ভেতরে ঢুকলো মহিলা। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে : “ঠিক আছে, ডার্লিং। আটটার সময় দেখা হবে! হ্যাঁ…আই লাভ ইউ।”
ফোন কেটে দিয়ে হাতের ফ্যানটা চালিয়ে দেয় সে। কিছুক্ষণ ফ্যানের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে, বাতাসে চুলগুলো উড়ছে। এরপর একটা তুলি হাতে নিয়ে এগিয়ে যায় জানালার ধারে দাঁড় করানো ইজেলের দিকে। এখনও আমার দিকে পিঠ দিয়ে আছে। হঠাই থমকে যায় সে, জানালায় আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছে। প্রথমে বোধহয় আমার ছুরিটার চকচকে ফলাই নজরে এসেছে তার। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ধীরপায়ে ঘুরে দাঁড়ালো এরপর। একে অন্যের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলাম আমরা।
সেবারই প্রথম অ্যালিসিয়া বেরেনসনের সাথে প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল আমার।
বাকিটা ইতিহাস।
৫. মাত্র চলে গেল খিও
পঞ্চম পর্ব
আমি নিরপরাধ, কিন্তু আমার নিজের কথাই আমাকে অপরাধী করে তোলে।
–ইয়োব ৯:২০
৫.১
অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ডায়েরি
ফেব্রুয়ারি ২৩
মাত্র চলে গেল খিও। এখন একা আমি। যত দ্রুত সম্ভব সবকিছু লিখে ফেলতে হবে আমাকে। খুব বেশি সময় নেই হাতে। কতক্ষন শরীরে কুলাবে, জানি না।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমার মাথায় সমস্যা আছে। সত্যটা মেনে নেয়ার চাইতে এরকম ভাবাটাই সহজ ছিল। কিন্তু আসলে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।
প্রথমবার যখন তাকে থেরাপি রুমে দেখি, কিছু একটা পরিচিত মনে হয়। কিছুক্ষণ ভাবার পর বুঝতে পারি চোখদুটো আগেও দেখেছি। তাছাড়া সিগারেট আর আফটারশেভের গন্ধটাও পরিচিত। কথা বলার ছন্দ, কথার মাঝে বিরতি–এসবও মিলে যায়, শুধু কণ্ঠস্বরটা কোন এক কারণে অন্যরকম ঠেকেছিল। কিন্তু পরের বার দেখা হওয়ার সময় নিজেকে আর লুকোতে পারেনি। আমার বাসায় ঢুকে যে কথাটা বলেছিল, ঠিক সেই একই কথা আবারো আমাকে এখানে বলে সে। কথাগুলো কখনোই ভোলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে:
“আপনাকে সাহায্য করতে চাই আমি। বিশ্বাস করুন কথাটা। সত্যিটা হচ্ছে, আমি চাই আপনি যাতে ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারেন।”
এই কথাগুলো শোনা মাত্র সব পরিস্কার হয়ে যায় আমার কাছে। ধাঁধার সূত্রগুলো একদম খাপে খাপে বসে গেছে।
এই লোকটাই সেই আততায়ী।
হঠাৎই কি যেন একটা হয়ে যায় আমার। ঝাঁপিয়ে পড়ি তার ওপরে। ওখানেই শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম তাকে। মারবো নাহয় মরবো। গলা চেপে ধরি, চোখ ওপড়ানোর চেষ্টা করি, বারবার মেঝেতে মাথা ঠুকে ঘি বের করে ফেলার চেষ্টা করি কিন্তু লাভ হয় না। মারতে পারিনি তাকে। আমাকে আটকে ফেলে কয়েকজন মিলে। ঘুম পাড়িয়ে বন্দী করে রাখে। এরপর আবারো সাহস হারিয়ে ফেলি। সংশয়ে ভুগতে থাকি যে আমার বোধহয় ভুল হচ্ছে। পুরোটাই কল্পনা বৈ কিছু নয়।
থিও আর সেই লোকটা একই ব্যক্তি হয় কি করে? গ্রোভে এসে আমাকে এভাবে উসকে দেয়ার পেছনে তার কি উদ্দেশ্যে থাকতে পারে? তখনই সত্যটা বুঝতে পারি। আমাকে সাহায্য করার বিষয়টা একদমই গাঁজাখুরি। আসলে এসব থেকে বিকৃত এক ধরণের তৃপ্তি পাচ্ছে সে। সেজন্যেই ফিরে এসেছে নিজেকে জাহির করার জন্যে।
“আপনাকে সাহায্য করতে চাই আমি। বিশ্বাস করুন কথাটা। সত্যিটা হচ্ছে, আমি চাই আপনি যাতে ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারেন।”
হ্যাঁ, এখন ঠিকঠাকই চিন্তা করতে পারছি। আমি যে সত্যটা জানি সে বিষয়ে কোন রাখঢাকও করিনি। সেজন্যে ইচ্ছে করে গ্যাব্রিয়েলের মৃত্যুর ব্যাপারে মিথ্যে গল্প ফেঁদেছি। থিও’র চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে বুঝতে পারছে আমি মিথ্যে বলছি। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা। আমি তাকে চিনে ফেলেছি, এটা টের পায় সে। তার চোখে এমন একটা অনুভূতি দেখতে পাই, যেটা আগে কখনো দেখিনি। ভয়। আমাকে ভয় পাচ্ছিল সে। কাকে কী বলে ফেলি সেটা নিয়ে আতঙ্কে ছিল নিশ্চয়ই। আমার কণ্ঠস্বর ওর ভেতরের সুপ্ত ভয়টা আবারো জাগিয়ে তোলে।
সেজন্যেই কয়েক মিনিট আগে ফিরে এসেছিল। তবে এবারে আর কিছু বলেনি। সোজা এগিয়ে এসে আমার কব্জিতে একটা সুই বিধিয়ে দেয়। আমি তাকে আটকানোর চেষ্টা করিনি, কোন প্রকার ধস্তাধস্তিও করিনি। এই শাস্তিটা আমার প্রাপ্য। হ্যাঁ, আমি আসলেও অপরাধী। কিন্তু থিও’র ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। সেজন্যেই ডায়েরিতে সব লিখে রাখছি, যাতে এবারে আর পার না পায় সে। শাস্তি পেতেই হবে তাকে।
তাড়াতাড়ি লিখতে হবে। আমার শরীরে কি ইনজেক্ট করেছে জানি না, কিন্তু সেটার প্রভাব টের পাচ্ছি। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। বালিশটা হাতছানি দিয়ে ডাকছে অনেকক্ষণ ধরেই। ঘুমাবো আমি…না, এখন ঘুমোলে চলবে না। জেগে থাকতেই হবে। আগে পুরো গল্পটা শেষ করতে হবে। আর এবারে, একদম সত্যটাই বলবো।
সেই রাতে বাসায় ঢুকে লিভিংরুমে একটা চেয়ারের সাথে আমাকে বেঁধে ফেলে থিও। এরপর গ্যাব্রিয়েল বাড়ি ফিরলে তাকেও বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত দিয়ে অজ্ঞান করে। প্রথমে ভেবেছিলাম মেরেই ফেলেছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর টের পাই যে গ্যাব্রিয়েল শ্বাস নিচ্ছে। তাকেও একটা চেয়ারে বসিয়ে বাধে থিও। আমাদের চেয়ার দুটো এমন অবস্থানে রাখে যাতে একে অপরের চেহারা দেখতে না পারি।
“প্লিজ,” আকুতি জানাই আমি। “প্লিজ, ওকে কষ্ট দেবেন না। আপনি যা চান, তা-ই করবো আমি।”
আমার কথা শুনে হেসে ওঠে থিও। শুকনো এই হাসিটাকে যে কতটা ঘৃণা করি আমি তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। “কষ্ট দেব?” বলে মাথা ঝকায় সে। “ওকে খুন করবো আমি।”