চিনতে পারিনি কারণ অন্যদের চেয়ে তাকে আলাদা করার কোন উপায় নেই।
চেয়ারে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে অ্যালিসিয়া। কড়া সিডেটিভ দেয়া হয়েছে তাকে, নিশ্চিত। হাতে চায়ের কাপ। অনবরত কাঁপুনির কারণে নিয়মিত বিরতিতে সেখান থেকে চা পড়ছে মেঝেতে। উঠে গিয়ে তার কাপটা সোজা করে দেয়া থেকে নিজেকে আটকালাম। পারিপার্শ্বিকের কোন হুশই নেই তার। আমি যদি কাজটা করিও, কিছু বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না।
তার অবস্থা যে এতটা খারাপ হবে তা ধারণা করিনি। আগের সৌন্দর্যের কিছুটা ছাপ অবশ্য এখনও বিদ্যমান। গাঢ় নীল চোখ, নিখুঁত গড়নের চেহারা। তবে সেগুলো ছাপিয়ে চোখে পড়বে এলোমেলো লাল, নোংরা চুল। হাতের নখগুলো বারবার চিবোনোর কারণে বিশ্রী দেখাচ্ছে। দু কব্জির ক্ষতচিহ্নগুলো প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে। অ্যালসেস্টিস ছবিটায় এই ক্ষতদুটো একদম স্পষ্ট। এক মুহূর্তের জন্যেও থামছে না তার হাতের কাঁপুনি, সিডেটিভ ড্রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। নিশ্চয়ই রিস্পেরিডোন আর অন্যান্য অ্যান্টিসাইকোটিক ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে তাকে। ভোলা মুখের ভেতরে লালা জমে একাকার। এটাও ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
এসময় খেয়াল হলো, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ডায়োমেডেস। অ্যালিসিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে ফিরলাম। “আমার মনে হয় নিজের পরিচয় তুমি নিজেই সবচেয়ে ভালো করে দিতে পারবে, থিও।” মুখে মৃদু হাসি ফুটেছে তার। “কিছু বলবে না?”
“ধন্যবাদ,” মাথা নাড়লাম একবার। “আসলে নতুন করে খুব বেশি কিছু যোগ করবো না। শুধু এটুকু বলতে পারি, এখানে যোগ দিতে পেরে খুশি আমি। সেই সাথে কিছুটা নার্ভাসও বটে। সবার সাথে ভালোমতো যাতে পরিচিত হতে পারি, বিশেষ করে রোগিদের সাথে-সেই চেষ্টা করবো। আমি-”
এসময় হঠাৎ শব্দ করে দরজা খুলে যাওয়ায় থেমে যেতে হলো আমাকে। প্রথমে ভাবলাম, উল্টোপাল্টা দেখছি। দুটো চোখা লাঠি নিয়ে বিশালদেহী এক দৈত্য ভেতরে প্রবেশ করেছে। হাত ওপরে তুলে ও দুটো সামনে ছুঁড়ে দিল সে। মনে হলো আমাদের গায়ের ওপরে এসে পড়বে, তবে শেষমেশ সেরকম কিছু ঘটলো না। চক্রের মাঝখানে এসে পড়লো লাঠিদুটো। চিৎকার করে উঠলো রোগিদের একজন। ভালোমতো খেয়াল করার পর বুঝতে পারলাম ওগুলো আসলে সাধারণ লাঠি নয়, বিলিয়ার্ড খেলার লম্বা ছড়িকেই ভেঙে দু’টুকরো করা হয়েছে।
বিশালদেহী মহিলা নিশ্চিত এখানকার রোগি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে। তুর্কী। বয়স চল্লিশের আশপাশে। “রাগ লাগে আমার। গত এক সপ্তাহ ধরে এটা ভেঙে পড়ে আছে! কী বাল করেন আপনারা?”
“ভদ্রভাবে কথা বলো, এলিফ।” ডায়োমেডেসের কন্ঠস্বর একদম স্বাভাবিক। “আগে আমরা আলাপ করবো, তোমাকে আদৌ এত দেরি করে কম্যুনিটি মিটিংয়ে যোগ দেয়ার অনুমতি দেব কি না সে বিষয়ে। এরপর বিলিয়ার্ডের পুল কিউ নিয়ে কথা বলা যাবে।” চোখে প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকালেন তিনি। “তোমার কি মনে হয় থিও?”
