নাঃ, ভাঙে-টাঙেনি। তবে অনেক জায়গায় চোট খেয়েছে। কোনোরকমে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করি। পাশের লোকগুলো আমায় ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। হেঁটে সুনন্দের কাছে গিয়ে দেখি মামাবাবুর মাথায় জামা ছিঁড়ে কাপড়ের ফালির ব্যান্ডেজ বাঁধছে। মামাবাবুর চোখ বোজা, তবে নিশ্বাসের তালে বুক ওঠানামা করছে। কিছুটা স্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন মামাবাবু?
সুনন্দ জবাব দেয়, ভালো। মাথায় লেগেছে। রক্ত পড়ছিল, তবে সিরিয়াস কিছু নয়।
আর তুই?
পারফেক্টলি ফিট। শুধু বাঁ হাতের কব্জিটায় একটু লেগেছে। ভগবানকে ধন্যবাদ দে, বালিতে আছড়ে পড়ায় আমরা প্রাণে বেঁচে গেছি।
একটু পরে মামাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। খুব অবসন্ন দেখাচ্ছিল তাকে। চারিদিক তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে এটা কোনো দ্বীপ। রুফিজি নদীর মোহনার কাছে কয়েকটা ছোট ছোট জঙ্গুলে দ্বীপ আছে। ম্যাপে তাদের পয়েন্ট আউট করা হয় না। বোধহয় তাদেরই একটায় এসে পড়েছি!
সুনন্দ বলল, এখানে তো একমাত্র উপজাতি ছাড়া অন্য লোক দেখছি না! আর কোনো জাতি থাকে কিনা কে জানে!
না থাকাই সম্ভব। এই দ্বীপগুলো অস্বাস্থ্যকর বলে সাধারণত মানুষ বাস করে না।
হঠাৎ একটি লোক এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। দশাসই পুরুষ। পরনে একখানা লাল রঙ মাখানো পশুচর্ম। হাতে বিরাট লম্বা বর্শা। অঙ্গে নানারকম গয়নাগাটির বিশেষত্ব চোখে পড়ার মতো। বেশ ভারিক্কি চালে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে হড়বড়িয়ে একগাদা কী সব বলে গেল। কী জানি প্রশ্ন করল। ভাষাটা চেনা, সোয়াহিলি। কিন্তু অর্থ ঠিক ধরতে পারলাম না।
মামাবাবু একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন সোয়াহিলিতে।
সঙ্গে সঙ্গে আবার একপ্রস্থ প্রশ্নবাণ নিক্ষিপ্ত হয়।
তার দ্রুত কথা বলার জন্য এবং বিচিত্র অপরিচিত উচ্চারণভঙ্গির ফলে আমার বা সুনন্দের সামান্য সোয়াহিলি জ্ঞানে কুলোলাচ্ছিল না।
ইতিমধ্যে সমুদ্রতীরের তাবৎ মেয়ে-পুরুষ এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আগ্রহভরে সমস্ত কথা গিলছে। তাদের গুঁতো খেয়ে আমি ও সুনন্দ অনেকটা তফাতে হটে গেলাম। সেখান থেকেই ঘাড় উঁচু করে আমরা মামাবাবু ও সেই লোকটির কথাবার্তার সারমর্ম বুঝতে চেষ্টা করলাম। খাপছাড়াভাবে কয়েকটা কথা বুঝলেও আসল বক্তব্য কিছুই ধরতে পারছিলাম না।
মামাবাবু হাত-টাত নেড়ে বোঝাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আঙুল তুলে সমুদ্রের দিকে। দেখাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাদের উদ্দেশ করে বললেন, ঠিকই ধরেছি এটা দ্বীপ, উপকূলের কাছেই। এই উপজাতিরা দ্বীপের একমাত্র বাসিন্দা। ইনি হচ্ছেন সর্দার। জানতে চাইছেন আমরা কে? কেন এসেছি? কী করে এসেছি ইত্যাদি।
সুনন্দ বলে, এদের রকম-সকম কেমন বুঝছেন?
