অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র

 

মুখবন্ধ

যেদিন প্রথম ছোটদের জন্য দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প লেখা শুরু হয়েছিল, সেদিন থেকে শিশুসাহিত্যের একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেছিল। বলা বাহুল্য, এর সূচনা হয়েছিল ইয়োরোপে। এবং সে সময়ে শিশুসাহিত্যের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ রত্ন দিনের আলোর মুখ দেখেছিল। রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের, ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’, ‘কিডন্যাপড’, জুল ভের্নের ছোটবড় সকলের জন্য লেখা নানান বিজ্ঞানভিত্তিক কিংবা অসমসাহসিক অভিযানের নানান বইয়ের গুণ আজ পর্যন্ত ম্লান হয়নি। পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য বিস্ময়ের দিকটা চিরকালই ছোটদের মুগ্ধ করেছে। এ-ও তাদের বড় হওয়ার একটা বলিষ্ঠ দিক; অজ্ঞাতকে জানবার, দুর্গমকে জয় করবার, প্রতিকূল শক্তির সঙ্গে লড়বার, দেহ-মনের বল আহরণের প্রবল একটা দিক।

অনেক দিন আগেই বাংলায় এই ধরনের কিছু কিছু বই বেরিয়েছে, লেখকদের মধ্যে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের নাম করতে হয়। তাছাড়া আরো আছেন। এই বইখানির রচয়িতা অজেয় রায় সেই জাতের লেখক, যাঁরা দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প অতিশয় সরস ও সহজ ভাবে লিখতে পেরেছেন। এর মধ্যে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় সংবলিত আছে। অজেয় রায় কোনো তথ্য পরিবেষণ করার আগে, সেটি নির্ভুল কিনা সে বিষয়ে পরীক্ষা করে নিতে যত্নবান হন। এইটি তাঁর বিশেষত্ব। এমন কি দুটো একটা বিদেশী কথা ব্যবহার করতে হলেও, আগে শব্দগুলি সম্বন্ধে নিজে নিঃসন্দেহ হন, তারপর লেখেন। ছোটদের বইতে ভুল লিখলে চলে না ।

এই ধরনের বই কোনো কোনো অভিভাবক স্রেফ রোমাঞ্চময়, নিকৃষ্ট শ্রেণীর লেখা বলে অপছন্দ করেন। তাঁরাও এই বইখানি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারেন, এর কাল্পনিকতা তথ্যপুষ্ট বলেই এত আকর্ষণীয়। রস ও কল্পনাশক্তিই হল সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। এ ছাড়া হাজার জ্ঞাতব্য তথ্যে পূর্ণ হলেও রচনা উরোয় না। ছোটরা আনন্দের সঙ্গে পাঠ করলে তবে না তাদের জন্য গল্প লেখা সার্থক হয়।

অজেয় রায়ের ছাত্র-জীবনের ও কর্ম-জীবনের পটভূমিকা হল গিয়ে শান্তিনিকেতন, কল্পনায় ভরা স্থান। তাঁর বয়স চল্লিশের অনেক কম। ছোটদের আদর্শ লেখক তিনি ।

লীলা মজুমদার
কলকাতা
১৫ মে, ১৯৭৫

ভূমিকা

কোনো বাঙালি ছেলের পক্ষে আফ্রিকা যাওয়াই একটা বিরাট অ্যাডভেঞ্চার। তার ওপরে সেখানে গিয়ে যদি তাকে সব লোমহর্ষক ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! ডার-এস-সালাম পৌঁছনোর কিছুদিন পর থেকেই আমার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসে সেগুলোর কথা ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়। অথচ যখন ঘটেছিল তখন সেগুলো ছিল বিস্ময় ও বিভীষিকা মেশানো এক বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চার। কত কথাই না মনে পড়ছে আজ!…মামাবাবুর সেই আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মুহূর্তটা ; ঢ্যাঙা উইচ ডক্টর কামাউ, টোটো, ডক্টর হাইনে, অল্পক্ষণের জন্য দেখা ডেয়ারিং বিল! আর মনে পড়ছে রুফিজি নদীর মোহনার সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড়, যে ঝড় না হলে আমার কাহিনি একেবারে অন্য চেহারা নিত : কিংবা সে-কাহিনী হয়তো লেখাই হতো না।…

আফ্রিকা যাবার ব্যাপারটা যেভাবে ঘটেছিল সেটা অবিশ্যি তেমন চমকপ্রদ কিছু নয়। এর জন্য দায়ী আমার বন্ধু সুনন্দ। ঘটনাটা ঘটল সেপ্টেম্বর মাসে আমার শোবার ঘরে। তখন রাত এগারোটা। আমি বিছানায় শুয়ে বেশ জমিয়ে একটা ডিটেকটিভ বই পড়ছি, এমন সময় সুনন্দর আবির্ভাব। সময়টা বেয়াড়া, তবে সুনন্দর পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক নয়। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই সে প্রশ্ন করল, ‘কীরে অসিত—আফ্রিকা যাবি?’

‘কোথায় ?’

‘ইস্ট আফ্রিকা। টাঙ্গানিকা ।’

‘রাতদুপুরে এসে রসিকতা! কেটে পড়।’

‘বইটা বন্ধ কর। রসিকতা নয়। সিরিয়াসলি বলছি। সম্প্রতি মামাবাবুর বন্ধু জার্মান বৈজ্ঞানিক ডক্টর হাইনে ডার-এস-সালাম-এর মিউজিয়ামের কিউরেটর হয়েছেন। তিনি মামাবাবুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিছুদিনের জন্য তাঁর অতিথি হতে। ডক্টর হাইনে আফ্রিকার প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণী ও উদ্ভিদের অনুসন্ধান করছেন। সে-কাজে তিনি মামাবাবুর সাহায্য চান।

আমি হাত থেকে বই রেখে উঠে বসলাম ।

‘কিন্তু যাতায়াতে অনেক টাকার ধাক্কা।’

‘তারও একটা সুরাহা হাইনে করেছেন। তিনি ব্যবস্থা করেছেন যে ডক্টর ঘোষ—মানে মামাবাবু আফ্রিকায় গিয়ে কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাকেন্দ্রে বক্তৃতা করবেন । তাতে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। হিসেব করে দেখেছি ওতে আমাদের তিনজনের এক পিঠের ভাড়া কুলিয়ে যাবে। সুতরাং তোর খরচ হচ্ছে সিঙ্গল ফেয়ার, ডবল জার্নি। আর থাকা-খাওয়া ফ্রি, কারণ ওখানে তুই হবি মামাবাবুর অর্থাৎ হাইনের গেস্ট।’

প্রস্তাবটি অতি লোভনীয় সন্দেহ নেই। মামাবাবু অর্থাৎ বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী প্রোফেসর নবগোপাল ঘোষ এবং তাঁর ভাগনে আমার বাল্যবন্ধু সুনন্দর সঙ্গে আমি দেশ-বিদেশে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। মনে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম, কিন্তু বাইরে কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে একটু ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘আচ্ছা, ভেবে দেখি।’

পরদিন সকালে বাড়িতে ঘোষণা করলাম, ‘এবার পুজোয় আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। আফ্রিকা। সুনন্দের সঙ্গে।’

তারপর টেলিফোনটা তুলে নিয়ে সুনন্দর নম্বরটা ডায়াল করলাম।

 

মুঙ্গু

মুখবন্ধ

যেদিন প্রথম ছোটদের জন্য দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প লেখা শুরু হয়েছিল, সেদিন থেকে শিশুসাহিত্যের একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেছিল। বলা বাহুল্য, এর সূচনা হয়েছিল ইয়োরোপে। এবং সে সময়ে শিশুসাহিত্যের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ রত্ন দিনের আলোর মুখ দেখেছিল। রবার্ট লুইস স্টিভেনের ট্রেজার আইল্যান্ড, কিডন্যান্ড, জুল ভের্নের ছোটবড় সকলের জন্য লেখা নানান বিজ্ঞানভিত্তিক কিংবা অসমসাহসিক অভিযানের নানান বইয়ের গুণ আজ পর্যন্ত ম্লান হয়নি। পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য বিস্ময়ের দিকটা চিরকালই ছোটদের মুগ্ধ করেছে। এ-ও তাদের বড় হওয়ার একটা বলিষ্ঠ দিক; অজ্ঞাতকে জানবার, দুর্গমকে জয় করবার, প্রতিকূল শক্তির সঙ্গে লড়বার, দেহ-মনের বল আহরণের প্রবল একটা দিক।

অনেক দিন আগেই বাংলায় এই ধরনের কিছু কিছু বই বেরিয়েছে, লেখকদের মধ্যে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের নাম করতে হয়। তাছাড়া আরো আছেন। এই বইখানির রচয়িতা অজেয় রায় সেই জাতের লেখক, যাঁরা দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প অতিশয় সরস ও সহজ ভাবে লিখতে পেরেছেন। এর মধ্যে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় সংবলিত আছে। অজেয় রায় কোনো তথ্য পরিবেষণ করার আগে, সেটি নির্ভুল কিনা সে বিষয়ে পরীক্ষা করে নিতে যত্নবান হন। এইটি তার বিশেষত্ব। এমন কি দুটো একটা বিদেশী কথা ব্যবহার করতে হলেও, আগে শব্দগুলি সম্বন্ধে নিজে নিঃসন্দেহ হন, তারপর লেখেন। ছোটদের বইতে ভুল লিখলে চলে না।

এই ধরনের বই কোনো কোনো অভিভাবক স্রেফ রোমাঞ্চময়, নিকৃষ্ট শ্রেণীর লেখা বলে অপছন্দ করেন। তারাও এই বইখানি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারেন, এর কাল্পনিকতা তথ্যপুষ্ট বলেই এত আকর্ষণীয়। রস ও কল্পনাশক্তিই হল সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। এ ছাড়া হাজার জ্ঞাতব্য তথ্যে পূর্ণ হলেও রচনা উরোয় না। ছোটরা আনন্দের সঙ্গে পাঠ করলে তবে না তাদের জন্য গল্প লেখা সার্থক হয়।

অজেয় রায়ের ছাত্র-জীবনের ও কর্ম-জীবনের পটভূমিকা হল গিয়ে শান্তিনিকেতন, কল্পনায় ভরা স্থান। তার বয়স চল্লিশের অনেক কম। ছোটদের আদর্শ লেখক তিনি।

লীলা মজুমদার
কলকাতা ১৫ মে, ১৯৭৫

.

ভূমিকা

কোনো বাঙালি ছেলের পক্ষে আফ্রিকা যাওয়াই একটা বিরাট অ্যাডভেঞ্চার। তার ওপরে সেখানে গিয়ে যদি তাকে সব লোমহর্ষক ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! ডার-এস-সালাম পৌঁছনোর কিছুদিন পর থেকেই আমার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসে সেগুলোর কথা ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়। অথচ যখন ঘটেছিল তখন সেগুলো ছিল বিস্ময় ও বিভীষিকা মেশানো এক বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চার। কত কথাই না মনে পড়ছে আজ!…মামাবাবুর সেই আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মুহূর্তটা; ঢ্যাঙা উইচ ডক্টর কামাউ, টোটো, ডক্টর হাইনে, অল্পক্ষণের জন্য দেখা ডেয়ারিং বিল! আর মনে পড়ছে রুফিজি নদীর মোহনার সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড়, যে ঝড় না হলে আমার কাহিনি একেবারে অন্য চেহারা নিত; কিংবা সে-কাহিনী হয়তো লেখাই হতো না।….

আফ্রিকা যাবার ব্যাপারটা যেভাবে ঘটেছিল সেটা অবিশ্যি তেমন চমকপ্রদ কিছু নয়। এর জন্য দায়ী আমার বন্ধু সুনন্দ। ঘটনাটা ঘটল সেপ্টেম্বর মাসে আমার শোবার ঘরে। তখন রাত এগারোটা। আমি বিছানায় শুয়ে বেশ জমিয়ে একটা ডিটেকটিভ বই পড়ছি, এমন সময় সুনন্দর আবির্ভাব। সময়টা বেয়াড়া, তবে সুনন্দর পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক নয়। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই সে প্রশ্ন করল, কীরে অসিত–আফ্রিকা যাবি?

কোথায়?

ইস্ট আফ্রিকা। টাঙ্গানিকা।

রাতদুপুরে এসে রসিকতা! কেটে পড়।

বইটা বন্ধ কর। রসিকতা নয়। সিরিয়াসলি বলছি। সম্প্রতি মামাবাবুর বন্ধু জার্মান বৈজ্ঞানিক ডক্টর হাইনে ডার-এস-সালাম-এর মিউজিয়ামের কিউরেটর হয়েছেন। তিনি মামাবাবুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিছুদিনের জন্য তার অতিথি হতে। ডক্টর হাইনে আফ্রিকার প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণী ও উদ্ভিদের অনুসন্ধান করছেন। সে-কাজে তিনি মামাবাবুর সাহায্য চান।

আমি হাত থেকে বই রেখে উঠে বসলাম।

কিন্তু যাতায়াতে অনেক টাকার ধাক্কা।

তারও একটা সুরাহা হাইনে করেছেন। তিনি ব্যবস্থা করেছেন যে ডক্টর ঘোষ–মানে মামাবাবু আফ্রিকায় গিয়ে কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাকেন্দ্রে বক্তৃতা করবেন। তাতে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। হিসেব করে দেখেছি ওতে আমাদের তিনজনের এক পিঠের ভাড়া কুলিয়ে যাবে। সুতরাং তোর খরচ হচ্ছে সিঙ্গল ফেয়ার, ডবল জানি। আর থাকা-খাওয়া ফ্রি, কারণ ওখানে তুই হবি মামাবাবুর অর্থাৎ হাইনের গেস্ট।

প্রস্তাবটি অতি লোভনীয় সন্দেহ নেই। মামাবাবু অর্থাৎ বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী প্রোফেসর নবগোপাল ঘোষ এবং তার ভাগনে আমার বাল্যবন্ধু সুনন্দর সঙ্গে আমি দেশ-বিদেশে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। মনে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম, কিন্তু বাইরে কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে একটু ভুরু কুঁচকে বললাম, আচ্ছা, ভেবে দেখি।

পরদিন সকালে বাড়িতে ঘোষণা করলাম, এবার পুজোয় আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। আফ্রিকা। সুনন্দের সঙ্গে।

তারপর টেলিফোনটা তুলে নিয়ে সুনন্দর নম্বরটা ডায়াল করলাম।

.

মুঙ্গু

০১.

পূর্ব আফ্রিকার টাঙ্গানিকা প্রদেশের প্রধান বন্দর হল ডার-এস-সালাম। অনেক কালের শহর। শহরের কিছু কিছু অংশে যেমন আদ্যিকালের নোংরা গলিখুঁজি, পুরনো আমলের ঘর-বাড়ি রয়েছে, তেমনি অন্যান্য অংশে গড়ে উঠেছে অতি আধুনিক অট্টালিকা, হোটেল, আলো ঝলমল রাজপথ, দোকানপাট।

মিউজিয়ামটি শহরের বাইরে। নগর-বন্দরের কোলাহল থেকে দূরে। প্রায় চার-একর জমি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে বড় বড় গাছ ও বাগান। মাঝখানে মিউজিয়ামের বাড়ি।মিউজিয়াম মানে লম্বা লম্বা পাঁচ-ছটা একতলা হলঘর। কম্পাউন্ডের একপ্রান্তে ডক্টর হাইনের বাংলো প্যাটার্নের কোয়ার্টার। একজনের পক্ষে যথেষ্ট বড়। তারই একাংশ তিনি আমাদের জন্য ছেড়ে দিলেন।

ডক্টর হাইনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আশ্বস্ত হলাম। ভয় ছিল অমন ঘোরতর পণ্ডিত ব্যক্তি, কে জানে যদি গোমড়ামুখো বদমেজাজী হন! মামাবাবুর খাতিরে মুখে কিছু না। বললেও হয়তো আমার মতো এক উটকো ছোকরার আগমন মোটেই সুনজরে দেখবেন না। সুনন্দ না হয় প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু আমি তো এ-লাইনে স্রেফ মুখ। মিউজিয়াম ঝাট দেওয়া ছাড়া আমার দ্বারা তাদের কোনো উপকার হবে না।

কিন্তু দেখলাম, এ এক যুবক বৃদ্ধ।

মাঝারি লম্বা। দাড়ি-গোঁফ কামানো গোল মুখখানা ভারি হাসিখুশি। মাথায় চুল আর টাক সমান সমান জায়গা অধিকার করেছে। একটু ব্যস্ত মানুষ। প্রচুর এনার্জি। হন্ হন্ করে চলেন। লাফ দিয়ে টপকে টপকে সিঁড়ি ভাঙেন। যখন তখন দরাজ গলায় হো-হো করে কী হাসি! ভদ্রলোক বেশ ইংরেজি জানেন, কাজেই কথা বলতে অসুবিধা নেই।

প্রথম আলাপেই আনন্দের আতিশয্যে হ্যাল্লো বলে আমার পিঠ এমন চাপড়ে দিলেন যে বেশ কিছুক্ষণ ব্যথা ছিল।

মিউজিয়ামের ইতিহাস শুনলাম।

মিউজিয়ামটি ছিল এক লক্ষপতি জর্মন কফিবাগিচার মালিকের। জীবজন্তুর স্পেসিমেন সংগ্রহ করা ছিল ফন স্লীমান-এর নেশা। বহু কষ্টে ও অর্থব্যয়ে বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের দূর দূর প্রান্ত থেকে তিনি হাজার হাজার জীবজন্তুর মৃতদেহ জোগাড় করে এনে মিউজিয়াম তৈরি করেন। এছাড়াও আফ্রিকার আরও অনেক বিচিত্র দুর্লভ জিনিস তিনি জোগাড় করেছিলেন। বছর পাঁচেক হল স্লীমান মারা গেছেন। উইলে তিনি তার সাধের মিউজিয়াম ও তৎসংলগ্ন বাড়িঘর বাগান সরকারকে দান করে যান। তারপর থেকে মিউজিয়ামটি তালাবন্ধ অবস্থাতেই পড়ে ছিল। তেমন যোগ্য কাউকে পাওয়া যায়নি মিউজিয়ামের ভার দেবার মতো। এমন সময় মাত্র কয়েক মাস ডক্টর হাইনে টাঙ্গানিকায় আসেন নিজের গবেষণার কাজে। ডক্টর হাইনে শুধু বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী নন, মিউজিয়াম পরিচালনার কাজেও তার প্রচুর অভিজ্ঞতা। টাঙ্গানিকা সরকার এমন সুযোগ হাতছাড়া করেনি। সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর হাইনেকে অনুরোধ জানানো হয় অন্তত কিছুদিনের জন্য মিউজিয়ামটির দায়িত্ব। নিতে। মিউজিয়ামকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাজিয়ে গুছিয়ে আরও বড় করে দিতে।

ডক্টর হাইনে রাজি হয়ে গেলেন। ভাবলেন মন্দ নয়। পরের পয়সায় একটা ভালো আস্তানা হবে। মিউজিয়ামের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের গবেষণাও চালিয়ে যেতে পারবেন। এখনো অবশ্য আসল কাজ কিছুই এগোয়নি। বাগান পরিষ্কার, ঘর-দোরের ধুলো ঝাড়তেই সময় কেটে গেছে।

মিউজিয়ামে ঢুকেই প্রথমে নজরে পড়ল দরজার দুপাশে দাঁড় করানো দুটি প্রকাণ্ড হাতির দাঁত। হাইনে বললেন, প্রত্যেকটা দাঁত লম্বায় ন-ফুটেরও বেশি এবং ওজন দুশো পাউন্ডের ওপর। ঘরগুলোর মধ্যে টেবিল, টুল এবং বড় বড় কাঁচ-ঢাকা শো-কেসে অজস্র জন্তু-জানোয়ার, পাখি, কীট-পতঙ্গের মৃতদেহ। জন্তু ও পাখিগুলির মধ্যে খড়কুটো কাঠের গুঁড়ো ভরে স্টাফ করা। নানা ভঙ্গিতে সাজানো। দেখলে মনে হয় জীবন্ত। ফর্মালিন ভর্তি বড় বড় কাঁচের বয়ামে ডোবানো পোকা-মাকড়, সাপ। শো-কেসে পিচবোর্ডের গায়ে পিন। আঁটা রকমারি প্রজাপতি, ফড়িং ইত্যাদি। এদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রাণী আমি কলকাতার মিউজিয়ামে দেখেছি। তবে সীমানের মিউজিয়ামের এক বিশেষত্ব আছে। ফন সীমান যেনতেন প্রকারে একটা স্পেসিমেন সংগ্রহ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল এই মিউজিয়ামের প্রতিটি সংগ্রহ হবে একেবারে সেরা।

আমি ও সুনন্দ যখন তৃতীয় হলঘরটায় ঢুকেছি, মামাবাবু ও ডক্টর হাইনে কিন্তু তখনো প্রথম ঘরটাই শেষ করে উঠতে পারেননি। প্রতিটি স্পেসিমেনের খুঁটিনাটি নিয়ে দুজনে আলোচনা করছেন, মাঝে মাঝে তর্ক হচ্ছে।

মিউজিয়ামের একেবারে শেষ ঘরটায় কোনো জীবজন্তু নেই। নানা ধরনের জিনিসে ঘর ভর্তি। বিভিন্ন উপজাতিদের পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, মুখোশ। কতকগুলো বিচিত্র কাঠ ও পাথরের মূর্তি। অদ্ভুত তাদের চেহারা, আশ্চর্য খোদাই কাজ।

ছোট এক শো-কেসের মধ্যে দেখি একটা প্রকাণ্ড ডিম। বাসরে কী পেল্লায়! অস্ট্রিচের ডিমের অন্তত সাত-আট গুণ বড়। সঙ্গে রাখা কার্ডে লেখা–ফসিল্ড এগ। এলিফ্যান্ট বার্ড। আঙুলে টোকা দিয়ে দেখলাম শক্ত পাথর। কেবলমাত্র মাদাগাস্কারে এই পাখির হাড় ও ডিম ফসিল অবস্থায় পাওয়া গেছে।

আপাতত মামাবাবু লেগে গেলেন ডক্টর হাইনের সঙ্গে মিউজিয়ামের স্পেসিমেনের ক্যাটালগিং করতে। দিন চারেক পরে মামাবাবু লেকচার-ট্যুরে বেরোবেন। এখানে বলে রাখি, মামাবাবুর বক্তৃতার বিষয় হচ্ছে মিসিং লিঙ্ক বা হারানো সূত্র। মানুষের পূর্বপুরুষ যে বাঁদর একথা সকলেই জানে। কিন্তু বাঁদর আর মানুষের মাঝখানে যে একটা নর-বানর অবস্থা, সেটার কোনো হদিস আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এটাকে তাই বলা হয় মিসিং লিঙ্ক। অবিশ্যি মামাবাবু যে মিসিং লিঙ্ক নিয়ে বক্তৃতা দেবেন, সেটা কিন্তু মানুষের ব্যাপার নয়। সেটা পাখির ব্যাপার। পাখি এসেছে সরীসৃপ থেকে! সবচেয়ে পুরনো যে পাখির ফসিল পাওয়া যায়, তাকে বলে আর্কিয়পটেরিক্স। এই পাখিতে সরীসৃপের কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু মামাবাবুর ধারণা, এর চেয়েও প্রাচীন পাখি নিশ্চয়ই ছিল, যেটাকে বলা যেতে পারে সরীসৃপ আর পাখির ঠিক মাঝামাঝি অবস্থা। এটাই পাখির মিসিং লিঙ্ক–আর এটার কোনো নমুনা বা ফসিল আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ছ-সাত দিন লাগবে মামাবাবুর বক্তৃতা শেষ করতে। তারপর আমরা টাঙ্গানিকার একটা বিশেষ জায়গায় গিয়ে ক্যাম্প ফেলব। ডক্টর হাইনে সেখানে নাকি একটি অতি প্রাচীন গুহার সন্ধান পেয়েছেন। তাতে নাকি প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কিছু কিছু চিহ্ন তিনি দেখেছেন। কাজেই সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি হবে, আদিম পৃথিবীর মানবজাতির ইতিহাস আবিষ্কারের চেষ্টা চলবে।

আমি এই সুযোগে ডার-এর-সালাম ভালো করে ঘুরে দেখে ফেললাম। মাঝে মধ্যে সনন্দ মামাবাবুর সাকরেদিতে ফাঁকি দিয়ে সঙ্গে জোটে। আমাদের গাইড হচ্ছে ডক্টর হাইনের অ্যাসিস্ট্যান্ট-সাড়ে ছফুট লম্বা কাফ্রি যুবক ওকেলো।

মাঝারি শহর। জাহাজঘাটায় অগুন্তি নৌকো, লঞ্চ ও ছোট-বড় জাহাজ সর্বদা গিসগিস করছে। শহরে পাঁচমিশেলি জাতের ভিড়। আফ্রিকান ছাড়াও এখানে কিছু ইউরোপীয় এবং বহু ভারতীয় ও আরবদেশীয় লোকের বাস। বাঙালি অতি অল্প। ব্যবসা বা খেতখামার করে তারা অনেকেই পূর্ব আফ্রিকায় কয়েক পুরুষ ধরে বাস করছে। পূর্ব আফ্রিকার অন্যান্য জায়গার মতো এখানকার প্রধান ভাষা সোয়াহিলি। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষিত লোকেই অল্প-বিস্তর ইংরেজি জানে।

আসার আগে আমি ও সুনন্দ মামাবাবুর কাছে সোয়াহিলি ভাষায় কিছুটা তালিম নিয়েছিলাম। ভাষাটা আরও রপ্ত করতে আপাতত ওকেলোকে পাকড়ালাম। আমরা ওকেলোর সঙ্গে সমস্ত বাক্যালাপ চালাতে লাগলাম সোয়াহিলিতে। সেই দুর্বোধ্য সোয়াহিলি শুনতে শুনতে বেচারা ভালোমানুষ একেবোর প্রাণ ওষ্ঠাগত। অর্ধেক মর্ম উদ্ধার করতে পারে না। ক্রমাগত ভুল শুনে তার নিজেরই মাতৃভাষা গুলিয়ে যেতে লাগল।

.

০২.

আরও দুদিন কেটেছে।

আমরা প্রত্যেকদিন ডক্টর হাইনের সঙ্গে সকালবেলা একটা ঝাকড়া বাদামগাছের নিচে চেয়ার-টেবিল পেতে প্রাতরাশ করি। তৃতীয় দিন চায়ের আসরে যোগ দিতে গিয়ে দেখি একজন অপরিচিত ব্যক্তি বসে হাইনের সঙ্গে গল্প করছেন।

হাইনে বললেন, আসুন আলাপ করিয়ে দিই–ইনি হচ্ছেন–

আগন্তুক তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ইয়া চওড়া একখানা পাঞ্জা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার নাম উইলিয়াম হার্ডি।

না না, বলুন ডেয়ারিং বিল। যে নামে আপনাকে সারা পূর্ব আফ্রিকা চেনে–হাইনে বললেন।

উইলিয়াম হার্ডি ওরফে ডেয়ারিং বিল, অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, তা বটে, তা বটে, ও-নামটা বড্ড চালু হয়ে গেছে। আসল নামটা বোধহয় ভুলেই গেছে লোকে।

হাইনে বললেন, মিস্টার হার্ডি একজন বিখ্যাত শিকারী। দেশ-স্কটল্যান্ড। তবে আফ্রিকাতেই স্থায়ীভাবে আড্ডা গেড়েছেন। বোধহয় আর দেশে ফেরার ইচ্ছেও নেই। কী বলেন–মিস্টার হার্ডি?

ডেয়ারিং বিলের ঠোঁটের কোণে একটা পাইপ কামড়ানো ছিল। পাইপটা হাতে নিয়ে বললেন, রাইট! ত্রিশ বছর আফ্রিকায় আছি। বনে বনে ঘুরে জংলি বনে গেছি। এখন আপনাদের সভ্য জগতে ফিরে গিয়ে আর খাপ খাওয়াতে পারব না। তাই এখানেই থেকে গেছি। ভালোবেসে ফেলেছি দেশটা। আমি একা মানুষ। কেনিয়ায় নাইভাসা হ্রদের কাছে। একটি ছোট্ট কুটির বানিয়ে বাস করছি। আজকাল অবশ্য শিকার ছেড়ে দিয়েছি। নেহাৎ প্রয়োজন না হলে রাইফেল ধরি না। অনেকদিন ঘুরেছি কিনা, তাই পা দুটোকে রেস্ট দিচ্ছি। বাড়িতে বসে খাই-দাই বই পড়ি। আত্মজীবনী লিখি। আর কুটিরের বারান্দায় বসে বসে দেখি আফ্রিকার রহস্যময় প্রকৃতি। হ্রদের নীল জল। দূরে পাহাড়-জঙ্গলের রেখা। অজস্র জীবজন্তু, পাখি। আর নমাসে ছমাসে দরকার পড়লে শহরে আসি। দিব্যি কাটছে।

ডেয়ারিং বিল-এর চেহারা রোদে-জলে পোড় খাওয়া দীর্ঘ পাকা বাঁশের মতো; বয়স ধরা যায় না। মুখের দিকে তাকালে প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঘন ভুরুর নিচে একজোড়া উজ্জ্বল নীল চোখ। দৃঢ় চোয়াল। উন্নত নাসা। মাথায় কোকড়া চুল, রগের কাছে সামান্য পাক ধরেছে।

মিউজিয়ামের অনেক সংগ্রহ বিলের পূর্বপরিচিত। স্পেসিমেনগুলি সংগ্রহের ইতিহাস তিনি বলতে থাকেন।

শেষ ঘরটায় ঢুকে সেই বিচিত্ৰদৰ্শন মূর্তিগুলোর সামনে বিল স্তব্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। ঘন ঘন পাইপ টানছেন। মুখ দেখে মনে হল যেন অতীত স্মৃতির রোমন্থনে তার মন তোলপাড় হচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এই মূর্তিগুলোর পরিচয় জানেন কি?

মনে হচ্ছে আফ্রিকার নানা উপজাতির শিল্প কাজ।–হাইনে বলেন।

হ্যাঁ। তবে শুধু শিল্পকর্ম বললে ভুল হবে। এদের মধ্যে অনেকগুলি ছিল আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতির উপাস্য দেবতা।

তাই নাকি? আমরা নতুন আগ্রহে মূর্তিগুলোকে দেখি।

বিল বলে চলেন, স্লীমানের এই এক অদ্ভুত খেয়াল ছিল। উপজাতিদের বিগ্রহমূর্তি ছলে-বলে-কৌশলে সংগ্রহ করা। এজন্য কয়েকবার তাকে ভীষণ বিপদেও পড়তে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, একটা মূর্তি সে জোগাড় করতে পারেনি। সেটা মিউজিয়ামে আনতে না পারার আপশোস সে কখনো ভোলেনি।

কীসের মূর্তি? প্রশ্নটা আমাদের সকলের গলা থেকে একই সময় বেরিয়ে এল।

সে এক অদ্ভুত বিগ্রহ। আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। পাইপে তামাক টানতে টানতে বিল বলেন, প্রায় সতেরো-আঠারো বছর আগেকার কথা। একবার ঘুরতে ঘুরতে আমি টাঙ্গানিকার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে উপকূলের কাছাকাছি এক উপজাতির গ্রামে গিয়ে হাজির হই। পৌঁছলাম যখন বিকেল। সেদিন গ্রামে কোনো উৎসবের আয়োজন হচ্ছিল। মস্ত অগ্নিকুণ্ড জ্বালাবার জোগাড়যন্ত্র চলেছে। গ্রামের সব মেয়ে-পুরুষ জড়ো হচ্ছে চারপাশে। একটু পরেই আরম্ভ হবে উৎসব। আমার একজন সঙ্গী ছিল। সেও আফ্রিকান, কিন্তু ভিন্ন উপজাতির লোক। আমরা দুজনেই বেজায় ক্লান্ত। ইচ্ছে ছিল রাতটা ওখানে আগুনের পাশে বসে নাচ-গান দেখে কাটিয়ে দিই। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। একটা ঢ্যাঙা মতো লোক, বোধহয় তাদের উইচ-ডক্টর–আমাদের বলল চলে যেতে। উৎসবের সময় তাদের বিগ্রহ উন্মোচিত করা হবে। সেই পূণ্য দেবমূর্তি দর্শন করা নাকি কোনো বিদেশির পক্ষে নিষিদ্ধ। স্বাভাবিক কৌতূহলবশে সেই দেবমূর্তির সন্ধানে চারদিকে চাইতে দেখি যেখানে অগ্নিকুণ্ড তৈরি হচ্ছে সেখানে কাঠের গাদার পাশে বেদির ওপর একখানা চৌকো বড় পাথর শোয়ানো। চামড়া দিয়ে ঢাকা। ঐ পাথরের গায়েই নিশ্চয় কোনো মূর্তি খোদাই করা আছে।

যাহোক বাধ্য হয়ে তখন আমরা বিদায় নিলাম। আমার মনে কিন্তু কৌতূহল চাড়া দিয়ে উঠল। মূর্তিটা দেখতে কেমন? গ্রামবাসীদের চোখের সামনে দিয়ে, তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে ঘাসবনের পথ বেয়ে অনেকখানি সোজা গিয়ে আমরা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। তারপর রাত্রি নামে অন্ধকার ঘন হয়। আমি আমার সঙ্গীকে অপেক্ষা করতে বলে ফের গ্রামের পথে ফিরলাম।

দূর থেকে সমবেত কণ্ঠের হুঙ্কার আর ঢাকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। ঘাসবন আর ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি গ্রামের কাছে এসে উপস্থিত হলাম। একটা ঝোঁপের আড়ালে গোপনে বসে দেখলাম–প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। আগুনের একধারে আরম্ভ হয়েছে উন্মত্ত নাচ। বড় বড় ঢাক বাজছে। আর অগ্নিকুণ্ডের পাশেই সেই বেদির গায়ে চৌকো পাথরের খণ্ডটা ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো। পাথরের গায়ে আঁকা মূর্তিটা ভালো করে দেখতে বায়নোকুলার চোখে লাগালাম।

যে অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম তা জীবনে ভুলব না।

হাত দেড়েক লম্বা, হাতখানেক চওড়া, ইঞ্চি চারেক পুরু একটা কালচে পাথরের খণ্ডের গা কেটে এক কিম্ভুত কঙ্কাল আকৃতির রূপ দেওয়া হয়েছে। মূর্তির রঙ কিন্তু কালো নয়। হালকা হলুদ রং করা। আফ্রিকার আনাচে-কানাচে বহু দুর্গম জায়গায় আমি ঘুরেছি। বহু উপজাতির গ্রামে গেছি, তাদের বিগ্রহ দেখেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুতদর্শন ভাস্কর্য কোথাও চোখে পড়েনি।

মামাবাবু হঠাৎ প্রশ্ন করেন, ওরকম কালচে রঙের পাথর ওরা পেল কোথায়? কাছাকাছি কোথাও ছিল নাকি?

হ্যাঁ। কাছে এক উপত্যকায় ঐরকম পাথর আমি দেখেছি। বোধহয় সেখান থেকেই পাথরের খণ্ডটা ওরা জোগাড় করে।

তারপর? তারপর কী হল? আমি ও সুনন্দ অধীর হয়ে পড়ি।

হ্যাঁ, তারপর ঘণ্টাখানেক ধরে গোপনে তাদের উৎসব এবং দেবতাকে দেখে আমি নিঃশব্দে ফিরে গেলাম।

এই কাহিনি হয়তো এখানেই ইতি হত, কিন্তু গোলমাল পাকালো স্লীমান। এ-ঘটনার চার মাস পরে তার সঙ্গে আমার দেখা। সেই অদ্ভুত বিগ্রহের গল্প শুনে সে ক্ষেপে উঠল, ঐ মূর্তি তার চাই।

এ-ব্যাপারে আমার মোটেই উৎসাহ ছিল না। জানতাম ও-মূর্তি জোগাড় করা রীতিমতো দুঃসাহসিক কাজ। কেন মিছিমিছি ঝাটে জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু স্লীমানের জেদ চেপে গেছে। তার অনুরোধে বাধ্য হয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে আবার সেই গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম।

গ্রামে পৌঁছে আমরা স্তম্ভিত। কুটিরগুলো ভাঙাচোরা; জনমানবশূন্য। যেন একটা প্রলয় ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। অনেক খুঁজে কয়েকজনকে আবিষ্কার করলাম–সবাই অথর্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। জানলাম পাশের এক উপজাতির সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। তারাই অতর্কিতে আক্রমণ করে গ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছে। অনেকে নিহত বা বন্দী হয়েছে। বাকিরা। পালিয়েছে। তাদের বিগ্রহের ভাগ্যে কী ঘটেছে তারা জানে না।

গেলাম সেই আক্রমণকারী উপজাতির গ্রামে।

তারাও মূর্তিটার কোনো খবর বলতে পারল না। খুব সম্ভব যারা পালিয়েছে তারাই সঙ্গে নিয়ে গেছে।

মুর্তিটা সংগ্রহ করতে না পারায় স্লীমান অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল। আমি কিন্তু মনে মনে খুশি হই। চাইলে কেউ তাদের দেবতাকে দেবে না। অর্থাৎ চুরি করতে হত এবং নির্ঘাত এক ফ্যাসাদ বাধত। তাছাড়া বিগ্রহ চুরি ব্যাপারটা আমি ঠিক পছন্দ করতাম না, যদিও পাল্লায় পড়ে দু-একবার করেছি।

ডেয়ারিং বিল সেদিন আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেলেন।

প্রচুর রকমারি সুস্বাদু খাদ্যবস্তুর আয়োজন করা হয়েছিল। বিল পরম তৃপ্তিভরে খাওয়া শেষ করে বললেন, আঃ! দারুণ খাওয়ালেন। জংলি মানুষ, মাঝে মাঝে শহরে এলে গণ্ডেপিণ্ডে গিলে যাই। স্লীমানের কাছে যখন আসতাম সেও আমাকে ভূরিভোজ করাত। তার প্রতিদানে আমি প্রত্যেকবার তার মিউজিয়ামের জন্য কিছু-না-কিছু নিয়ে এসেছি।

বটে! তাহলে আমাদের বেলা শূন্য হাত কেন? ডক্টর হাইনে হেসে বললেন। কী দোষ করলাম আমরা। আমাদের নেমন্তন্নটা বুঝি হেয়? স্লীমানের স্ট্যান্ডার্ডে হয়নি?

আরে না না, কী যে বলেন! বিল প্রবল প্রতিবাদ করে। সত্যি চমৎকার হয়েছে রান্নাগুলো। তারপর একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বললেন, তাছাড়া আপনাদের জন্য যে খালি হাতে এসেছি জানলেন কী করে? একটা খবর আছে। তবে জানি না আপনাদের কতটা কাজে লাগবে।

কী খবর? বলুন শিগগির।

দেখুন, আমি পূর্ব উপকূলের কাছে মাফিয়া দ্বীপ থেকে আসছি। একটা কাজে গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকজন গ্রামবাসী রাস্তা তৈরির জন্য খুঁড়তে খুঁড়তে কয়েকটা অদ্ভুত আকৃতির পাথর পায়। দৈবাৎ আমি তখন সেখানে ছিলাম। পাথর কটা দেখে আমার সন্দেহ হয় এগুলো সাধারণ পাথর নয়, ফসিল। কোনো আদিম বিশাল জন্তুর হাড় জমে পাথর হয়ে গেছে। আমি গ্রামের লোকদের বলে-কয়ে রাজি করিয়েছি যেন তারা। পাথরগুলো যত্ন করে রেখে দেয়। আর খোঁড়াখুঁড়ি কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখে। আমি গিয়ে বিশেষজ্ঞদের এ-বিষয়ে বলছি। তারা এসে পরীক্ষা করে দেখুক।

ডক্টর হাইনে উত্তেজিত স্বরে বললেন, আপনি তো মশায় বেশ! এমন দামি খবরটা এতক্ষণ স্রেফ চেপে রেখেছিলেন!

বিল বললেন, আমি তো এ-ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই। ওগুলোর কোনো মূল্য আছে। কিনা কে জানে! আমার ভুল হতে পারে। তাই এসেই দুম করে ফসিলের খবর ঘোষণা করতে সংকোচ হচ্ছিল।

তারপর হাসতে হাসতে বললেন, খবরটা শুনেই আপনারা যেরকম ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সকালে বললে কী আর দুপুর অবধি আমার সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটাতেন! ব্রেকফাস্ট খাইয়েই হয়তো বিদেয় দিতেন। তা যাক, কয়েক ঘন্টা সময় নষ্টে কোনো ক্ষতি হবে না। ঠিকানা দিচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে যান।

উইলিয়াম হার্ডি আমাদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, আপনারা সার্ভেতে বেরিয়ে যদি কেনিয়া যান, দীনের কুটিরে একবার পদার্পণ করবেন।

ডক্টর হাইনে পরদিন মাফিয়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আর তার পরের দিন মামাবাবু বেরলেন লেকচার-টুরে। ব্যস, আমি সুনন্দ তখন বাঁধন-ছাড়া মুক্ত জীব। হাইনের জিপগাড়িটা চালিয়ে আমরা শহরের বাইরে লম্বা লম্বা পাড়ি জমাতে লাগলাম। ওকেলোকে বললাম, রাখো তোমার মিউজিয়াম। তোমার বস্ ফিরে এলে যত ইচ্ছে ডিউটি কোরো। আপাতত আমাদের ক-দিন আফ্রিকা দেখাও। একটু গাই-ই করে সে রাজি হয়ে গেল।

শহর ছাড়িয়ে অনেকখানি গেলে আরম্ভ হয় পথের দু-পাশে দিগন্তবিস্তৃত তৃণভূমি। সেখানে অজস্র তৃণভোজী জন্তু দলে দলে চরে বেড়ায় নানা জাতের হরিণ, লম্বা গলা জিরাফ, সাদা-কালো জার্সি আঁটা জেব্রারা। অস্ট্রিচদের কৌতূহল বেশি। অন্য জন্তুদের মতো গাড়ির আওয়াজে দূরে সরে যায় না। গলা বাড়িয়ে চোখ পাকিয়ে দেখে–এমন বদখৎ শব্দ করতে করতে আসছে, কে হে বটে?

একদিন দূরে কয়েকটা বুনো মোষ দেখেছিলাম। ওকেলো কাছে যেতে বারণ করল। বড় বদমেজাজী প্রাণী। তবে সিংহ দেখা হল না। ওকেলে বলল, সেরেনগেটি রিজার্ভ ফরেস্টে যাও, যত খুশি সিংহ দেখবে। একেবারে পোযমানা হয়ে গেছে! মানুষ দেখলে কেয়ার করে না। সেরেনগেটি অনেক দূরে, ঠিক হল মামাবাবু ফিরে এলে যাব।

কটা দিন তোফা কাটল। সারাদিন টো-টো করি; সন্ধেবেলা বাড়ি এসে রাঁধনে ইসমাইলের অমৃত সমান গরম খানা। তারপর টেনে ঘুম।

.

০৩.

মামাবাবু ডার-এস-সালাম ফিরলেন ছ-দিন পরে। আমি ও সুনন্দ তখন বারান্দায় বসে।

ট্যাক্সি থেকে নেমে মামাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সব ভালো তো? উঃ, খুব ঘুরেছি। একেবারে হারিকেন টুর। তারপর ডক্টর হাইনের খবর কী? ফিরেছেন?

না। সুনন্দ জবাব দেয়।

কোনো চিঠিপত্র?

কয়েকটা চিঠি আছে আপনার নামে। একটা এসেছে মাফিয়া থেকে, হয়তো হাইনের চিঠি।

বেশ চল, দেখছি।

জিনিসপত্র রেখে হাত-মুখ ধুয়ে, পোশাক পাল্টে মামাবাবু খাবার ঘরে ঢুকে হাঁক দিলেন, ইসমাইল, এককাপ গরম কফি দাও। বড্ড টায়ার্ড।

সুনন্দ তাকে তিনটে চিঠি দিল।

একটা খাম বেছে তুলে নিয়ে মামাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এই তো ঠিকানায় দেখছি হাইনের হাতের লেখা। অন্য দুটি চিঠিতে একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি খামটা খুললেন।

চিঠি জর্মন ভাষায় লেখা। মামাবাবু গভীর আগ্রহে তার পাতার ওপর ঝুঁকে পড়েন। আমরা দুজন উৎসুক চিত্তে তার মুখপানে চেয়ে থাকি।

পড়তে পড়তে হঠাৎ মামাবাবু বলে ওঠেন, বাঃ, জোর খবর দিয়েছে ডেয়ারিং বিল।

সুনন্দ তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করে, কী লিখেছেন হাইনে? ফসিলটা কীসের, কিছু বুঝতে পেরেছেন?

হুঁ, পেরেছেন। কোনো অতিকায় ডাইনোসরের। দাঁড়াও বলছি সব। আগে পুরোটা পড়ে নিই।

পশ্চিমের খোলা জানলাটা দিয়ে শেষ বিকেলের রশ্মি এসে ঘরে পড়েছে। বাইরে দেখা যাচ্ছে মিউজিয়ামের বাগানের একাংশ। ঘন পাতা ভরা বড় বড় ডালগুলোর ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো গোধূলির আকাশ। মস্ত ডাইনিং রুমে আমরা তিনটি প্রাণী। মাথার ওপরে ঝোলানো বৈদ্যুতিক আলোয় মেহগনি কাঠের কালো পালিশ করা টেবিলটা চকচক করছে। সামনে বসে মামাবাবু পত্র পাঠে নিমগ্ন। উল্টোদিকে আমি ও সুনন্দ পাশাপাশি বসে। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ। শুধু রান্নাঘর থেকে টুংটাং কাপ-ডিসের আওয়াজ ভেসে আসছে।

সুনন্দ প্রস্তুত হও। মামাবাবু চিঠি থেকে মুখ তুললেন। আমরা পরশু দিন মাফিয়া রওনা দেব। ডক্টর হাইনে অনুরোধ করেছেন, আমরা যেন যত শীঘ্র সম্ভব মাফিয়া গিয়ে তার সঙ্গে কাজে যোগ দিই। পুরো ফসিলটা উদ্ধার করতে হবে।

কিন্তু কী পেয়েছেন তিনি, বললেন না তো? সুনন্দ প্রশ্ন করে। পেয়েছেন কঙ্কালের খুলি এবং আরও কতকগুলো অংশ। একটা পাজরার হাড় পেয়েছেন প্রায় আট ফুট লম্বা। দেখো আমি বলে দিচ্ছি এ নির্ঘাত ব্রাকিওসরাস। এত বড় পাজরের হাড় আর কোনো প্রাণীর হতে পারে বলে তো জানি না। যাও তুমি এখুনি। গোছগাছ শুরু করে দাও। আমি কফিটা শেষ করি আর লিস্টটা পড়ে নিই। হাইনে পাঠিয়েছেন–যাবার সময় কয়েকটা জিনিস নিয়ে যেতে হবে।

সুনন্দ পাশের ঘরে যাওয়া মাত্র আমি জিজ্ঞেস করি, ব্রাকিওসরাস কী মামাবাবু?

শুনলে তো একধরনের অতিকায় ডাইনোসর। জুরাসিক যুগের অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় সতেরো-আঠারো কোটি বছর আগেকার সরীসৃপ। পূর্ব আফ্রিকায় ব্রাকিওসরাসের ফসিল পাওয়া গেছে।

কত বড় হতো এগুলো?

তা ধর একটা পূর্ণবয়স্ক ব্রাকিওসরাস সত্তর-আশি ফুটেরও বেশি লম্বা হত বলে অনুমান করা হয়।

আরে বাস, ওজন কত? মামাবাবুর সাড়া পেয়ে ওকেলো নিঃশব্দে এসে ঘরে ঢুকেছিল। সে বিস্ফারিত চক্ষে প্রশ্ন করে।

প্রায় পঞ্চাশ টন হত। একটা হাতির ওজন কত হবে, বলতে পার?

ওকেলো ভেবেচিন্তে বলে, ম্যাক্সিমাম ছ-সাত টন।

তবেই বুঝে দেখ এদের বপূখানা কীরকম ছিল? অনায়াসে একটা বাচ্চা হাতিকে ইনি জলযোগ করতে পারতেন। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, ব্রাকিওসরাস হাতি-টাতি খেত না। কারণ তখনও হাতি সৃষ্টি হয়নি এবং এরা ছিল উদ্ভিদভোজী।

কেমন দেখতে ছিল? এবার আমার পালা।

আমার পড়ার টেবিলের ওপর একটা বই দেখবে লাল মলাট, বেশ মোটা, নিয়ে এসো। মামাবাবু বলেন।

বইটা খুলে পাতা জোড়া কিম্ভুত আকৃতির এক প্রাণীর ছবি খুলে ধরে বললেন, এই দেখ, ব্রাকিওসরাস। বৈজ্ঞানিকরা কঙ্কালের ওপর অনুমান করে এই চেহারা এঁকেছেন।

দেখলাম অনেকটা জিরাফের আকৃতি। লম্বা গলা, দেহের তুলনায় ছোট মাথা, মোটা লম্বা লেজ মাটিতে লুটোচ্ছে। বিরাট বপু। থামের মতো চারটে পা। সামনের পা দুটো পিছনের পায়ের চেয়ে লম্বা।

মামাবাবু বললেন, আদিম পৃথিবীতে অনেক বিশাল বিশাল প্রাণীর বাস ছিল। ডাঙার জন্তুদের মধ্যে ব্রাকিওসরাস বোধহয় ছিল সবচেয়ে বৃহৎ। এই বিরাট দেহটা নিয়ে ডাঙায় ঘোরাফেরার অসুবিধা হত বলে এরা সাধারণত জলাভূমিতে বাস করত।

কফিতে চুমুক মেরে মামাবাবু ডক্টর হাইনের লিস্টটা মেলে ধরলেন। আমার মাথায় তখনও ব্রাকিওসরাস পাক খাচ্ছে। দুম করে আর একখানা প্রশ্ন ছাড়ি, ওটা মাফিয়া দ্বীপে গেল কী করে? সাঁতরে?

লিস্ট থেকে চোখ সরিয়ে মামাবাবু বললেন, এরা অবশ্য কিছুটা সাঁতার জানত কিন্তু সাঁতারের দরকার হয়েছিল কিনা সন্দেহ আছে।

মানে?

মানে হয়তো হেঁটেই গিয়েছিল। স্রেফ চার পায়ে হেঁটে। মামাবাবু মুচকি হাসেন।

জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে কি? আমি হতভম্ব।

তখন ওখানে সমুদ্র ছিল কে বলেছে? গণ্ডোয়ানা ল্যান্ড থিওরির কথা শোননি? অনেকে মনে করেন আদিম যুগে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ভারতবর্ষ, অস্ট্রেলিয়া সব জুড়ে এক প্রকাণ্ড মহাদেশ ছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছে গণ্ডোয়ানা ল্যান্ড। জুরাসিক যুগের কিছু আগে এই মহাদেশে ফাটল ধরে। কয়েকটি বড় বড় খণ্ডে ভাগ হয়ে যায় এবং ক্রমে খণ্ডগুলি পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তাদের মাঝখানে সৃষ্টি হয় সমুদ্র। ব্যাপারটা ঘটতে বেশ সময় লেগেছিল। প্রায় দশ-বারো কোটি বছর ধরে একটু একটু করে সরে গিয়ে ভূ-খণ্ডগুলি এখনকার পজিশনে এসে দাঁড়ায়।

কোনো মানে হয় আলাদা হয়ে যাবার! আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বলি। তাহলে আর সমুদ্র-টমুদ্রের ঝামেলা থাকত না, দিব্বি ডাঙাপথে ভারত থেকে আফ্রিকা আসা যেত।

হুঁ, জাহাজে চড়তে হত না, কত সুবিধে। হাওড়ায় ট্রেনে চড়ো, সোজা ডার-এস-সালামে এসে নামো। সুনন্দ পাশের ঘর থেকে একটি মন্তব্য ছাড়ে।

তার লক্ষ্যস্থল আমি। জাহাজে আসতে একদিন আমি ঢেউয়ের দোলায় গা গুলিয়ে সামান্য অসুস্থ হয়েছিলাম। তাই এই বিদ্রূপ।

কিন্তু প্রমাণ স্যার? কী করে বুঝল লোকে এ-দেশগুলো জোড়া ছিল? ওকেলোর বিশ্বাস হয় না।

প্রমাণ অনেক আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদের চিহ্ন। এমন কিছু একই জাতের বিশেষ ধরনের প্রাণী এবং উদ্ভিদের অস্তিত্ব এইসব সুদূর দেশগুলিতে পাওয়া গেছে, যাদের পক্ষে আজকের দিনের বিশাল জলপথের বাধা পেরিয়ে কিছুতেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া সম্ভব নয়। এরা নিশ্চয়ই স্থলপথেই ছড়িয়ে পড়েছিল।

অস্ট্রেলিয়া আর আফ্রিকা এক মহাদেশের মধ্যে?–ওকেলোর যেন তত্ত্বটা তবুও ঠিক হৃদয়ঙ্গম হয় না।

কেন হবে না? আদিম পৃথিবীর সঙ্গে আজকের জগতের মিল কতটুকু? তাছাড়া এই ছাড়াছাড়ি হতে বড় কম দিন লাগেনি ভেবে দেখ। অবশ্য এমনও হতে পারে, তখন দেশগুলো খুব কাছাকাছি ছিল আর স্থলপথের সেতু দিয়ে তাদের পরস্পরের সঙ্গে যোগ ছিল। মোট কথা, এদের মধ্যে যে ডাঙাপথে যোগ ছিল এ-কথাটা প্রায় সব বিজ্ঞানীই মেনে নিয়েছেন।

আমরা আরও প্রশ্ন তুলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মামাবাবু থামিয়ে দেন, আজ আর নয়, আর একদিন হবে। অনেক কাজ বাকি।

লিস্টটা পড়তে পড়তে মামাবাবু চেঁচিয়ে ওঠেন, সুনন্দ, হাইনের কাণ্ডটা দেখ। কী একখানা অর্ডার। লিখেছেন–আসার সময় কয়েকটা ডাইনামাইটের স্টিক সঙ্গে নিয়ে আসবেন। এ জায়গায় মাটির নিচে পাথরের স্তর খুব প্রাচীন। অনেক প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে জায়গাটা জুড়ে অনেকগুলো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথরের চাই পড়ে থাকায় খুঁড়তে অসুবিধা হচ্ছে। ব্লাস্টিং করে চাইগুলো ভেঙে ফেলব। ওকেলোকে বললে ডাইনামাইট জোগাড় করে এনে দেবে। অতএব বৎস ওকেলো, তোমার গুরুদেবের আদেশ তো শুনলে? এখন আজ্ঞা পালনে তৎপর হও। আমি বেরোচ্ছি, কিছু কেনাকাটা দরকার।

.

০৪.

আমরা রুফিজি নদীর মোহনায় এসে উপস্থিত হলাম। এখান থেকে একটা ধাওয়ে চেপে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মাফিয়া যাব। ধাও একরকম সমুদ্রগামী নৌকো। শত শত বছর ধরে এই নৌকোগুলি যাত্রী ও মালপত্র নিয়ে আফ্রিকা ও ভারতবর্ষের উপকূলে যাতায়াত করছে। মোহনায় একটি নৌকো নিয়ে ছজন আরব মাঝি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পালতোলা নৌকো। আজকাল অবশ্য মোটর-ইঞ্জিন বসানো ধাওয়ের চলন হয়েছে, কিন্তু তাড়াহুড়োয় ব্যবস্থা করার ফলে কোনো মোটরলঞ্চ বা মোটর-ইঞ্জিন চালিত ধাওয়ের বন্দোবস্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

মামাবাবু বললেন, কিছুটা সময় বেশি নেবে। এখন সকাল নটা, সন্ধের আগে পৌঁছতে পারব আশা করছি। তবে অনুকুল বাতাস পাব, তাই আরও তাড়াতাড়ি যাওয়া যেতে পারে। আমি আর সুনন্দ বেজায় খুশি। দিনটা একটু মেঘলা করেছে। কবিত্ব করতে করতে দিব্যি সমুদ্র-বিহার জমাব। মালপত্র তোলা হলে নৌকো ছেড়ে দিল।

প্রায় আধাআধি পথ পেরিয়েছি। মাঝিরা ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাতে লাগল। একজন বলল, হুজুর আকাশের গতিক বড় সুবিধের নয়। তুফান আসতে পারে। তারা তাড়াতাড়ি পালটা নামিয়ে ফেলল।

দেখলাম, আকাশের কোণে একখণ্ড জমাট কালো মেঘ। বাতাসের বেগও বেশ বেড়েছে।

দেখতে দেখতে ঘোর কালো মেঘে সারা আকাশ অন্ধকার করে ফেলল। তারপরই হঠাৎ হু হু করে ছুটে এল দমকা ঝড়। আরম্ভ হল বৃষ্টি। বড় বড় জলের ফোঁটা তিরের মতো গায়ে বিধতে লাগল। নিমেষে কী আশ্চর্য পট পরিবর্তন। সেই শান্ত রোমান্টিক সমুদ্র হয়ে উঠল ভয়াল উত্তাল। নীল সাগরের রঙ পাল্টে হয়ে যায় আলকাতরার মতো মসিঘন। ঘন ঘন বিদ্যুতের কশাঘাতে আকাশ যাচ্ছে চিরে। ঢেউয়ের পর ঢেউ ধেয়ে আসছে। বিশাল পর্বতপ্রমাণ। জলের ফসফরাসের অস্পষ্ট সবজে আভায় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে ক্ষ্যাপা সমদ্রের। রূপ। প্রাণের আশঙ্কা না থাকলে এ-সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।

বিক্ষুব্ধ জলরাশির মধ্যে আমাদের নৌকো মোচার ভোলার মতো একবার ঢেউয়ের। চূড়ায় লাফিয়ে ওঠে, তারপরই তলিয়ে যায়। আবার ওঠে ভেসে। দিকদিশাহীনভাবে নৌকো অন্ধবেগে ছুটে চলেছে।

আমরা তিনজন পাটাতন আঁকড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। লোনা জল ঢুকছে চোখে-মুখে। মৃত্যুর আশঙ্কায় ভগবানের নাম জপছি আর প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছি, এই বুঝি শেষ।

কিন্তু অদ্ভুত সেই মাঝিদের সাহস ও ক্ষমতা। প্রকৃতির ঐ প্রচণ্ড তাণ্ডবের মধ্যে তারা। মরণপণ লড়াই চালিয়ে চলেছে। আর্তস্বরে আল্লার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে আর। প্রাণপণ চেষ্টায় টাল সামলে নৌকো ভাসিয়ে রাখছে।

একটা তীব্র কাতর আর্তনাদ ঝড়ের গর্জন ছাপিয়ে কানে এল। বিদ্যুতের ক্ষণিক দীপ্তিতে দেখলাম দুজন মাঝি নেই। ঢেউয়ের ঝাঁপটা তাদের সমুদ্রগর্ভে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। বাকি চারজন তখনও নিশ্চিত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষায় মত্ত। বিলীন সঙ্গী দুটির জন্য শোক প্রকাশের সময় নেই তাদের।

কতক্ষণ এইভাবে কেটেছিল খেয়াল নেই। অকস্মাৎ নৌকোর তলদেশের সঙ্গে কঠিন কোনো বস্তুর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হল। নৌকোটা লাফিয়ে উঠল। সেই নিদারুণ ঝাঁকুনিতে আমার মুঠো গেল আলগা হয়ে। সজোরে ছিটকে পড়লাম শুন্যে। তারপর আছড়ে পড়লাম–জলে নয়, শক্ত মাটিতে। আর আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালাম।

ধীরে ধীরে চোখ মেলোম! চোখের পাতা দুটো ভীষণ ভারী, তাকাতে কষ্ট হয়। চাইতেই উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল, আবার চোখ বুজলাম।

ভাবতে চেষ্টা করি কোথায় আমি। চিন্তাটা জট পাকিয়ে যায়। মনে আবছা আবছা ভেসে ওঠে–নৌকোযাত্রা, সমুদ্র, ঝড়, সুনন্দ, মামাবাবু। ফের চোখ খুলি। টান টান করে চাই। আর দেখি কয়েকটা আবলুস-কালো মুখ আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই তাদের চকচকে সাদা দন্তপাটি বিকশিত হয়। হাসছে? সভয়ে আবার আমি চক্ষু মুদি।

বুঝেছি, আমি নির্ঘাত পটোল তুলেছি। সমুদ্রগর্ভে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। তারপর এসে উপস্থিত হয়েছি যমপুরীতে। আমার চারপাশে এরা সব যমদূত।

নাঃ, কী সব ভাবছি যা তা!

প্রাণপণ চেষ্টায় মাথাটা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করি। একটা জলের ঝাঁপটা খেলাম মুখে। কানে আসে কতকগুলো দুর্বোধ্য আওয়াজ, মানুষের কণ্ঠস্বর। কথা বলছে।

তাড়াতাড়ি চোখ খুলি। উঠে বসতে চেষ্টা করি। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। হাত-পা নাড়তে পারছি না। মাথাটা যেন বিশ-মনি পাথর। কোনোরকমে আধশোয়া অবস্থায় যতটা। সম্ভব চারপাশে চাই।

দেখলাম কোনো এক সমুদ্রসৈকতে এসে পড়েছি। আশেপাশে লম্বা লম্বা নারিকেল গাছ। সামনে নীল সাগর। অসীম জলরাশি। ঢেউগুলি একটানা নাচতে নাচতে এসে বেলাভূমিতে ভেঙে পড়ছে। মাথার ওপর প্রভাতী সূর্য। বেলা বোধহয় বেশি নয়। তবে পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশে রোদের বেশ তেজ। আমাকে ঘিরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। আরও প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন মেয়ে-পুরুষ তটভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। তারা সবাই কৃষ্ণকায়। পোশাক স্বল্প। পুরুষদের দেহের উধ্বাঙ্গ খালি। কেবল কোমরে জড়ানো উরু অবধি লম্বা একটুকরো জানোয়ারের বা গাছের ছাল। আবার কারও গায়ে দেখলাম রঙচঙে সুতির কাপড় রয়েছে। মেয়েদের পরনেও ঐসব জিনিস। গলার নিচ থেকে হাঁটু অবধি ঢাকা। মেয়ে-পুরুষ সবারই গায়ে নানারকমের বিচিত্র গয়নাগাঁটি। কড়ি, শঙ্খ ইত্যাদির মালা, বালা। লোহা, পিতল ইত্যাদির গয়নাও দেখলাম। অনুমান হল এরা আফ্রিকার কোনো আদিম উপজাতি।

তারা উত্তেজিত স্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। একটা কথা বার বার কানে এল–মাহিন্ডি, মাহিন্ডি। কথাটার মানে জানি। সোয়াহিলি ভাষায় মাহিন্ডির অর্থ ভারতীয়। পিছনে তাকিয়ে দেখি তীরভূমি ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠেছে। স্বল্প বালুরাশির শেষে নানারকম গাছগাছালির শুরু। উদ্ভিদরাজ্য ক্রমে ঘন হয়েছে। জায়গাটা যে কোথায় কিছু বুঝতে পারলাম না। আফ্রিকার কোনো উপকুলে? কিন্তু চক্রাকার তটরেখা এবং সমুদ্রবেষ্টনী দেখে সন্দেহ হল কোনো দ্বীপ। হঠাৎ মনে পড়ল, সুনন্দ? মামাবাবু?–কই তারা! দুঃসহ আশঙ্কায় চারদিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে দেখি।

ঐ তো!

কতগুলো লোকের ভিড়ের মাঝে মামাবাবু শুয়ে রয়েছেন। পাশে সুনন্দ বসে। নিচু হয়ে কী জানি করছে। ডাকলাম, সুনন্দ! ক্ষীণ স্বর বেরোল।

সুনন্দ চকিতে ফেরে। কে অসিত? উঃ, বাঁচালি বাবা! এখন কেমন লাগছে? উঠিস নে, আমি যাচ্ছি।

মামাবাবুর কী হয়েছে? শুয়ে কেন? নিজের হাত-পাগুলো আস্তে আস্তে নাড়াই।

নাঃ, ভাঙে-টাঙেনি। তবে অনেক জায়গায় চোট খেয়েছে। কোনোরকমে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করি। পাশের লোকগুলো আমায় ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। হেঁটে সুনন্দের কাছে গিয়ে দেখি মামাবাবুর মাথায় জামা ছিঁড়ে কাপড়ের ফালির ব্যান্ডেজ বাঁধছে। মামাবাবুর চোখ বোজা, তবে নিশ্বাসের তালে বুক ওঠানামা করছে। কিছুটা স্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন মামাবাবু?

সুনন্দ জবাব দেয়, ভালো। মাথায় লেগেছে। রক্ত পড়ছিল, তবে সিরিয়াস কিছু নয়।

আর তুই?

পারফেক্টলি ফিট। শুধু বাঁ হাতের কব্জিটায় একটু লেগেছে। ভগবানকে ধন্যবাদ দে, বালিতে আছড়ে পড়ায় আমরা প্রাণে বেঁচে গেছি।

একটু পরে মামাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। খুব অবসন্ন দেখাচ্ছিল তাকে। চারিদিক তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে এটা কোনো দ্বীপ। রুফিজি নদীর মোহনার কাছে কয়েকটা ছোট ছোট জঙ্গুলে দ্বীপ আছে। ম্যাপে তাদের পয়েন্ট আউট করা হয় না। বোধহয় তাদেরই একটায় এসে পড়েছি!

সুনন্দ বলল, এখানে তো একমাত্র উপজাতি ছাড়া অন্য লোক দেখছি না! আর কোনো জাতি থাকে কিনা কে জানে!

না থাকাই সম্ভব। এই দ্বীপগুলো অস্বাস্থ্যকর বলে সাধারণত মানুষ বাস করে না।

হঠাৎ একটি লোক এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। দশাসই পুরুষ। পরনে একখানা লাল রঙ মাখানো পশুচর্ম। হাতে বিরাট লম্বা বর্শা। অঙ্গে নানারকম গয়নাগাটির বিশেষত্ব চোখে পড়ার মতো। বেশ ভারিক্কি চালে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে হড়বড়িয়ে একগাদা কী সব বলে গেল। কী জানি প্রশ্ন করল। ভাষাটা চেনা, সোয়াহিলি। কিন্তু অর্থ ঠিক ধরতে পারলাম না।

মামাবাবু একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন সোয়াহিলিতে।

সঙ্গে সঙ্গে আবার একপ্রস্থ প্রশ্নবাণ নিক্ষিপ্ত হয়।

তার দ্রুত কথা বলার জন্য এবং বিচিত্র অপরিচিত উচ্চারণভঙ্গির ফলে আমার বা সুনন্দের সামান্য সোয়াহিলি জ্ঞানে কুলোলাচ্ছিল না।

ইতিমধ্যে সমুদ্রতীরের তাবৎ মেয়ে-পুরুষ এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আগ্রহভরে সমস্ত কথা গিলছে। তাদের গুঁতো খেয়ে আমি ও সুনন্দ অনেকটা তফাতে হটে গেলাম। সেখান থেকেই ঘাড় উঁচু করে আমরা মামাবাবু ও সেই লোকটির কথাবার্তার সারমর্ম বুঝতে চেষ্টা করলাম। খাপছাড়াভাবে কয়েকটা কথা বুঝলেও আসল বক্তব্য কিছুই ধরতে পারছিলাম না।

মামাবাবু হাত-টাত নেড়ে বোঝাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আঙুল তুলে সমুদ্রের দিকে। দেখাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাদের উদ্দেশ করে বললেন, ঠিকই ধরেছি এটা দ্বীপ, উপকূলের কাছেই। এই উপজাতিরা দ্বীপের একমাত্র বাসিন্দা। ইনি হচ্ছেন সর্দার। জানতে চাইছেন আমরা কে? কেন এসেছি? কী করে এসেছি ইত্যাদি।

সুনন্দ বলে, এদের রকম-সকম কেমন বুঝছেন?

ভালোই। আপাতত আমাদের কোনো ক্ষতি করার লক্ষণ নেই। তবে বিদেশি অতিথি বিশেষ পছন্দ করে বলে মালুম হচ্ছে না।

আমি বললাম, জিজ্ঞেস করুন না এখান থেকে তীরে ফিরে যাবার কী উপায়?

হুঁ, করছি। তারপর আবার প্রশ্নোত্তর।

একটি লোক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

লোকটা বেজায় ঢ্যাঙা। রোগা, পাকানো দড়ির মতো হাত-পা। মুখে অজস্র বলিরেখা। দেখলে বোঝা যায় প্রচুর বয়স। তার সারা গায়ে-মুখে বিচিত্র নকশা কাটা। গলায় হাড়ের টুকরো গাঁথা মালা। কোমরে জড়ানো একখানা লাল-কালো রঙ করা চামড়া। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুকটা শিরশির করে উঠল। বাজপাখির মতো চাউনি, তীক্ষ্ণ কুর। সর্দারের ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সে মন দিয়ে সব শুনছিল, মাঝে মাঝে দু-একটা প্রশ্ন করছিল।

খানিক পরে মামাবাবু বললেন, বলছে দ্বীপের কাছ দিয়ে নাকি কোনো নৌকো জাহাজ-টাহাজ যায় না। তবে ওরা নিজেরা মাঝেমধ্যে সমুদ্র পেরিয়ে উপকুলে যায়। তখন আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক স্পষ্ট কথা দিচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে। উপহার-টুপহার দিয়ে একটু সন্তুষ্ট করলে রাজি হবে। যাক, এখন চল আমাদের মাঝিদের কী অবস্থা দেখি। নৌকোটার খোঁজ করি।

চারজন মাঝিকে দেখতে পেলাম কাছেই। সৌভাগ্যবশত তারা সবাই জীবিত। তবে দুজন বেশ আহত হয়েছে। একজনের লেগেছে কোমরে, সে শুয়ে ছটফট করছে। আর একজনের ডান হাতের কনুইয়ের হাড় ভেঙেছে বা মচকেছে। বেচারা হাত চেপে ধরে বসে যন্ত্রণায় অস্ফুট কাতরোক্তি করছে। অন্য দুজন মোটামুটি অক্ষত। তারা বালির ওপর বসে। দিশাহারা ভাব। কয়েকজন দ্বীপবাসী তাদের ক্রমাগত নানারকম প্রশ্ন করে চলেছে। মাঝিরা কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুধু জড়োসড়ো হয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে। আমরা কাছে যেতেই তারা মহা খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল।

মামাবাবু আহত দু-জনকে পরীক্ষা করলেন। আঘাতের গুরুত্ব আপাতত কিছু বোঝা গেল না। তিনি অন্য দু-জনকে আহতদের পাশে বসে থাকতে আদেশ দিয়ে আমাদের বললেন, চল, নৌকোটা দেখি। ঐ যে পড়ে আছে। আমাদের সঙ্গে ওষুধপত্র ব্যান্ডেজ ছিল। আহত লোকগুলোর জন্য দরকার।

নৌকোটা জলের কিনারে বালির ওপর ওল্টানো অবস্থায় পড়ে ছিল। ভাঙা, দুমড়ানো। নৌকোর দিকে যেতে যেতে সুনন্দ বলল, মামাবাবু, ঐ লোকটা কে? সর্দারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। বেজায় ঢ্যাঙা।

ওর নাম কামাউ। এই উপজাতির উইম্ ডক্টর।

বুঝেছি। আমাদের দেশে যাদের বলে ওঝা।

না, আমাদের দেশের ওঝা বা গুণিনদের থেকে এদের তফাত আছে। এদের ক্ষমতা আরও বেশি। উপজাতিদের মধ্যে এরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। এরা বহুবিদ্যাবিশারদ। একাধারে উপজাতি পল্লির হেকিম, পূজারি, সর্দারের পরামর্শদাতা, আরও অনেক কিছু।

লোকটাকে কিন্তু সুবিধের মনে হল না। সুনন্দ বলে।

হ্যাঁ। মামাবাবু চিন্তান্বিত স্বরে বললেন। যাহোক ভালোয় ভালোয় ফিরতে গেলে ওকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে।

টেনেটুনে নৌকোটা সোজা করলাম। আমাদের মালপত্র পাটাতনের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা ছিল, তাই খুলে পড়ে যায়নি। এক এক করে প্যাকেটগুলো খুলে দেখতে থাকি।

হালকা ঠুনকো সমস্ত জিনিস ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। তবে টিনের খাবার, জামা-কাপড়, তাঁবু, বইপত্র, ওষুধের বাক্স, স্টিলের বাসন ইত্যাদি অনেক কিছু মোটামুটি অক্ষত রয়েছে। সুনন্দ বলল, ভাগ্যিস ক্যামেরাটা আমার কাঁধে ছিল। তাই বালিতে পড়ে বেঁচে গেছে।

মামাবাবুর নজর বইয়ের দিকে। যাক বইগুলো রক্ষে পেয়েছে। অল্প ভিজেছে, কিন্তু ছেড়ে-টেড়েনি।

জিনিসগুলো বের করে পরীক্ষা করছি, এমন সময় এক কাণ্ড ঘটল। দ্বীপবাসীরা এতক্ষণ আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে চোখ গোল গোল করে বিদেশিদের সম্পত্তি দর্শন করছিল। হঠাৎ একজন একটা মোজা হাতে তুলে নিল। দেখাদেখি অন্যরাও টপাটপ যে যা পারে হাতাতে শুরু করল।

মহা মুশকিল। বারণ করতে ভরসা হচ্ছিল না, কিন্তু যে রেটে হাতছাড়া হচ্ছে তাতে আমাদের সম্পত্তির আর কিছু বাকি থাকলে হয়! একজন সুনন্দের সিগারেট লাইটারটা ছোঁ মারল। ব্যস, সুনন্দের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। লাইটারটা সুনন্দের এক জাপানি বন্ধু তাকে প্রেজেন্ট করেছিল।

তবে রে! সে খপ করে লোকটার হাত থেকে লাইটার কেড়ে নিয়ে খচ্‌ করে তার মুখের সামনে আগুন জ্বালল। বলা নেই কওয়া নেই, নাকের কাছে অগ্নিশিখা লাফিয়ে উঠতে দেখে সে তত বাপরে বলে মারল পিছনে এক লম্ফ। অন্যদেরও আক্কেলগুড়ুম। ঘাবড়ে গিয়ে হুড়মুড় করে কয়েক পা হটে গেল। কয়েকজন নারী ও শিশু দিল দৌড়। জাদু, বিদেশি জাদু–মুজিমা ইয়া মাগেনি বলতে বলতে লোকগুলো মহা সোরগোল করে যে যা নিয়েছিল সব ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগল। সুযোগ পেয়ে মামাবাবু বোঝালেন, সাবধান, হাত দিও না, সব মন্ত্র দেওয়া আছে। ভীষণ বিপদে পড়বে।

এই ঘটনাটায় আমাদের মহা উপকার হয়েছিল। দ্বীপবাসীদের ধারণা হয়ে গেল বিদেশিদের জিনিস মন্ত্রপূত বিপজ্জনক। কখন কোনটা থেকে অগ্নিদেব ফোঁস করে উঠবেন কে জানে! ভবিষ্যতে নিজে থেকে না দিলে আমাদের জিনিসে এরা কক্ষনো হাত দেয়নি। সেধে দিতে গেলেও কি আর সহজে নেয়! অনেক করে বোঝাতে হয়েছিল, মন্ত্র-ট সরিয়ে নিয়েছি। নির্ভয়ে গ্রহণ কর বৎস।

একখানা প্লাস্টিকের থালায় দুটো রুমাল, কয়েকটা চকচকে বোতাম, একটা লাল টাই, ইত্যাদি সাজিয়ে নিয়ে আমরা সর্দারের সামনে নিবেদন করলাম–উপঢৌকন।

সর্দার হাত বাড়িয়েই টেনে নিল। আমাদের মুখপানে একটু সন্ত্রস্তভাবে তাকাল। মামাবাবু অভয় দিলেন, ভয় নেই।

সর্দার আড়ম্বর সহকারে প্রণামী গ্রহণ করলেন। মুখ দেখে মনে হল খুশি হয়েছে।

এরপর কিছু উপহার দেওয়া হল কামাউকে। উপহার সে বিনা বাক্যব্যয়ে টেকস্থ করল, কিন্তু মুখে কোনো সন্তোষ প্রকাশ করল না।

যতটা সম্ভব জিনিস বেঁধে-ঘেঁদে কাঁধে তুলে আমরা দ্বীপের মধ্যে উপজাতিদের গ্রামে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। রীতিমতো শোভাযাত্রা করে আমরা বনপথ দিয়ে এগোলাম।

আহত দু-জনকে আমরা ডাল দিয়ে তৈরি স্ট্রেচারে বয়ে নিয়ে চললাম। মামাবাবু তাদের যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ দিয়েছিলেন। যাতে নড়াচড়ায় বেশি কষ্ট না হয়।

প্রায় আধ মাইল চলে আমরা একটা খোলা জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম। মস্ত গোল প্রাঙ্গণ। গাছ কেটে আগাছা সাফ করে পরিষ্কার সমতল করা হয়েছে। চারধারে বাঁশঝাড়ের বেড়া। চত্বরের সীমানা ঘেঁষে ছোট-বড় দশ-বারোটি কুটির। কুটিরের দেয়াল বাঁশের ওপর কাদা লেপে তৈরি। চালে ঘাস-পাতা চাটাইয়ের ছাউনি। এই হচ্ছে আদিবাসীদের গ্রাম।

আমরা ঘাড় থেকে জিনিস নামিয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। তিনটে নারকেল দু-আধখানা করে ভেঙে আমাদের দেওয়া হল খেতে। চমৎকার টাটকা শাঁস। খিদের মুখে স্বাদ লাগল। যেন অমৃত।

আমাদের পৌঁছে দিয়ে পুরুষরা আবার বেরিয়ে গেল তাদের দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহের ধান্দায়।

একটা ডেরা বাঁধতে হয়। আপাতত যে-কটা দিন এখানে থাকতে হবে, মাথা গোঁজার। আশ্রয় চাই। ওদের কুটিরে ওদের সঙ্গে তো আর থাকা চলে না! সুতরাং তাঁবু খাটালাম।

তবু পাতলাম চত্বরের ভিতরে নয়, গ্রাম থেকে একটু দূরে। সমুদ্রতীরের কাছে। এধারে গাছপালা তেমন ঘন নয়, কিন্তু পরে দেখেছি দ্বীপের অন্য পাশে বেশ ঘন।

আমাদের তাঁবুটা বেশ বড়। মাঝখানে একখানা ক্যানভাস ঝুলিয়ে দিতেই দুটো কামরা হয়ে গেল। একটায় থাকবেন মামাবাবু, অন্যটায় আমি ও সুনন্দ। বাকি সমস্ত দিনটা কেটে গেল ক্যাম্প খাটাতে।

মাঝিদের তাঁবুটি পড়ল আমাদের থেকে কিছু দূরে। মামাবাবু আহতদের যথাসম্ভব সেবাশুশ্রূষা করলেন। ওষুধ দিলেন। শক্ত করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। বললেন, আশা করছি কয়েকদিন রেস্ট নিলেই ভালো হয়ে উঠবে।

দ্বীপের বালখিল্যের দল এবং অল্পবয়সী কিছু ছেলে-মেয়ে কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও আমাদের সঙ্গ ছাড়ে নি। আমাদের রকম-সকম, তাঁবু খাটানো, জিনিস গোছানো, সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহে দেখছে এবং অনর্গল বকর বকর করে নিজেদের মধ্যে আমাদের সমালোচনা করছে। তবে সর্বদাই তারা বেশ খানিকটা নিরাপদ ব্যবধান বজায় রেখেছিল–বিদেশি জাদুর ভয়ে।

সূর্য ডোবার আগে দ্বীপের সবাই ঘরে ফিরল। তাদের আহ্বানে আমরা গ্রামে গেলাম। মাঝিরা যেতে চাইল না। প্রথমত দ্বীপবাসীদের সঙ্গে মেশার কোনো আগ্রহ তাদের নেই। দ্বিতীয়ত আহত সঙ্গী দুজন রয়েছে।

দেখলাম চত্বরের মাঝখানে এক অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। সবাই জড়ো হয়েছে চারপাশে। সর্দার এবং কামাউ বসেছে দুটো উঁচু পাথরের আসনে। আগুনের আঁচে ঝলসানো হচ্ছে মাংস, মাছ। একটু পরেই বড় বড় ঢাকে পড়ল কাঠির ঘা। ধ্বনিত হয়ে উঠল আকাশ-বাতাস। তৎক্ষণাৎ একদল উঠে শুরু করল নাচ। একদল ধরল গান। ক্রমে বাজনার লয় বাড়ে, নাচের তাল দ্রুততর হয়। আগুনের লালচে আভায় সঞ্চরমান সুগঠিত কৃষ্ণবর্ণ মূর্তিগুলি কেমন অপার্থিব বোধ হচ্ছিল। সে-ধ্বনি সুন্দর, সে-দৃশ্য কেমন ঘোর লাগায়। আমরাও মাথা নেড়ে তাল ঠুকি।

ছেলে ও মেয়ের দল পালা করে নাচল। কখনো যৌথ নৃত্য। নানারকম নাচ। জন্তু জানোয়ারের অঙ্গভঙ্গি নকল করে নাচ। উদ্দাম সমর-নৃত্য, কত কী!

দিব্যি আছে এরা। ভবিষ্যতের ভাবনা নেই। অতীতের জন্য আক্ষেপ নেই। শুধু বর্তমান। প্রত্যক্ষ জীবনধারণের তাগিদে কঠোর সংগ্রাম আর অনাবিল আনন্দ।

ঘণ্টা দুয়েক পর নাচ-গান থামল। আরম্ভ হল যথেচ্ছ পানভোজন। আমরাও এক-এক টুকরো মাংস এবং এক পাত্র মাংসের কাথ মেশানো ভুট্টার সুরুয়া পেলাম। স্যুপটা মন্দ নয়, কিন্তু আধপোড়া মাংস মুখে রুচল না। খাবার ভান করে লুকিয়ে ফেললাম।

পেটপুরে ভোজন করে সবাই টইটুম্বুর। কেউ কেউ আগুনের ধারেই সটান শুয়ে পড়ে নাসিকা গর্জন শুরু করল। কেউ কেউ উঠে গেল কুটিরে। আমরাও সুযোগ বুঝে নিঃশব্দে উঠে পড়ি।

.

০৫.

দ্বীপটাতে শুছিয়ে বসলাম।

মেয়াদ অবশ্য বেশিদিন নয়, মাত্র দশদিন। সর্দার বলেছে আমরা যেদিন দ্বীপে এসেছি তারপর ঠিক এগারো দিনের দিন ময়োজিমাকুবা অর্থাৎ পূর্ণিমা। আকাশে সেদিন মস্ত গোল চাঁদ উঠবে। পূর্ণিমার আগের দিন তাদের নৌকো যাবে ওপারে। আমাদেরও তখন সঙ্গে নিয়ে যাবে।

সূচনায় বেঘোরে প্রাণ যাবার উপক্রম হলেও পরের ব্যাপারটা মন্দ দাঁড়াচ্ছে না। বরাতে শিকে ছিঁড়ে খাসা একটা অ্যাডভেঞ্চার জুটে গেছে। দশটা দিন তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। অতএব প্রাণভরে এই হঠাৎ-পাওয়া রোমাঞ্চের স্বাদ উপভোগ করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমাদের থাকার ব্যবস্থাটি ভালোই হয়েছে। আর খাওয়ার ভাবনা মামাবাবু সুনন্দের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন, কারণ রান্নার ব্যাপারে সুন্দর দারুণ উৎসাহ।

ঠিক করা হল প্রথমে দ্বীপটা সার্ভে করা যাক।

সকালে একবার সপারিষদ সর্দার এসেছিল খোঁজ নিতে। আসা মাত্র সুনন্দ তাকে একটা পেন-নাইফ প্রেজেন্ট করল। ছুরিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সর্দার মহাখুশি। এখন তাদের ব্যবহার বেশ সহজ, বন্ধুত্বপূর্ণও বলা যায়। শুধু ঐ কামাউ হল ব্যতিক্রম। সেও এসেছিল, কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। মামাবাবু এগিয়ে তাকে নমস্কার জানালেন–জাম্বো বানা। কিন্তু তার সন্দিগ্ধ আচরণ কিছু সরল হল বলে মনে হল না। যাক বাবা মিশতে না চায় ক্ষতি নেই, কোনো বাগড়া না করলেই বাঁচোয়া।

সর্দার সুনন্দকে অনুরোধ করল, মাহিন্ডি, তোমার জাদুটা একবার দেখাও তো। সেই যে। হঠাৎ অগ্নির আবির্ভাব, ছোট্ট একখানা নীল বাক্স থেকে।

সনন্দ গেরামভারি চালে পকেট থেকে লাইটার বের করল। দেখেই জনতা সাত হাত তফাতে সরে গেল।

সুনন্দ বার কয়েক হিংটিং-ছট মন্ত্র আউড়াল, শূন্যে বহু আন্দোলিত করল, তারপর খ করে লাইটার টিপল।

মোটো, মোটো–আগুন, আগুন,ভীত বিস্মিত দর্শকদের মধ্যে থেকে কোলাহল ওঠে। বিদেশি ভারতীয়দের জাদুর মাহাত্ম নিয়ে জোর একচোট আলোচনা হয়।

এই ফাঁকে সুনন্দ আমাদের দেশে ফেরার কথাটা তোলে।

সর্দার বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ যাবে বইকি! তবে ক-দিন অপেক্ষা কর। আমরা যখন-তখন সমুদ্রযাত্রা করি না। ওপারের দেশ ভালো নয়। ওখানে আমাদের অনেক শত্রু। শিকো কুমি অর্থাৎ দশ দিন অপেক্ষা কর।

তাদের ভালোমতো লোভ দেখালে বা জেদাজেদি করলে হয়তো আগেই আমাদের পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা হতে পারত, কিন্তু এ নিয়ে আমরা বেশি চাপাচাপি করলাম না। ক-টা দিন এই অজানা দ্বীপে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার আকর্ষণ কম নয়।

সর্দার দলবল নিয়ে চলে গেলে আমরাও বেরলাম। স্থির হল সমুদ্রের ধারে ধারে গোটা। দ্বীপটা চক্কর দিয়ে আসব। একজন দ্বীপবাসীকে সঙ্গে নিলাম পথ দেখাতে।

যেতে যেতে লোকটির মুখে শুনলাম এ-দ্বীপে বড় হিংস্র জন্তু নেই। বন্য বড় জন্তু বলতে আছে কেবল শুয়োর। তবে সংখ্যায় বেশি নয়। প্রায়ই তাদের শিকার করা হয় কিনা! আমাদের সঙ্গে বন্দুক-টন্দুক ছিল না, কাজেই সংবাদটা শুনে আশ্বস্ত হলাম।

লোকটি বলল, অবশ্য ছোট জানোয়ার বা সাপখোপের অভাব নেই। খটাসগুলো আকারে ছোট, কিন্তু শয়তানিতে বড় জন্তুকে হার মানায়। প্রায়ই তাদের পোষা ছাগলছানা মারে।

খটাস বা ছোট জন্তু নিয়ে আমরা মাথা ঘামালাম না। তবে কিছুদূর গিয়েই এক দৃশ্য দেখে আমাদের টনক নড়ল। বুঝলাম দুশ্চিন্তার কিছু কারণ আছে বটে।

দেখি একটি লোক বল্লমের ডগায় একটা প্রকাণ্ড মরা সাপ বিধিয়ে ঝুলিয়ে আনছে। লম্বায় সাপটা অন্তত সাত ফুট হবে। মামাবাবু দেখে বললেন, গ্রিন মাম্বা। অতি বিষাক্ত। গোখরো-কেউটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

দ্বীপের যেদিকে আমাদের তাঁবু পড়েছে, তার উল্টো দিকে গাছপালা ঘন। একটা অগভীর জলাশয় রয়েছে। চারপাশ ঘিরে নিবিড় জঙ্গল। জলাশয়ের ধারে ম্যানগ্রোভ গাছের দুর্ভেদ্য বেষ্টনী। একটু শুকনো জায়গায় বাঁশ-ঝাড় ও খাটো আকারের প্রচুর ডালপালাওলা কাঁটাঝোঁপ। ম্যানগ্রোভ বনে অসংখ্য কাঁকড়া। সন্ন্যাসী কাঁকড়া ও বীণাবাদক কঁকড়াই বেশি। পুরুষ বীণাবাদক কাকড়াগুলো ভারি মজার দেখতে। একটা দাঁড়া ছোট্ট, অন্যটা বিরাট। বড় দাঁড়াটা মুখের সামনে বাগিয়ে ধরে রাখে, যেন বীণা, আর ছোট হাতটা দিয়ে যেন বাজাচ্ছে।

মামাবাবু সন্ধানী দৃষ্টিতে চারদিকে চাইছিলেন। বললেন, এখানকার কীট-পতঙ্গ লক্ষ করো। কতকগুলো দেখছি একেবারে নতুন, অচেনা। ভালো করে সাজসরঞ্জাম নিয়ে পরে আসতে হবে। বনে ঢুকব। স্পেসিমেন নিয়ে যাব।

কয়েকটা কীট-পতঙ্গ তিনি আমাদের দেখালেনও। খটমট ল্যাটিন নাম বললেন তাদের। একবার মামাবাবু হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, একী! আঙুল দিয়ে দেখালেন, গাছের গুঁড়িতে বসা একটা গোবদা গঙ্গাফড়িং।

ভালো করে দেখ। মাথায় দুটো শিং রয়েছে। এ-জাতের ফড়িং তো কেবল মাদাগাস্কারে পাওয়া যায় জানতাম! এখানে এল কী করে!

ধরার চেষ্টা করতেই ফড়িংটা ফড়ফড় করে উড়ে পালাল।

সমুদ্রের কিনার ঘেঁষে চলেছি। দেখলাম, আমাদের নৌকো দ্বীপের যে-পাশে আছড়ে পড়েছিল সে-ধারের সৈকতভূমিই সবচেয়ে চওড়া। অন্য সব ধারে সমুদ্রতীর অপরিসর, খানাখন্দে ভরা পাথুরে। আমাদের নৌকো তীরের এসব অংশে আঘাত করলে আর প্রাণে বাঁচতে হত না।

লক্ষ করলাম দ্বীপের চারপাশে তীরের কাছাকাছি অনেক শিলাখণ্ড ও প্রবাল প্রাচীর জলের মধ্যে থেকে মাথা তুলে রয়েছে। ঢেউ এসে সবেগে আছড়ে পড়ছে তাদের ওপর। চোখে দেখা যায় না এমনি ডুবো পাহাড় না জানি আরও কত লুকিয়ে আছে সমুদ্রগর্ভে। বোধহয় এইসব বিপজ্জনক শিলাস্তূপ ও প্রবাল প্রাচীরের ভয়েই দ্বীপের কাছ দিয়ে জাহাজ বা নৌকো চলে না। আমরা সর্বক্ষণ সমুদ্রের পানে নজর রেখেছিলাম। কিন্তু বৃথা আশা, কোনো নৌকো-চৌকো চোখে পড়ল না।

একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম।

এক প্রাচীন ভগ্নস্তূপ। কেল্লা জাতীয় বাড়ি ছিল মনে হল। বড় নয়, ছোট আকারের বাড়ি তৈরি হয়েছিল আগাগোড়া পাথরে। ইটের চিহ্নমাত্র নেই। অজস্র পাথরের টুকরো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ছাদ ভেঙে পড়েছে, তবে দেয়ালগুলো এখনও খাড়া। বৃক্ষ, লতাগুল্মে ঢেকে ফেলেছে ভগ্নাবশেষ।

এখানে বাড়ি কে তৈরি করল? দ্বীপে সভ্য মানুষের বসতি ছিল বলে তো মনে হয়নি। তাহলে আরও বাড়িঘরের চিহ্ন চোখে পড়ত। মাত্র একটি কেন?

মামাবাবু বললেন, জলদস্যুদের আড্ডা হতে পারে। নির্জন দ্বীপে আরব বা পর্তুগিজ জলদস্যুদের গোপন ঘাঁটি ছিল।

সুনন্দ আমার কানে কানে বলল, পরে খুঁজে দেখব, যদি গুপ্তধন পাওয়া যায়।

কাজ নেই আমার গুপ্তধনে। ঐ সাপের আড্ডায় আমি ঢুকছি না।

যেতে যেতে মামাবাবু আদিবাসীটির সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করছিলেন। এই দ্বীপ ও এখানকার অধিবাসীদের খবরাখবর নিচ্ছিলেন। দ্বীপের গাছপালা পশুপাখি সম্বন্ধে তথ্য জোগাতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু নিজেদের সম্পর্কে বেশি কথা বলতে সে নারাজ।

আশ্চর্য হয়ে দেখছিলাম, কত পাখি। জলের ধারে উড়ছে নানান সামুদ্রিক পাখি। গাছে গাছে রঙ-বেরঙা পাখির কাকলি। বাঃ-চেনা শিস, তাকিয়ে দেখি গাছের ডালে ঝুটি মাথায় বুলবুলি। ভারি আপনজন মনে হল পাখিটাকে।

একজাতের ক্ষুদে বাঁদর আমাদের দেখে মহা হল্লা জুড়ে দিল। বোধকরি শার্ট-প্যান্ট পরা মানুষ এই প্রথম দেখছে।

পুরো দ্বীপটা একপাক ঘুরে আসতে আমাদের ঘণ্টা চারেকের বেশি লাগল না।

ছোট্ট ভূখণ্ড। কোনো রকমে জলের ওপর মাথা জাগিয়ে রেখেছে। মনে হয়, যে কোনো সময় সমুদ্র তাকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। এইটুকু সামান্য জমি এবং এখানের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্যই বোধ হয় এখন পর্যন্ত সভ্য মানুষ এ-দ্বীপে বসতি স্থাপনে উদ্যোগী। হয়নি।

মামাবাবু বললেন, একটা উঁচু গাছের মাথায় চড়ে দেখ তো চারদিক।

আমি ছোটবেলায় গাছে চড়তে ওস্তাদ ছিলাম, কাজেই আমিই উঠলাম।

পরিষ্কার ঝকঝকে দিন। যেদিকে তাকাই চারপাশে চঞ্চল সমুদ্র। নীলচে-সবুজ ঢেউগুলি ফেনার মুকুট পরে নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে। পশ্চিমদিকে দেখলাম বহু দরে একটা কালো রেখা। অস্পষ্ট। নিশ্চয় আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব উপকূল। কত দুর হবে? সাত-আট মাইল। যাক, খুব বেশি দূরে এসে পড়িনি। নেমে এসে রিপোর্ট করলাম।

আমাদের ডেরার কাছাকাছি আসতে দেখি তাঁবুর সামনে ভিড়। দ্বীপবাসীরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। সর্দারও রয়েছে। মাঝখানে আমাদের নৌকোর দুজন মাঝি, যে দুজন দুর্ঘটনায় অক্ষত আছে। কী ব্যাপার? তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। দ্বীপের লোকেরা উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে। মনে হচ্ছে কোনো কারণে খুব চটেছে।

এর মধ্যে আবার কী ফ্যাসাদ বাধল রে বাবা।

মামাবাবু আমাদের অপেক্ষা করতে বলে ভিড়ের মাঝে ঢুকে গেলেন।

অনেকক্ষণ তিনি সর্দার ও অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বললেন। মাঝিদের কী সব জিজ্ঞাসা করছেন দেখলাম। মনে হল ধমকাচ্ছেন। তারপর ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে সর্দার ও তার লোকজনরা মাঝি দুটিকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিল।

মামাবাবু বললেন, আর বল কেন, লোক দুটো এক নম্বর বুন্ধু। এক কাণ্ড বাধিয়েছে। ওদের বিশ্বাস হয়নি যে সত্যি এরা কদিন পরে আমাদের দেশে ফেরত পাঠাবে। তাই সকালবেলা নিজেরাই একটা নৌকো চুরি করে পালাবার তাল করছিল। কিন্তু তীর থেকে জলে নৌকো নামাবার আগেই দ্বীপের লোকেরা দেখে ফেলে। ব্যস, ছুটে গিয়ে ধরে-বেঁধে আনে। আমাদের কাছে এসেছিল এই চক্রান্তে আমাদেরও কোনো হাত আছে কিনা জানতে। ওদের কাছে নৌকো অত্যন্ত মূল্যবান সম্পত্তি, তাই নৌকো চুরির চেষ্টা করায় দারুণ চটেছে। তারপর আবার মাঝিরা আরব। আরবদের এরা মোটেই সুনজরে দেখে না। উপজাতিদের ওপর তো কম অত্যাচার করেনি আরবরা! যাহোক, ভাগ্যিস ঠিক সময় এসে পড়েছি, নইলে একটা খুন-খারাপি হয়ে যেত। অনেক বলে-কয়ে ওদের শারীরিক অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। কিন্তু ছাড়বে না, বন্দী করে রাখবে! বিশ্বাসভঙ্গ এদের কাছে মারাত্মক অপরাধ।

কিন্তু আমাদের সঙ্গে শেষে ফিরে যেতে দেবে তো? আমি জিজ্ঞেস করি।

দেবে। মানে যাতে দেয়, সে-চেষ্টা নিশ্চয় করতে হবে। রাগ কমুক। তারপর বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাব।

অন্য দুজন মাঝি কাণ্ড দেখে ভীষণ ঘাবড়েছিল। তারা আমাদের কিছুতেই ছাড়বে না। সঙ্গী দুজনের দুরভিসন্ধির কথা তারা বিন্দুবিসর্গ জানত না। অসহায় বন্ধুদের ফেলে কেটে পড়ছিল শুনে গালিগালাজ করে বেইমানদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে লাগল।

আমরা অনেক বুঝিয়ে তাদের অভয় দিলাম। খবরদার! লুকিয়ে পালাবার চেষ্টা কোরো না। দেখলে তো কী সাংঘাতিক ফল হতে পারে! আমরা যদি ফিরি তোমাদের ফেলে রেখে যাব না।

যার কোমরে ব্যথা, সে-বেচারা হাঁটাচলা করতে পারে না। শুয়ে থাকে। অন্যজনের অবস্থা মোটামুটি ভালো। তার ব্যান্ডেজ বাঁধা ডান হাতটা গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো। তার ওপরেই কোমর ভাঙা লোকটির দেখাশোনার ভার দিলাম।

মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। মেনুটিনের মাংস ও নারকেল। খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে মামাবাবু বুট, টুপি, চামড়ার জারকিন ইত্যাদি ধড়াচূড়া এঁটে ব্যাগে স্পেসিমেন সংগ্রহের নানারকম সরঞ্জাম নিয়ে জঙ্গল ছুঁড়তে বেরোলেন। আমি ও সুনন্দ গেলাম সমুদ্রতীরে মাছধরা দেখতে।

তিনটি ছোট ছোট ডিঙিনৌকো চেপে সাত-আটজন লোক সমুদ্রে মাছ ধরছিল। তাদের কারও হাতে ছোট দড়ির জাল, কারও হাতে বল্লম, মাছ ভাসলেই গেঁথে ফেলবে। বল্লমের পিছনে দড়ি বাঁধা। শিকারকে বিদ্ধ করবার পর টেনে আনা যাবে। অদ্ভুত ব্যালান্স এদের। সরু নৌকোর ওপর বসছে, দাঁড়াচ্ছে। ঢেউয়ের মাথায় টলমল নৌকোগুলো অপূর্ব দক্ষতায় চালনা করছে। জলের জায়গায় জায়গায় শিলাস্তূপ। নৌকো তাদের গায়ে ধাক্কা খেলে। চুরমার হয়ে যাবে। এরা অনায়াসে সেসব বাধা এড়িয়ে নৌকো নিয়ে ঘুরছিল।

সুনন্দের শখ হল নৌকো চাপবে। পারে কয়েকজন দাঁড়িয়েছিল, তাদের ভাঙা ভাঙা সোয়াহিলিতে অনুরোধ করল। কিন্তু তারা তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল, আপানা অর্থাৎ না না।

আমি ক্ষেপালাম, যদি অতিথি দেবতা জলে ডুবে অক্কা পায়। গেরস্তের অকল্যাণ হবে। তাই রাজি হচ্ছে না।

সুনন্দ রেগে বলে, যা যাঃ। আমি পূর্ব বাংলার ছেলে। পদ্মায় অমন ঢের ঢের নৌকা বাইসি। জলে ডোবা অত সস্তা নয়।

কিন্তু এটা নদী নয়, সমুদ্দুর।

জানি। তবে পদ্মার ঢেউও খুব সোজা নয়। তাছাড়া আমি তো আর একা চাপতে চাইছি না। ওদের সঙ্গে থেকে একটু প্র্যাকটিস করতাম।

অজস্র ছোট-বড় নানা রঙের কাঁকড়া। বালির ভিতর গর্ত থেকে উঠে দৌড়াদৌড়ি বা পদচারণা করতে করতে আবার টুক করে গর্তে সেঁধুচ্ছিল। সুনন্দ বলল, আয়, ধরি।

প্রাণপণ চেষ্টায় গলদঘর্ম হয়ে আট-দশটা কাঁকড়া ধরলাম।

দ্বীপের লোকেরা আমাদের লক্ষ করছিল। একজন এগিয়ে এসে আমাদের একটা কাঁকড়া উপহার দিল।

প্রকাণ্ড সামুদ্রিক কাকড়া। খোলাটা যেন একখানা ছোট কড়াই। দাঁড়াগুলো তেমনি লম্বা ও মোটা, সাঁড়াশির মতো। নিশ্চয় শাঁসে ভরা।

সুনন্দ আহ্লাদে আটখানা হয়ে উপহারদাতাকে বারবার হ্যান্ডসেক করে পিঠ চাপড়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।

প্রতিদানে কী দেওয়া যায়?

সে পকেট হাতড়ে বের করল একটা রঙচড়ে রাংতা। চকোলেটের। দুঃখের বিষয় চকোলেটটি সে খেয়ে ফেলেছে। আর কিছু নেই। রাংতাই দেব? তাই সই।

লাইটারের ম্যাজিক দেখাবার পর থেকে এরা সুনন্দকে রীতিমতো সমীহ করে। তাই মাহিন্ডি জাদুকরের কাছে এমন খাতির পেয়ে এবং এমন চমৎকার চকচকে একখানা উপহার লাভ করে লোকটি তত বেজায় খুশি হয়ে গেল।

ফেরার সময় সুনন্দ বলল, ইস, কী যে আপশোস লাগছে! সঙ্গে মশলাপাতি নেই, এমন পেল্লাই কঁকড়াটা জুত করে রান্না করা যাবে না। চল সিদ্ধ করি, নুন-গোলমরিচ দিয়ে শাসটা খাই। নেহাৎ মন্দ লাগবে না।

.

০৬.

রাত্রে দ্বীপের নিয়মিত ক্যাম্প-ফায়ারে যোগ দিলাম।

আমাদের প্রথম দিনের আড়ষ্টতা কেটে গেছে। এখন অনেক সহজ।

দুদিন সান্ধ্য বৈঠকেই একটা বিচিত্র ব্যাপার আমাদের নজরে পড়েছিল।

প্রথম দিন তিনটি এবং দ্বিতীয় দিন একটি লোক আগুনের পাশে গুটিসুটি মেরে কুঁকড়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে কেঁকাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম পেটব্যথা। কিন্তু পরে তাদের গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি গা খুব গরম। বেশ জ্বর।

অসুস্থ লোকগুলির চিকিৎসার ব্যবস্থাও দেখলাম।

মাহঙ্গা অর্থাৎ ওঝা কামাউ দ্বীপের বদ্যি। তার নির্দেশে অন্যরা লোকগুলিকে ধরে ধরে নিয়ে একটি ছোট কুটিরের মধ্যে ঢোকাল।

কৌতূহলী হলেও প্রথমে কী ডাক্তারি হচ্ছে দেখার সুযোগ পাইনি। দ্বিতীয় দিনে উঁকি মেরে লক্ষ করলাম।

দেখি কুটিরের মধ্যে এক চুলি জ্বলছে! রুগীরা আগুনের পাশে শুয়ে পড়ল। তাদের গায়ের ওপর কয়েকটা জানোয়ারের ছাল চাপিয়ে দেওয়া হল। তারপর কামাউ এসে দু-চারটে মন্ত্র আউড়ে খানিকটা তরল পদার্থ প্রত্যেক রুগীকে খাইয়ে দিল। অতঃপর তাদের সেখানে রেখে অন্যরা ফিরে এল।

এই দেশি টোটকায় খুব উপকার হয় বলে বিশ্বাস হয়নি। কারণ, দেখছি লোকগুলি সে-রাতে আর উঠতে-বসতে পারেনি। জুরে অচেতন হয়ে রয়েছে।

তবে রোগ মারাত্মক নয়। কারণ পরে দেখেছি তাদের, আবার চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। দুর্বল দেহ, চোখে-মুখে শ্রান্ত অবসন্ন ভাব। বোধহয় জ্বর নেই বা কমে গেছে। কে জানে কী ব্যারাম!

আগেই বলেছি এখানে আমাদের কিছু অনুরাগী জুটেছিল। একদল বালক-বালিকা। তারা সর্বত্র ছায়ার মতো আমাদের অনুসরণ করেছে। লক্ষ্য করেছে আমাদের হাবভাব। পুরো দেড়দিন আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি।

ক্রমে তাদের বিদেশিদের প্রতি উৎসাহ কমে গেল–শুধু একজন ছাড়া।

ছেলেটিকে আমরাও নজর করেছিলাম, বয়স সতেরো-আঠারো। যেন কষ্টিপাথরে কোঁদা শরীর। চোখাচোখি হলেই দু সারি মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হাসত। আমাদের সম্বন্ধে তার কৌতূহল অদম্য।

তৃতীয় দিন ভোরে দেখি–ইতিমধ্যে ছেলেটি এসে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সুনন্দ বলল, ছোঁড়া পেটুক। দেখেছিস যখনই আমরা খেতে বসি, এসে আমাদের খাওয়া দেখে। জিভ চাটে।

দুগ্ধহীন কফি ও বিস্কুট সহযোগে প্রাতরাশ সারছি, ছেলেটি যথারীতি কাছে এগিয়ে এল।

সুনন্দ একটা বিস্কুট বাড়িয়ে সোয়াহিলিতে ডাকল, ভিতরে এস, ভয় নেই। খাবে?–টাকা কুলা?

সে তৎক্ষণাৎ খানিক দূরে সরে গিয়ে মাথা নাড়াতে লাগল। জাদুমন্তর জানা বিদেশিদের বড় ভয়।

আমি ও সুনন্দ খুব ডাকাডাকি করতে থাকি, অভয় দিই। বারবার দেখিয়ে দেখিয়ে বিস্কট খাই এবং হাত বাড়িয়ে অফার করি, খাও খাও, লজ্জা কী?

এই টোপেই কাজ হল। গুটিশুটি এগিয়ে এসে ছেলেটা টপ করে সুন্দর হাত থেকে বিস্কুট নিয়ে ফের দূরে সরে গেল।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিনিসটা পরীক্ষা করল। শুকল। তারপর ভয়ে ভয়ে এক টুকরো কামড়াল।

খানিকক্ষণ সে চোখ বন্ধ করে মুখ কুঁচকে বস্তুটির আস্বাদ নিল। তারপরই ফিক করে হাসি! বাঃ, খানা, গ্র্যান্ড! মুজুরি সানা।

সঙ্গে সঙ্গে বাকিটুকু মুখে পুরে কামড়িয়ে চিবিয়ে আবার হাত পাতল, ইঙ্গিনে মোজা। অর্থাৎ আর একটা।

তার নামটি জেনে নিই। বলল, জেনা ইয়াঙ্গু টোটো। অর্থাৎ আমার নাম টোটো।

টোটো ফের হাজির। ঘড়ি ধরে ঠিক বারোটায় বোধহয় সারা সকালটা সে তার ছায়ার ওপর দৃষ্টি রেখে এই মাহেন্দ্রক্ষণটির প্রতীক্ষা করছিল। এখন তার লজ্জা-ভয় কমে গেছে। একবার ডাকতেই তাঁবুর মধ্যে ঢুকে এককোণে উবু হয়ে বসল।

আমাদের সঙ্গে চাল ছিল। ফেন-ভাত বেঁধেছিলাম, সঙ্গে মাখন ও টিনের মাংস।

প্লেটে অল্প মাংস দিয়ে টোটোর সামনে রাখলাম। কচ্ছপের মাংস, সামান্য মশলা দেওয়া। একবার গরম করে নিলেই খাসা খেতে। সুনন্দ বলল, দেখ হে টেস্ট করে। তোমাদের তো যত ঝলসানো আর আধপোড়ার কারবার, এ-বস্তুর মর্ম বুঝলে হয়!

টোটো দেখল, শুকল, চাটল, তারপর সন্তর্পণে একটু মুখে পুরল। আধ মিনিট তার চক্ষুমোদা, সমস্ত ইন্দ্রিয় স্বাদগ্রহণে তন্ময়। চোয়াল অল্প অল্প নড়ছে। হঠাৎ চোখ খুলল! মুহূর্তে বাকি মাংস নিঃশেষ এবং প্লেটসহ হস্ত প্রসারিত, মুফা–আরও দাও।

আধ টিন মাংস শেষ করার পর আমরা বাধ্য হয়ে তাকে আর পরিবেশন করতে নারাজ হলাম।

ব্যস, এরপর থেকে সে আমাদের নিয়মিত অতিথি বনে গেল। যেখানেই থাকুক খাবার সময় তার হাসিমুখটি ঠিক তাঁবুর দরজায় উঁকি মারবে।

টোটোর সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়ে গেল। দ্বীপের সোয়াহিলি বুঝতে আর এখন আমাদের তেমন কষ্ট হয় না। মামাবাবু একদিন ঠাট্টা করে বললেন, কেন মাথা খাচ্ছ। ছেলেটার? তোমরা তো দুদিন পরে চলে যাবে, তখন? দেশি রান্না কি আর ওর মুখে রুচবে?

সুনন্দ বলল, সে আমি ভেবে রেখেছি। অনেকগুলো মাছ-মাংসের সোজা সোজা রান্না আমি টোটোকে শিখিয়ে দেব। তারপর যেদিন উপকূলে ফিরব, ওকে সঙ্গে নেব। ওখান থেকে প্রচুর টিনফুড আর দরকারি মশলাপাতি কিনে দেব। মাটির হাঁড়ি-কুড়ি ওরা বানাতে পারে! মাছ-মাংসের অভাব নেই। যখন ইচ্ছে খুশিমতো মুখ বদলাবে।

টোটোকে আমি জিজ্ঞেস করেছি, এ-দ্বীপে তোমরা কতদিন এসেছ?

অ-নে-ক-দিন। আমার জন্ম তো এখানে।

আগে কোথায় থাকতে?

আগে ছিলাম এ-মহাসাগর, বাহারিকু, এই সমুদ্র পেরিয়ে ওপারের দেশে। বালিসানা–অনেকদূরে-পাহাড়-জঙ্গলের রাজ্যে।

সুনন্দ বলল, আচ্ছা এখন সবার সঙ্গেই আমাদের বেশ ভাব-সাব হয়েছে, কিন্তু কামাউ-এর ব্যাপারটা কী? আমাদের সঙ্গে কথা বলে না, কাছে আসে না, কেন?

কামাউ কোনো বিদেশিকেই পছন্দ করে না। আর সাদা মানুষদের ওপর তো ভীষণ চটা।

কেন?

শুনেছি, কামাউ যখন ছোট ছিল, একদল শয়তান সাদামানুষ তাকে দূর দেশে ধরে নিয়ে যায়। খুব অত্যাচার করে। অনেক কষ্টে কামাউ পালায়। সেই থেকে তার রাগ। মাহিন্ডি বলে বেঁচে গেছ, সাদাদের বাগে পেলে ও খুন করতে পারে।

টোটো একদিন সকালে এল না, দুপুরেও এল না, এল রাত্রে। তাঁবুর কাছে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সতর্কভাবে দেখল, তারপর গুটিগুটি তাঁবুর গা ঘেঁষে ছায়ায় বসল। কী ব্যাপার?

শুনলাম, কামাউ তাকে ধমকেছে, এই ছোঁড়া, মাহিভিগুলোর কাছে অত ঘুরঘুর কীসের? শুনছি ওখানে অখাদ্য-কুখাদ্য গিলিস। খবরদার ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। বিদেশিদের সঙ্গে অত ভাব চলবে না।

কী হিংসুটে লোক! কিন্তু পেটুক টোটোকে ভয় দেখিয়ে আটকানো যায়নি। তবে বলে গেল দিনের বেলায় আর আসবে না। রাত্তিরে আসবে। সবাই যখন নাচ-গানের জন্য তৈরি হচ্ছে, তখন লুকিয়ে।

এই দ্বীপের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে আমরা কিছু কিছু জেনেছি।

দ্বীপের জনসংখ্যা একশোর বেশি নয়। এরা চাষবাস ভালোবাসে না। সামান্য ভুট্টা, রাঙাআলু ও দু-এক রকম শস্য ফলায়। জীবনধারণের প্রধান উপায় শিকার ও মাছধরা। গরু ও ছাগল পোষে। মাংসের অভাব মেটে। আধুনিক জগতের সঙ্গে যোগাযোগ তাদের খুবই কম। পারতপক্ষে মহাদেশের মাটিতে পা দেয় না। নৌকো এদের মহামূল্যবান সম্পদ। নৌকো চুরি করতে গিয়ে আমাদের মাঝিদের কী হাল হয়েছিল তা তো আগেই বলেছি। সামান্য কয়েকটি লোহার হাতিয়ার সম্বল করে অনেক কষ্টে গাছের গুঁড়ি কেটে নৌকো বানায়।

ছোট আর মাঝারি ডিঙিগুলো কাছাকাছি মাছ ধরার জন্য। কয়েকটা বড় ছিপ নৌকো আছে দূরে পাড়ি দেবার উদ্দেশ্যে।

মামাবাবু প্রত্যহ দ্বীপের সান্ধ্য আসরে যোগদান করে এদের আচার-ব্যবহারের খুঁটিনাটি লক্ষ করতেন। নোট করে রাখতেন। এমন চমৎকার গবেষণার ক্ষেত্র পেয়ে মাফিয়া না, যেতে পারার শোক তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন।

.

০৭.

দ্বীপবাসের পঞ্চম দিন। সন্ধেবেলা। আমি ও সুনন্দ তাঁবুর ভিতর বসে রাতের খাবারের আয়োজন করছি। মামাবাবু তার নিজের কামরায়। সারাদিনের সংগ্রহ নমুনাগুলি সাজিয়ে। গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত। টোটো যথারীতি হাজির। তাঁবুর পাশটিতে উবু হয়ে বসে। কেমন, চুপচাপ। কথাবার্তা বলছে না। হঠাৎ সে সটান মাটিতে শুয়ে পড়ল।

কী হল, কী হল?

তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখি খুব জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে।

আমাদের ডাক শুনে মামাবাবু বেরিয়ে এলেন। টোটোর জিভ, চোখ ইত্যাদি পরীক্ষা করে বললেন, , যা ভেবেছি, ম্যালেরিয়া। আগুনের ধারে অসুস্থ লোকগুলোকে দেখেও আমার এই সন্দেহ হয়েছিল।

এ্যাঁ, এখানে ম্যালেরিয়া? আমরা দুজন অবাক। এটা তো জানতাম আমাদের দে পেটেন্ট অসুখ। অন্য দেশেও ম্যালেরিয়া আছে?

নিশ্চয়। মামাবাবু বললেন, আফ্রিকা হচ্ছে ম্যালেরিয়ার ডিপো। এখান থেকে পথিনী বহু জায়গায় ম্যালেরিয়া ছড়িয়েছে। ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ে এই মহাদেশে বহু উপজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। মাফিয়ায় যেখানে যাচ্ছিলাম, সেখানেও খুব ম্যালেরিয়া হচ্ছিল। হাইন তাই আমাকে বেশ কিছু ম্যালেরিয়া-প্রতিরোধক ট্যাবলেট নিয়ে যেতে লিখেছিলেন। যাক ওষুধগুলো কাজে লেগে যাবে। সুনন্দ আমাদের বড় প্যাকিং-বাক্সটার মধ্যে দেখবে একটা হলুদ রঙের প্যাকেট রয়েছে। নিয়ে এসো তো!

ওষুধ মুখে নিয়ে টোটো থু থু করে ফেলে দিল। আমরা বোঝাই, খেয়ে নাও ভাই, দেখবে অসুখ সেরে যাবে। লক্ষ্মী ছেলের মতো খেলে তবে অনেকগুলো বিস্কুট পাবে। বিস্কুটের লোভেই বোধহয় সে মুখ বিকৃত করে, বড়ি কটা গিলে ফেলল। তাকে তাবর। মধ্যে শুইয়ে দিয়ে দুটো কম্বল ঢাকা দিয়ে দিলাম।

কিছুক্ষণ পর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর কমেছে।

ঘণ্টাতিনেক পর টোটো উঠে বসল। গরম চা-বিস্কুট খেল। সে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। সত্যি মাহিন্ডিদের ওষুধের আশ্চর্য গুণ। এই হোমা অর্থাৎ কাঁপুনি-জ্বর তার আগেও হয়েছে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কখনো ভালো হয়নি। আর জ্বরের পর এত চাও কখনো বোধ করেনি। প্রতিবারই ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছে।

বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে সে বিদায় নিল।

অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। সেদিন আর দ্বীপের সান্ধ্য আসরে গেলাম না! মামাবাবু বললেন, সঙ্গে তো মশারি আছে, এবার বের করো। জেনেশুনে ম্যালেরিয়া বাধিয়ে কাজ নেই।

পরদিন ভোরবেলা। সবে ঘুম ভেঙেছে। একজন লোক এসে তাঁবুর সামনে বেজায় হাঁকাহাঁকি শুরু করে দিল।

সর্দার ডাকছে, জলদি।

হঠাৎ সর্দারের তলব কেন?

তা জানি না। বলে দিয়েছে সেই দাওয়াই নেবে।

দাওয়াই? ওষুধ? কীসের? ঐ যে টোটোকে খাইয়েছিলে। সেই ওষুধ।

ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ আঁচ করি। সর্দার কি চটেছে? তার অগোচরে বিদেশি ওষুধ খাওয়ানো কি অপরাধ হয়ে গেল? পরোপকার করতে গিয়ে নতুন ফ্যাসাদ বাধালাম না তো? টোটোও আচ্ছা পেট আলগা, কী দরকার ছিল জানানোর? অবশ্য আমরাও তাকে বারণ করিনি বলতে।

অগত্যা তিনজনে দূতের সঙ্গে চললাম। দুরু দুরু বক্ষে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যাই। হুকুম মাফিক কিছু ম্যালেরিয়ার ট্যাবলেটও নিলাম।

গ্রামের ডাক্তারখানা। সেই ছোট্ট কুটির।

সর্দার তার দলবল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। যেতেই কুটিরের ভিতরে আঙুল দেখিয়ে বলল, এদের ওষুধ দাও, জ্বর হয়েছে। কাল যেমন টোটোকে দিয়েছ, তেমনি–

টোটো সামনে ছিল। দাঁত বের করে হাসল। বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। যত নষ্টের মূল।

কুটিরের ভিতর দুজন লোক শুয়ে জুরে কাঁপছিল। মামাবাবু ভিতরে ঢুকলেন। পরীক্ষা। করে বললেন, হুঁ-ম্যালেরিয়া। ট্যাবলেট দিলেন। সর্দারকে বললেন, পরে আমায় খবর দিও গা গরম কমেছে কী না।

সর্দার বলল, এ-অভিশাপ দ্বীপে আগে ছিল না। মাত্র বছরখানেকের আমদানি। কয়েকজন উপকূল থেকে ঘুরে এসে এই হোমা অর্থাৎ কাঁপুনি-জ্বরে পড়ে। ক্রমে আজ দ্বীপের অধিকাংশ লোককে এই রোগ ধরেছে। সহজে মরে না কেউ, কিন্তু দিন দিন দুর্বল করে দিচ্ছে আমাদের। আমার নিজেরও একবার জ্বর হয়েছিল। জ্বর ছেড়ে গেল দুদিনে। কিন্তু ওঃ, পরে সাত দিন ধরে পা টলত, মাথা ভনভন করত। টোটো বলছে, তোমাদের ওষুধ খেয়ে নাকি অল্পক্ষণেই জ্বর সেরে গেছে, আর এক রাতেই তাজা হয়ে উঠেছে। তাই তো ডাকলাম। কী যে করি এই নিয়ে! কামাউ বলে, দুষ্ট্র অপদেবতা ভর করেছে। অনেক পুজো-টুজো তো দিচ্ছি, কিন্তু তাড়াতে পারছি না।

প্রায় দুঘণ্টা পর।

দেখি একটা বড় দল ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে। সর্দার সামনে। সেই রুগী দুজনও রয়েছে। হেঁটে আসতে পারছে, অর্থাৎ জ্বর কমেছে। আমরা গম্ভীর মুখে অপেক্ষা করি।

রুগী দুজন সামনে এসেই সটান শুয়ে পড়ল, জয় বাবা মাহিন্ডি! কী দাওয়াই দিয়েছ। জাদু!

সর্দার বলল, আশ্চর্য ওষুধ তোমাদের। এতদিন কামাউ-এর ওষুধ খেয়েছি। কিন্তু এ অদ্ভুত ব্যাপার কোথায় শিখলে?

সুনন্দ চাল মেরে বলে, হুঁ হুঁ বাবা, এ কি যে-সে জিনিস! মন্ত্রপূত করা। কামাউ এ-বস্তু পাবে কোথা? গুরুর কাছে শিখতে হয়।

মাহিন্ডিদের অসামান্য শক্তি দেখে সবাই ভক্তিতে গদগদ।

মামাবাবু বললেন, আবার কারো জ্বর হলে খবর দিও, বা এখানে পাঠিও। না-না, পাঠানোর দরকার নেই, আমরাই যাব। প্রত্যেকদিন সকালে ঐ কুটিরে।

রুগীরা দুটো বড় বড় ডাব নিয়ে এল। ডাক্তারের ফি!

সবাই খুশি, শুধু একজন ছাড়া। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে, কপালে ভ্রুকুটি, হিংস্র চাউনি। সে কামাউ।

.

০৮.

ঘটনাটায় আমাদের দ্বীপের জীবনযাত্রা এক নতুন পথে মোড় নিল।

প্রত্যেকদিন সকালে একবার গ্রামের হাসপাতালে হাজির হই, দু-একটি রুগী মজত থাকে প্রত্যেকদিন।

দ্বীপের প্রত্যেকটি লোকের মধ্যেই বোধহয় ম্যালেরিয়ার জীবাণু সংক্রামিত হয়েছে। শিশু ও বালক-বালিকারাই ভোগে বেশি। এদের জীবনীশক্তি খুব জোরালো। তাই দু-এক ডোজ ওষধ খেয়েই গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু এভাবে কতদিন যাবে? সাময়িকভাবে প্রতিরোধ করে কী লাভ! বারবার জ্বর হয়ে প্রাণশক্তি যে ক্ষয় হয়ে যাবে। মামাবাবু বললেন, ফিরে গিয়ে স্বাস্থ্যদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ওষুধপত্র নিয়ে দল পাঠাতে হবে। ডিডিটি ছড়িয়ে ম্যালেরিয়ার বিষবাহী মশা ধবংস করতে হবে, নইলে এরা মরবে।

আমাদের খাতির এখন দেখে কে?

নাচ-গানের আসরে সর্দারের পাশেই আমাদের আসন নির্দিষ্ট হয়েছে। তাদের সঙ্গে নাচে যোগ দিতে আমাদের সাধাসাধি করে। তাল বুঝে সুনন্দ একদিন লাফিয়ে উঠে নাচ শুরু করে দিল। আধঘণ্টা নেচে-কুঁদে বেদম হয়ে সে বসে পড়ে। সকলে খুব তারিফ কল, তোমার হবে। কদিন অভ্যেস করলেই হবে। ফার্স্ট ক্লাস নাচিয়ে হয়ে যাবে। শুনে সুনন্দের কী গর্ব!

আমার বাবা নাচার শখ নেই! তবে ওদের নাচের তালে পা আপনি নেচে ওঠে। তখন চুপ করে বসে থাকা যায় না। আমি তাল ঠুকি। টিনের কৌটো বাজাই। মামাবাবুকেও দেখেছি ঘাড় নেড়ে তাল দিচ্ছেন।

নাচ এদের রক্তে। ছেলে-বুড়ো মা-মেয়ে সবাই নাচের নামে পাগল। থুথুরে বুড়ো, বয়সের ভারে বেঁকে গেছে, সেও পা ঠোকে। হাততালি দেয় নাচের সাথে। এদের সমস্ত সুখ-দুঃখের প্রকাশ নাচের মাধ্যমে।

সমুদ্রে একটা বড় মাছ উঠল। অমনি তীরে যারা ছিল একপাক নেচে নিল। শুয়োর মারা হয়েছে, ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আজ, ব্যস, নাচ চলবে দু-গুণ। আবার একজন বুড়ো মরল, তার শ্রাদ্ধেও দেখি সবাই নেচে নেচে শোক প্রকাশ করছে।

সর্দার নাচে। কামাউও নাচে। চত্বরের একটু বাইরে এদের এক মন্দির আছে। উঁচু টিলার ওপর ছোট্ট ঘর। দেয়াল ও মাথার ছাউনি অন্য ঘরের মতো। কোমর সমান উঁচু এক প্রবেশপথ। তার ওপর তক্তা দিয়ে বন্ধ থাকে। কামাউ প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা সেই দরজা খুলে ভিতরে দেবতার উদ্দেশে মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে। সেই দেবতার চেহারা আমরা দেখিনি। কামাউ একা যায়, অন্য কেউ যায় না। বিশেষ উৎসবে নাকি দেবতাকে বের করা হয়। আমাদের দেবভক্তি তেমন প্রবল না হওয়ায় ও-বিষয়ে মাথা ঘামাইনি।

তবে যে-কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম তা হল, কামাউয়ের পুজোর পদ্ধতি।

দু-চার লাইন মন্ত্রপাঠ। তারপর সে মন্দিরের চারপাশে বারকয়েক নেচে নেচে ঘুরবে। পুজো শেষ। এইবার সে আসবে চত্বরে। মজলিসে যোগ দেবে। সেখানেও সে নাচে। তবে রোজ নয়, বিশেষ উপলক্ষে। তার নাচের বিশেষত্ব আছে।

সে নাচবে একা। অন্যরা তখন ওঠে না। ঢাক আর ডামের আওয়াজ চতৃর্তণ হয়ে ওঠে। কী সমস্ত সাংঘাতিক অঙ্গভঙ্গি ও মুদ্রা, তেমনি বিকট মেকআপ! মুখে বুকে হাতে পায়ে লাল কালো সাদা হলদে রঙের ছড়াছড়ি। হঠাৎ দেখলে বুক ধড়াস করে ওঠে। কী বাবা ওটা? মানুষ না রাক্ষস?

ভাঁটার মতো চক্ষুতারকা ঘুরছে। গায়ে হাড়ের গয়নায় খটাখট আওয়াজ। মাথায় লম্বা লম্বা পালকের মুকুটে ঝোড়ো কাপন। থেকে থেকে হুহুঙ্কার।

ভূতপ্রেত অপদেবতা বশ করা হচ্ছে কিনা, তাই এইসব ভয়ঙ্কর কলাকৌশল।

সুনন্দ আপসোস করে, ইস একটা মুভি ক্যামেরা থাকলে যা হত! কোথায় লাগত হলিউডের ছবি!

আমাদের তাঁবু উপহারে ভরে যেতে লাগল। আমরা সর্দারের প্রিয়পাত্র, তাদের মহা উপকারী বন্ধু, সবাই চায় আমাদের সন্তুষ্ট করতে। উপহার যা আসে বেশির ভাগই খাদ্যবস্তু। মাছ, মাংস, পাখি, কচ্ছপের ডিম, কাঁকড়া। ফলটলও আসে। একরকম শিম আসত, দেশি শিমের মতো স্বাদ। আর আসত কাড়িকাড়ি নারকেল ও জল-ভরা কচি মিষ্টি ডাব।

একটা চিংড়িমাছ দিয়েছিল, খোলাটা বাঁশের মতো মোটা। দুহাত লম্বা। একটির কালিয়াতে বাড়িসুন্ধুর পেট ভরে যাবে। সুন্দর তো চোখে জল আসার উপক্রম। আহা। এমন জিনিসটি যদি-মাসিমার (আমার মার) হাতে পড়ত! যাহোক নারকেল দিয়ে চিংড়িমাছের মালাইকারি গোছের কী একটা যে বানাল!

খেতে খেতে মামাবাবু বললেন, বাঃ, চমৎকার হয়েছে মাছটা!

সত্যি সুনন্দর কৃতিত্ব আছে। আমাদের সঙ্গে আনা যৎসামান্য মশলা দিয়ে কত কত কী নতুন রান্না খাইয়ে মুখের একঘেয়েমি কাটিয়ে দেয়।

টোটো এখন বুক ফুলিয়ে আসে। কামাউকে ঘোড়াই কেয়ার করে। বরং আমাদের সঙ্গে

দোস্তি আছে বলে বন্ধুমহলে তার খাতির বেড়েছে।

আমাদের দিন কাটছে প্রায় একই ধাঁচে। মামাবাবু সকালে বেরিয়ে ফেরেন দুপুরে। পোকা-মাকড়, ফল-ফুল-পাতা কত কী যে জোগাড় করে আনেন! দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়েই বসেন স্পেসিমেনগুলির পরিচয় উদ্ধার করতে। বই ঘাঁটেন, নোট করেন। যত্ন করে স্পেসিমেন বাক্সবন্দী করেন।

একদিন ফিরলেন, হাতে কয়েকটা ধুঁধুল।

এখানে ধুঁধুল পেলেন কোত্থেকে?

বনের মধ্যে লতা আছে।

কিন্তু এখানে ধুঁধুল এল কী করে? আমি আশ্চর্য হয়ে বলি।

বাঃ, বঁধুল তো এখানকারই ফল! এখান থেকে ভারতে গিয়েছে। শুধু ধুঁধুল কেন, আরও অনেক ফল-ফুল বাইরে থেকে ভারতবর্ষে গিয়েছে। আজ আমরা তাদের ভাবি খাঁটি দেশি।

গেল কী করে?

বণিকরা এনেছে। পর্যটকরা এনেছে। অবশ্য ভারত থেকেও অনেক ফল-ফুল বিদেশে। গেছে।

ধুঁধুল ভাজা (তেল নয়, মাখন দিয়ে) খেয়ে একটু চেনা খাবারের স্বাদ পেলাম। বাড়ির কথা, মার হাতের রান্নার কথা মনে পড়ছিল। আহা কতদিন খাইনি!

সুনন্দের বেশ সুবিধে হয়েছে। সমুদ্রে নৌকো চালানোর শখ এতদিনে মিটেছে। এখন তাকে সাধাসাধি করতে হয় না, বরং কার নৌকোয় সে উঠবে সেই নিয়ে টানাটানি।

সুনন্দ আগে নদীতে ডিঙিনৌকো চালিয়েছে, কাজেই সমুদ্রে ডিঙি বাওয়া রপ্ত করতে তার সময় লাগল না। আমিও চাপি। তবে ওর মতো দাঁড়িয়ে বল্লম দিয়ে মাছ শিকারে সাহস হয় না। পারতপক্ষে আমি সুনন্দর সঙ্গে এক নৌকোয় উঠি না। যা দাপাদাপি করে। প্রায়ই তার জন্যে নৌকো উল্টোয়। সাঁতরাতে সাঁতরাতে নৌকো সোজা করতে হয়। জলে হাঙর আছে, কোনোদিন ঘ্যাঁক করে ঠ্যাংখানা কেটে নিলে বুঝবে ঠ্যালা।

সুনন্দ একজনের কাছে বেজায় জব্দ। লুম্বাকে দেখলেই তার মুখ শুকিয়ে যায়। আমাকে বলেনি ব্যাপারটা, কিন্তু একদিন ঘটনাচক্রে জেনে ফেললাম।

বনপথে আসছি দুজনে। সারা সকাল ধরে মাছ ধরেছি। সাঁতার কেটেছি। পেটে চনচনে ক্ষিদে। হঠাৎ সুনন্দ বলল, এই খেয়েছে! বলেই সে চট করে একটা গাছের পাশে লুকোয়। তুই এগিয়ে যা, আমার দিকে তাকাসনি।

বেশ। আমি এগোলাম। সামনে দেখি একটি যুবক। ওকে চিনি, লুম্বা।

লুম্বাকে দেখেই লুকোল নাকি?

লুম্বাও আমাদের দেখেছে। দুজনকেই। কারণ সে আমার দিকে একবার তাকিয়েই সোজা সুনন্দকে লক্ষ্য করে দৌড়ল।

আমি হাঁ করে দেখছি ব্যাপারখানা।

লুম্বা ছুটে গিয়ে খ করে সুনন্দর হাত চেপে ধরল। এ্যা। মারবে-টারবে না কি?আমি বাধা দিতে এগোই।

আরে দূর দূর! এই জন্যে এত কাণ্ড! আমি হেসে ফেলি।

লুম্বা সুনন্দের ঘড়িসুদ্ধ কব্জিটা টেনে নিয়ে ঘড়িটা তার ডান কানের ওপর চেপে ধরেছে। তার চোখ বোজা, নাক-মুখ কুঁচকে প্রাণ ঢেলে শুনছে–

সুনন্দ অসহায়ভাবে বলে, দেখছিস, এই এক যন্ত্রণা! যখনই দেখবে টিক্ টিক্ শোনা চাই।

কিন্তু রহস্যটি টের পেল কী করে! তুই শুনিয়েছিলি বুঝি?

হুঁ। সুনন্দ বিরসবদনে বলে। একদিন মজা দেখতে ওর কানে ঘড়ি চেপে ধরেছিলাম। ব্যাটা তো আঁতকে উঠে মারল ডিগবাজি। তারপর বুঝিয়ে শুনিয়ে ভয় ভাঙিয়ে টিক্ টিক্‌ শোনালাম। ব্যস, সেদিন থেকে আরম্ভ হয়েছে এই গেরো।

এই ছাড় ছাড়! হাত ব্যথা হয়ে গেল যে।–আর একটু, আর একটু। লুম্বা এবার বাঁ কানের ওপর ঘড়ি চেপে ধরে।

সুনন্দ রেগেমেগে ঘড়ি খুলে দেয়! নাও শোনো।

পনেরো মিনিট পর অনেক ঝুলোকুলি করে তবে ঘড়ি ফেরত পাওয়া যায়। সবাই খুশি, শুধু কামাউ আর তার গুটিকয়েক ভক্তের মুখ দিন দিন থমথমে হচ্ছে। কামাউয়ের কয়েকজন ভক্ত ছিল। সর্বদা তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। তাদের মধ্যে দুটিকে আমরা খুব চিনেছি। দুটি যেন মানিকজোড়। সর্বদা একসঙ্গে থাকবে। তাদের নাম দিয়েছিলাম ত্যাড়া-বাকা। আসলে বলা উচিত ছিল ট্যারা-বাকা। কারণ একজনের চোখ কিঞ্চিৎ ট্যারা এবং অন্যটির পা দুটো ধনুকের মতো বাঁকা।

লোক দুটো বেজায় লোভী এবং ধড়িবাজ। আমাদের কাছে প্রায়ই এটা-সেটা চাইত। আবার কখনো চাইত কামাউয়ের নাম করে। পরে খবর পেয়েছি সেসব উপহার বেশির ভাগ সময় কামাউয়ের হাতে পৌঁছয়নি। দুই শিষ্যই গাপ মেরে দিয়েছে।

যেদিন আমাদের চিকিৎসাপাট আরম্ভ হয়, তার দুদিন পরে। বিকেলে ক্যাম্পের বাইরে বসে আছি, হঠাৎ দেখি একজন আসছে এদিকে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম–কামাউ। কামাউয়ের হাঁটা ভুল হবার নয়। ব্যাপার কী?

কামাউয়ের দীর্ঘ শরীর সামনের দিকে নোয়ানো। যখন চলে দেহ সামনে আরও ঝুঁকে পডে ধনুকের মতো বেঁকে যায়। লম্বা লম্বা পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে এগোয় যেন রণ-পা চড়ে হাঁটছে। আর হাত দুটো তার পেণ্ডুলামের মতো ক্রমাগত সামনে পিছনে দোল খায়।

জাম্বো, বানা অর্থাৎ নমস্কার।

কামাউ হাসি হাসি মুখে সম্ভাষণ জানায়। কিছু একটা মতলব আছে নিশ্চয়। মনের ভাব চেপে রেখে বলি, কুজা কুজা, অর্থাৎ আসুন আসুন। কী সৌভাগ্য! খেতি হিকো (এখানে বসুন)।–একটা প্যাকিং বাক্স এগিয়ে দিই।

কামাউ বসল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে, বিদেশি মাহিন্ডি তোমরা দেখছি অনেক দৈবশক্তি-টক্তি রাখো। ওষুধ-টষুধ জানেনা। তা আমাকে ঐ হোমার দাওয়াই তৈরি শিখিয়ে দাও। তোমরা চলে গেলে আমাকেই তো চিকিৎসা করতে হবে।

ওঃ, এই মতলব!

সুনন্দ বাংলায় মামাবাবুকে বলে, দেখছেন কী ধড়িবাজ! এসে পর্যন্ত পিছনে লাগবার চেষ্টায় আছে, ভদ্রভাবে দুটো কথা অবধি বলেনি, এখন ওষুধ শিখে নাম কেনার ধান্দা। কী মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা হচ্ছে!

মামাবাবুকে কিছু বলতে না দিয়ে সুনন্দ মেজাজের মাথায় বলল, ওষুধ তৈরি কী করে শেখাব? সেসব অনেক জিনিসপত্র লাগে। এখানে পাব কোথায়?

তাই বুঝি? কামাউ একটু দমে যায়। সেসব এখানে পাওয়া যাবে না?

না।

কামাউ খানিক ভাবে। তারপর বলে, বেশ তোমাদের কাছে কত ওষুধ আছে? কতদিন চলবে?

খুব বেশি দিন নয়। আমরা ডাক্তারি করতে হবে জেনে আসিনি। এই ধরো আর এক চাঁদ (অর্থাৎ একমাস)।

সুনন্দ বাড়িয়ে চলল। এই রেটে খরচ হলে ট্যাবলেট আর পনেরো দিন চলবে বড়জোর।

বেশ, যা ওষুধ আছে আমায় দিয়ে দাও। এবার থেকে আমিই চিকিৎসা করব। কামাউ বলে।

বটে, আবদার তো মন্দ নয়! কেন টোটোকে এখানে আসতে, আমাদের সঙ্গে মিশতে বারণ করার সময় মনে ছিল না? সুনন্দ বাংলায় জানায়।

তারপর কামাউকে বলে, তা তো সম্ভব নয়।

কেন? কামাউয়ের মুখ গম্ভীর।

ওষুধের গুণ নষ্ট হয়ে যাবে। গুরুর কাছে অনেক দিনের চেষ্টায় ওষুধ তৈরি শিখেছি। গুরু বলেছে এ-ওষুধ অন্য কারও হাতে পড়লে আর কাজ হবে না!

কামাউয়ের কুঞ্চিত। বলল, মনে রেখো আমিও মন্ত্রট জানি। আমার হাতে ওষুধের গুণ নষ্ট হবে কেন?

হবে হবে। সুনন্দ বলে। তুমি তো আর আমাদের গুরুর কাছে মন্ত্র নাওনি। কামাউয়ের মুখে অবিশ্বাস। বলল, বেশ দেখি পরীক্ষা করে। দাও তোমাদের ওষুধ।

উত্তম। সুনন্দ তাঁবুর ভিতর ওষুধ আনতে যায়।

আমি ও মামাবাবু চুপচাপ শুনছিলাম। সুনন্দটা তো আচ্ছা প্যাচালো বুদ্ধি রাখে। মামাবাবুর মুখে চাপা হাসি।

সুনন্দ ফিরে এসে দুটো বড়ি কামাউয়ের হাতে দিল, কি, কোনো রুগী আছে নাকি হাতে? তাহলে এখুনি খাইয়ে দেখতে পারো।

কামাউ বলল, আছে।

দীর্ঘ শরীরটা সামনে ঝুঁকিয়ে, পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কামাউ হাঁটতে লাগল। আমরা তিনজনও সঙ্গে চললাম।

একটি কুটিরে একজন জ্বরে কাতর হয়ে শুয়েছিল। কামাউ তাকে বড়ি দুটো খাইয়ে দিল। দু-চারবার নিজস্ব মন্ত্রও আউড়াল।

সুনন্দ বলল, কাল জানতে পারবে ফলাফল। আজ চলি।

খেতে খেতে মামাবাবু বললেন, কী দিলে?

মাথাধরার ট্যাবলেট। সাদা, একরকম দেখতে, ধরতে পারেনি।

কাজটা ভালো করলে না। ও কিন্তু তোমার কথায় বিশ্বাস করেনি। বুঝেছে ঠকাচ্ছে। ওষুধ শেখাবার ইচ্ছে নেই। কাল যখন দেখবে জ্বর নামল না, চটে যাবে। আমাদের বিপদে ফেলবার চেষ্টা করবে।

ফুঃ, ঘোড়ার ডিম করবে। ওকে কিছু দিচ্ছি না। ব্যাটা মহা হিংসুটে। যদি যাবার সময় কিছু বাঁচে তো সর্দারকে বরং দিয়ে যাব।

পরদিন দ্বীপের হাসপাতালে গিয়ে দেখি রাত্তিরের সেই লোকটি আমাদের চিকিৎসার অপেক্ষা করছে। তার জ্বর কমেনি, বরং বেড়েছে। তাকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ দিলাম।

কামাউ পাশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের কার্যকলাপ দেখছিল। সুনন্দ তাকে হেসে বলল, কী হে, বলেছিলাম না? বিশ্বাস হল তো?

কামাউ উত্তর দিল না। পাঁচন খাওয়া মুখ করে অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

কামাউ যদিও গোপনে এসেছিল আমাদের গুপ্তবিদ্যা জানতে, কিন্তু কথাটা পাঁচকান হতে দেরি হল না। ঐ রুগীই সব্বাইকে বলে দিল তার ব্যর্থতার কাহিনি। ফলে সমাজে কামাউয়ের প্রেস্টিজ বেশ ক্ষুণ্ণ হল।

টোটো খবর দিল কামাউ নাকি আমাদের বিরুদ্ধে লোকজনকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছে। মাহিন্ডিদের ওষুধ খেও না। ভবিষ্যতে ফল ভালো হবে না।

কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউ কান দেয়নি তার কথায়। উল্টে তারা বলেছে, বিদেশিদের মন্ত্রের জোর বেশি। অপদেবতা তাদের ওষুধে তাড়াতাড়ি পালায়। ফলে কামাউয়ের পসার ভীষণ নষ্ট হচ্ছে।

সর্দার নাকি ধমকেছে। বিদেশিদের পিছনে লাগছ কেন? তোমার দৌড় তো দেখলাম এতদিন। খবরদার! ওদের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করলে তোমাকে আমি আস্ত রাখব না।

কামাউ আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে না, ধারে কাছে আসে না। জ্বলন্ত চোখে দূর থেকে তাকায়। ক্ষমতা থাকলে নির্ঘাত ভস্ম করে দিত।

.

০৯.

দেখতে দেখতে ন-টা দিন কেটে গেল। আজ দশ দিনের দিন। কাল আমরা উপকূলে ফিরে যাব।

সকালে সমুদ্রতীরে গিয়ে দেখলাম দুটো বড় বড় ছিপনৌকো সাজানো হচ্ছে। সেগুলোকে জলের ধারে টেনে আনা হয়েছে। নানারকম জিনিস বোঝাই হচ্ছে নৌকোতে। নারকেল, ছোবড়া, শাঁখ, ঝিনুক, কড়ি, হাঙরের দাঁত, পশুচর্ম, প্রবাল প্রভৃতি হরেক রকম তাদের রপ্তানির জিনিস। টোটো বলল, এই সবের বদলে আনা হবে শস্য, কাপড়, লোহার ফলা, সৌখিন গয়নাগাঁটি, নুন।

আমাদের মন খুব উৎফুল্ল হবার কথা, কিন্তু জানি না মন কেমন করছে চলে যেতে।

মামাবাবু একবার বললেন, ইস, এত তাড়াতাড়ি যাব! আমার কাজ তো কিছুই এগোয়নি। দ্বীপের কতটুকু বা সার্ভে হল? এক কাজ কর না, তোমরা চলে যাও, আমি ক-দিন পরে যাব। নৌকো পাঠিয়ে দিও।

আমাদেরও ইচ্ছে করছে না যেতে। দিব্যি রাজার হালে ছিলাম। সুনন্দর আপশোস, নৌকো চালানোটা ভালো করে শেখা হয়নি। বড্ড তাড়াতাড়ি যেন কেটে গেল দিনগুলো।

টোটো শুকনো মুখে ঘুরছে, বেচারার মন খারাপ। বলেছি, বাকি টিনফুড ও বিস্কুটগুলো ওকে দিয়ে যাব। উপকূল অবধি সে অবশ্য আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। সেখান থেকে সুনন্দ : তাকে রান্নার প্রয়োজনীয় মশলাপাতির জোগাড়যন্ত্র দিয়ে দেবে।

তড়িঘড়ি তাকে কতগুলো রান্না শিখিয়েছে সুনন্দ। রান্নার ফরমুলা মুখস্থ করিয়েছে। হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছে।

আমি বলেছিলাম, কী দরকার এত ঝাটে! দু-দণ্ডে তো ভুলে মেরে দেবে। তার চেয়ে অনেকগুলো টিনের খাবার কিনে দে।

না না, ওর রান্নার ন্যাক আছে। ঠিক রাঁধবে। সুনন্দ বলে।

বন্দী মাঝি দুজনেরও ব্যবস্থা করেছি। একফাঁকে সর্দারকে বলে রাজি করিয়ে রেখেছি। সর্দার বলেছে, বেশ, যখন তোমরা বলছ ছেড়ে দেব। কিন্তু লোক দুটো চোর। আপাতত বন্দী থাক, যখন যাব, সঙ্গে যাবে।

সুনন্দ বিকেলে বলল, যাই জেনে আসি কখন নৌকো ছাড়বে। সেই বুঝে মালপত্র গোছাব।

সুনন্দ ফিরে এল প্রায় আধ ঘণ্টা পরে। দেখি সে হনহন করে আসছে। চোখ-মুখ লাল। কী ব্যাপার!

আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলে সে গটগট করে তাঁবুর ভিতরে ঢুকে প্রায় চিৎকার করে ডাকল, মামাবাবু! মামাবাবু!

মামাবাবু বই পড়ছিলেন শুয়ে শুয়ে। চমকে উঠে বললেন, কী হয়েছে?

সর্দার কী বলছে জানেন? এখন নাকি আমাদের যাওয়া হবে না।

কেন?

কেন সেটা তো স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। নানান আবোল-তাবোল বকছে। নৌকোয় জায়গা কম। তোমরা সাতুজন। হেনতেন।

আবার বলছে এত তাড়াহুড়ো কীসের? থাক না আরও কিছুদিন। পরের বারে যাবে। মোট কথা যেতে দেবার ইচ্ছে নেই এবং মতলব বোঝা যাচ্ছে না।

সুনন্দ ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে সর্দারের নামে যা-তা বলতে লাগল, ধাপ্পাবাজ, ভণ্ড, মিথ্যেবাদী, ওরাংওটাং। নিশ্চয় ওই কামাউটা দুর্বুদ্ধি দিয়েছে। ওটাই নাটের গুরু। ওকে আমি দেখে নেব…

মামাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, দাঁড়াও দেখে আসি। ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমরা বসো, মাথা গরম করে কোনো কাজ হবে না।

মামাবাবু ফিরে এসে বললেন, বুঝলে হে, ম্যালেরিয়া আমাদের ডুবিয়েছে। পরোপকার করতে গিয়ে ফেঁসে গেছি।

মানে?

ম্যালেরিয়ার ভয়ে ওরা আমাদের ছাড়তে চাইছে না। ওদের ধারণা আমরা চলে গেলে হোমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?

কিন্তু আমাদের ওষুধ তো দুদিন পরে শেষ হয়ে যাবে, তখন?

বলেছি সে কথা। বলছে, শেষ হলে যেও। ততদিন বাঁচাও।

তার চেয়ে সর্দারের হাতে বাকি ট্যাবলেটগুলো দিয়ে যাই। ওপারে পৌঁছে আরও কিনে দেব। নিজেরাই চিকিৎসা করুক, আমাদের থাকার দরকার কী?

তাও বলেছি। কোনো লাভ হয়নি। তুমিই ভেলকি দেখিয়ে, মন্ত্র, গুরু, এইসব বলে-টলে গণ্ডগোল পাকিয়ে বসে আছ। ওষুধ ওরা ভয়ে ছুঁতেই চায় না। পাছে তার গুণ নষ্ট হয়ে যায়। আর এতে কামাউয়ের কোনো হাত নেই। সে বরং চাইছিল আমরা চলে যাই। আইডিয়াটা সর্দারের মাথায় হঠাৎ খেলেছে। কামাউয়ের কথা শোনেনি।

একটু বুদ্ধি করে বললেন না কেন, নতুন কায়দায় ওষুধ বানিয়ে দেব যাতে ওদের হাত লাগলে গুণ নষ্ট না হয়ে যায়।

তাও বলেছি। কিন্তু ওদের দৃঢ় ধারণা উপকূলে একবার পা দিলে আমরা ঠিক পালাব। কাজেই যতক্ষণ ওষুধ আছে আমাদের আটকাও।

যাকগে মন খারাপ কোরো না। বলেছিলে তো আরও কটা দিন থাকলে হয়। পাকেচক্রে ঘটে গেল।

মামাবাবু দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে চলে গেলেও আমরা দুজনে বেশ ভড়কে গেলাম। কটা দিন বেশি থাকতে আপত্তি নেই কিন্তু এভাবে জোর করে আটকে রাখা ভালো চোখে দেখলাম না। ওষুধ ফুরোলে সত্যি সত্যি যেতে দেবে তো, না আবার ফাঁকড়া বের করবে?

সুনন্দের রাগ। ভণ্ডামি করল কেন? ভালোভাবে অনুরোধ জানালেও তো পারত। সর্দারটা মোটেই তেমন সরল লোক নয়, হাড়ে হাড়ে প্যাঁচালো।

পরদিন ভোরবেলা আমাদের নাকের ডগা দিয়ে দুখানা ছিপনৌকো সমুদ্রের জল কেটে তীব্র গতিতে বেরিয়ে গেল। নৌকোয় গেল দশ-বারোজন, বাকিরা তীরে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাল। বারবার দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা জানাল, হে ভগবান, ভালোয় ভালোয় যেন ফিরে আসে।

নৌকো দুটি ফিরল পরদিন দুপুর নাগাদ।

সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নৌকো ফিরতেই জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। যাক, সকলে ফিরেছে ভালোভাবে।

দ্বীপের নোক ঝুঁকে পড়ল, দেখি দেখি, কী সওদা এনেছে?

.

১০.

দুপুর থেকেই ঢাক বাজছিল। দুম দুম দুম–

বেলা যত পড়তে থাকে ঢাকের আওয়াজ বেড়ে চলে। দ্বীপের আকাশ-বাতাস ধ্বনিত হতে থাকে, দুম দুম দুম…

বোধহয় কোনো বড় উৎসব আজ।

সন্ধে নামতেই আকাশের গায়ে মস্ত রুপোর থালার মতো পূর্ণিমার গোল চাঁদ উঠল। আমি আর সুনন্দ সমুদ্রের তীরে বেড়াতে গেলাম।

জোয়ারের বেগে সাগর উথাল-পাথাল। বড় বড় ঢেউ নাচছে, তাদের মাথায় ফসফরাসের ঝিকিমিকি। ওপর থেকে গড়িয়ে নামছে তরল রুপোলি জ্যোৎস্নাধারা। নীল-সবুজ জলের সঙ্গে মিশে সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

মনে হয় ঐ বুঝি পাতাল রাজ্য। অগাধ জলরাশির নিচে লুকিয়ে আছে অপরূপ পাতালপুরী। এই নির্জন সাগরবেলা থেকে আমরা সরে গেলেই বুঝি জল থেকে উঠে আসবে জলকন্যারা।

পিছনে আমাদের সাদামাটা গাছপালা ভরা দ্বীপটাকে লাগছে রীতিমতো রহস্যময়। গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছোপ ছোপ চাঁদের আলো মাটিতে লুটোচ্ছে। মাটি পাথরের রঙ বদলিয়ে দেখাচ্ছে কেমন চকচকে তকতকে। নারকেল গাছগুলির পাতায় পাতায় ঝমাঝম বাজনা। তারা ছায়া দুলিয়ে প্রাণপণে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কাকে? ঐ জ্যোৎস্নাভরা পূর্ণিমার চাঁদ, না উত্তাল সমুদ্রকে?

খানিকক্ষণ বসে থেকে মনটা ভারি স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। কথা কইতে ইচ্ছে করে না। কান পেতে শুনি প্রকৃতিরাজ্যে নানান আনন্দধ্বনি। কতরকম কীটপতঙ্গ ডাকছে মনের খুশিতে। আর অবিশ্রান্ত জলরাশির আনন্দ উচ্ছ্বসিত কলধ্বনি।

চুপচাপ দুজনে বসে থাকি।

ফিরে আসতে মামাবাবু বললেন, আজ জমজমাট ব্যাপার। কী ঢাক বাজছে! শুনলাম, ওদের মুঙ্গু অর্থাৎ দেবতাকে আজ বের করবে। জানো তো, সোয়াহিলি ভাষায় মুঙ্গু মানে দেবতা। চলো দেখে আসি।

সুনন্দ বলল, আমি যাব না। তার বিরক্তি কাটেনি।

আমার মনটা কিন্তু উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। দ্বীপের আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু সুনন্দকে ফেলে যাই কী করে? অতএব আমিও বললাম, থাক, আজ যাব না। তখন মামাবাবু একলাই গেলেন।

রাত্রে আবার কিছুক্ষণ সমুদ্রতীরে এসে বসি। তরঙ্গের কলরোল ছাপিয়ে সমানে কানে আসছে ঢাকের দুম দুম দুম…। মাঝে মাঝে অট্টরোল। কুটিরবাসী মুঙ্গুকে এরা সহজে বের করে না। চোখেই দেখিনি তাকে! ইস, সুনন্দ না বেঁকে বসলে যাওয়া যেত।

বিকেলে দেখেছি নাচিয়েরা নানারকম সাজপোশাক করে প্রস্তুত হচ্ছে। কত রকম মুখোশ, বিদঘুঁটে সাজ।

তাঁবুতে ফিরে এসে শুয়েছি। ঢাকের বাদ্যিতে ঘুম আসা দায়। সুনন্দ তো দিব্যি নাক ডাকাতে লাগল। এপাশ ওপাশ করছি, হঠাৎ দেখি মামাবাবু ফিরে এলেন।

তিনি শুলেন না। তাঁবুর মধ্যে একটু খুটখাট করেই আবার বেরিয়ে গেলেন। কী দরকার কে জানে! তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

পরদিন মামাবাবুকে কিঞ্চিৎ গম্ভীর দেখলাম। অন্যমনস্কভাবে কী জানি ভাবছেন।

অবশ্য দৈনন্দিন প্রোগ্রামে কোনো বদল হয়নি। যথারীতি সকালে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করেছেন। তারপর বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দুপুরে বই পড়েছেন। স্পেসিমেন সাজিয়েছেন। তবে কথাবার্তা বলছেন কম।

তার এই ভাবটা সুনন্দরও চোখে পড়েছিল। বলল, কী ব্যাপার রে?

বললাম, কিছু বুঝছি না।

পরদিন মামাবাবুর মুড ঐ একই খাতে বইল।

একটা নতুন জিনিস লক্ষ করলাম, তার বই পড়ার সময় বেড়েছে। ব্যস্তভাবে এ-বই সে-বই ঘাঁটছেন।

সাধারণত প্রাণিবিজ্ঞানের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে তিনি সুনন্দর সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু এ দুদিন সুনন্দকে তিনি মোটেই আমল দিলেন না।

আমার মন বলছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে!

তৃতীয় দিন চা-পানের পর। এবার আমাদের দৈনিক ডিউটি দ্বীপের হাসপাতালে যাওয়া। যদি কোনো রুগী থাকে।

সেদিন মামাবাবুর গাত্রোত্থানের কোনো লক্ষণ দেখলাম না। বেশ নিশ্চিন্ত মনে গাছের তলায় পা ছড়িয়ে খুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বসে বই পড়ছেন।

আমাদের কী? যাই, নৌকো চাপি। গুটিগুটি উঠছি, একজন লোক এসে দাঁড়াল।

লোকটাকে চিনি, সর্দারের এক পার্শ্বচর। বলল, শীগগির চলো। সর্দারের ছেলের হোমা হয়েছে। গা তেতে, পুড়ে যাচ্ছে। সবাই তোমাদের জন্য সেই কুটিরের সামনে অপেক্ষা করছে। যাচ্ছ না দেখে সর্দার আমায় ডাকতে পাঠাল। চলো চলো–

আমি ও সুনন্দ দাঁড়িয়ে পড়ি। দূর ছাই অযাত্রা কোথাকার! মামাবাবু একা যাবেন, না আমাদেরও সঙ্গে যেতে হবে ভাবছি, এমন সময় মামাবাবুর গম্ভীর গলা শুনতে পেলাম, যাইনি, কারণ গেলে কোনো লাভ হত না। আমাদের ওষুধে সর্দারের ছেলে বা অন্য কোনো কাঁপুনি রুগীই আর সেরে উঠবে না।

তার মানে? লোকটির চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে যায়।

মানে ওষুধের গুণ নষ্ট হয়ে গেছে। ওষুধ যখন বানানো হয় তখন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত করা হয়। সেই সময় পেরিয়ে গেলে ওষুধ হয়ে পড়ে প্রাণহীন, অকেজো। আমাদের ওষুধে কাল অবধি শক্তি ছিল, আজ ঐ বড়িগুলোর শক্তি মৃত। বড়িতে আবার নতুন করে শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। পুজো-আর্চা করতে হবে। অনেক সরঞ্জাম চাই। সেসব এখানে পাব কোথায়? তুমি সর্দারকে বলো, ছেলের জন্যে কামাউকে ডাকতে। আমার দ্বারা হবে না।

লোকটা এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল।

আমরা দুজন হতভম্ব। এ কী কাণ্ড! মামাবাব হাঁডিপানা মখ করে বসে আছেন। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না। দেখা যাক কী ঘটে।

দূরে দেখা গেল সর্দার আসছে। সদলবলে হন্তদন্ত হয়ে।

সে এসেই উত্তেজিত স্বরে বলল, কী ব্যাপার? শুনলাম নাকি ওযুধ দেবে না? ওষুধের শক্তি শেষ হয়ে গেছে! পুজোটুজো করতে হবে?

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ।

তবে বসে আছ কেন, পুজো লাগাও। কী কী লাগবে বলো, কটা বলি? এক্ষুনি আনিয়ে দিচ্ছি। মন্ত্র-টস্ত্র তোমাদের জানা আছে তো?

হ্যাঁ, তা আছে কিন্তু যে বস্তুটি নইলে হাজার মন্ত্র পড়েও কাজ হবে না, ওষুধে একফোঁটা শক্তিও ফিরিয়ে আনা যাবে না, সে জিনিসটি এখানে কই?

কী সে জিনিস?

একটি দৈবশক্তিসম্পন্ন পাথর। সেটা আছে আমাদের দেশে। সেরকম পাথর না পেলে শুধু মন্ত্র পড়ে কী হবে? বরং কামাউয়ের ওষুধ খাওয়াও তোমার ছেলেকে।

ধুত্তেরি! এ কামাউয়ের কম্ম নয়। ভীষণ জ্বর, ওর সাধ্য নেই এমন রুগীকে সারায়। এত জ্বরে কামাউয়ের ওষুধ খাওয়ানো হলে দেখেছি রুগী প্রায়ই সারেনি। মরে গেছে। তোমরা যাহোক কিছু ব্যবস্থা করো।

কী আর করব? মামাবাবু হতাশ কণ্ঠে জানান।

অমন জাঁদরেল সর্দার হাউমাউ করে প্রায় কেঁদে ফেলল, ওঃ, কী হবে! আমার অমন জোয়ান ছেলেটা বেঘোরে মরবে নাকি? ও যে আমার সেরা ছেলে। কী কব্জির জোর! কী বর্শার তাক! উৎসবের দিন থেকে জ্বর হয়েছে। আমাকে বলেনি। ওষুধ খায়নি। বন্ধুদের বলেছিল, ও আপনি সেরে যাবে। এখন উঠতে পারছে না। চোখ দুটো রক্তের মতো লাল, শুধু গোঙাচ্ছে, ছটফট করছে। থরথর করে কাঁপছে। ধরে রাখা যাচ্ছে না। গায়ে হাত দেওয়া যায় না, এত তাত! ওঃ! ওঃ!।

সর্দারকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মামাবাবু নির্বিকার। শুধু মাথা দুলিয়ে বললেন, তাই তো! আহা, তোমার অমন ছেলেটা!

সর্দার বলল, খুঁজে দেখেছ এ-দ্বীপে তেমন কোনো পাথর আছে কিনা।

না, তা দেখিনি অবশ্য। মামাবাবু বলেন।

বেশ, বলো কীরকম দেখতে। দ্বীপের সমস্ত লোক যত রাজ্যের পাথর আছে তোমার। সামনে হাজির করবে। দেখ পাও কিনা।

না না, আমার কাছে পাথর আনতে হবে না। আর সে পাথর কি বাইরে থেকে দেখে চেনা যায়? আচ্ছা আমি গণনা করে দেখছি, যদি তেমন কোনো পাথর থাকে, ঠিক জানতে। পারব। কোথায় আছে তাও জানব। কিন্তু যদি না থাকে তো আমি নিরুপায়।

দেখ, দেখ শীগগির। সর্দারের ধৈর্য আর বাঁধ মানে না।

বেশ। মামাবাবু উঠে দাঁড়ান। হাঁক পাড়েন, সুনন্দ, তাঁবু থেকে দাবার বোর্ড আর গুটি নিয়ে এস তো।

সুনন্দ বোর্ড আর গুটির বাক্স নিয়ে এল।

মামাবাবু বললেন, সাজাও। এক দান খেলা যাক।

সত্যি খেলবেন? সুনন্দ ভয়ে ভয়ে বলে।

নিশ্চয়। মামাবাবু বসে পড়ে গুটি সাজাতে থাকেন।

সুনন্দ আমার দিকে আড়চোখে তাকায়। তার চোখে কৌতুক ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

খেলা আরম্ভ হয়।

সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে দুজনকে ঘিরে। স্তম্ভিত বিস্ময়ে দেখতে থাকে খোপ খোপ ঘর কাটা বোর্ড। অদ্ভুত দেখতে গুটিগুলো।

আমিও হাঁ করে দেখছি। হঠাৎ এমন সাড়ম্বরে দাবা খেলার শখ কেন মামাবাবুর? গভীর উদ্দেশ্য একটা আছে নিশ্চয়, কিন্তু রহস্যটা কী? মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারছি না। গম্ভীর মুখে মামাবাবু চাল দিচ্ছেন।

মামাবাবু দুর্ধর্ষ দাবাড়ু। সুনন্দ কতক্ষণ টিকবে তার সামনে? তারপর ব্যাপার-স্যাপার দেখে সে নার্ভাস। দেখতে দেখতে বোড়ে, ঘোড়া, গজ ইত্যাদি ঝপাঝপ কাটা পড়তে লাগল। পাঁচ মিনিটে মাৎ। সুনন্দর রাজাকে নিয়ে মামাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন সোয়াহিলিতে, পেয়েছি, পেয়েছি। ইউরেকা! হা হা, আছে। এই দ্বীপেই আছে। সেরকম এক দৈবশক্তি সম্পন্ন পাথর। তার সাহায্যে আমার ওষুধের গুণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

কোথায়? কোথায়? সমস্ত জনতা চিৎকার করে ওঠে।

দাঁড়াও সেটা গুণে দেখি।

মামাবাবু এবার পকেট থেকে বের করলেন একখণ্ড সাদা কাগজ। মাটিতে বিছিয়ে পাতলেন। তারপর পেন ঘুলে খসখস করে এঁকে চললেন বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, পঞ্চভূজ–যত রাজ্যের জ্যামিতিক নকশা।

মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছেন। কখনো কী গুণছেন। সবাই গোল গোল চোখ করে দেখছে। দারুণ টেনশন।

হঠাৎ তিনি বলে ওঠেন, ই পেয়েছি। কাগজের ওপর চোখ রেখে তিনি জোরে জোরে হিসেব করেন–চত্বরের পুব-দক্ষিণ কোণ বরাবর পঞ্চাশ হাত। একটা ছোট কুটির। কেউ থাকে না তাতে। না না ভুল হল, থাকে। তবে মানুষ নয়। মূর্তি। এ হচ্ছে তোমাদের মুঙ্গুর কুটির। ভিতরে আছে পাথরটা।

মুঙ্গুর কুটিরের ভিতর? সর্দার আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ, কালো রঙের বেশ বড় পাথর।

কই সেরকম কোনো পাথর তো নেই কুটিরে। একজন বলে।

নেই? মামাবাবু অবাক হন। আবার কয়েকবার আঁচড় কাটেন কাগজে। তারপর বলেন, আচ্ছা, তোমাদের মুঙ্গু কী দিয়ে তৈরি? পাথরের? কালো রঙ, চৌকো গড়ন?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

মামাবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ব্যস, তবে ঐ মুহূকে আমার চাই। মুই একমাত্র পারে আমার ওষুধের গুণ ফিরিয়ে দিতে। আর কোনো তেমন পাথর নেই এখানে। মুঙ্গুর সামনে আমি পুজো করব। মন্ত্র পড়ব। তারপর ওষুধ ছোঁয়াব তার গায়ে। অমনি ওষুধে। আবার নতুন প্রাণ পাবে। সেই ওষুধ খেলেই সর্দারের ছেলে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

সমস্ত জনতা কেমন আড়ষ্ট অসাড় হয়ে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এ ওর দিকে তাকাচ্ছে।

বুঝলাম কোথাও একটা গরমিল হয়ে গেছে।

ভেবেছিলাম মুঙ্গুর নাম শুনেই সর্দার হুকুম দেবে–লে আও মুকে। আভি। কিন্তু এই দ্বিধা কেন? প্রস্তাবটি কাজে পরিণত করতে কোথায় যেন বাধা আছে।

সর্দার এগিয়ে এল। আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু মূহুর সামনে পুজো হবে কী করে? বিদেশিদের পক্ষে এই দেবতাকে দর্শন যে বারণ। নিষিদ্ধ।

মামাবাবু আশ্চর্য হয়ে বলেন, তাই নাকি! বিশেষ কারণেও দেখা চলবে না?

না।

তাহলে আমি নিরুপায়। মামাবাবু উদাসভাবে মুখ ফেরান। তোমার ছেলের জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। বেচারার দেখছি নেহাতই প্রাণটা যাবে। কী কড়া তোমাদের নিয়ম! দেখো ভেবে, কোনো রকমেই কি সম্ভব নয় মুম্বুর সামনে আমার পুজো করা? তাহলে ছেলেটা বাঁচত।

না না না। এ অসম্ভব। একেবারে অসম্ভব। একটা তীক্ষ্ণ, তীব্র গলা মামাবাবুর কথা শেষ করতে দেয় না।

সচকিতে তাকিয়ে দেখি কামাউ।

তার দীর্ঘ বাঁকানো শরীরটা উত্তেজনায় সোজা হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে রাগে।

অপবিত্র বিদেশির দৃষ্টি মুঙ্গুর গায়ে লাগলে সর্বনাশ হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সবাই।

কামাউ সর্দারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, মাহিন্ডির শয়তানি। ওরা আমার দেবতাকে অপমান করতে চায়।

মামাবাবু সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে হাতজোড় করেন, আরে ছি ছি! তোমার পবিত্র মুঙ্গুকে অপমান করতে কি পারি? মুঙ্গুকে দেখা নেহাত যদি নিষিদ্ধ হয় তবে থাক। কিন্তু এও শোনো সর্দার–আমরা সাধারণ বিদেশি নই। অনেক শক্তি আমাদের। অনেক মন্ত্র জানি। তার প্রমাণ তো তোমরা পেয়েছ, বিদেশির দৃষ্টি গায়ে লাগলে মুঙ্গ যাতে অসন্তুষ্ট না হন তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আমরা করব। পুজো দেব। তোমরাও ভালো করে পুজো লাগিও তার রাগ কমাতে। আমি নিশ্চিত জানি সর্দারের প্রিয় ছেলের প্রাণরক্ষার চেষ্টা করতে এই সামান্য নিয়মভঙ্গ হলে মুঙ্গু অপরাধ নেবেন না। দ্বীপের কারো কোনো ক্ষতি হবে না। এখন তোমরা ভেবেচিন্তে কী করতে চাও–

মামাবাবু কলমটা পকেটে গুঁজলেন। সযত্নে বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ অঙ্কিত জ্যোতিষচর্চার নিদর্শন কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন, তারপর গালে হাত দিয়ে উদাস হয়ে বসে রইলেন।

দাবার গুটি বোর্ড সুনন্দ ইতিমধ্যে গুছিয়ে ফেলেছিল।

দেখি, কামাউয়ের মুখ আক্রোশে বিকৃত হয়ে উঠেছে। মুঙ্গুর সম্মান রক্ষা করতে সে বদ্ধপরিকর।

সর্দার দ্বিধাগ্রস্ত। ধর্মবিশ্বাস ও প্রিয় ছেলের প্রাণ, এই দোটানায় দুলছে তার হৃদয়। সর্দার কামাউয়ের দিকে এগিয়ে গেল। সমস্ত ভিড়টা তাদের ঘিরে ধরল।

সর্দার ও কামাউয়ের মধ্যে কথা আরম্ভ হল। বুঝলাম, কামাউ সম্মতি দিলেই সর্দার আমাদের মুঙ্গুর সাক্ষাতে হাজির করবে।

প্রথমে নিচু স্বরে কথাবার্তা হচ্ছিল, কিন্তু ক্রমে দুজনের গলাই চড়তে থাকে। কামাউয়ের এক কথা বার বার কানে আসছিল, আপানা আপানা, অর্থাৎ না না।

সর্দারের মেজাজও গরম হচ্ছিল।

অন্যদের হাবভাব দেখে মনে হল তারাও সর্দারের পক্ষে। অসুস্থ ছেলেটি তাদের পরম প্রিয়। তার প্রাণ বাঁচাতে তাদের আগ্রহ বেশ বোঝা যাচ্ছিল। তাছাড়া মুঙ্গুর মেজাজ শান্ত করতে যে দাওয়াই মামাবাবু বাতলেছেন সেটাও তাদের মনে ধরেছে। কামাউয়ের চেয়ে আমাদের শক্তির ওপরই তাদের বেশি আস্থা।

মিনিট দশেক পর সর্দার গটগট করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর স্বরে বলল, আমি আদেশ দিচ্ছি, যাও তোমরা মুঙ্গুর সামনে পুজো আরম্ভ করো। কেউ বাধা দিতে এলে তার মাথাটা আর ধড়ের ওপর আস্ত থাকবে না, মনে রেখো।

মুখ ঘুরিয়ে সর্দার কামাউ এবং তার গুটিকতক ভক্তকে ক্রুদ্ধ চোখে দেখে নেয়।

কামাউ তখন রাগে ফুলছে। চিৎকার করে অভিশাপ দিচ্ছে, সবংশে নিপাত যাবি।

মুঙ্গু কাউকে রক্ষা রাখবে না। শয়তান বিদেশিগুলোকে এখুনি খতম কর। কী, তোরা দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? বাধা দে।

কিন্তু কেউ বাধা দিল না। প্রতিবাদ করল না। কামাউয়ের দুই চেলা ত্যাড়া-বাকা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। কিন্তু তারাও এগোলো না।

উঃ অসহ্য! নিষ্ফল ক্রোধে ফুলতে ফুলতে কামাউ দ্রুত পায়ে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেল।

সর্দার বলল, কী কী দরকার বলো, আনিয়ে দিচ্ছি।

মামাবাবু বললেন, থাক, আমরা নিজেরাই জোগাড় করে নেব! তারপর গলা নামিয়ে আশ্বাসের সুরে বললেন, কিছু ঘাবড়িও না। মুত্যুকে আমি ঠিক ম্যানেজ করে দেব। চটবে না।

সুনন্দ শীগগির বেশ কিছু নারকেল ছোবড়া জোগাড় করো। আর একটা পাত্র। ধোঁয়া দিতে হবে।

কার বুদ্ধির গোড়ায় কে জানে! আমার কানে ফিসফিসিয়ে কথা কটা বলে সুনন্দ, এই যাচ্ছি মামাবাবু! বলে একলাফে এগোলো।

মুঙ্গুর মন্দিরের দরজায় চাপা কাঠের তক্তাটা আগে থাকতেই ভোলা ছিল। মন্দিরের কাছে পৌঁছে মামাবাবু অর্ডার দিলেন, এবার ছোবড়ায় আগুন লাগাও। খুব ধোঁয়া হয় যেন।

একটা হাতলওলা স্টিলের ডেকচি ঠেসে নারকেল ছোবড়া ভরা হয়েছিল। সুনন্দ লাইটার জ্বেলে আগুন দিল। তারপর দুজনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করে ফেললাম।

মামাবাবু হঠাৎ হাঁ রে রে রে বলে বিকট এক হুঙ্কার ছাড়লেন। তারপর দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমাদের বললেন, আমি ভিতরে ঢুকছি। তোমরা দরজার মুখে বসে পড়ো। খুব ধোঁয়া ওঠাও আর যা ইচ্ছে মন্ত্র আওড়াও। জোরে জোরে।

মন্ত্র! কীসের মন্ত্র?

আহা, ঐ কবিতা-টবিতা যা হয় কিছু। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত যা মনে আসে। থামবে । এই বলে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে মুজুর মুখোমুখি হলেন।

একনজরে একবার দেখে নিলাম মুঙ্গুকে।

ঘরটার সামনে তখন সমস্ত দ্বীপের বাসিন্দা এসে জড়ো হয়েছে। থমথমে আবহাওয়া। মুহূকে বিদেশি চর্মচক্ষে দেখল–না জানি কী অঘটন ঘটবে। বজ্রপাত না ভূমিকম্প! এক অজানিত আশঙ্কায় তাদের হৃদয় আচ্ছন্ন। মুখগুলো বিবর্ণ। চোখে ভয় বিস্ময়।

বুঝছি যে সমস্ত ব্যাপারটায় এক বিরাট প্যাঁচ খেলছেন মামাবাবু। কিন্তু কেন? উদ্দেশ্য কিছু ধরতে পারছি না। জিজ্ঞেস করারও উপযুক্ত সময় নয় এটা। অতএব প্রতীক্ষা করা যাক। ধীরে ধীরে সব রহস্যই উঘাটিত হবে।

সুনন্দকে বললাম, আমি বাংলা চালাচ্ছি, তুই দেবভাষা ঝাড়।

অলরাইট! সংস্কৃতে আমার লেটার ছিল ম্যাট্রিকে, শুনবি?

দুজনে আচমকা এমন বিটকেল হেঁড়ে গলায় আওয়াজ ছাড়লাম যে সামনের লোকগুলো চমকে সাত হাত পিছিয়ে গেল। দুটো তালপাতার পাখা দিয়ে প্রাণপণে ধোঁয়া ওড়াই আর মুঠি পাকিয়ে কী ভীমবিক্রমে কাব্যপাঠ। বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল কারণ ভিতর থেকে মামাবাবুর চাপা স্বর শুনলাম, একটু আস্তে।

ঝাড়া পনেরো কুড়ি মিনিট চিৎকার করে গলাটা আমার ধরে এল। দম নিতে থামলাম।

মামাবাবু কী করছেন? কৌতূহলী হয়ে পিছনে তাকালাম।

ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম তিনি সেই অদ্ভুতদর্শন বিগ্রহের পরে ঝুঁকে পড়েছেন। হাতে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। গ্লাসে চোখ লাগিয়ে কী দেখছেন। একেবারে তন্ময়। পাশে মাটির ওপর খোলা একখানা সাদা কাগজ, কী সব ছবি আঁকা। একটা পেন্সিল মাটিতে পড়ে।

একটা নিচু মাটির বেদির ওপর শিলের মতো একখণ্ড কালচে পাথর চিৎ করে শোয়ানো। পাথরের ওপর খোদাই করা এক মূর্তি। প্রায় হাতখানেক লম্বা। মানুষের মূর্তি নয় এটুকু বুঝলাম। কোনো জন্তু বা কোনো কাল্পনিক বস্তু। অদ্ভুত আকৃতি।

আমার দেখাদেখি সুনন্দও পিছনে তাকিয়েছে। দুজনেরই চিৎকার বন্ধ হয়ে গেছে।

মামাবাবু মুখ তুললেন, কী ব্যাপার? দেখলেন, আমরা হাঁ করে তাকিয়ে আছি। আঙুল নেড়ে ডাকলেন, দেখে যাও।

ধুনুচিটা দরজার গোড়ায় রেখে আমরা পায়ে পায়ে যাই।

এবার স্পষ্ট করে খুঁটিয়ে দেখলাম।

উপাস্য বিগ্রহ যে এমন ভয়াবহ বিকট হতে পারে ধারণাই ছিল না। উপজাতিদের কাণ্ডকারখানাই আলাদা! এটাকে কী বলব? কোনো জন্তু? না। মনে হল কোনো টিকটিকি বা গিরগিটি জাতীয় জীবের কঙ্কাল যেন পাথরের ওপর সেঁটে দেওয়া হয়েছে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্মৃতি-কোঠায় একটি বর্ণনা বিদ্যুতের মতো চমক দিয়ে যায়।

জঙ্গলের মধ্যে আগুন ঘিরে অসভ্য আদিবাসীদের উৎসব হচ্ছে। আগুনের পাশে রাখা হয়েছে এক মূর্তি–বিচিত্র। বীভৎসাকৃতি। আর দুর থেকে লুকিয়ে দূরবীন চোখে দেখছে–বিল। ডেয়ারিং বিল।

মামাবাবু বললেন, মনে পড়েছে কারো কথা?

হা হা। দুজনে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠি।

আমার মনে হয় এটা সেই মূর্তি। সেই দেবতা। কিন্তু কী বস্তু এটা বুঝতে পেরেছ? প্রশ্নটা তিনি করেন সুনন্দকে।

এ তো খোদাই করা মূর্তি নয়। ফসিল। সুনন্দ বলে।

কারেক্ট। কিন্তু কীসের?

কোনো সরীসৃপের বোধহয়। গিরগিটি বা কুমীরের ছানা।

তোমার মুণ্ডু। মামাবাবু চাপা গলায় ধমকে ওঠেন। সুনন্দ থতমত খেয়ে যায়।

ব্যস ব্যস, দেখা হয়েছে। এবার তোমাদের ডিউটি করো। দরজায় লোক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বেশিক্ষণ নয়, আর পাঁচ মিনিট। আমি স্কেচটা শেষ করে নিই।

এক অজানিত রহস্যের গন্ধে আমার মন আনচান করে ওঠে। খোদাই করা মূর্তি, না ফসিল! সুনন্দের প্রাণিবিজ্ঞান চর্চা করা চোখ সেটুকু আবিষ্কার করতে ভুল করেনি। কিন্তু কীসের? সুনন্দও ভুল করেছে। যাক আপাতত মামাবাবুর কথামতো আবার মন্ত্রপাঠ আরম্ভ করি। ধোঁয়া ওড়াই।

উত্তেজনার বশে এবার আমি ধরেছি ইংরেজি আর সুনন্দ বাংলা।

পাতার পর পাতা হ্যামলেট বলে যাচ্ছি। দু-এক টুকরো অভিনয়ও দেখাচ্ছি সামনের স্তম্ভিত মুগ্ধ দর্শকবৃন্দকে। কলেজ লাইফে অসিত রায় হ্যামলেট করে মেডেল পেয়েছিল। সুনন্দ আউড়াচ্ছে নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ। এক কবিতাতেই পাঁচ মিনিট কাবার করে দেবার মতলব।

সহসা যবনিকা পতন।

পিছন থেকে মামাবাবুর গলা পেলাম, ব্যস, থামো এবার। চলো, সর্দারের ছেলেকে দেখতে যাই।

তাঁবুতে ফেরার পথে মামাবাবুকে দেখলাম চুপচাপ, অন্যমনস্কভাবে পথ চলছেন। ক্যাম্পে পৌঁছে তিনি আমাদের সঙ্গে একটি কথা না বলে বই হাঁটকাতে আরম্ভ করলেন। দেখলাম, মুঙ্গুর ছবিটা পিচবোর্ডের ওপর ক্লিপ দিয়ে আটকে পাশে রেখেছেন।

এরকম গুরুগম্ভীর ভাবগতিক দেখে আমার প্রশ্ন-টশ্ন করার সাহস উবে গেল। যদিও প্রচণ্ড কৌতূহল। নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে কথা কই। বাইরে রান্নার জোগাড়যন্ত্র করি আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি মামাবাবুর হালচাল।

একদফা চা হল।

মামাবাবুকে দিলাম এক কাপ। মুখ না তুলেই তিনি কাপ নিলেন।

চারদিক নিস্তব্ধ! শুধু টুপটাপ পাতা ঝরার শব্দ। টুংটাং বাসনের আওয়াজ। সুনন্দকে জিজ্ঞেস করি, হারে, ওটা বুঝি খোদাই করা মূর্তি, না ফসিল?

হ্যাঁ।

দেখতে কিন্তু অবিকল খোদাই করা মূর্তির মতন। যেন পাথর কুঁদে একটা কঙ্কাল তৈরি করেছে কেউ।

হুঁ, পুরো দেহটা কাদায় পড়ে ডুবে যায়। তারপর প্রাণিদেহের নরম অংশগুলো গলে গিয়ে পুরো হাড়ের অংশটুকু জমে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। আর যে কাদায় ডুবেছিল সেই কাদায় হয়েছে কাদা পাথর। দেখলি না পাথরটার রঙ কালো কিন্তু মূর্তিটার রঙ সাদাটে। দুটো তো এক পাথর নয়।

কিন্তু কীসের ফসিল?

সেইটেই তো ধরতে পারছি না! সুনন্দ চিন্তিত স্বরে বলে।

দু-ঘন্টা কেটে গেছে।

রান্না তৈরি। আজ সুনন্দ বানিয়েছে ভুট্টার ছাতুর সঙ্গে মাংস মিশিয়ে সুরুয়া, নুন মাখানো সিদ্ধ ধুঁধুল। কাছিমের সিদ্ধ ডিম এবং সামুদ্রিক শ্যাওলা।

এই শ্যাওলা মামাবাবুর আবিষ্কার। সমুদ্রের ধারে পাথরের খাঁজে দেখেই বলেছিলেন, এ শ্যাওলা আমি খেয়েছি, জাপানে। খুব উপকারী। অতএব আমরাও খাচ্ছি, কাঁচাই। ভালো করে ধুয়ে নিয়ে সামান্য টমাটো সস মাখিয়ে। আমার তত উপাদেয় ঠেকে না, কিন্তু সুনন্দ খুব ভক্ত হয়ে পড়েছে।

মামাবাবুর সাড়াশব্দ নেই। খেতে ডাকা উচিত হবে কি না ভাবছি। এমন সময় ডাক শুনলাম, সুনন্দ শুনে যাও। অসিত তুমিও এসো।

দুজনে এক ছুটে তাঁবুর ভিতরে ঢুকলাম।

দেখি, মামাবাবু মাটিতে কম্বল পেতে বসে, সামনে একখানা খোলা বই। পাশে বিছানো রয়েছে সেই স্কেচটা বইয়ের যে পাতা খোলা সেটার পাতা জোড়া কোনো ফোটোগ্রাফের ছবি। কোনো অদ্ভুত আকৃতির প্রাণী বা প্রাণীর কঙ্কাল।

মামাবাবু বইয়ের ছবিটা দেখিয়ে সুনন্দকে বললেন, চিনতে পারো? এখন মিলিয়ে দেখ এর সঙ্গে এদের দেবতাকে।

সুনন্দ তাকিয়ে রইল। এক-দুই…প্রায় দশ সেকেন্ড। চোখের পলক পড়ছে না। তারপরই সে চেঁচিয়ে ওঠে, আর্কিঅপটেরিক্স! এ তবে আর্কিঅপটেরিক্স-এর ফসিল?

না। মামাবাবু মাথা নাড়েন। আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। ভালো করে পরীক্ষা করো। তফাত ধরতে পারছ?

আমি তখন বইয়ের ছবি খুঁটিয়ে দেখছি–

কোনো জীবন্ত প্রাণী নয় বুঝলাম, ফসিলের ছবি। পাথরের গায়ে কোনো প্রস্তরীভূত কঙ্কাল। দেহের রক্তমাংস মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে। শুধু হাড়ের কঙ্কাল জমে পাথর হয়ে গেছে।

লম্বা গলা। ছোট মাথার খুলি। চোয়াল ক্রমশ ছুঁচলো হয়ে গেছে, অনেকটা কুমীরের চোয়ালের মতো গড়ন। চোয়ালের মধ্যে দু-সারি দাঁত দেখা যাচ্ছে। চার পা। সামনের পা দুটো অপেক্ষাকৃত ছোট। বাঁকানো আঙুলের মাথায় তীক্ষ্ণ নখ। প্রাণীটার লম্বা লেজও ছিল। এখন মাংস তো নেই। ছোট ছোট অস্থিখণ্ড জোড়া পাথরের লেজটা দেখতে বীভৎস।

একটা জিনিস দেখে চমকে উঠি। ছবির নিচে লেখা Archaeopteryx (ancient bird)। এই সেই প্রাচীন পাখি–

দেখলে গিরগিটির মতো কোনো সরীসৃপের ফসিল বলেই মনে হয়।

মামাবাবুর হাতে আঁকা মুঙ্গুর ছবির সঙ্গে আরকিঅপটেরিক্স-এর ফসিলের ছবিটা মিলিয়ে দেখলাম, দুই-ই একরকম। অমনি গলা, মাথা, মুখের ভিতর দাঁতের সারি। লম্বা লেজ, চারটে পা, দুটো এক ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুটো যে এক জাতের নয় সে তো কানেই শুনলাম। কিন্তু বইয়ের ঐ ছবি পাখির ফসিল হয় কী করে?

সুনন্দ একদৃষ্টে চেয়ে ভাবছে। একবার বইয়ের ছবি, একবার মুজুর স্কেচটাকে লক্ষ্য করছে।

মামাবাবু নীরব।

মামাবাবু বললেন, এই পাখি জুরাসিক যুগ, অর্থাৎ প্রায় আঠারো কোটি বছর আগেকার জীব। এর চেয়ে প্রাচীন পাখির ফসিল এখনও আবিষ্কার হয়নি।

তখনও এরা পুরোপুরি আধুনিক পাখি হয়ে উঠতে পারেনি। সরীসৃপের অনেক চিহ্ন তখনও তাদের দেহে বর্তমান।

জীবন্ত আরকিঅপটেরিক্স দেখার সৌভাগ্য অবশ্য কোনো মানুষের হয়নি। বৈজ্ঞানিকরা আন্দাজে স্থির করেছেন কেমন দেখতে ছিল সরীসৃপের অতি নিকট-আত্মীয় পক্ষি-জগতের এই আদিপুরুষ।

মামাবাবু বই খুলে একখানা ছবি দেখান—

আরেব্বাস! বলে না দিলে কে একে পাখি ভাববে? ভাবতাম নির্ঘাত সেই রূপকথার ড্রাগন। কঙ্কালের গায়ে মাংস লাগানো হয়েছে। অক্ষিকোটরে বসেছে একজোড়া হিংস্র চক্ষুতারকা। ফাঁক করা ঠোঁটের মধ্যে দু-সারি করাতের মতো দাঁত দেখা যাচ্ছে। পাখির চিহ্ন বলতে দেখলাম, একজোড়া ডানা। সামনের দু-পায়ের সঙ্গে আটকানো। আর তার পাখায়, লম্বা লেজে বড় বড় মোটা মোটা পালক। পালকগুলো নরম নরম নয়। কেমন শক্ত শক্ত, সোজা সোজা। গায়ে ওগুলো কী? আঁশ, না পালক?

মামাবাবু বললেন, দুই-ই ছিল।

ছবিতে গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলছে পাখিটা।

কত বড় হত এই পাখি? আমি জিজ্ঞেস করি।

বেশি বড় নয়। ধরো এই কাক বা পায়রার সাইজ। কই হে সুনন্দ, কিছু বলছ না যে? মামাবাবু অধীর হয়ে ওঠেন।

না, মানে কয়েকটা তফাত ধরতে পারছি, তবে ঠিক–সুনন্দ আমতা আমতা করতে থাকে।

কি, আমার স্কেচটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? বেশ এই দেখ।

একটা পেন্সিল নিয়ে উল্টো পিঠ দিয়ে তিনি পয়েন্ট আউট করতে থাকেন।

এই হচ্ছে বার্লিন মিউজিয়ামে যে ফসিলটা রয়েছে তার ফোটো। আরকিঅপটেরিক্স-এর বেস্ট স্পেসিমেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি। এখন লক্ষ্য করো, প্রথমে গলা–মুর গলা দেহের তুলনায় অনেক লম্বা এবং সরু। তারপর মাথা।

এই গিরগিটি-অবতারের মাথার খুলি বেশি বড়। চোয়াল চওড়া, দাঁতগুলোও বড় বড়। অর্থাৎ এই প্রাণীর পাখির সঙ্গে আদল আরও কম এবং পূর্বপুরুষ সরীসৃপের অনেক কাছাকাছি।

হ্যাঁ, লেজ দেখ।

এই ফসিলের লেজ বার্লিন ফসিলের তুলনায় কিছুটা লম্বা। আঙুলও এর মোটা মোটা। সোজা সোজা, আরকিঅপটেরিক্স-এর মতো বাঁকানো বাঁকানো নয়। নখ ভেঁতা। ওড়ার চেয়ে হাঁটত বেশি, তাই এইরকম আঙুলের গঠন। যেমন উটপাখির হয়।

ছবি দেখে ঠিক বুঝতে পারবে না। আরকিঅপটেরিক্স-এর ফসিল চোখে দেখলে বুঝতে দ্বীপের ফসিলের সামনের পায়ের হাড় মোটা ও লম্বা। অর্থাৎ তখনও সামনের পা দুটো একেবারে অকেজো হয়ে যায়নি। পরে দিনে দিনে সামনের পা ডানার সঙ্গে জুড়ে ডানার অংশ হয়ে যায়।

আর এই প্রাণী যে আরকিঅপটেরিক্স থেকে পুরনো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এর ডানা এবং পালক। মুঙ্গুর ডানাটি এঁকেছি আরকিঅপটেরিক্স-এর থেকে ঢের ছোট। কাদা পাথরের গায়ে ডানার ছাপ স্পষ্ট পড়েছে, হয়তো এই প্রাণী একেবারেই ডানা নেড়ে উড়তে পারত না। মাঝে মাঝে ছুটে এসে দু-ডানা মেলে খানিকক্ষণ বাতাসে ভাসত। অবশ্য আরকিঅপটেরিক্স কিছু ওড়ায় ওস্তাদ ছিল না, আধা-ওড়া আধা-হাঁটার ওপর থাকত বলে অনুমান করা হয়েছে।

মামাবাবু বলেন, এবার লক্ষ করো পালক। সবচেয়ে ইমপর্ট্যান্ট পয়েন্ট। স্কেচটা অবশ্য তেমন নিখুঁত হয়নি, তাড়াহুড়োয় এঁকেছি। আগুনের আভায় মুঙ্গুকে দূর থেকে দূরবিনে দেখে আমিও ভেবেছিলাম আরকিঅপটেরিক্স। অবশ্য একদম প্রথমে আমারও সরীসৃপ বলে ভুল হয়েছিল। তারপরই ডানার ছাপটা লক্ষ করলাম। কিন্তু কুটিরে ঢুকে কাছ থেকে দেখে চমকে গেলাম। একি! আরকিঅপটেরিক্স তো মনে হচ্ছে না–কিছু কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গড়ন যেন অন্যরকম। পাথরের দেহের কোমল অংশের ছাপ পরীক্ষা করে বুঝলাম এ আরকিঅপটেরিক্স নয়, তার পূর্বপুরুষ। কাদা পাথরে আঁশ এবং পালকের ছাপ পরিষ্কার পড়েছে। দেখলাম এটায় আরকিঅপটেরিক্স-এর তুলনায় পালক অনেক কম, আঁশ বেশি।

আপনি বুঝি লুকিয়ে দেখেছিলেন মুস্তুকে?এতক্ষণে সুযোগ বুঝে আমি প্রশ্ন করি। ঐ জন্যে তাঁবুতে এসেছিলেন রাত্তিরে? দূরবিন নিতে?

হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে। শুনলে তো মুঙ্গুকে বিদেশিদের দেখা বারণ। ডেয়ারিং বিলকেও দেখতে দেয়নি। নাচের আসরে যাওয়া মাত্র কামাউ আমাকে ভাগিয়ে দেয়। আমিও ছাড়ব না। তবু থেকে দুরবিন নিয়ে গিয়ে বিলের মতোই আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখি। চত্বরের এককোণে পাথরটা খাড়া করা ছিল।

ও তারপরে আরও ভালো করে দেখবার জন্য এই ফন্দি আঁটলেন? সুনন্দ বলে।

হ্যাঁ। মামাবাবু হাসেন। এত সহজে খেটে যাবে প্ল্যানটা ভাবিনি। যাক এ-প্রাণী যে আরকিঅপটেরিক্স থেকে কয়েক কোটি বছরের পুরনো আশা করি তা প্রমাণ হচ্ছে।

মামাবাবু বলেন, আমি এই প্রাণীকে পুরোপুরি পাখি বলব না। আবার পুরোপুরি সরীসৃপও নয়। বলব সরীসৃপ এবং পাখির মধ্যে এটাই হচ্ছে মিসিং লিঙ্ক–হ্যারানো সূত্র। আই ওয়াজ রাইট!

মামাবাবু শেষ করতেই সুনন্দ লাফিয়ে ওঠে, ওঃ এটা যে দারুণ একটা আবিষ্কার হবে মামাবাবু। চারদিকে একেবারে হইচই পড়ে যাবে!

তা একটু পড়বে। তবে আমি সবচেয়ে খুশি হয়েছি কেন জানো?

কেন? সুনন্দ বলে।

এইবার ডক্টর মিলার ধরাশায়ী হবেন। তার ধারণা, পাখি নাকি ইউরোপেই প্রথম হয়েছিল। কারো কথা মানে না। বেজায় দাম্ভিক। ফসিল দেখে বাছাধন কী করবেন তাই ভাবছি।

কিন্তু ফসিল দেখাবেন কী করে? এখান থেকে নিয়ে যাবেন কী উপায়ে? সুনন্দ বলল।

সে নিয়ে পরে মাথা ঘামানো যাবে। আপাতত খেতে দাও। বকবক করে বেজায় খিদে পেয়ে গেছে।

মামাবাবু আশ্চর্য লোক।

অমন উত্তেজনার দিনেও তার দৈনন্দিন প্রোগ্রামে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত হল না। খেয়ে উঠে যথারীতি নিশ্চিতভাবে বই খুলে শুয়ে পড়তে লাগলেন।

আমরা এদিকে ছটফট করছি। কথা বলতে চাইছি, কিন্তু মামাবাবুর যেন ও-বিষয়ে কোনো আগ্রহই নেই। আমি ও সুনন্দ অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করি। কথা বলতে পারছি না পাছে মামাবাবুর ডিসটার্বেন্স হয়। তবু ফিসফিস করে বললাম, ওঃ মামাবাবু সাংঘাতিক ফেমাস হয়ে যাবে, বুঝলি। মিসিং লিঙ্ক আবিষ্কার! সোজা ব্যাপার?–তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

ঘুম থেকে উঠে দেখলাম মামাবাবু নেই। সুনন্দ, ভেঁস ভেঁস করে ঘুমোচ্ছে। তাকে ধাক্কা দিলাম, এই ওঠ ওঠ। তিনটে বাজে।

কী হয়েছে! সুনন্দ তড়াক করে উঠে বসল।

আর কতক্ষণ ঘুমোবি! শোন না–তোকে কতগুলো জিনিস জিজ্ঞেস করব।

কী? সুনন্দ চোখ কচলাতে কচলাতে বলে।

আচ্ছা, ফসিলের বয়স জানা যায় কী করে?

আধুনিক পদ্ধতি হচ্ছে তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করা। রেডিও-অ্যাক্টিভিটি টেস্ট। প্রস্তরীভূত কঙ্কাল অথবা যে পাথরের ভিতর ফসিলটা আটকে আছে তার মধ্যে ইউরেনিয়াম, পটাশিয়াম, থোরিয়াম ইত্যাদি কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকলে রাসায়নিক পরীক্ষা করে সহজেই ফসিলের বয়স ঠিক করা যায়।

আর যদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ না থাকে?

তখন দেখতে হবে কোন ভূ-স্তরে ফসিলটা পাওয়া গেছে। সেই স্তরের বয়স কত? অথবা সেই স্তরে অন্য যেসব উদ্ভিদ বা জীবের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে তারা কত পুরনো। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা অনেক পাথর এবং ফসিলের বয়স বের করে ফেলেছেন। সেরকম কোনো জানা ফসিল বা পাথরের সঙ্গে মিলিয়ে যে ফসিলটা আবিষ্কার হল তারও বয়স অনেকটা জানা যাবে।

কিন্তু ঐ মুঙ্গু মানে দ্বীপের ফসিলের বয়স বুঝবি কী করে? রাসায়নিক পরীক্ষা হল না, কোথায় পাওয়া গেছে জানা নেই। তবে?

এফসিলটা জলের মতো সহজ। এর জন্যে পরীক্ষার দরকার হয় না। স্রেফ দেখেই বলা যায়। কারণ আরকিঅপটেরিক্স-এর বয়স বের করা আছে। এটা যে তারই পূর্বপুরুষ তোর মতো গাধাও চোখে দেখে বলে দিতে পারে!

ও! তা তুই বলতে পারলি না কেন? বললি গিরগিটি।

মামাবাবুর মতো আমার অত অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া আরকিঅপটেরিক্স-এর ফসিল আমি চোখে দেখিনি, শুধু ছবি দেখেছি। তারপর অন্ধকার ঘর, ধোঁয়া, কিন্তু পরে ঠিক বলেছিলাম, মামাবাবুর স্কেচ দেখেই। তবে তফাতটা ধরতে দেরি হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম দুটো এক নয়, কিন্তু নার্ভাস লাগছিল। আর একটু সময় পেলেই–

.

১১.

কটা দিন রীতিমতো উত্তেজনার মধ্যে কেটেছে।

আমার ও সুনন্দর আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই আবিষ্কার।

আমরা আরও দুদিন মুম্বুর সামনে যাগযজ্ঞ করেছি। ফসিল সম্বন্ধে মামাবাবুর ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে। সুনন্দও উৎসাহের মাথায় আমাকে আরও একদফা লেকচার দিয়েছে। পাখির উৎপত্তি, বিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে, মামাবাবুর ইচ্ছে ফসিলের ফোটো তোলেন। কিন্তু অন্ধকার ঘরে ফ্ল্যাস ছাড়া ছবি উঠবে না। আর আমাদের একটি বাল্বও আস্ত নেই।

দ্বীপের লোকের চোখে আমরা প্রায় অবতার বনে গেছি। মুঙ্গুকে স্বচক্ষে দেখেও যে তারা এবং আমরা উভয় পক্ষই বহাল তবিয়তে টিকে আছি এমন অভাবনীয় কাণ্ড তারা কল্পনাও করতে পারেনি।

আর কামাউ? অনুভব করছি সর্বদা সে আমাদের মস্তকে যাবতীয় অভিশাপ বর্ষণ করে। চলেছে। বয়ে গেছে, আমরা থোড়াই কেয়ার করি। তবে শুধু যে শাপমন্নি করে কামাউ হাত গুটিয়ে বসে ছিল না, অচিরেই টের পেলাম হাড়ে হাড়ে।

ইতিমধ্যে আমরা এক নতুন তথ্য জেনেছি।

মুঙ্গু দর্শনের পরের দিন। মামাবাবু আমাদের বলেছিলেন, টোটো এলে আমায় ডেকো। ওর সঙ্গে কথা আছে। সন্ধ্যায় টোটো আসতেই মামাবাবুকে ডাকলাম।

মামাবাবুকে কাছে আসতে দেখেই টোটো কঁচুমাচু হয়ে গেল। রাশভারি মামাবাবুকে সে এড়িয়ে চলত। হাসিমুখে বললেন, টোটো, খবর কী? সর্দারের ছেলে কেমন আছে?

একদম ভালো হয়ে গেছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বেশ বেশ। সুসংবাদ। আচ্ছা এই মুহূকে তোমরা কদ্দিন পুজো করছ? অনেকদিন?

আমরা পুজো করব কেন? ও তো কামাউয়ের দেবতা! আমরা কোনো মূর্তিপুজো করি না।

সেকি! আমরা তিনজনেই অবাক।

কামাউয়ের দেবতা, কিন্তু তোমাদের নয়? আশ্চর্য। কামাউ কি তোমাদের জাতের লোক নয়? মামাবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

নয়ই তো, ও ভিন্ন জাতের লোক। সাদা মানুষেরা ওকে ধরে নিয়ে যায়। দাস করে রেখে, খুব খাঁটিয়েছিল। অত্যাচার করেছিল। তারপর একদিন সে পালায়। আমাদের গায়ে এসে আশ্রয় চায়। তখন থেকে আমাদের সঙ্গে আছে।

তা বাইরের জাতের লোক কামাউ তোমাদের মাহুঙ্গা হল কী করে?–মামাবাবু গভীর আগ্রহে প্রশ্ন করেন।

ও কিনা অনেক ওষুধ-টষুধ জানে। আর ম্যাজিক দেখাত। তাই আমাদের জাতে ওর খুব খাতির হল। তারপর আমাদের পুরনো মাহুঙ্গা মরে গেলে ও হল নতুন মাহুঙ্গা।

মাহুঙ্গা কী? আমি বলি।

উইচ-ডক্টর! ওঝা। মামাবাবু উত্তর দিলেন।

অ্যাঁ! ওঝা হয়ে গেল, কেউ আপত্তি করল না? আমি বললাম।

ও বাব্বা, কার অত সাহস! কামাউ ভীষণ লোক। সবাই ওকে ভয় করে। তাছাড়া অসুখ-বিসুখ হলে, সাপে কাটলে, জানোয়ারে কামড়ালে বা দুষ্ট অপদেবতা ভর করলে ও ছাড়া আমাদের গতি নেই।

তুমি এত কথা জানলে কী করে? মামাবাবু বলেন।

ঠাকুমার মুখে শুনেছি। ইস, কী ভালো যে গল্প বলত ঠাকুমা, যদি শুনতে, কত রকম কথাই জানত। কিন্তু কী করে শুনবে, ঠাকুমা আমার মরে গেছে চার বছর হল।

টোটো তার ঠাকুমার আরও কিছু প্রশস্তি গাইতে যাচ্ছিল, মামাবাবু থামিয়ে দিলেন—

আচ্ছা এই মূর্তি কামাউ কোত্থেকে পেয়েছে? সঙ্গে নিয়ে এসেছিল?

মোটেই না। আমাদের গ্রামে আসার কিছুদিন পরে কামাউ হঠাৎ মুহূকে পায়। গ্রামের কাছে ছিল একটা পাথুরে খাদ। কামাউ খাদের পাশে একদিন বসে আছে, এমন সময় চড়চড় করে পাথর ফেটে গেল, ভিতর থেকে আবির্ভূত হলেন মুঙ্গু। কামাউ তখুনি পাথর কেটে তাকে নিয়ে এল।

বাঃ চমৎকার, মিলে যাচ্ছে। মামাবাবু আমাদের উদ্দেশ করে বললেন। ডেয়ারিং বিলও দেখেছিল গ্রামের কাছে এক উপত্যকা, সেখানে কালো রঙের পাথরের স্তর।

এ কদ্দিন আগের ঘটনা? মামাবাবু টোটোকে জিজ্ঞেস করলেন।  কদ্দিন হবে? টোটো গালে হাত দিয়ে ভাবল। ঠাকুমা বলেছিল এখানে আসার বেশ কিছু বছর আগে।

কিন্তু কামাউয়ের দেবতার সামনে তোমরা নাচগান করো কেন? সুনন্দ কিঞ্চিৎ উত্তপ্ত হয়ে বলল।

আজ করছি, প্রথমে করতাম না। ঠাকুমা বলেছে, প্রথম প্রথম কামাউ নাকি একা একা কুটিরের ভিতর মুঙ্গুর পুজো করত। করে সে নাকি দৈবশক্তি পায়। আমাদের জাতের কেউ কাছে যেত না, আমল দিত না। পরে যখন ওর দাপট বাড়ল, গ্রামে কোনো বড় উৎসব হলে ও মুলুকে নিয়ে আসত নাচ-গানের আসরে। প্রথম দিকে কেউ কেউ বলেছিল, ওর দেবতার সামনে আমরা নাচব কেন? কিন্তু বেশির ভাগ ওর দলে। কামাউকে তাদের দারুণ বিশ্বাস। তাছাড়া লোকটা ভয়ঙ্কর। ঠাকুমা বলত, ও নাকি বাণ মারতে জানে। তোমার ওপর কোনো কারণে চটে গেছে, রাত্তিরে তুমি ঘুমোত গেলে, কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। ওমা, সকালে সবাই দেখবে মরা কাঠ হয়ে আছ।

হুম্। তোমার ঠাকুমা দেখছি অনেক গল্প বলেছে।

মামাবাবুর মন্তব্যে উৎসাহিত হয়ে টোটো বলল, ঠাকুমা যে কত গল্প জানত! সব মনে ছিল।

বেশ শুনব আর একদিন। মামাবাবু চিন্তান্বিতভাবে তাঁবুতে ঢুকে যান।

রাত্রে মামাবাবু বললেন, এতক্ষণে বুঝলাম কামাউয়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কেন সর্দার আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল। ফন্দিটা এঁটেছিলাম বটে, কিন্তু রীতিমতো সন্দেহ ছিল। কতটা খাটবে। নিজেদের দেবতা হলে খুব সম্ভব ছেলের প্রাণ গেলেও সর্দার ধর্মের আইনকানুন ভাঙত না। আমাদের মূর্তি দেখতে দিত না। কিন্তু ও তো কামাউয়ের দেবতা। কাজেই ছেলের প্রাণ বাঁচাতে নিয়ম বদলানো যেতে পারে।

ঐ জন্যে কামাউয়ের সঙ্গে সর্দারের অত তর্ক হচ্ছিল। সুনন্দ বলল, উঃ! কী ক্ষেপেছিল ওঝাটা, কিছুতেই দেখতে দেবে না। শেষে সর্দার জোর করে অর্ডার দিল তবে–

প্রথমবার মুঙ্গুদর্শনের পর চতুর্থ দিন।

আমি ও সুনন্দ বনপথে আসছি হঠাৎ সর্দারের সঙ্গে মুখোমুখি। দুজন সঙ্গী নিয়ে সে আসছিল। সর্দারকে দেখে সুনন্দ হেঁকে বলল, এই যে সর্দার, কোত্থেকে? তারপর তোমাদের নৌকো আবার ওপারে যাচ্ছে কবে?

দিন পনের-ষোল পরে।

বেশ বেশ। যাবার দিন দুই আগে আমাদের খবর দিও কিন্তু। একেবারে শেষ সময়ে বললে হু করে বেরনো মুশকিল। গোছগাছ করতে হবে, সংসার পেতে বসেছি।

সুনন্দের উচ্ছ্বাসে সর্দারের কিন্তু বিন্দুমাত্র ভাবান্তর দেখা গেল না। বলল, তোমরা এখন যাবে না।

অ্যাঁ! সে কি! কথাটা যেন বিশ্বাস হয় না। বোধহয় শুনতে ভুল করেছি।

তোমাদের এখন যাওয়া হবে না। সর্দার পুনরুক্তি করে।

তবে কবে যাব? আমাদের ওষুধ তো শেষ হয়ে যাবে দিন পনেরোর মধ্যে। তারপর এখানে থাকব কী করতে?

নতুন ওষুধ বানাও। এদেশ থেকে যখন এই ভীষণ রোগ একদম চলে যাবে, আর একটা লোকও হোমার অপদেবতার কবলে পড়বে না, তখন তোমাদের ছুটি। আমাদের অভিশাপ মুক্ত করে দাও, তোমাদের সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।

কিন্তু সর্দার ওষুধ বানাব কী করে? সেসব মালমশলা এদেশে পাব কোথায়? দেশে যাই, অনেক ওষুধ তোমাদের বানিয়ে দেব। আমরা নিজেরা ওষুধ নিয়ে এসে রোগ একেবারে তাড়িয়ে দেব দ্বীপ থেকে।

না, এখন যাওয়া চলবে না। আগে কাঁপুনিরোগ সারুক। সর্দার দৃঢ় স্বরে বলে।

কী মুশকিল, ওষুধ পাব কোথায়? বানাও।

বারবার ঐ এক কথা। সুনন্দ অধীর হয়ে ওঠে। এখানে বসে ওষুধ বানানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়–

হ্যাঁ সম্ভব, আমি জানি। সর্দারের গলায় উম্মা ফুটে ওঠে।

কী করে জানলে? সুনন্দ আশ্চর্য হয়ে বলে, কে বলল?

কামাউ বলেছে। ও তোমাদের কাছে ওষুধ শিখতে গিয়েছিল। তোমরা বলেছ–ওষুধ বানাতে পারি, কিন্তু আমরা ছাড়া অন্য লোকের হাতে সে-ওষুধ কাজ করবে না।

মিথ্যে কথা। ডাহা মিথ্যুক। আমাদের কাছে ও ওষুধ শিখতে গিয়েছিল ঠিক। আমরা এও বলেছি ওষুধ যার-তার হাতে কাজ করে না। কিন্তু এখানে ওষুধ বানাতে পারব, একথা কক্ষনো বলিনি। আসলে ও আমাদের বিপদে ফেলতে চায়। আমাদের হিংসেয় একথা বলেছে।

হিংসে কেন?

ও অ্যাদ্দিন ওঝাগিরি করছে, কিন্তু ওর দাওয়াইয়ের চেয়ে আমাদের ওষুধের জোর বেশি। রোগ সারছে। লোকে আমাদের খাতির-যত্ন করছে। এটা ও সহ্য করতে পারছে না।

সর্দার ঘাড় নাড়তে থাকে। আমাদের যুক্তি তার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। উঁহু, তোমরা এত ম্যাজিক মন্ত্র-তন্ত্র জানো, আর ওষুধ বানাতে জানো না। তা কি হয়?

বিশ্বাস করো সর্দার, সত্যি পারি না। সুনন্দের কণ্ঠে অনুনয়, আমাদের মিছিমিছি। আটকে রেখে কোনো লাভ নেই।

সর্দারের ভ্রমরকৃষ্ণ মুখমণ্ডল রাগে বেগুনি হয়ে গেল। কণ্ঠস্বর গম্ভীর, কর্কশ।

পারবে। পারতেই হবে। তোমরা আমাকে ধোঁকা দিচ্ছ। এ তোমাদের পালাবার মতলব। সব বুঝি। আমি অত বোকা নই। একবার দেশে ফিরলে আর তোমাদের পাত্তা পাব ভেবেছ? দেখ, আমাদের মরণের মুখে ফেলে রেখে তোমরা দিব্যি সটকান দেবে, তা হচ্ছে না। মতলব করে ওষুধ যদি না বানাও, আমরা যদি মরি, জেনে রেখো তোমরাও প্রাণে বাঁচবে না। চল–

সর্দার তার সঙ্গীদের প্রতি আদেশ দিয়ে সোজা হাঁটা দিল।

আমরা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

সুনন্দ হঠাৎ তার লম্বা পা ফেলে গ্রামের দিকে এগোতে থাকে।

কোথায় চললি?

কামাউয়ের খোঁজে।

কেন?

কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেব শয়তানটাকে।

দাঁড়া। আমি দৌড়ে গিয়ে তার হাত চেপে ধরি।

বলি, কোনো লাভ নেই। কামাউকে ঠ্যাঙ্গালেই সর্দার আমাদের কথা বিশ্বাস করবে ভেবেছিস? বরং কেস আরও খারাপ হবে। এখন টেস্টে চল।

মামাবাবু সব শুনে বললেন, হুম? প্রতিশোধ! খুব স্বাভাবিক। আমরা ওর ভাত মারার জোগাড় করেছি, ও কি ছেড়ে কথা কইবে? আমি আঁচ করেছিলাম ও কিছু মতলব ভাজছে। যাকগে ভালোই হল।

সে কী! আমরা হতবাক।

মামাবাবু! সুনন্দ কাতরে ওঠে, ভবিষ্যৎটা ভেবে দেখেছেন? দুদিন পরে ম্যালেরিয়ার ট্যাবলেট শেষ। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও খতম, এদের হাতে বেগুনপোড়া হতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।

আমারও নেই। অসিত, তোমার?

মোটেও না। মরি মরব, বীরের মতো মরব। খুঁটির আগায় রোস্ট হচ্ছি না।

ঠিক ঠিক!

তবে যে বলছেন ভালোই হল? আমি প্রশ্ন করলাম।

কারণ আমি একটা দোটানায় পড়েছিলাম। তার সমাধান হয়ে গেল।

কীরকম?

সমস্যাটা হল, যদি এদের নৌকো চেপে ফিরে যাই একজনের কিন্তু যাওয়া হচ্ছে না।

কার?

মুঙ্গুর। এই মহামূল্যবান বৈজ্ঞানিক সম্পদটি ছেড়ে রেখে যাই কী করে? কেন ফিরে এসে নিয়ে যাব। সুনন্দ বলল। মামাবাবু হাসেন। কী ভেবেছ? এরা তোমায় তাদের দেবতাকে দান করবে?

তবে জোর করে নেব। তাহলে এদের তুমি চেন না। একটি প্রাণ বেঁচে থাকতে ওরা দেবতা ছাড়বে না। সুনন্দ বলল, কিন্তু দেবতা তো কামাউয়ের, অন্যদের অত মাথাব্যথা কীসের?

তাহলেও দেবে না। কারণ আমরা বিদেশি। মাঝ থেকে জোরজার করতে গিয়ে হয়তো চিরকালের মতো ফসিলটা হারাব এবং অনর্থক কিছু প্রাণ নষ্ট হবে।

তাহলে উপায়?

উপায় পালানো। নৌকো চুরি করে আমরা লুকিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেব। মুহূকেও সঙ্গে নেব চুরি করে। নিরাপদে ফিরে যাব, নাকি জেনে শুনে এত বড় রিস্কটা নেব? তাই ভাবছিলাম। আমি একা থাকলে দ্বিতীয় পন্থাটাই ধরতাম, কিন্তু তোমরা রয়েছ, মাঝিরা আছে। ভালোয় ভালোয় উপকূলে পৌঁছুতে পারব কি না কে জানে! যাক, আপাতত একটি পথই এখন খোলা।

কামাউয়ের মুঙ্গুকে চুরি করবেন? সুনন্দের মুখ হাসি-হাসি।

কামাউয়ের দেবতা বলেই তো চুরি করব। নইলে যদি জানতাম, এই উপজাতির কাছে এ-মূর্তি অতি পবিত্র, মূর্তি হারালে তারা বিষম ব্যথা পাবে মনে, বিজ্ঞানের খাতিরেও আমি এ-কাজ করতে পারতাম না। কিন্তু সেদিন টোটোর কথায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে দ্বীপের লোকেরা কামাউয়ের মুহূকে ভক্তি করে না, ভয় করে।

আমি বললাম, কামাউ নিজেই কত মুঞ্জুকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে সন্দেহ আছে। ধূর্ত লোক, নিজের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে একটা অদ্ভুত দেখতে মূর্তি খাড়া করেছে। এটা তার পুরুষানুক্রমের দেবতাও নয়।

মুঙ্গু উধাও হলে কামাউ দারুণ প্রেস্টিজ খোয়াবে। লোকে ভাববে দেবতা নেই, অতএব তার দৈবশক্তিও বুঝি গেল এবার। সুনন্দ খুশিমুখে মন্তব্য করে।

আশা করছি তোমাদের মনস্কামনা পূর্ণ হবে। মামাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা ওর ওপর খুব চটে আছ দেখছি। যাক। বলো নৌকো চালানো কতটা রপ্ত করলে? মনে রেখো ছিপনৌকো নাও পাওয়া যেতে পারে। ওগুলো থাকে ডাঙায়, অনেক দূরে। যেতে হবে ডিঙি বা মাঝারি নৌকো চড়ে।

সনন্দ চিন্তিত স্বরে বলল, সেটা এক হিসেবে ভালোই। কারণ ডিঙি আমরা বেশি চড়ি। চিপ বাইতে শিখিনি। কিছুটা আমি রপ্ত করেছি। অসিতও মোটামুটি পারবে। তবে ঢেউ বেশি উঠলে সামলাতে পারব কি?

আকাশ পরিষ্কার দেখে বেরোতে হবে। সমুদ্র যেদিন শান্ত, দিন নয়, বলা উচিত রাতে। কারণ রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে পালাতে হবে। তবে যতটা শক্ত ভাবছ তত কঠিন নাও হতে পারে। দ্বীপের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মোজাম্বিক স্রোত। এই তে গিয়ে ঠেকেছে তটভূমির গায়ে। নৌকো কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমে চালিয়ে নিয়ে মোজাম্বিক স্রোতের টানে পড়তে পারলেই আর ভাবনা নেই। ঠিক হাজির হয়ে যাব মহাদেশের কূলে। শুধু নৌকো ভাসিয়ে রাখতে পারলেই হল। বন্দী মাঝি দুজনকেও সঙ্গে নেব। তারাও সাহায্য করতে পারবে।

আমি বললাম, মাঝিদের মুক্ত করতে গিয়ে আবার নতুন হাঙ্গামা বাধবে না তো? যদি ধরা পড়ে যাই!

কিন্তু ওদের ফেলে রেখেও তো যাওয়া যায় না। আমরা পালালে ওদের পরিণতি কী দাঁড়াবে ভেবে দেখেছ? স্রেফ থোড় কুচো করে ফেলবে রাগে। অবশ্য সবচেয়ে কঠিন কর্ম কী করে মুত্যুকে চুরি করা যায়। যাহোক, এসব প্ল্যান আমি ভেবে-চিন্তে ঠিক করছি। তোমাদের কর্তব্য, যতটা পারো নৌকো চালানো প্রাকটিস করা। তবে সাবধান, ওরা যেন ঘুণাক্ষরেও আমাদের মতলব টের না পায়। তাহলে সর্বনাশ ঘটবে।

.

১২.

এরপর ক-দিন ধরে আমরা প্রবল উৎসাহে নৌকো চালানো প্র্যাকটিস করলাম। কামাউকে দেখতাম দূরে থেকে বাঁকা দৃষ্টি দিয়ে আমাদের কার্যকলাপ লক্ষ করছে। সুনন্দ মাঝে মাঝে কটমটিয়ে তাকে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ব্যাটা শকুনি, ব্যাটা শয়তান। একবার বাগে পাই তো দেখাই মজা।

দিন চারেক পর মামাবাবু তার প্ল্যান উপস্থিত করলেন।

সকালবেলা চা খেতে খেতে বললেন, আমরা পরশু পালাব।

পরশু কেন?

কারণ ঐ দিন দ্বীপে এক উৎসব আছে। হই-হল্লাটা একটু গুরুতর হবে। উৎসবের শেষে সবাই নিঃসাড়ে ঘুমোবে, সেই ফাঁকে–

মুঙ্গু? বন্দী মাঝি দুজন?

হুঁ, বলছি সব। মাঝিদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি। দেখেছ রাত্রিতে তারা একটা কুটিরে বন্দী থাকে। হাত শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে খুঁটোর সঙ্গে। দুজনে ঘরের দুপ্রান্তে। এক হাতে সে গিট খোলা অসম্ভব। কিন্তু একখানা ধারালো ছুরি পেলে তারা অনায়াসে বাঁধন কেটে প্রস্তুত হয়ে থাকবে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে শিসের সংকেত শুনলেই বেরোবে।

বেরোবে কী করে? আমি বলি, বাঁশ মাটির দেওয়াল বেশ মজবুত। দরজা ঝাঁপ দিয়ে আটকানো থাকে—

বেরোবে চাল ফুটো করে। ঘাস-পাতার চাল ফাঁক করা শক্ত নয়। হা, ওদের একটা ছুরি দিয়ে আসতে হবে। অসিত, তুমি এই ভার নাও। সুযোগমতো কুটিরের পিছনে দক্ষিণ কোণে গিয়ে আস্তে দু-বার শিস দেবে। ভিতর থেকে উত্তর আসবে–একবার শিস। দেখবে মাটি থেকে দু-ফুট ওপরে দেওয়ালের গায়ে ছোট ফুটো। আমি করে রেখেছি। পাশে ক্রশ চিহ্ন। তুমি খোলা ছুরিটা ফোকরের মধ্য দিয়ে গলিয়ে ফেলে দেবে। ব্যস, ছুরি পড়বে আবদুলের পাশে। পালাবার চরম সংকেত পাওয়ামাত্র ওরা বেরিয়ে এসে সোজা সমুদ্রতীরে হাজির হবে।

এইবার আসছে মুঙ্গু অপহরণপর্ব। এইটাই সবচেয়ে জটিল কাজ। তোমরা দেখেছ মঙ্গুর কুটিরের দরজা খোলা হয় দিনে একবার। সান্ধ্য আসর বসবার মুখে। কামাউ তার পুজো করে। তারপর চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চিন্ত। কেউ মুঙ্গুর খোঁজ করে না। অতএব এই সময়ের মধ্যে কাজ হাসিল করতে হবে। গিরগিটি অবতারকে সরাতে হবে উৎসবের শেষে। যখন সকলে নেচে-কুঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। দিনের বেলা বা উৎসব চলার সময় চুরি করা অসম্ভব, কারণ যে কারো চোখে পড়ে যেতে পারি। চত্বর থেকে পরিষ্কার দেখা যায় কুটিরটা। সুনন্দ, এটা তোমার ডিউটি। পাতলা দেয়াল কেটে ভিতরে ঢুকবে। তারপর ফসিলটা নিয়ে সোজা সমুদ্রতীরে চলে যাবে, নৌকোর কাছে। আমি আর অসিত যাব ক্যাম্প থেকে। দু-চারটে প্রয়োজনীয় জিনিস শুধু সঙ্গে নেব। আর আহত মাঝিদের ডেকে নেব। অতঃপর নৌকো জলে নামানো ও দুর্গা বলে সাগরের বুকে পাড়ি।

ভোররাত্রে বেরোলে একটা মাত্র বিপদ থেকে যাচ্ছে যে আমরা দ্বীপ থেকে বেশি দূরে সরে যেতে পারছি না। ভোরে উঠে দ্বীপবাসীরা যখন টের পাবে পাখি পালিয়েছে, তারা তৎক্ষণাৎ ছিপ নিয়ে তাড়া করবে। হয়তো মাঝপথে ধরেও ফেলতে পারে। যাহোক, এ ঝুঁকিটুকু আমাদের নিতেই হচ্ছে, উপায় নেই। আরও আগে বেরোতে পারলে ভালো হত। এদের মুঠো থেকে অনেক দূরে সরে যেতে পারতাম।

সুনন্দ বলল, যদি উৎসব ছাড়া অন্য কোনোদিন পালাই। সেসব দিন অনেক আগে এদের আসর ভাঙে।

সেসব দিন সম্ভব নয় ঐ কামাউ বুড়োর জন্যে।

কেন?

কামাউয়ের ঘর মুঙ্গুর কুটিরের একদম লাগোয়া। আমি লক্ষ্য করেছি, বুড়োটা রাত্রে ভালো ঘুমোয় না। প্রায়ই জেগে থাকে। খক খক করে কাশে। লোকটার আবার কান ভারি সজাগ। তবে উৎসবের দিন প্রচুর নেচে-কুঁদে আর কড়া নেশার পানীয় গিলে ঘুমটা নিশ্চয় ওর গাঢ় হবে। তাছাড়া উৎসবের পর বেশিরভাগ সময়ই এরা কুটিরে ঘুমোতেই যায় না, চত্বরেই লম্বা হয়। সুতরাং পরশুই উপযুক্ত দিন।

বুঝলাম সব দিকে হুঁশ রেখেই মামাবাবু পরিকল্পনা তৈরি করেছেন।

মামাবাবু বললেন, সাবধান! খুব সতর্ক হয়ে কাজ করবে। একটু সন্দেহ হলেই সঙ্গে সঙ্গে কাবার!

সমস্ত দিন এক চাপা উত্তেজনার মধ্যে আছি। নানা সম্ভব-অসম্ভব আশঙ্কা মনের মধ্যে ঘরপাক খাচ্ছে। কাউকে বলছি না। ভাববে ভীতু। সুনন্দও ঘাবড়েছে। তবে ভান করছে। যেন এ তো ছেলেখেলা। শুধু একবার মনের ক্ষোভ প্রকাশ পেল।

ব্যাজার মুখে বলল, যত শক্ত কাজ দেখছি আমার ঘাড়ে। ঐ ভারী পাথরখানা বয়ে নিয়ে অতটা পথ হাঁটা! বাপরে! দেশি-বিদেশি যত জানা দেবদেবী আছেন সবাইকে স্মরণ করছি। হে মা, হে বাবা, ভালোয় ভাসোয় পার করে দিও।

সত্যি বলতে কি একটু উৎসাহও লাগছে। অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়েছি কত। এবার একেবারে হাতেনাতে এক্সপেরিমেন্ট। যেমন বিচিত্রভাবে আমাদের এই দ্বীপে আগমন, তেমনি রোমাঞ্চকর প্রস্থান (পলায়নও বলতে পারেন। দেশে ফিরলে নির্ঘাত হিরো বনে যাব। খবরের কাগজে ছবিটবি বেরিয়ে যাবে। অবশ্য যদি ফিরি।

সেদিন রাতে টোটোর সঙ্গে গল্প হচ্ছিল তাঁবুর সামনে বসে। ছেলেটার ওপর মায়া পড়ে গেছে। বেচারা হঠাৎ জানবে তার বন্ধু মাহিণ্ডিরা পালিয়েছে। পেটুক মানুষ, ভালো-মন্দ বিদেশি খানা আর জুটবে না।

টোটো বলছিল তাদের জাতির অতীত গৌরবের কাহিনি।

বাবা-জ্যাঠারা বলে, দূর দূর এ কী জীবন? শিকার নেই। যুদ্ধ নেই। তোরা ছাগল বনে গেছিস। কী সব দিন ছিল আমাদের সেই জঙ্গলের দেশে। বর্শা দিয়ে সিংহ শিকার দেখেছিস? তির ছুঁড়ে প্রকাণ্ড দাঁতাল হাতিকে পেড়ে ফেলতাম। হায়, সেসব দিন গেল কোথায়! এইটুকু দ্বীপে বন্দী হয়ে আছি। কাজের মধ্যে কেবল নৌকো চড়া। ছছাঃ ছেঃ! যতসব মেয়েলিপনা! তার চেয়ে তির ছুঁড়ে নারকেল পাড়া ঢের শক্ত।

এ-দ্বীপে তোমরা এলে কেন? আমি প্রশ্ন করি।

বাধ্য হয়ে, যুদ্ধে হেরে। আমার তো এখানেই জন্ম। শুনেছি পাশের গ্রামের ওঙ্গামিদের সঙ্গে ছিল আমাদের দারুণ শত্রুতা। বার বার যুদ্ধ হত। ওঙ্গামিরা পারত না। শেষে একবার তারা অতর্কিতে আক্রমণ করল। আমরা প্রস্তুত হবার সুযোগটুকু পেলাম না। আমাদের বেশির ভাগ পুরুষ মরল। বাকিরা মেয়ে আর বাচ্চাদের নিয়ে পালালো। ওসামিরা সহজে ছাড়েনি। সমুদ্রতীর অবধি পিছন পিছন তেড়ে এসেছিল। একেবারে ঝাড়ে-বংশে শেষ করে দেবার মতলব আর কী! ওদের ভয়েই আমরা এই দ্বীপে পালিয়ে আসি। দেখ না, আজও ওপারে গিয়ে আমরা বেশিদিন থাকি না। ঐ ওঙ্গামিদের ভয়ে। তবে আবার ফিরব।

কবে?

সর্দার বলেছে। আমরা আরও সংখ্যায় বাড়ি। যুদ্ধ জানা যুবকে যখন আমাদের দল বেশ ভারী হবে তখন ফিরব সেই জঙ্গলের দেশে। ওঙ্গামিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে। কিন্তু ইদানীং সবাই খুব মুষড়ে পড়েছে। এই মারাত্মক কাঁপুনি জ্বরে আমাদের গায়ের জোর কমে যাচ্ছে। লোকও মরছে। ওঙ্গামিদের সঙ্গে লড়ব কী করে?

ওঙ্গামিদের সঙ্গে তোমাদের শত্রুতার কারণ কী?

কেন জানো? ওগামিরা ছিল ঐ অঞ্চলের প্রভু। আমরা গিয়ে জমিতে ভাগ বসাতে ভয়ানক চটে যায়। ফলে প্রাণপণে আমাদের তাড়াতে চেষ্টা করে।

ও তোমরা বুঝি অন্য দেশ থেকে এসেছিলে? কোথায় ছিলে আগে?

আমরা আগে ছিলাম আরও গভীর বনের রাজ্যে। আকাশছোঁয়া এক পাহাড়ের গায়ের কাছে আমাদের গ্রাম। সেই তো আমাদের আসল দেশ।

সেখান থেকে এলে কেন?

ভয়ে।

কীসের ভয়?

মোটো। মালিমা ইয়া মোটো।

মামাবাবু! সুনন্দ ডাকে।

কি? মামাবাবু বই থেকে মুখ তোলেন।

মোটো। মালিমা ইয়া মোটো মানে কী?

মোটো মানে আগুন। মালিমা ইয়া মোটো মানে হচ্ছে আগ্নেয়গিরি বা অগ্ন্যুৎপাত। কোথায় শুনলে কথাটা?

টোটো বলছে, ওদের আদি বাসস্থান নাকি ছিল গভীর জঙ্গলে। পাহাড়ের কোলে। সেখান থেকে পালিয়ে আসে আগুনের ভয়ে।

তাই নাকি? মামাবাবু কৌতূহলী হলেন, ব্যাপারটা কী হয়েছিল টোটো?

টোটো বলল, আমি ঠাকুমার মুখে শুনেছি। উঃ, সে এক ভীষণ ব্যাপার। আমার বাবা তখন ছোট, এই আমার মতো। ঠাকুমার মুখে সে-গল্প শুনলে বুঝতে কী সাংঘাতিক কাণ্ড! আমি তেমন জমিয়ে বলতে পারব না। কিন্তু ঠাকুমাকে আর পাবে কোথা? ঠাকুমা তো মরে গেছে।

বেশ তুমিই বলো শুনি।

টোটো বলল, ঐ পাথরের মধ্যে ছিল অগ্নিদেবতার বাস। মাঝে মাঝে গুড়গুড় আওয়াজ উঠত। চোঙার মতো মাথা দিয়ে বেরতো কালো ধোঁয়া। গরম হাওয়া। শব্দটা বাড়তে লাগল। সবাই বলল, দেবতা রেগেছে। ভালো করে পুজো দিতে হবে। কিন্তু পুজো দেবার আর সময় পাওয়া গেল না। সেদিন রাত্তিরে পাহাড়ের মাথা থেকে ঝলকে ঝলকে অগ্নিদেবের গরম নিশ্বাস বের হতে লাগল। মাটি তেতে উঠল। আকাশে ধোঁয়া, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সবাই বলল, পালাও। এক্ষুনি। দেবতার রোষে নইলে কেউ রক্ষা পাবে না। গ্রামসুদ্ধ পালিয়ে চলল। পালাতে পালাতে আরম্ভ হল আগুনবৃষ্টি। জ্বলন্ত পাথর ছুটতে লাগল। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এল শত শত আগুনের ধারা। মানুষ পশুপাখি সবাই ছুটল দিশেহারা হয়ে, প্রাণের ভয়ে। অনেকে মরল পাথরের ঘায়ে। আমার ঠাকুর্দা এক হাতে ঠাকুমাকে অন্য হাতে বাবাকে ধরে হিচড়াতে হিচড়াতে টেনে নিয়ে চলল। উঃ! কী ভীষণ রাত্রি! যারা বাঁচল, কোনোরকমে গিয়ে উঠল দূরে এক পাহাড়ে।

পরদিন দুপুর নাগাদ এক বিকট শব্দ। সে কী কান-ফাটানো আওয়াজ! মনে হল সৃষ্টি বুঝি ভেঙে গুঁড়িয়ে উড়ে গেল। প্রচণ্ড আলোর ঝলক ও ভয়ঙ্কর শব্দে অনেকক্ষণ সবাই হতবুদ্ধি হয়ে রইল। সম্বিত ফিরতে দেখল আগুন দেবতার বাসা সেই উঁচু পাহাড়ের ডগাটা ফেটে চুরচুর হয়ে উড়ে গেছে। আর সেই মাথাভাঙা পাহাড়ের ভিতর থেকে নেমে আসছে অজস্র জ্বলন্ত স্রোত। মস্ত মস্ত পাথর ছিটকাচ্ছে। আবার ছোট ছোট। অনেক দূরে এক সমতলে এসে সবাই থামল। সেখানে তৈরি করল নতুন গ্রাম। জায়গাটা চমৎকার ছিল। প্রচুর শিকার। কিন্তু জুটল এক নতুন হাঙ্গামা,–ওঙ্গামি। তাদের সঙ্গে ঝগড়া আর কিছুতেই মিটল না।

এই দ্বীপেও অগ্নিদেব আছে নাকি? মামাবাবু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করেন।

কে জানে, থাকতে পারে! তবে শুনিনি তো কখনও। থাকলে তো মরেছি। ঠাকুমা বলত, অগ্নিদেব ঘুমিয়ে থাকে মাটির নিচে, একদিন হঠাৎ জাগে। তখন তার মেজাজ হয় অগ্নিশর্মা। ধারে কাছে কারো তখন রক্ষা নেই।

টোটো, তুমি দেখছি বড্ড ভয় পাও অগ্নিদেবকে। মামাবাবু ঠাট্টা করতে লাগলেন।

ডরাব না? কী রাগী দেবতা! আমি আর কী ডরাই! আমার বাপ-জ্যাঠা, ঐ দারুণ সাহসী বীর সর্দার সব্বাই অগ্নিদেবের নামে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। একটা দড়াম করে শব্দ হোক, খানিকটা আগুন দেখা যাক, দু-চারটে পাথর ছুটুক–আর চেঁচিয়ে বলুন–অগ্নিদেব সাবধান! ঊর্ধ্বশ্বাসে সব পালাবে, অন্ধের মতো। একবার পিছন ফিরে দেখতে ভরসা পাবে, গাছ পড়ল না মশাল ছুঁড়ল কেউ। আমরা ছয় চাঁদ অন্তর একবার ঘটা করে অগ্নিদেবের পুজো দিই।

টোটো ফিরে যেতেই মামাবাবু বলে উঠলেন, আমাদের প্ল্যান কিছু বদলাতে হবে।

কীরকম? আমরা উদ্বিগ্ন হই।

পরশু আমরা সমুদ্রযাত্রা করছি না। সেদিন হবে শুধু এক অংশ-মুঙ্গু অপহরণ পর্ব।

তারপর?

তারপর সমুদ্রে ভাসছি, মানে ফাইনালি চম্পট দিচ্ছি যে কোনোদিন সুবিধা মতো।

সুনন্দ বলল, পরদিন কুটিরের দরজা খুলে যখন দেখবে মুঙ্গু নেই, তখন যদি আমাদের সন্দেহ করে?

দরজাই থাকবে না, তো খুলবে কী? মুঙ্গুর কুটির বা দরজার কোনো চিহ্নই থাকবে না।

সেকি! আমরা তো অবাক।

কী করে?

মাফিয়া-যাত্রার সময় ডক্টর হাইনের অর্ডারমাফিক কয়েকটা ডিনামাইট স্টিক সঙ্গে নিয়েছিলাম মনে আছে? মনে হয় স্টিকগুলো নষ্ট হয়নি, ফাটবে। পরশু উৎসবের শেষে যখন এরা অচেতন হয়ে ঘুমোবে, তোমরা দুজনে মুঙ্গুর কুটিরের দেয়াল ফুটো করে। ফসিলটা সরাবে। নিয়ে আসবে ক্যাম্পে। না, ক্যাম্পে রাখা ঠিক হবে না। কাছাকাছি কোনো গর্তটর্ত আছে, ফসিলটা লুকিয়ে রাখা যেতে পারে?

আছে। সামনের ঐ প্রকাণ্ড গাছটার গুঁড়ির ওপর দিকে একটা মস্ত গর্ত আছে। ফসিলটা পুরো ঢুকে যাবে।

বেশ। ভালো করে শুকনো পাতা চাপা দিয়ে রাখবে। তারপর আবার ফিরে যাবে মুঙ্গুর কুটিরে। কুটিরের নিচে একটা গর্ত খুঁড়ে তোমরা পয়লা নম্বর ডিনামাইটটা ফিক্স করবে। তারপর আরও দুটো লাগাবে কুটিরের পিছনে যে ঢিবি আছে তার নিচে। ঢিবির ওপর মস্ত একটা গাছ আছে। আমার আশা ডিনামাইট ফাটলে হয়তো উল্টে পড়বে। ব্যস, রাত্তিরে এই অবধি। কারণ বিস্ফোরণ ঘটবে সকালে। স্টিকের পলতেগুলো বেশ লম্বা নেবে আর ঘাস-পাতা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখবে, যাতে কারও চোখে না পড়ে।

পরদিন আমরা যাব রুগী দেখতে, আমি আর অসিত। সুনন্দ গোপনে গিয়ে ডিনামাইটের পলতেতে আগুন লাগাবে। তারপর চট করে আমাদের কাছে চলে আসবে। পলতের আগুন স্টিকে পৌঁছতে লাগবে বড়জোর চার-পাঁচ মিনিট। তুমি প্রথমে মুঙ্গর কুটিরের নিচে লাগানো ফিউজে আগুন দেবে, আর তার দশ-পনেরো সেকেন্ড পরে আগুন দিও বাকি দুটো পলতেয়। এরপর কী ঘটবে স্বচক্ষেই দেখতে পাবে।

সুনন্দ বলল, কিন্তু এত কষ্ট করার কারণ তো বুঝছি না? পরশুদিন সবাই মিলে কেটে পড়লেই তো হাঙ্গামা চুকে যায়।

কারণ শেষ রাতে সমুদ্রযাত্রাটা এড়াতে চাই। যদি মাঝপথে ধরা পড়ি? মুস্তুকে আগে থাকতে সরিয়ে রাখলে প্রথম রাতেই পালাতে পারব। অবশ্য ফেরা দু-একদিন পিছিয়ে যাবে। তাতে কিছু এসে যায় না, অনেক নিরাপদে ফিরব।

ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছিল না। ডিনামাইট ফাটিয়ে আমাদের কী উপকার হচ্ছে? বললাম, যদি ওরা বিস্ফোরণের জন্য আমাদের দায়ী করে?

না করবে না। মামাবাবু বলেন, কী শুনলে এতক্ষণ টোটোর গল্প? ভাববে অগ্নিদেবের কাণ্ড। কোনো মানুষ যে এমন ব্যাপার ঘটাতে পারে মাথায়ই আসবে না। বরং লেগে যাবে অগ্নিদেবের ক্রোধ নিবারণের জন্য ঘটা করে পুজো দিত। এই তালেগোলে আমরা পালাব।

উৎসবের রাতে আমি ও সুনন্দ কীভাবে মহামান্য মুলুকে অপহরণ করলাম, কীভাবে ডিনামাইটগুলি বসালাম, তার বিশদ বিবরণ দেবার দরকার নেই। শুধু বলে রাখি, সে-রাতে ঘুম আমাদের ভাগ্যে জোটেনি এবং কাজ শেষে তাঁবুতে যখন ফিরেছি হাত-পিঠ টনটন করছিল, সারা গায়ে ঘাম।

পরদিন সকালে চত্বরে গিয়ে দেখি অনেকেই তখনও নাক ডাকাচ্ছে বা ঝিমুচ্ছে। গত রাত্রের ফুর্তির ধকল সামলে উঠতে পারেনি। রুগী দেখা হল। মামাবাবু সর্দারের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দিলেন। কামাউকে দেখলাম এক কোণে বসে ঢুলছে।

সুনন্দ একটু পরেই এল।

মামাবাবু বাংলায় বললেন, কি, সব রেডি?

হ্যাঁ।

বেশ এখন কথা বলতে বলতে গাছের আড়ালে সরে যাও। পাথর ছিটকাতে পারে।

গুড়ম্‌-ম্‌-ম্‌।

ঘড়ির ওপর চোখ রেখে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম, তবু এত কাছে ডিনামাইট ফাটায় চমকে কান চেপে বসে পড়লাম। মাটি, পাথর, বাঁশের টুকরো ছিটকে পড়ল চারপাশে। দেখলাম মুঙ্গুর কুটির বেমালুম নিশ্চিহ্ন।

প্রথম কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব অবস্থা। তারপরই শুরু হল চিৎকার দৌড়াদৌড়ি। সদ্য ঘুমভাঙা লোকগুলো দিশাহারার মতো এদিক সেদিক ছুটল। তাদের বিপর্যস্ত স্নায়ু ধাতস্থ হবার আগেই আবার বিস্ফোরণ দু-দুটো।

ছোট-বড় পাথরের খণ্ড দুমদাম্ করে পড়ল চারপাশে। একটা গাছ মড়মড় শব্দে মুখ থুবড়ে পড়ল। কয়েকজন দেখলাম আহত হয়েছে।

আতঙ্কে সবাই প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল। মালিমা ইয়া মোটো–মালিমা ইয়া মোটো বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সবাই উর্বশ্বাসে দৌড়ল। আমরাও ছুটলাম সঙ্গে-বাবাগো মাগো, বলে চিল্লাতে চিল্লাতে। তারপর টুক করে একসময় কেটে পড়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়লাম। দ্বীপের লোকেরা ছুটে চলল সমুদ্রের তীরে। প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে শুনলাম সমুদ্রতীর থেকে ভেসে আসছে তুমুল হট্টগোল হইচই। আস্তে আস্তে কোলাহল শান্ত হল।

ঘণ্টাখানেক পরে মামাবাবু বললেন, কী ব্যাপার? একটা লোকেরও গলার আওয়াজ পাচ্ছি না যে! চল তো দেখে আসি।

সমুদ্রতীরে এসে আমরা থ।

বেলাভূমি খাঁ-খাঁ করছে। জনমনিষ্যি নেই। গা একেবারে ফাঁকা নয় অবশ্য। কয়েকজন বুড়োবুড়িকে দেখলাম পাথরের খাঁজে, গাছের তলায় লুকিয়ে বসে। কিন্তু বাকিরা কই!

এবার নজর পড়ল। একটাও নৌকো নেই। ডিঙি ছিপ সব উধাও, দেখি অনেক দূরে সমুদ্রের জলে কালো কালো বিন্দুর মতো সার সার নৌকো, ভেসে চলেছে উপকূলের দিকে।

যাব্বাবা! সুনন্দ বলে, এ যে গুষ্টিসুদ্ধ হাওয়া! যাক ভালোই হল, এখন থেকে আমরাই দ্বীপের রাজা।

হুঁ রাজা বটে! তবে নির্বাসিত। মামাবাবু মন্তব্য করলেন।

কেন?

বাঃ, সবকটা নৌকো যে নিয়ে গেছে। দ্বীপ থেকে বেরোবার রাস্তা বন্ধ।

তাইতো! আমরা একটু মুষড়ে পড়ি।

এরা আর ফিরবে না? আমি জিজ্ঞেস করি।

ফিরতে পারে। অগ্নিদেবের ধ্বংসলীলা কতদূর গড়ায় দেখেশুনে হয়তো ফিরবে। তবে কবে ফিরবে কে জানে! যাহোক, সুনন্দ অসিত তোমরা পালা করে সমুদ্রতীরে পাহারা দাও। আমার ধারণা শব্দ উপকূল অবধি পৌঁছেছে। কিংবা দ্বীপের রিফিউজিদের কাছ থেকে খবর পেয়েও উপকূল থেকে খোঁজ নিতে আসতে পারে–ব্যাপারখানা কী!

পরদিন সকালে আরও দুটি ডিনামাইট ফাটানো হল। সেই বিকট বজ্রনিনাদ দ্বীপের চারপাশের জলবেষ্টনীর তরঙ্গে তরঙ্গে কাঁপুনি জাগিয়ে ছুটে গেল দূর দিগন্তে। মহাভয়ে পশুপাখিরা দিভ্রান্ত হয়ে পালাতে লাগল। মানুষ তো আগেই পালিয়েছে।

বন্দী মাঝি দুজন আবদুল ও রশিদ মহানন্দে দ্বীপময় চষছে। কতদিন পরে তারা স্বাধীনভাবে ঘুরছে। একটা নতুন খবর দিল তারা–শুধু কিছু বুড়োবুড়ি নয়, কয়েকজন জোয়ান পুরুষও নাকি রয়েছে দ্বীপে। কী কারণে তারা পালাতে পারেনি জানি না। হয়তো ভয় পেয়ে বনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, অন্যরা তখন ভেগেছে।

মাঝিরা বলল, বনের মধ্যে হঠাৎ দুটো লোক তাদের সামনে পড়ে। অমনি তারা তোক দুটোকে লাঠি বাগিয়ে তাড়া করে। দ্বীপের লোকের ওপর তাদের ভীষণ রাগ। লোক দুটোও তৎক্ষণাৎ ভোঁ দৌড়।আবদুলরা খুব বাহাদুরি নিল, ব্যাটারা ভিতুর একশেষ। সঙ্গে তির-ধনুক ছিল, কিন্তু দেখেই পালাল। একবার ধরতে পারলে

আমাদের ধারণা ওরা মোটেই ভীতু নয়। আকস্মিক দুর্যোগে বেচারারা ঘাবড়ে গেছে। হয়তো ভেবেছে–বিস্ফোরণের পিছনে ভারতীয় জাদুকরদের কোনো কারসাজি আছে। কারণ কাল থেকে দ্বীপের কোনো লোক আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষেনি। দেখলেই লুকিয়ে পড়েছে।

দুপুর বারোটা নাগাদ।

আমি ও সুনন্দ সমুদ্রতীরে রাউন্ড দিচ্ছি। সুনন্দের চোখে দূরবিন। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে ওঠে, লঞ্চ! একটা লঞ্চ আসছে এদিকে!

কই দেখি, দেখি। আমি তার হাত থেকে দূরবিন কেড়ে নিই। সত্যি তো লঞ্চ! কয়েকজন মানুষ রয়েছে। ঠিক চেনা যাচ্ছে না তাদের।

দে দে। সুনন্দ কাড়াকাড়ি করে। কিন্তু আমি শক্ত হাতে দূরবিন ধরে থাকি।

একটু একটু করে স্পষ্ট হতে থাকে লঞ্চ। দূরবিনের মধ্য দিয়ে মানুষগুলোকে দেখি।

সুনন্দ! ডক্টর হাইনে! ঐ তো ওকেলো! আরও তিন-চারজন লোক দেখছি, বোধহয় খালাসি।

সুনন্দ দূরবিন কেড়ে নিল। তারপর বলে চলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। হাইনে, ওকেলো।

সুনন্দ তার শার্টটা খুলে প্রাণপণে নাড়তে লাগল। আর গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, ও-কে-লো! হাইনে!

দুম্‌দুম্‌। লঞ্চ থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। অর্থাৎ তারা আমাদের দেখেছে।

দাঁড়া মামাবাবুকে ডেকে আনি। সুনন্দ পাই-পাঁই করে দৌড়ল।

.

১৩.

লঞ্চ থামল দ্বীপ থেকে প্রায় দুশো গজ দুরে। তীরের কাছে কাছে জলের মধ্যে অজস্র শিলাস্তূপ, প্রবাল প্রাচীর। লঞ্চের ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা। একটা ছোট বোট জলে নামানো হল। তাতে চাপলেন ডক্টর হাইনে এবং ওকেলো। দুজন খালাসি দাঁড় বাইতে লাগল।

হাইনে লাফ দিয়ে ডাঙায় নেমে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন মামাবাবুকে।

ওঃ প্রোফেসর ঘোষ। আপনারা জীবিত!

কেন সন্দেহ আছে নাকি? কী দেখছেন সামনে? ভূত? মামাবাবু হাসেন। হাত দিয়ে অনুভব করুন খাঁটি রক্তমাংসের শরীর। আরও সাচ্চা প্রমাণ ঐ দেখুন ছায়া পড়েছে মাটিতে।

উঃ কী মনোকষ্টে যে দিন কাটাচ্ছিলাম! অনুতাপে পুড়ে যাচ্ছিল বুক। আমারই জন্যে এই দুর্ঘটনা! কেন আপনাদের মাফিয়া আসতে লিখলাম! কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার, কী করে বোঝাই। পাষাণ-ভার নেমে গেল মন থেকে।

আমি ও সুনন্দ তখন আনন্দে উন্মত্ত ওকেলোর অক্টোপাস-সম ভীমবাহুপাশের আলিঙ্গনে দমবন্ধ হয়ে ছটফট করছি। প্লিজ ওকেলো, ভাই এবার ছেড়ে দাও। এবার কিন্তু সত্যি সত্যি অক্কা পাব।

হাইনে বললেন, মাফিয়ায় আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি। চারদিন কেটে গেল, দেখাই নেই। আবার খবর পাঠাই, কই, চটপট চলে এসো।

ওকেলো টেলিগ্রাম করল, আপনারা রওনা দিয়েছেন চারদিন আগে! কী ব্যাপার? সঙ্গে সঙ্গে ডার-এস-সালাম ফিরলাম। তারপর জানি, রুফিজি নদীর মোহনা থেকে আপনারা রওনা হওয়ার কয়েক ঘন্টা পরে প্রবল ঝড় ওঠে। বুঝলাম ঝড়ে পড়েছেন। মোহনার দুইপাশ, কাছাকাছি সমুদ্রতীর সব তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। নাঃ, কোনো পাত্তা নেই। জীবিত ফিরে পাবার আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, মৃত দেহগুলোও যদি পাই। কিন্তু কোনো চিহ্নই পাচ্ছিলাম না। এমনকি ভাঙা নৌকো বা জিনিসপত্রগুলোরও কোনো সন্ধান নেই। ভাগ্যিস এখনও আপনাদের দেশে খবর পাঠাইনি। ঠিক করেছিলাম, আপনাদের কোনো চিহ্ন না পেয়ে, স্থির নিশ্চিত না হয়ে আপনাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে এই মর্মান্তিক সংবাদ পাঠাব না।

এত খুঁজেছেন কিন্তু এই দ্বীপটা বাদ দিলেন কেন? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

রাইট, এ-দ্বীপে আমি খুঁজতে আসিনি। এত দূরে এসে পড়বেন ভাবিনি। তবে একেবারে খোঁজ নিইনি বলতে পারেন না। কিছুদিন আগে এই দ্বীপের অধিবাসীরা যখন উপকূলে এসেছিল তাদের জিজ্ঞেস করা হয়–ঝড়ে কোনো নৌকো কি তাদের দ্বীপে গিয়ে পড়েছে?–কোনো ভারতীয় ছিল নৌকোয়? তারা বলল–না।

তাহলে আমাদের খোঁজ পেলেন কী করে! ডিনামাইটের শব্দে? শব্দ তীরে পৌঁছেছিল, তবে খুব ক্ষীণ। কীসের শব্দ বোঝা মুশকিল। তারপরই হুড়মুড় করে দ্বীপবাসীরা কুলে হাজির হল। তাদের মুখে বিস্ফোরণের কাহিনি শুনে লোকেদের সন্দেহ হল অগ্ন্যুৎপাত নয়, কারণ সবাই জানে ওটা প্রবাল দ্বীপ। অতএব মানুষের হাত আছে। বারুদের কাণ্ড। আদিবাসীরা তো বারুদের ব্যবহার জানে না।–কোনো বিদেশি গেছে দ্বীপে? তারা উত্তর দেয়–না।

তবে খবর পেলেন কী করে?

শুধু একটা ছেলে, এই ষোল-সতের বছর বয়স হবে, খবর দিল তিনজন ভারতীয় নাকি বেশ কিছুদিন ধরে তাদের দ্বীপে রয়েছে। ঝড়ে তাদের নৌকো গিয়ে দ্বীপে পড়েছিল। ছেলেটা লুকিয়ে এসেছিল। বলে গেল–কাউকে বলবেন না আমি বলছি, তাহলে সর্দার কেটে ফেলবে তাকে।

টোটো, নিশ্চয় টোটো। আমি বলে উঠলাম।

টোটো কে? হাইনে বললেন।

একটি ছেলে, আমাদের ভারি ভালোবাসে।

ডক্টর হাইনে বলেন, সব্বাইকে বলা ছিল আপনাদের সন্ধান পেলেই যেন আমাকে খবর দেওয়া হয়। গতরাত্রে ট্রাঙ্ককল পেলাম। সকালে পৌঁছেই লঞ্চ জোগাড় করে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু আশ্চর্য, ওরা বার বার আপনাদের কথা চেপে গেল কেন?

কারণ ওরা চাইছিল না আমরা এখান থেকে চলে যাই।

কেন?

তাহলে হোমার খপ্পর থেকে ওদের বাঁচাবে কে?

মানে? হাইনে বিভ্রান্ত। সে আবার কে?

মামাবাবু তখন সংক্ষেপে বললেন, আমরা কেমন করে নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি সেই কাহিনি।

সমস্ত শুনে হাইনে প্রথমে একচোট হাসলেন হো হো করে, বেশ হয়েছে, যেমন হাতুড়ে বদ্যি তেমনি নাছোড়বান্দা পেসেন্ট। আচ্ছা জব্দ। যাক খুব সময়ে এসে পড়েছি,

এখন লঞ্চে আরাম করে ফিরে চলুন।

ওকেলো ফোড়ন কাটল, কিন্তু সুনন্দ আসিটের কি এমন নিরামিষ প্রস্থান পছন্দ হবে? অ্যাডভেঞ্চার কই? ওরা বরং আমাদের জালিবোটটা নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিক। আমরা প্রোফেসরকে নিয়ে লঞ্চে চলে যাই।

আমরা দুজন সরবে আপত্তি জানাই, নেভার।

খেয়াল করলাম মামাবাবু তার গল্পের মধ্যে মুঙ্গু অর্থাৎ ফসিলের বিবরণ বেমালুম চেপে গেলেন।

ডক্টর হাইনে ব্যস্ত হয়ে বললেন, তবে আজই ফেরা যাক। আপনাদের জিনিসপত্র নিয়ে আসি? বেড়াতে এসে কী দুর্ভোগ! এতগুলো দিন আপনাদের নষ্ট হল।

মামাবাবু বললেন, দুর্ভোগ কিছুটা হয়েছে বটে, কিন্তু দিনগুলো নষ্ট হয়েছে বলতে পারি না। একেবারে শূন্য হাতে ফিরছি না। অনেক অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে এবং মুঙ্গু। এই আমাদের পুরস্কার!

মুঙ্গু কী?

দ্বীপের দেবতা। কিন্তু আমাদের কাছে তার পরিচয় মিসিং লিঙ্ক। সরীসৃপ ও পাখির মাঝামাঝি এক জীবের ফসিল। আরকিঅপটেরিক্স-এর পূর্বপুরুষ।

কী বললেন, মিসিং লিঙ্ক? ফসিল এখানে পেয়েছেন? হেঃ হেঃ প্রোফেসর ঘোষ, আমি কাটখোট্টা সায়ান্টিস্ট হতে পারি, কিন্তু অল্পস্বল্প রসিকতা বুঝি।

রসিকতা নয়, সিরিয়াসলি।

অ্যাঁ সত্যি? কোথায়?

ক্যাম্পে রয়েছে।

তবে চলুন, দাঁড়িয়ে কেন? ইস, এতক্ষণ আজবাজে বকে সময় নষ্ট করছেন। উত্তেজিত হাইনে মামাবাবুর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারলেন।

আহা অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? মামাবাবু কাতর কণ্ঠে জানান, পালাচ্ছে না তো?

পাতলা কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় একটা বক্সের মধ্যে ফসিলটা শোয়ানো ছিল। কাপড় সরাতেই হাইনে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

কখনো খালি চোখে, কখনো ম্যাগনিফাইং গ্লাস লাগিয়ে দেখছেন। বাহ্যজ্ঞানশূন্য, তন্ময়ভাবে। আমরা দুরুদুরু বক্ষে ভাবছি–মামাবাবুর ধারণা সত্যি হবে তো?

প্রায় আধ ঘণ্টা পর হাইনে লাফিয়ে উঠলেন, প্রোফেসর ঘোষ, কনগ্রাচুলেসনস! আপনি ঠিক ধরেছেন–মিসিং লিঙ্ক। জীবটা না-পাখি, না-সরীসৃপ। আরকিঅপটেরিক্স-এর চেয়ে পুরনো। এর গায়ে পালক খুব সামান্য, সবে বেরিয়েছে ছোট ছোট। এখন দয়া করে বলুন এই মহামূল্যবান আবিষ্কারটি করলেন কী করে! এ যে সাত রাজার ধন মানিক! প্রাণিবিজ্ঞানীদের স্বপ্ন। এরকম আবিষ্কারের জন্যে আমি একবার কেন, সাত-সাতবার টাইফুনে পড়তে প্রস্তুত আছি।

মামাবাবু বললেন, সুনন্দ কফি বানাও, জমিয়ে বসা যাক। জানলে ডক্টর হাইনে, এরকম বিচিত্র কাহিনি অ্যাডভেঞ্চারের বইয়ে পড়া যায়। কিন্তু সত্যি সত্যি নিজেদের জীবনে তেমনি এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হব কে জানত?

প্রথমেই বলে রাখি এই ফসিল আবিষ্কারের অনেকখানি কৃতিত্ব ডেয়ারিং বিলের। বিল অবশ্য বুঝতে পারেনি, কিন্তু আমার তখনই সন্দেহ হয় যে ও যে-বিগ্রহটা দেখেছিল সেটা আসলে একটা ফসিল। তারপর এখানে সেই মূর্তি দেখে ভালো করে নজর করি। তখন না শুনলে হয়তো এই মূর্তি নিয়ে এত মাথাই ঘামাতাম না।

তাছাড়া ফসিলটা কোথায় পাওয়া গেছে ভেবেও কূলকিনারা পেতাম না। পরে টোটোর কথায় আমি নিঃসন্দেহ হই। কারণ এ-দ্বীপে এত পুরনো ফসিল পাওয়া অসম্ভব।

মামাবাবু মুঙ্গু আবিষ্কার কাহিনি আরম্ভ করেন।

ডক্টর হাইনে ও ওকেলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন।

মামাবাবু শেষ করামাত্র হাইনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন।

ওয়ান্ডারফুল! এক নম্বর–অদ্ভুত তীক্ষ্ণ আপনার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি। বায়নোকুলারের ভিতর দিয়ে অতটুকু সময়ে চিনতে পারলেন কী করে?

না, ঠিক চিনতে তো পারিনি।

ঐ হল। আরকিঅপটেরিক্স ভেবেছিলেন। সেটাই বা ক-জনের মাথায় আসবে। দ্বিতীয় নম্বর–হাইনে মিটমিট করে আমাদের দিকে তাকাতে থাকেন–দুষ্টু বুদ্ধিতেও আপনি বড় কম যান না। আচ্ছা প্যাঁচ কষে বেচারা কামাউয়ের দেবতাটিকে হাতালেন। সব্বাইকে দেশছাড়া করে ছাড়লেন মশাই।

সমবেত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সবাই।

হাইনে মহাখুশি হয়ে বলেন, প্রোফেসর ঘোষ, চালিয়াত মিলার এবার চিৎপটাং।

.

১৪.

স্থির হল কাল আমরা ফিরে যাব। হাইনে দ্বীপটা দেখতে উৎসাহ প্রকাশ করলেন। মামাবাবু তাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন।

সকাল থেকে যাবার তোড়জোড় শুরু হল।

দফায় দফায় মালপত্র লঞ্চে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল। মামাবাবু বললেন, আমি একদম শেষে যাব স্পেসিমেনের বাক্সগুলি এবং ফসিল নিয়ে। আমরাও একে একে লঞ্চে উঠি। মাঝি চারজন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বাব্বাঃ, জংলিগুলোর খপ্পর থেকে বেঁচে বেরোলাম তাহলে?

হাইনের ইচ্ছে ছিল মামাবাবুর সঙ্গে যাবেন। কিন্তু মামাবাবু আপত্তি করলেন, না না আপনি আগে চলে যান। জিনিসগুলো গুছিয়ে রেখে স্পেসিমেন আর ফসিলের জন্য একটু ভালো জায়গা করে রাখবেন। ঢেউয়ের দোলায় কোনো ভারী জিনিস যেন ওদের ঘাড়ে গড়িয়ে না পড়ে।

লাস্ট ট্রিপ।

লঞ্চ চালক পেড্রো ইঞ্জিন চালু করেছে। ঘোর গর্জনে থরথর করে কাঁপছে লঞ্চ। মামাবাবু এলেই সে লঞ্চ ছেড়ে দেবে।

বালির ওপর শোয়ানো মুঙ্গুকে মামাবাবু আস্তে আস্তে তুলে ধরলেন। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় ফসিলের গায়ে জড়ানো কাপড়ের টুকরোটা হুস্ করে উড়ে গেল। মুহূর্তে ডানা মেলে উধাও হয়ে গেল কাপড়টা। মামাবাবু বোকার মতো চেয়ে রইলেন। লঞ্চে আমরা খুব একচোট হেসে উঠি এই দৃশ্য দেখে।

আমাদের হাসি থামতে না থামতে শুনি এক চিৎকার। মামাবাবু বা খালাসিদের গলা নয়। অপরিচিত কণ্ঠস্বর। এক নয়, একাধিক।

সমুদ্রতীরে মামাবাবুর কাছ থেকে প্রায় শতখানেক গজ দূরে কিছু ঝোঁপঝাড়ের অন্তরাল থেকে যেন জাদুবলে আবির্ভূত হল দুটি কৃষ্ণকায় মূর্তি। তারা চেঁচিয়ে ওঠে, মুঙ্গু মুঙ্গু! তারস্বরে কী সব জানি বলতে লাগল।

হাইনে আশ্চর্য হয়ে বলেন, কে লোক দুটো? দ্বীপের আদিবাসী? এরা বুঝি পালায়নি? কী বলছে?

আমরা দেখেই চিনেছি–সেই মানিকজোড়। ত্যাড়া-ব্যাঁকা। ত্যাড়াকে চিনতে না পারলেও ব্যাঁকার ধনুকের মতো পা ভুল হবার নয়। মুঙ্গুকে চুরি করতে দেখলে অন্য কেউ বোধ হয় খুশিই হত। কিন্তু এ দুটো কামাউয়ের চেলা। হয়তো বাধা দেবে।

আমরা বললাম, ওরা মুঙ্গুকে চিনতে পেরেছে। এতক্ষণ লুকিয়ে দেখছিল। মুঙ্গুকে ফিরিয়ে দিতে বলছে। শাসাচ্ছে।

ত্যাঁড়া-ব্যাঁকা দ্রুতবেগে বালির ওপর দিয়ে দৌড়ে আসতে লাগল।

মামাবাব মুহূর্তে হৃদয়ঙ্গম করলেন ব্যাপারটা। চটপট ফসিল বগলদাবা করে জলে নামলেন। ঝপঝপ করে ঢেউ ভেঙে এগোতে থাকেন। নৌকো রয়েছে প্রায় এক কোমর জলে।

নৌকোয় পৌঁছে ফসিলটি সাবধানে ভিতরে শুইয়ে তিনি লাফিয়ে উঠলেন। খালাসি দজন তৈরি ছিল। ঝপাং করে দাঁড় পড়ল। ঢেউ কেটে তীব্রবেগে বোট গভীর জলে এগিয়ে গেল।

লোক দুটো যখন জলের ধারে হাজির হল নৌকো অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সাঁতার কেটে ধরা যাবে না তাকে।

ওকি! হতবাক আমরা লক্ষ করি লোক দুটো ধনুকে তির বসিয়ে জ্যা টানছে।

উল্কাগতিতে তির ছুটল। অব্যর্থ নিশানা।

আ আ আ! একজন খালাসি কাতর আর্তনাদ করে উঠল। তার বাহুমূলে তির লেগেছে। ফলাটা গেঁথে গেছে মাংসে। তার সঙ্গী একটানে তিরটা তুলে নেয়। জামাটা লাল হয়ে ওঠে তাজা রক্তে। মুঠো আলগা হয়ে তার দাঁড়টা জলে ভেসে গেল।

আবার তির ছুটল।

মামাবাবুরা সাবধান হয়ে গেছেন। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন পাটাতনে। চালকহীন নৌকো পাক খেতে খেতে অন্ধের মতো ভেসে চলল।

আমরা প্রাণপণে চিৎকার করছি। ঘুঁসি দেখাচ্ছি–যদি লোকগুলো ভয় পায়। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। তারা মরিয়া। গুরুদেব কামাউয়ের দেবতাকে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না।

দেখলাম, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে, মাছের মতো সাঁতরে চলল নৌকোর দিকে।

মামাবাবু সাবধান! ওরা আসছে!

আমাদের চিৎকার তার কানে পৌঁছয়নি কিংবা তিরের ভয়ে খানিকক্ষণ মাথা তুলতে সাহস পায়নি। আমরা প্রাণপণে ডাকতে থাকি।

ত্যাঁড়া-ব্যাঁকা নৌকোর কাছে এসে পড়েছে–

বলি ব্যাপারখানা কী? পেড্রোর বাজখাঁই গলা শোনা গেল। সে এতক্ষণ ইঞ্জিনঘরে ব্যস্ত ছিল। ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দে কিছুই তার কানে ঢোকেনি। চিৎকার চরমে উঠলে শুনতে পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।

ওই জংলি দুটো বোট আক্রমণ করেছে। সাঁতরে আসছে। তির ছুঁড়েছে। একজন আহত।

তবে রে! দৈত্যাকার পেড্রো ব্যাঘ্রলম্ফ দিয়ে তার কেবিনে ঢুকল। পরমুহূর্তে ফিরে এল, হাতে বন্দুক।

বন্দুকে টোটা ভরে সে তাক করল।

হাইনে তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরলেন, আরে করছ কী? দেখছ না লোকগুলো আর নৌকো এক লাইনে। যদি নৌকোয় গুলি লাগে?

ওঃ! অসহায় রাগে পেড্রো সজোরে পা ঠুকতে লাগল।

মামাবাবু ও খালাসিরা মাথা তুলেছে কিন্তু নৌকো এগোয় না। একটা মাত্র দাঁড। ক্রমাগত পাশে সরে যেতে লাগল। ত্যাড়া-বাকা ধরে ফেলেছে নৌকো। তারা নৌকোর চারপাশে সাঁতরায় আর সুযোগ খোঁজে ওঠবার।

একজন খালাসী দাঁড় তুলে জলের মধ্যের মাথাগুলো লক্ষ্য করে ঘা কষায়। তারা টুপটাপ ডুব দিয়ে সরে যায়। একজন হঠাৎ নৌকোর তলায় মারল ধাক্কা। খালাসিটি হুমডি খেয়ে পড়ল নৌকোর কানায়। অমনি তার ঘাড় ধরে মেরেছে টান। ব্যস, দাঁড় সুদ্ধ সে জলের মধ্যে গোত্তা খেয়ে পড়ল। অমনি লেগে গেল জাপটা-জাপটি।

মামাবাবু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন জলযুদ্ধ দেখতে। অন্য লোকটা সেই সুযোগে নৌকোয় উঠে পড়ল। মারল তাঁকে এক প্রচণ্ড ধাক্কা। লোকটাকে নৌকোয় ওঠামাত্র চিনেছি–বাকা।

মামাবাবু ঠিকরে পড়লেন জলে।

আহত খালাসিটিও বাধা দেবার চেষ্টা করল। তার জামা-প্যান্ট রক্তে লাল। এক হাতে ঘুষি চালাল। কিন্তু এক প্রচণ্ড লাথি খেয়ে সে উল্টে পড়ল জলে।

ব্যাঁকা এবার নিচু হয়ে মুঙ্গুকে দুহাতে তুলে ধরল, বিজয়োল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল, পেয়েছি।

গুড়ুম! হঠাৎ কানের কাছে প্রচণ্ড শব্দ। চমকে দেখি পেড্রোর বন্দুকের নল দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মুখে তার তৃপ্তির হাসি। খতম।

বাঃ, চমৎকার লক্ষ্যভেদ। টু শব্দটি করার ক্ষমতা হয়নি। ব্যাঁকা উল্টে পড়েছে নৌকোর বাইরে জলে। হাতের ফসিল নৌকোর পাটাতনে সজোরে আছড়ে পড়ল—ঠকাস্‌।

আমাদের দৃষ্টি মামাবাবুকে অনুসরণ করল। দেখি তিনি আহত খালাসিটিকে নিয়ে কোনো রকমে পাড়ে যাবার চেষ্টা করছেন।

দ্বিতীয় খালাসিটি ফিরে আসছে দেখলাম। নিশ্চয় যুদ্ধে তার জয়লাভ হয়েছে। সে দ্রুত সাঁতার কেটে এসে আহত সঙ্গীকে ধরল লঞ্চ থেকে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। তাদের সাহায্য করতে ছুটল।

নৌকো আটকাও। মামাবাবুর গলা ভেসে এল।

সত্যি তো, নৌকো কোথায়? এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলাম নৌকোর কথা, লক্ষ্য করতে গিয়ে শিউরে উঠি।

দূরে নৌকোটা ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে হেলেদুলে ছুটে চলেছে এক সর্বনাশা নিয়তির উদ্দেশে। তার লক্ষ্য কুফানি।

কুফানি? একটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি। নামটা দ্বীপের লোকের দেওয়া। কুফানি মানে মৃত্যুদ্বার। যমের দক্ষিণ দুয়ারই বটে। কতগুলো ডুবো পাহাড়ের মাঝখানে সমুদ্রের জল লাটুর মতো বন বন করে পাক খাচ্ছে। একবার তার ভিতরে গিয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই। স্রোতের টানে পাতালে তলিয়ে যাবার আগেই স্রেফ পাথরে ধাক্কা খেতে খেতেই টুকরো হয়ে যাবে।

এ-দ্বীপের ওস্তাদ মাঝিদেরও দেখেছি সভয়ে এড়িয়ে চলত এই ঘূর্ণিকে। সুতরাং আমরা। শঙ্কিত হয়ে উঠি।

বোট বাঁচাও! মামাবাবু চিৎকার করে ওঠেন।

অসম্ভব। নৌকো এখন আমাদের নাগালের বাইরে। দেখতে দেখতে নৌকোর গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হল। তারপর সোজা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুফানির গর্ভে।

দেখলাম চরকির মতো পাক খাচ্ছে নৌকো। তারপরই কোনো শিলাস্তূপের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হল।

নৌকোটা অন্ধের মতো ঘুরছে আর বার বার ঢুঁ মারছে কঠিন পাথরে। যেন সেই নিষ্ঠুর ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ক্রমশ সেটা জলের ভিতর ডুবে যেতে লাগল, তারপর হঠাৎ দেখি আর নেই। অদৃশ্য। শুধু কয়েকটা ছোট তক্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

সবাই হায় হায় করে উঠলাম।

একটা নৌকো গেলে কী এসে যায়? কিন্তু ওর সঙ্গে যে তলিয়ে গেল মামাবাবুর আবিষ্কার। বিজ্ঞানজগতের এক অমূল্যনিধি। কেমব্রিজের মিলারকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার। কামাউয়ের মুঙ্গু!

পেড্রো দুম করে পা ঠুকে খালাসিদের উদ্দেশে গর্জন ছাড়ে, তোরা উজবুক, অকম্মার ধাড়ি! একটু সময় থাকতে ডাকতে পারলি না? পেড্রোর বন্দুকের কথা মনেই পড়ল না। হতভাগাদের? দেখতাম ঐ জংলি দুটো কী করে নৌকোর কাছে ঘেঁষে! ওফ্‌!

