তু তার স্বামী তো তাকে একটু হলেও ভালোবাসে।
“অ্যালিসিয়া…কি হলো-”
মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোয় না আমার। কি করে কথা বলতাম? ও তো নিজের মুখেই আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।
আর মৃত মানষ কথা বলে না।
পায়ের বাঁধন খুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। নিচু হয়ে মেঝেতে হাত দিতেই বন্দুকটা হাতে ঠেকে। স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি গরম মনে হচ্ছিল জিনিসটা। হেঁটে গিয়ে গ্যাব্রিয়েলের মুখোমুখি হই। ওর চোখ বড় বড় হয়ে যায় আমাকে দেখে।