ভালোই। আপাতত আমাদের কোনো ক্ষতি করার লক্ষণ নেই। তবে বিদেশি অতিথি বিশেষ পছন্দ করে বলে মালুম হচ্ছে না।
আমি বললাম, জিজ্ঞেস করুন না এখান থেকে তীরে ফিরে যাবার কী উপায়?
হুঁ, করছি। তারপর আবার প্রশ্নোত্তর।
একটি লোক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
লোকটা বেজায় ঢ্যাঙা। রোগা, পাকানো দড়ির মতো হাত-পা। মুখে অজস্র বলিরেখা। দেখলে বোঝা যায় প্রচুর বয়স। তার সারা গায়ে-মুখে বিচিত্র নকশা কাটা। গলায় হাড়ের টুকরো গাঁথা মালা। কোমরে জড়ানো একখানা লাল-কালো রঙ করা চামড়া। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুকটা শিরশির করে উঠল। বাজপাখির মতো চাউনি, তীক্ষ্ণ কুর। সর্দারের ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সে মন দিয়ে সব শুনছিল, মাঝে মাঝে দু-একটা প্রশ্ন করছিল।
খানিক পরে মামাবাবু বললেন, বলছে দ্বীপের কাছ দিয়ে নাকি কোনো নৌকো জাহাজ-টাহাজ যায় না। তবে ওরা নিজেরা মাঝেমধ্যে সমুদ্র পেরিয়ে উপকুলে যায়। তখন আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক স্পষ্ট কথা দিচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে। উপহার-টুপহার দিয়ে একটু সন্তুষ্ট করলে রাজি হবে। যাক, এখন চল আমাদের মাঝিদের কী অবস্থা দেখি। নৌকোটার খোঁজ করি।
চারজন মাঝিকে দেখতে পেলাম কাছেই। সৌভাগ্যবশত তারা সবাই জীবিত। তবে দুজন বেশ আহত হয়েছে। একজনের লেগেছে কোমরে, সে শুয়ে ছটফট করছে। আর একজনের ডান হাতের কনুইয়ের হাড় ভেঙেছে বা মচকেছে। বেচারা হাত চেপে ধরে বসে যন্ত্রণায় অস্ফুট কাতরোক্তি করছে। অন্য দুজন মোটামুটি অক্ষত। তারা বালির ওপর বসে। দিশাহারা ভাব। কয়েকজন দ্বীপবাসী তাদের ক্রমাগত নানারকম প্রশ্ন করে চলেছে। মাঝিরা কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুধু জড়োসড়ো হয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে। আমরা কাছে যেতেই তারা মহা খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল।
মামাবাবু আহত দু-জনকে পরীক্ষা করলেন। আঘাতের গুরুত্ব আপাতত কিছু বোঝা গেল না। তিনি অন্য দু-জনকে আহতদের পাশে বসে থাকতে আদেশ দিয়ে আমাদের বললেন, চল, নৌকোটা দেখি। ঐ যে পড়ে আছে। আমাদের সঙ্গে ওষুধপত্র ব্যান্ডেজ ছিল। আহত লোকগুলোর জন্য দরকার।
নৌকোটা জলের কিনারে বালির ওপর ওল্টানো অবস্থায় পড়ে ছিল। ভাঙা, দুমড়ানো। নৌকোর দিকে যেতে যেতে সুনন্দ বলল, মামাবাবু, ঐ লোকটা কে? সর্দারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। বেজায় ঢ্যাঙা।
ওর নাম কামাউ। এই উপজাতির উইম্ ডক্টর।
বুঝেছি। আমাদের দেশে যাদের বলে ওঝা।
না, আমাদের দেশের ওঝা বা গুণিনদের থেকে এদের তফাত আছে। এদের ক্ষমতা আরও বেশি। উপজাতিদের মধ্যে এরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। এরা বহুবিদ্যাবিশারদ। একাধারে উপজাতি পল্লির হেকিম, পূজারি, সর্দারের পরামর্শদাতা, আরও অনেক কিছু।