কিছুটা সময় নিলাম কথা বলার আগে। “সময়ানুবর্তিতা সবসময়ই জরুরি। তাছাড়া মিটিংয়ে সময়মতো আসলে-”
“যেমনটা তুমি এসেছো আজকে?” চক্রের অন্যপাশ থেকে একজন বলে উঠলো।
ক্রিস্টিয়ানের কণ্ঠস্বরটা চিনতে অসুবিধে হলো না আমার। নিজের কৌতুকে নিজেই হেসে উঠলো সে।
মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে এলিফের দিকে তাকালাম। “ঠিক বলেছে ও, আজ সকালে আমিও দেরি করে এসেছি। সুতরাং আমাদের দু’জনের জন্যেই একটা শিক্ষা হতে পারে গোটা বিষয়টা।”
“এসব কি বলছো?” এলিফ জিজ্ঞেস করলো। “আমাকে জ্ঞান দেয়ার তুমি কে?”
“এলিফ। ভদ্রভাবে কথা বলো,” আবারো বললেন ডায়োমেডেস। “আবারো তোমাকে টাইম-আউটে পাঠাতে বাধ্য করোনা আমকে। চুপচাপ বসো।”
দাঁড়িয়েই রইলো এলিফ। “আর পুল কিউটার কি হবে?”
প্রশ্নটা ডায়োমেডেসের উদ্দেশ্যে করা হলেও উত্তরের জন্যে আমার দিকে তাকালেন প্রফেসর।
“এলিফ, আমি বুঝতে পারছি, আপনি লাঠিটা ভেঙে যাওয়ায় রেগে আছেন। তার চোখের দিকে তাকালাম। “লাঠিটা যে ভেঙেছে সে-ও নিশ্চয়ই কোন কারণে রেগে গিয়েছিল। এরকম একটা ইনস্টিটিউশনে রাগের ব্যাপারটা আমরা কিভাবে পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার মধ্যে দিয়ে সামলাবো, সেটাই মুখ্য বিষয়। তাহলে এ মুহূর্তে আমরা রাগ নিয়ে কিছুক্ষণ। কথা বলি? বসুন, নাকি?”
বিরক্ত হলেও ঠিকই বসে পড়লো এলিফ।
সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ইন্দিরা। এরপর রোগিদের সাথে রাগ বিষয়ে আলোচনা শুরু করলাম আমরা দুজন। তাদের প্রত্যেকের অনুভূতি নিয়ে আলাদা আলাদা কথা বললাম কিছুক্ষণ। দুজনের জুটিটা খারাপ হলো না। ডায়োমেডেস যে জহুরি চোখে আমাকে যাচাই করছেন, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তাকেও সন্তুষ্টই মনে হলো।
একবার অ্যালিসিয়ার দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে সে-ও আমাকেই দেখছে। নাহ, ভুল বললাম। আসলে আমি যেখান বসে আছি, তার দৃষ্টি সেদিকেই। নির্দিষ্ট কোনকিছুর প্রতি মনোযোগ দেয়ার মত অবস্থায় এ মুহূর্তে নেই সে। চোখে বরাবরের মতনই শূন্য দৃষ্টি।
অ্যালিসিয়ার পরিচিত লোকেরা সবসময়ই বলে এসেছে, আগে কী রকম চটপটে আর উদ্দীপনায় ভরপুর ছিল সে। এখন কেউ যদি আমাকে এই হত্যোদম মানুষটাকে দেখিয়ে বলে যে তারা একই ব্যক্তি, তাহলে সেটা বিশ্বাস করাটা কষ্ট হবে বৈকি। গ্রোভে আসার সিদ্ধান্তটা একদম ঠিক ছিল, এটা সেই মুহূর্তেই পরিস্কার বুঝতে পারলাম। সব অনিশ্চয়তা দূর হয়ে গেল। যত দ্রুত সম্ভব অ্যালিসিয়ার চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে।