“ইউরি কিন্তু রোগিদের জন্যে কমও করেনি, এটা ভুলে গেলে চলবে না,” বলে ডায়োমেডেসের দিকে তাকালাম। আশা করছিলাম, তিনিও হয়তো কিছু বলবেন। “আমার আসলেও মনে হয় না।”
আমার কথা শেষ হবার আগেই কাঁধ ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস। “যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো, তাহলে বলবো যে অ্যালিসিয়া আগে থেকেই আত্মঘাতী কাজকর্ম করে অভ্যস্থ। আর কেউ যখন নিজের প্রাণ বিনাশের জন্যে উঠে পড়ে লাগে, তখন তাকে বাঁচানো কার সাধ্যি?”
“কিন্তু এটাই তো আমাদের কাজ, তাই না?” শ্লেষমাখা কন্ঠে বলল স্টেফানি। “তাদের এমন কিছু করা থেকে বিরত রাখা।”
“না।” মাথা ঝাঁকালেন ডায়োমেডেস। “আমাদের কাজ হচ্ছে তাদের সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করা। আমরা কিন্তু ঈশ্বর নই। জীবন মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের কোন হাত নেই। অ্যালিসিয়া বেরেনসন বারবার নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে চেয়েছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে তার সফল হবারই কথা ছিল। তবে এবারে অন্তত পুরোপুরি সফল হয়নি।”
কথাটা বলবো কি না বুঝতে পারছি না। বললে এখনই মোক্ষম সময়।
“আপনার যুক্তিতে কোন ভুল নেই প্রফেসর,” দ্বিধা ঝেরে ফেলে বললাম। “কিন্তু আমার মনে হয় না অ্যালিসিয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।”
“তোমার ধারণা এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা?”
“নাহ। দুর্ঘটনাও না।”
কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “কি বলতে চাইছো থিও? আত্মহত্যার চেষ্টা বা দুর্ঘটনা না হলে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে এসব?”
“প্রথমেই বলে রাখি, ইউরি অ্যালিসিয়াকে ওষুধগুলো দিয়েছে, এটা বিশ্বাস করি না আমি।”
“তাহলে, ক্রিস্টিয়ান ভুল দেখেছে?”
“না,” বললাম। “ক্রিস্টিয়ান মিথ্যে বলছে।”
স্টেফানি আর ডায়োমেডেস-দু’জনের দৃষ্টিতেই বিস্ময় ফুটলো। তাদের কেউ কিছু বলার আগেই আবারো মুখ খুললাম আমি। অ্যালিসিয়ার ডায়েরিতে ক্রিস্টিয়ানের ব্যাপারে কী পড়েছি সব বললাম তাদের। অ্যালিসিয়ার মানসিক সমস্যার বিষয়ে আগেও গোপনে পরামর্শ দিয়েছে সে, অনেক কিছু জানার পরেও বিচার চলাকালীন সময়ে কিছু বলেনি, গ্রোভে যোগ দেয়ার পর অ্যালিসিয়াকে না চেনার ভান করেছে-এসব শুনে দু’জনেই ভীষণ অবাক হলো। এমনটাই আশা করছিলাম। “অ্যালিসিয়া মুখ না খুললেই তার জন্যে ভালো,” বললাম। “নতুবা তার কুকীর্তি সবার জেনে যাবার ঝুঁকি ছিল।”
স্টেফানির মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। “কিন্তু থিও, আপনি নিশ্চয়ই এটা বোঝাচ্ছেন না যে সে-”।
“ঠিকই আন্দাজ করেছেন। এটা কোন আত্মহত্যার চেষ্টা বা ওভারডোজ নয়। অ্যালিসিয়াকে খুন করতে চেয়েছে কেউ।”
“অ্যালিসিয়ার ডায়েরি কোথায়?” ডায়োমেডেস জিজ্ঞেস করলো। “তোমার কাছে আছে?”
মাথা কঁকালাম। “না, ওকে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই ওর ঘরে আছে।”
“এখনই ওটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, স্টেফানির দিকে ঘুরে বললেন ডায়োমেডেস। “কিন্তু এর আগে বোধহয় আমাদের পুলিশে খবর দেয়া উচিৎ, তাই না?”
.
৪.১৯
এরপরের ঘটনাগুলো বেশ তাড়াতাড়িই ঘটলো।
খবর পেয়ে পুলিশ অফিসারদের একটা দল চলে আসে গ্রোভে। প্রথমেই অ্যালিসিয়ার ঘর আর আর্ট রুম সিল করে দেয়। প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা চিফ ইন্সপেক্টর স্টিভেন অ্যালেন বেশ রাশভারি স্বভাবের। চোখে বিশাল ফ্রেমের একটা রিডিং গ্লাস পরায় মণিগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বড় দেখাচ্ছিল। সব বিষয়েই ভীষণ কৌতূহল তার। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো অ্যালেন; ডায়োমেডেসকে যা বলেছি, তার সবকিছুই তাকে বললাম। এমনকি আমার ব্যক্তিগত নোটগুলো দেখালাম ড্রয়ার থেকে বের করে।
“আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ, মি. ফেবার।”
“থিও বলে ডাকবেন, প্লিজ।”
“আপনাকে একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে হতে পারে একটু পর। সামনে আরো কয়েকবার কাজের খাতিরে আমাদের আলাপ হবে।”
“নিশ্চয়ই।”
ডায়োমেডেসের অফিসে বসেই সবার সাথে কথা বলছে ইন্সপেক্টর অ্যালেন। আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল সে। এক জুনিয়র অফিসারের কাছে বিবৃতি দেয়ার পর বাইরের করিডোরে ঘোরাফেরা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর ক্রিস্টিয়ানকে ডেকে পাঠানো হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ভয় পেয়েছে বেচারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে ভেবে মনে মনে খুশি হলাম। অপেক্ষা ছাড়া করার মত কিছু নেই এখন আমার। গ্রোভ থেকে বের হবো, এমন সময় কি মনে করে একবার নার্স স্টেশনে উঁকি দিয়েই থমকে গেলাম।
এলিফকে এক হাতে একটা ওষুধের বোতল এগিয়ে দিচ্ছে ইউরি, আরেক হাতে নগদ কিছু টাকা। বাইরে বেরিয়ে আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকায় এলিফ।
“এলিফ,” বলি আমি।
“জাহান্নামে যাও,” বলেই হনহন করে হেঁটে সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল সে।
ইউরি নার্স স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখেই জমে গেল। “তু তুমি এখানে কি করছো? খেয়াল করিনি,” রীতিমত তোতলাচ্ছে সে এখন।
“সেটা তো বুঝতেই পারছি।”
“এলিফ ওর ওষুধগুলো নিতে ভুলে গিয়েছিল। ওগুলোই দিচ্ছিলাম ওকে।”
“আচ্ছা।”
তাহলে গ্রোভের ভেতরে অবৈধভাবে রোগিদের ওষুধ সরবরাহের হোতা ইউরি। কিছুক্ষণ আগে ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলে বোধহয় ভুলই করেছি। কড়া নজর রাখতে হবে এখন থেকে।
“তোমাকে একটা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম,” আমাকে নার্স স্টেশন থেকে দূরে এনে বলল সে। “মি. মার্টিনের ব্যাপারে কি করবো?”