মামাবাবু লঞ্চে উঠে টলতে টলতে এক কোণে বসে পড়লেন। তার সারা গা থেকে জল ঝরছে, চোখে বিষণ্ণ উদাস দৃষ্টি। যেন সর্বহারা। আমরা স্তব্ধ হয়ে দেখছিলাম। কাছে যেতে বা কথা কইতে সাহস হচ্ছিল না।

আহত খালাসিটিকে লঞ্চে তোলা হল। মামাবাবু একবার বলে ওঠেন, অ্যানটিসেপটিক দিয়ে ভালো করে ব্যান্ডেজ করো। ব্যান্ডেজ ওষুধ কোথায় আছে?

সুনন্দ বলল, জানি। ব্যস, মামাবাবু আবার চুপ মেরে গেলেন।

আহত লোকটিকে ড্রেস করে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখি মামাবাবু তখনও একভাবে বসে।

ডক্টর হাইনে গিয়ে মামাবাবুর সামনে দাঁড়ালেন। প্রোফেসর ঘোষ এবার উঠুন। পোশাক চেঞ্জ করে নিন। সবই বুঝছি, কিন্তু কী করবেন? মামাবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন।

হুঁ, যা বলেছেন। দুর্ভাগ্য। অতি দুর্ভাগ্য। আমার, আপনার, সারা বিজ্ঞানজগতের। কিন্তু হারানো সূত্রের আর একটি স্পেসিমেন আমি নিশ্চয় জোগাড় করব। তবে খাটতে হবে, সময় লাগবে।

কী করে? ডক্টর হাইনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।

কেন? সেই উপত্যকার কথা ভুলে যাচ্ছেন? ডেয়ারিং বিল যার উল্লেখ করেছিল। বিল সেখানে দেখেছিল কালো পাথরের স্তর। সেখানেই ফাটলের মধ্যে কামাউ খুঁজে পেয়েছিল মুঙ্গুকে–এই ফসিল। ডার-এস-সালাম ফিরে গিয়ে আমাদের কাজ হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নাইভাসা হ্রদের দিকে যাত্রা করা। বিলের কুটির হ্রদের কাছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। সেই উপত্যকায়। ভালো করে খুঁজে দেখলে এই প্রাণীর আরও দু-একটা ফসিল আবিষ্কার করা হয়তো অসম্ভব হবে না। কী বলেন হের হাইনে?

হাইনে বললেন, রাইট!

 

আমাজনের গহনে

ভূমিকা

দুনিয়ায় কত জায়গাতেই তো যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সাধ থাকলেই সাধ্যে, কুলোয় না। তাই মনে মনে বেড়াতে যেতে পারি এমন সুযোগ একমাত্র যাতে পাওয়া যায় তেমন বই পেলে আর কোনো দুঃখ থাকে না। কিন্তু তেমন বই কি সহজে মেলে? যাঁর কল্পনায় ভর করে যাব, তিনি হয়তো যেখানকার কথা বলছেন, সেখানে নিজে তো যান-ই নি, ভালো করে ঠিকমতো খবরাখবরও রাখবার চেষ্টা করেননি। তিনি হয়তো উত্তর মেরুতে পেঙ্গুইন পাখি দেখিয়ে ছাড়বেন আর দক্ষিণ মেরুতে শাদা ভাল্লুক।

তবে সে রকম বই যে বাংলায় মোটে নেই, তা কেউ যেন না বলে। এই তো আমার হাতে রয়েছে আমাজনের গহনে। যেমন তেমন জায়গায় নয়, সেই দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরের অজানা পেরু আর বলিভিয়ার যে সব অঞ্চলে আমাজন নদীর সব ধারাপথ এখনো পুরোপুরি খুঁজে বার করা হয়নি, সেইখানে যদি যেতে হয় তো আমি অজেয় রায়ের সঙ্গেই যাব। উত্তেজনা রোমাঞ্চ গা-ছমছম করা ভয় আর রুদ্ধশ্বাস উদ্বেগের খোরাক তো পুরোপুরি পাবই, সেইসঙ্গে এইটুকু নিশ্চিত মানব যে প্রাকৃতিক ভৌগোলিক যা সব বিবরণ পাচ্ছি, তার মধ্যে এতটুকু ভুল কোথাও নেই। আমাদের ছোটদের মনগুলোকে সমস্ত পৃথিবীতে সার্থকভাবে ঘুরিয়ে আনবার জন্যে এই আমাজনের গহনের মতো বই আর অজেয় রায়ের মতো লেখকের বড় দরকার।

প্রেমেন্দ্র মিত্র

.

টোনি মার্কোর সঙ্গে আমাদের আলাপ হয় এক বিচিত্র পরিবেশে, আর সেই আলাপই হল এক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের সূত্রপাত।

দক্ষিণ আমেরিকার পেরু রাজ্য। বিশাল আন্ডিজ পর্বতমালার এক অংশ পড়েছে এই পেরুর মধ্যে। আন্ডিজের এক সুউচ্চ মালভূমিতে লুকনো প্রাচীন ইংকা জাতির এক নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলাম আমরা তিনজন–আমি, সুনন্দ ও মামাবাবু। সঙ্গে ছিল আরও প্রায় জনা কুড়ি নানা দেশীয় ট্যুরিস্ট।

দুর্গম পথ, কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। সরু ফিতের মতো রাস্তা বেয়ে আমাদের ছোট ট্রেন ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে চড়েছে। মাঝখানে উরুবাম্বা নদীর গিরিখাত, তার ওপর লোহার ব্রিজ। ট্রেন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে ট্যুরিস্ট বাসে উঠতে হয়েছে। হাজার ফুট তলায় উদ্দাম পাহাড়ি নদীর আস্ফালন দেখলে মাথা ঘুরে যায়।

এ সমস্তই রীতিমতো রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। কিন্তু এর পর পাহাড়ে চড়ে যা দেখলাম তাতে অভিভূত হয়ে গেলাম সবাই।

দূরে, যত দূরে চোখ যায় শুধু ঢেউয়ের মতো পর্বতমালা। আর সামনে পাহাড়-ঘেরা মালভূমির ওপর এক আশ্চর্য নগরীর কঙ্কালদেহ। উঁচু চওড়া প্রাচীর, বিস্তৃত সোপান শ্রেণি, আর সারি সারি ছাদহীন কক্ষ সব পাথরে তৈরি। এই নির্জন মৃত প্রস্তরপুরী হচ্ছে ইংকাদের হারানো শহর ভিস্কাপম্পা যার আধুনিক নাম মাচুপিচু। আশ্চর্য জাতি এই ইংকারা; পাহাড়ের ওপর কী অদ্ভুত সব নগর গড়ে তুলেছিল। আমরা কুজকো শহরেও এমনি প্রকাণ্ড চৌকো পাথরের তৈরি প্রাচীন মন্দির প্রাসাদ ইত্যাদি দেখেছি, কিন্তু এমন খাড়া পাহাড়ের ওপর তাদের এই কীর্তি না দেখলে বিশ্বাসই হত না।

এক্সকিউজ মি।

মৃদু স্ত্রী-কণ্ঠ শুনে ফিরে দেখি এক প্রৌঢ়া মেমসাহেব। মাথায় পানামা হ্যাট, চোখে সানগ্লাস, হাতে একটি ক্যামেরা, পরনে সোয়েটার ও স্ন্যাকস। ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, আপনারা কি এই সাইটটা নিয়ে আলোচনা করছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি জানাই। যদি দয়া করে ইংরেজিতে বলেন, আমিও শুনি। আমার পুরনো সভ্যতা সম্বন্ধে খুব আগ্রহ। আমার নাম মিসেস এমিলি জোন্স। বাড়ি ক্যালিফোর্নিয়া। আপনারা বোধহয় ভারতীয়?

ঠিক বলেছেন। আমি উত্তর দিলাম।

আমার সঙ্গে অনেক ভারতীয়ের চেনা আছে। একবার ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম যে। মিসেস জোন্স উৎসাহিত হয়ে জানান।

বললাম, “আমরা ইংরেজিতেই আলোচনা করব। তাহলে আপনিও বুঝতে পারবেন। একটু গর্বের সঙ্গে সুনন্দর দিকে তাকালাম, যেন বোঝাবার দায়িত্বটা আমারই।

মিসেস জোন্স প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, এখানে থাকত কারা?

আমি উত্তর দিলাম, ইংকা রাজা ও রাজপরিবারের লোক, পুরোহিত এবং কিছু সৈন্য।

অ্যাঁ, তবে যে হোটেল ম্যানেজার আমায় বলল কুজকো ছিল ইংকাদের রাজধানী, মিসেস জোন্স সানগ্লাস খুলে আমায় কটমট করে দেখলেন। ভাবখানা যেন আমি ভুল বোঝাচ্ছি।

থতমত খেয়ে গেলাম। সুনন্দ মুখ লুকিয়ে হাসে। মামাবাবু উদ্ধার করলেন।–ম্যানেজার ঠিকই বলেছে। স্প্যানিয়ার্ডরা ষোলশো শতাব্দীতে পেরুর ইংকা সাম্রাজ্য এবং রাজধানী কুজকো অধিকার করে নেবার কিছু দিন পরে ইংকা রাজা মংকো সদলবলে পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ের ওপর এই নগরে আশ্রয় নেয়। তারপর বলা যায় এটাই ছিল তাদের রাজধানী।

তারপর বুঝি স্প্যানিয়ার্ডরা মাচুপিচু দখল করে?

আজ্ঞে না। স্প্যানিয়ার্ডরা কোনোদিনই মাচুপিচুর সন্ধান পায়নি।

মিসেস জোন্স বললেন, তাহলে ইংকারা এখানে অনেক দিন রাজত্ব করেছিল বুঝি?

বেশি দিন নয়। মাত্র চল্লিশ বছর। ইংকারা মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে নেমে এসে স্প্যানিয়ার্ডদের ওপর উৎপাত করত। শেষে একদল স্প্যানিয়ার্ড সৈন্য ইংকাদের দমন করতে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। তখন তরুণ টুপাক-আমারু ইংকাদের রাজা। সে ভয় পেয়ে মাচুপিচু ছেড়ে পাহাড়ের অন্য পাশে পালাতে চেষ্টা করে। স্প্যানিয়ার্ডরা তাদের তাড়া করল। ইংকারা পাহাড় থেকে নেমে বনের মধ্যে হাজির হল। সামনে আমাজনের অববাহিকার গভীর অরণ্য। রাজা আর এগোতে ভরসা পেল না। সন্ধি করার মতলবে সে স্প্যানিয়ার্ডদের হাতে ধরা দিল। কিন্তু স্প্যানিয়ার্ডরা তাদের কুজকোয় নিয়ে গিয়ে স্রেফ গর্দান নিল। ব্যস, ইংকা রাজবংশ ধ্বংস হল। স্প্যানিয়ার্ডরা পাহাড়ের ওপর কী আছে তা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। ইংকাদের পবিত্র নগরী ভিলকাঁপাম্প বহুকালের জন্য হারিয়ে গেল।

আই সি! ভেরি ইন্টারেস্টিং। ভদ্রমহিলা মন্তব্য করলেন।

মিসেস জোন্স দেখেন, প্রশ্ন করেন, আর কেবল বলেন—’ভেরি ইন্টারেস্টিং!

আমি ও সুনন্দ বিরক্ত হচ্ছিলাম। ভদ্রমহিলা খুটখুট করে চলেছেন আর গুচ্ছের প্রশ্ন করে আমাদের সময় নষ্ট করছেন। আমি একটা মতলব আঁটলাম। বললাম, মামাবাবু, চলুন। ওই উঁচু পাঁচিলটার ওপর চড়ি। অনেক দূর দেখা যাবে।

মামাবাবু বুঝলেন। আমাদের দিকে আড়চোখে হেসে বললেন, বেশ চলো।

মিসেস জোন্স ঘাবড়ে গেলেন। এতটা বাড়াবাড়ি করার ইচ্ছে তার নেই। বললেন, অনেক ধন্যবাদ, এবার আমি বরং ফিরে গিয়ে রেস্ট নিই। অগত্যা তিনি ফিরে চললেন।

আর পরমুহূর্তেই পুরুষকণ্ঠে ইংরেজিতে কথা এল–যাক, মিসেস জোন্স-এর খপ্পর থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

ফিরে দেখি এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। লালচে লম্বা চুল এবং প্রচুর দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে মুখ প্রায় ঢাকা। শুধু একজোড়া হাসিভরা ধূসর চোখ এবং তীক্ষ্ণ নাসিকা দেখা যাচ্ছে। উচ্চতা মাঝারি, তবে খুব জোয়ান বপু। বয়স মনে হল আমার চেয়ে কিছু বেশি। তার কাথে ঝলছে দুটো ক্যামেরা। লোকটি এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করে বলল–আমার নাম টোনি মার্কো। পেশা ফোটোগ্রাফি। বাড়ি সুইজারল্যান্ড।

মামাবাবু পরিচয় দিলেন।–আমি নবগোপাল ঘোষ, এই হচ্ছে আমার ভাগনে সুপ বোস, আর এ সুনন্দের বন্ধু অসিত রায়। আমরা ভারতীয়। আমি লেকচার ট্যুরে এসেছি সাউথ আমেরিকায়। এরা দুজনও সঙ্গে এসেছে। কাজ শেষ, হাতে সময় আছে, তাই দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো ঘুরে দেখছি। তা মিসেস জোন্স-এর সঙ্গে আপনার আলাপ আছে নাকি?

আছে। অতি সামান্য। আসার পথে উনি আমাকে মাচুপিচু সম্বন্ধে এমন নানা জেরা শুরু করলেন যে বাধ্য হয়ে আপনাদের দেখিয়ে দিলাম। বললাম–ওঁরা খুব ভালো জানেন এ-বিষয়ে। যাক, এখন মাপ চেয়ে নিচ্ছি। কেমন লাগছে মাচুপিচু? আমি এ-জায়গার বড় ভক্ত। যতবার এদিকে এসেছি জায়গাটি দেখে গেছি?

আমি বললাম, আপনি সাউথ আমেরিকায় আরও এসেছেন নাকি?

–হ্যাঁ । দুবার।

–ছবি তুলতে এসেছেন? সুনন্দ জানতে চাইল।

হ্যাঁ। আমাজনের অরণ্যে ঢুকব আদিম উপজাতিদের ছবি তুলতে। গতবারও গিয়েছিলাম এই ধরনের ছবি তুলতে, কিন্তু নানা ঝাটে তাড়াতাড়ি ফিরতে হল! তাই আবার এসেছি।

মার্কোর সঙ্গে মাচুপিচু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সূর্যমন্দির, রাজপ্রাসাদ, পূজাবেদি। মার্কো। ভারি আলাপী ও রসিক ব্যক্তি। জানলাম কুজকোয় আমরা যে হোটেলে উঠেছি মার্কোও। সেই হোটেলে আছে। আমরা একসঙ্গে ফিরলাম।

পরদিন সকালবেলা। হোটেলের ঘরে বসে কফি খাচ্ছি, এমন সময় মার্কো এসে জুটলেন, সঙ্গে তার তোলা ছবির অ্যালবাম।

অপূর্ব রঙিন ফোটোগুলি। জঙ্গল, পশু-পাখি এবং ইন্ডিয়ান উপজাতির ছবি। ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পর এদেশকে ভুল করে ইন্ডিয়া, মানে ভারতবর্ষ ভেবেছিলেন। তাই আজও এখানকার আদিবাসীদের লোকে সংক্ষেপে ইন্ডিয়ান বলে ডাকে।

কতরকম উপজাতি। বিচিত্র তাদের সাজপোশাক। ছবি দেখলে বোঝা যায় কী গভীর জঙ্গলে ঢুকেছিল মার্কো। মার্কো বলল, সেবার আমার সঙ্গে ছিল ভিক্টর। ভিক্টর। আমেরিকান ছাত্র। শখ করে আমার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছিল। এবার ভিক্টর আসতেন পারেনি।

তারপর হঠাৎ মার্কো বলল, আচ্ছা, প্রোফেসর ঘোষ আপনার সঙ্গে কি কেনিয়ার ডেয়ারিং বিল-এর পরিচয় আছে?

মামাবাবু অবাক হয়ে বলেন, আছে। কেন?

মার্কো খুশি হয়ে বলে, “ঠিক। কাল থেকে ভাবছি কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে। বিলের কাছে আপনার ফোটো দেখেছি। গল্প শুনেছি। ওঃ, আপনি তো বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী।

প্রশ্ন করলাম, আপনার সঙ্গে বিলের আলাপ হল কোথায়? আফ্রিকায়?

হুঁ। দুজনে যে অনেক শিকার করেছি।

আপনি শিকার করতেন?

করতাম বইকি! রীতিমতো প্রফেসনাল হান্টার ছিলাম। কিন্তু পরে হলাম ক্যামেরা হান্টার। প্রাণী হত্যা আর ভালো লাগল না। তার চেয়ে ফোটো তোলা অনেক ইন্টারেস্টিং। যথেষ্ট সাহসের কাজও বটে। কারণ দূর থেকে গুলি ছোঁড়া নয়। খুব কাছে যেতে হয় ক্যামেরা বাগিয়ে।

অ্যালবামের পাতা উলটিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ মামাবাবু একটা ছবির ওপর ঝুঁকে পড়ে মন দিয়ে দেখতে লাগলেন। তিনজন উপজাতীয় লোকের ছবি। একজনের পোশাক বড় মজার। সেই বোধহয় প্রধান। কারণ সে দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে। তার হাতে তিরধনুক, আর মুখে। একগাল হাসি। কোমরে হাতে-বোনা সুতির খাটো কাপড়। খালি গায়ে নানারকম নশা। কিন্তু সেই সঙ্গে আবার মাথায় একটি শোলার গোল টুপি এবং গলায় একখানা গিট দিয়ে বাঁধা নেকটাই। তার দুই সঙ্গীদের গায়ে অবশ্য কোনো আধুনিক সাজসজ্জা নেই।

মামাবাবু দেরাজ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে কাঁচের মধ্যে দিয়ে ফোটোখানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। মার্কো হেসে বলল, “এখানকার গহন বনের অধিবাসীদের মধ্যে অনেক সময় এমনি অদ্ভুত পোশাক দেখা যায়। যারা এদের কাছে রবার বা পশুচর্ম কিনতে যায়, তাদের কাছ থেকে আদায় করে। কিংবা কোনো পর্যটকের কাছ। থেকে পায়। আমি দেখেছি স্রেফ নেংটির ওপর দামি একখানা টেরিলিনের শার্ট চড়িয়েছে কেউ কেউ।

মামাবাবু মুখ তুলে বললেন, এ ছবি কোথায় তুলেছেন?

আমি তুলিনি। তুলেছে ভিক্টর।

কোথায়?

হিথ নদীর তীরে। আমি কয়েকদিন পায়ের ব্যথায় কাবু হয়ে তাঁবুতে শুয়েছিলাম। ভিক্টর সেই সময় একা নৌকো নিয়ে অনেক ঘুরে আসে।

মাদ্রে দ্য দিওস নদীর সঙ্গম থেকে ও জায়গাটা কত দূর? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

প্রায় একশো মাইল। এরা হিথ নদীর পাশেই থাকে। ইচোকাস ইন্ডিয়ান। এই লোকটা ওদের সর্দার।

আপনি কি ওই অঞ্চলে যাবেন এবার?

তাই তো ইচ্ছে আছে।

ছবি দেখা শেষ হল। মার্কো উঠল, ঘরে যাবে। মামাবাবু বললেন, মিঃ মার্কো, অরণ্য-যাত্রায় আমরা যদি আপনার সঙ্গী হই তাতে রাজি আছেন?

সে কি! মামাবাবুর এ আবার কী উদ্ভট খেয়াল! কী ভয়ঙ্কর জঙ্গল ছবিতে দেখেই বুঝেছি। সুনন্দর দিকে চাইলাম। সেও স্তম্ভিত। মার্কো আশ্চর্য হয়ে মামাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল।

মামাবাবু বললেন, “আমার খুব ইচ্ছে একবার আমাজনের অরণ্যে ঢুকব। ঠিক একা যেতে ভরসা হচ্ছিল না। অবশ্য আপনার যদি অসুবিধা না হয়।

মার্কো বলল, আমার আর কী অসুবিধা! একা যাচ্ছিলাম, আপনার মতো সঙ্গী পেলে সুবিধেই হবে। কিন্তু বড় কষ্টের জার্নি এবং খুব বিপজ্জনক বটে।

মামাবাবু হাসলেন। আমাজন অববাহিকার অরণ্য যে কী বস্তু আমি তা জানি মিঃ মার্কো।

মার্কো উৎফুল্লভাবে বলল, হা হা, বিলের কাছে আপনাদের অনেক অভিযানের গল্প শুনেছি। উত্তম। চলুন তবে। ভাবছিলাম একা একা একঘেয়ে লাগবে, ভগবান সঙ্গী জুটিয়ে দিলেন। আপনারা তৈরি হোন। তিন-চার দিনের মধ্যেই আমি যাত্রা করব।

মার্কো বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ও সুনন্দ উত্তেজিতভাবে চেঁচিয়ে উঠলাম– মামাবাবু, কী ব্যাপার?

মামাবাবু শান্ত কণ্ঠে বললেন–ব্যাপার আছে।

বলছি। বিছানার ওপর আরাম করে পা গুটিয়ে বসে মামাবাবু বললেন–ডক্টর সত্যনাথ সর্বজ্ঞর নাম শুনেছ?

বললাম, “শুনেছি। বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী। বাঙালি। মাস আষ্টেক আগে পেরু না বলিভিয়ার জঙ্গলে অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। কাগজে লিখেছিল, খুব সম্ভব জলে ডুবে মৃত্যু। কিন্তু মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।

মামাবাবু বললেন, অনেক কিছুই পাওয়া যায়নি। রীতিমতো রহস্যময় এই অন্তর্ধান। নদীর তীরে তার তাঁবু এবং কয়েকটা আজেবাজে জিনিস পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তার গবেষণা-সংক্রান্ত কাগজপত্র, বাক্স-ভরা স্পেসিমেন-সংগ্রহ এবং আরও অনেক নিজস্ব জিনিসের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ডক্টর সর্বজ্ঞ তখন একটি মাত্র উপজাতীয় লোক সঙ্গে করে পেরুর লা-মন্টানা অঞ্চলে আদিম উপজাতিদের গ্রামে গ্রামে ভেষজ উদ্ভিদের সন্ধান করছিলেন। লা-মন্টানা হচ্ছে আন্ডিজ পর্বতের পূর্বে আমাজন অববাহিকার অরণ্য যেখানে শুরু হয়েছে তার নাম। এই অঞ্চলে অজস্র নদী, পাহাড় এবং গভীর বনভমি। জগতের খুব কম লোকই সেখানে গিয়েছে। মন্টানার বেশিরভাগ অংশ আজও অজানা। ঘুরতে ঘুরতে বৈজ্ঞানিক হঠাৎ নিখোঁজ হন। তার সঙ্গের লোকটিরও পাত্তা পাওয়া যায়নি। সমস্ত ব্যাপারটাই ধোঁয়াটে।

ওঁর খোঁজ করা হয়েছিল ভালো করে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

পেরু সরকারের উদ্যোগে এক অনুসন্ধানী দল দুর্ঘটনার জায়গায় গিয়ে কিছু খোঁজাখুঁজি করে। তারপর রিপোর্ট দেয়, সম্ভবত নদীতে ডুবে মৃত্যু ঘটেছে। জিনিসপত্র ভেঙে গেছে। দেহ কুমিরে খেয়ে ফেলেছে।

অর্থাৎ তুমি সর্বজ্ঞর সন্ধানে আমাজনের বনে যেতে চাও? সুনন্দ গম্ভীর মুখে বলল।

হ্যাঁ।

কিন্তু সার্চ-পার্টি কোনো খোঁজ পায়নি, তুমি কি পাবে?

এতদিন সেই ভেবেই কিছু করিনি। বললেন মামাবাবু। কিন্তু ওই ফোটোটা দেখে আমার আশা জেগেছে।

কোন ফোটো?

যে ফোটোটায় দেখলে একজন জংলি ইন্ডিয়ান হ্যাট আর টাই পরে রয়েছে, ওইটে।

তার মানে?

মামাবাবু বলতে লাগলেন, অদ্ভুত লোক এই সত্যনাথ সর্বজ্ঞ। অতি প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক, কিন্তু একেবারে ভবঘুরে টাইপ। কোথাও স্থির হয়ে বেশিদিন বাস করা ওঁর ধাতে ছিল না। একা একা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন নতুন উদ্ভিদের খোঁজে। দুনিয়ায় তার একমাত্র বন্ধন একটিমাত্র মেয়ে রূপা। রূপা কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ে। বেচারা খামখেয়ালি বাবার জন্য সর্বদাই উদ্বিগ্ন। সর্বজ্ঞ এর আগেও এক্সপিডিশনে গিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছেন। সাময়িকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন কয়েকবার। তবে এবারে আট মাস হয়ে গেল। তবু রূপার ধারণা, ওর বাবা ঠিক বেঁচে আছেন। হয়তো কোথাও গিয়ে আটকে পড়েছেন, তাই ফিরে আসতে পারছেন না।

রূপা দেবীর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল বুঝি? সুনন্দ প্রশ্ন করল।

হয়েছিল। রূপা নিজেই এসেছিল আমার কাছে। সর্বজ্ঞর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ ছিল। সেই সূত্রে রূপাকেও চিনি। আমি এদেশে যাচ্ছি শুনে রূপা দেখা করতে আসে। আমাকে ভালো করে ওর বাবার খোঁজ করতে বলে। নিখোঁজ হবার কিছুদিন আগে ডক্টর সর্বজ্ঞ তার মেয়েকে একটা চিঠি লেখেন। তাতে আভাস দেন যে, তিনি শিগগিরি এক দুরূহ অভিযানে যাবেন কোনো এক গোপন জায়গায়। চিঠির ভাষা আমার মনে আছে–এক অজ্ঞাত জায়গায় আবিষ্কারের সন্ধানে যাচ্ছি। কিছুদিন আমার খবর না পেলে চিন্তা কোরো না। তাই রূপা আজও আশা ছাড়েনি।

কিন্তু ওই ফোটোতে আপনি কী কু পেলেন? আমি অধৈর্যভাবে জিজ্ঞেস করলাম। কু-টা হল, ওই হ্যাট এবং টাই। ওগুলো খুব সম্ভব ডক্টর সর্বজ্ঞর। খেয়ালি মানুষ ডক্টর সর্বজ্ঞর আর এক খেয়াল ছিল সর্বদা ওইরকম হ্যাট আর ওই রকম লালের ওপর নীল ডোরাকাটা টাই ব্যবহার করা। আমি রূপার কাছ থেকে ডঃ সর্বজ্ঞর একটা ফোটো এনেছি। সেটা তিনি মেয়েকে চিঠির সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। তাতেও ঠিক ওই রকম হ্যাট ও টাই পরা।

শুধু তাই না, আমি বলব, ঠিক ওই হ্যাটটাই তিনি পরে রয়েছেন। কারণ ফোটোতে ডক্টর সর্বজ্ঞর টুপির সামনের দিকে একটা খাঁজকাটা ভাঙা চিহ্ন রয়েছে। আমি মিলিয়ে দেখলাম সর্দারের টুপিতেও হুবহু ওই একই রকম খাঁজ রয়েছে। ওই টুপি আর টাই ইন্ডিয়ান সর্দার পেল কী করে, তাই আমি জানতে চাই।

খুব সোজা। সুনন্দ বলল। ডক্টর সর্বজ্ঞ সর্দারকে ওগুলো দিয়েছিলেন।

কিন্তু দেবে কীভাবে? সেটাই তো রহস্য। ডক্টর সর্বজ্ঞ যেখানে নিখোঁজ হন সেখান থেকে ওই সর্দারের বাস অন্তত ষাট-সত্তর মাইল দূরে।

সুনন্দ বলল, হতে পারে ডক্টর সর্বজ্ঞ নিরুদ্দেশ হবার আগে ওই জায়গায় গিয়েছিলেন। তখন সর্দার ওই হ্যাট আর টাই আদায় করে।

কিন্তু সেখানেও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মামাবাবু বলেন, কারণ ডক্টর সর্বজ্ঞ মেয়েকে তার শেষ চিঠিতে লেখেন–অনেক দিন কোনো ফোটো পাঠাইনি বলে রাগ করেছিস। কী করব, ছিল না যে! এবারে তাই পাঠালাম। দেখ তোর বাবা কেমন দারুণ। পোজ দিয়েছে। অর্থাৎ মনে হয় ফোটোটা তোলা হয়েছিল চিঠিটা লেখার অল্প দিন আগে। চিঠিতে পেরুতে এক ছোট্ট শহর পুয়ার্টো ম্যালভোনাডোর পোস্টমার্ক। ওই শহরে ডক্টর সর্বজ্ঞ তাঁর শেষযাত্রার আগে কয়েকদিন কাটিয়েছিলেন…যাহোক, ওই হ্যাট-পরা সর্দারের দেখা পেলে এসব ধাঁধা পরিষ্কার হবে। জানা যাবে, কবে এবং কীভাবে ও হ্যাট-টাই পেয়েছে। আর তারপর হয়তো জানব ডক্টর সর্বজ্ঞর ভাগ্যে কী ঘটেছে।

শেষ চেষ্টা করলাম, “আচ্ছা মামাবাবু, এই ফোটোর ক্লু যদি অনুসন্ধান কমিটিকে জানিয়ে দেন?

মাথা নাড়লেন মামাবাবু।–কোনো লাভ নেই। একজন বিদেশির জন্যে ওরা খুব গা দিয়ে খুঁজেছে বলে মনে হয় না। তাদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করে দেখেছি। বিরক্ত হয়। তাদের ধারণা, বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ আমাজনের বনে একা একা যখন ঘুরতে গেছেন তখন এমন দুর্ঘটনা তো হতেই পারে। ওই সরকারি কর্মচারীদের মতে, ডক্টর সর্বজ্ঞ একজন ছিটগ্রস্ত ব্যক্তি। নিখোঁজ হয়ে তাদের অযথা হয়রানি করেছেন। আমার বিশ্বাস, ক্ল-টা পেলে ওরা তো কিছু চেষ্টা করবেই না, উল্টে আমরা ওখানে যেতে চাইলে ভাববে ওদের ওপর টেক্কা দিচ্ছি। ফলে তারা বাধাও দিতে পারে। তার চেয়ে না জানানোই ভালো। লোকে জানুক বেড়াতে যাচ্ছি, ছবি তুলতে যাচ্ছি। হ্যাঁ, মার্কোকেও আমাদের মতলব এখন না বলাই উচিত। কী জানি যদি বেঁকে বসে?

.

০২.

কুজকো থেকে আমরা উড়োজাহাজে চেপে মাদ্রে দে দিওস নদীর পারে ছোট্ট শহর পুয়ার্টো ম্যালডোনাডোয় উপস্থিত হলাম। এখান থেকে লঞ্চে রওনা হব হিথ নদী দিয়ে।

মামাবাবু ও মার্কো ডক্টর কেন্ট নামে এক ব্যক্তির খোঁজ করতে শুরু করলেন। প্রকৃতপক্ষে এই কেন্টের সন্ধানেই আমাদের ম্যালডোনাডোয় আসা।

মামাবাবু বললেন, সার্চ-পার্টির রিপোর্টে আছে, ডক্টর সর্বজ্ঞ তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রার আগে এই লোকটির বাড়িতে কয়েক দিন থাকেন। আমি জানতে চাই সর্বজ্ঞ ডাক্তারকে কোনো গোপন জায়গায় যাত্রা সম্বন্ধে কিছু আভাস দিয়েছিলেন কিনা! মনে হয় দেননি। কারণ অনুসন্ধানী দল ডাক্তারের কাছে খোঁজখবর করেছিল। কিছু জানতে পারেনি। দেখা যাক চেষ্টা করে।

মার্কোর ইচ্ছে ডাক্তারের কাছে একজন ভালো মাঝির খোঁজ করবেন। সেই হবে গাইড। অচেনা গাইড নেওয়া বিপজ্জনক। এখানকার স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানরা খুব ভালো মাঝি, কিন্তু খামখেয়ালি। হঠাৎ তাদের মেজাজ বিগড়ে গেলে যাত্রীদের ফেলে পালাবে। সভ্য জগৎ থেকে বহু দূরে অজানা গভীর বনের মধ্যে তখন এক অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়। গতবার মার্কো একবার এমনি বিপদে পড়েছিল। তাই ডাক্তারকে চাই।

মার্কো শুনেছে বিচিত্র লোক এই ডাক্তার। ডাক্তারি বিদ্যায় রীতিমতো সুনাম আছে, কিন্তু প্র্যাকটিসে মন নেই। অন্তত পয়সা রোজগারে উৎসাহ নেই। এই অখ্যাত জায়গায় পড়ে আছেন, প্রায়ই বনের ভিতর ঘুরে বেড়ান আর রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদের চিকিৎসা করেন। এ অঞ্চলের দরিদ্র অধিবাসীরা নাকি ডাক্তারকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। কেন্ট-এর নেশা নাকি অর্কিড ফুল। তিনি একজন জগদ্বিখ্যাত অর্কিড-বিশেষজ্ঞ।

একেবারে শহরের সীমানায় ডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারের বাড়ির গেটের সামনে এসেছি এমন সময় এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক সাইকেল চেপে বাইরে থেকে এসে আমাদের দেখে নেমে পড়লেন। বেঁটেখাটো গোলগাল লোকটি, মাথাজোড়া টাক। মার্কো বলল, এটা কি ডাক্তার কেন্টের বাড়ি? আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

লোকটি কৌতূহলী চোখে চেয়ে বলল, “আমিই জর্জ কেন্ট। আপনারা?

মার্কো আমাদের পরিচয় দিল। ডাক্তার বললেন, চলুন ভিতরে।

প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডওলা কাঠের তৈরি বাংলো ধরনের বাড়ি। চারপাশে বাগান, তাতে নানান ফল-ফুলের গাছ। সামনে বারান্দার ছাদে বুগেনভিলিয়ার লতা টকটকে লাল ফুলে ছেয়ে আছে। বারান্দায় উঠে বেতের চেয়ারে বসলাম। মার্কো তার আগমনের উদ্দেশ্য বলল। কেন্ট বললেন-আচ্ছা সে হবে। আপাতত কফি হোক। মেরি! মেরি!

ডাক্তারের স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। ভারি স্নিগ্ধ চেহারা মহিলার। আলাপের পর হেসে বললেন, আপনাদের ডাক্তার যে এমন খ্যাতিমান ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন জানতাম না। দেশবিদেশ থেকে সম্মানিত ভদ্রলোকরা সব আসছেন তার কাছে। যাক, ভালো ভালো। আমি তো ভাবি ও বুনো হয়ে গেছে।

একটু পরে এল কফি, স্যান্ডউইচ আর কাজুবাদাম ভাজা।

ডাক্তারের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে উঠেছেন কোথায়?

বললাম, “ইচ্ছে আছে কোনো হোটেলে থাকব।

আরে ছি! ছি! এখানকার হোটেল অতি জঘন্য। আমাদের বাড়িতে থাকুন। আমরা খুব খুশি হব। ডাক্তারের ভদ্রতা-জ্ঞান নেই। এখনও পর্যন্ত এ-বিষয়ে কোনো খোঁজই নেয়নি।

ডাক্তার গম্ভীরভাবে বললেন, “দেখ মেরি, ওঁরা যে এখানে থাকবেন সে ডিসিশন আমি অলরেডি নিয়ে ফেলেছি। শুধু সুযোগ বুঝে কথাটাপাড়বার অপেক্ষায় ছিলাম। ডাক্তার ও মেরি কখনও ইংরেজি কখনও স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলছিলেন। মেরি জাতিতে ইংরেজ। ডাক্তার স্কচ। তারা কয়েক পুরুষ এ দেশে আছেন।

এদেশের বেশিরভাগ লোক স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে, কারণ স্প্যানিয়ার্ডরাই প্রথম পেরুতে বসতি স্থাপন করে। এখানে আসার আগে মামাবাবুর নির্দেশে আমরা কিছু স্প্যানিশ ভাষায় তালিম নিয়েছিলাম, আর অভিযানে বেরুবার আগে মার্কো শিখিয়েছেন, এখানকার অধিবাসীদের প্রচলিত ভাষা টোপি, সামান্য কাজ চালাবার মতো। ফলে কথাবার্তা আমরা মোটামুটি বুঝতে পারছিলাম।

কথার ফাঁকে ডাক্তার মামাবাবুকে প্রশ্ন করলেন, আপনারা ইন্ডিয়ার কোন অংশের লোক?

ইন্ডিয়া এবং ক্যালকাটা শুনে একটু থমকে গিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! আর একজন ক্যালকাটার লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। সায়ান্টিস্ট সর্বজ্ঞ। চেনেন তাকে?

মামাবাবুর চোখ চকচক করে উঠল। বললেন, চিনি, তবে সামান্য। আচ্ছা, সবজ্ঞর নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারটা কেমন রহস্যজনক নয় কি? না পাওয়া গেল দেহ, না পাওয়া গেল তার জিনিসপত্র। এমনও হতে পারে বৈজ্ঞানিক কোথাও আটকে পড়েছেন। বন্দী বা। অসুস্থ হয়ে আছেন। ফিরে আসতে পারছেন না।

হুঁ। হতে পারে। ডাক্তার মাথা নাড়েন। আমি একবার নিরুদ্দেশ হয়েছিলাম মেক্সিকোয়। মেরি তিন মাস আমার কোনো খবর পায়নি।

আচ্ছা, সর্বজ্ঞ ম্যালডোনাডো ছাড়বার আগে উনি কোথায় যাচ্ছেন সে-বিষয়ে আপনাকে কিছু বলেছিলেন?

না।

সংক্ষিপ্ত উত্তর। মনে হল যে এ-বিষয়ে আলোচনা করতে ডাক্তার অনিচ্ছুক। হয়তো তাকে অনেক জেরা করা হয়েছে, তাই এ-ব্যাপারে তার বিরক্তি জন্মেছে।

মার্কো ছবি তুলতে লেগে গেল। রক্তবর্ণ বুগেনভিলিয়ার ঝাড় ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে মেরির ফোটো তুলল। মামাবাবু বললেন, একটা কথা মনে পড়ল। আমি সাউথ আমেরিকায় আসার আগে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর মেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে। দুর্ঘটনার কিছুদিন আগে সর্বজ্ঞ মেয়েকে তার একখানা ফোটো পাঠিয়েছিলেন। ওঁর মেয়ে বলেছে, ফোটোতে সর্বজ্ঞ মাথায় শোলার হ্যাট ও লাল নেকটাই পরেছিলেন। গায়ে নেভি-বু শার্ট। ফোটোটা মেয়ে হারিয়ে ফেলেছে। ওই ফোটোর আরও কপি সে চায়। আমায় জোগাড় করে নিয়ে যেতে বলেছে। একমাত্র মেয়ে। বড্ড ভেঙে পড়েছে। আচ্ছা এখানে সর্বজ্ঞ কি কোনো ফোটো তুলেছিলেন? তুললে, কে তুলেছেন সেটা জানেন?

ডাক্তার বলল, “আমি স্বয়ং ওই ফোটো তুলি। দেব আপনাকে এক কপি। ফেরার সময় নিয়ে যাবেন।

মেরি আক্ষেপের সুরে বললেন, বৈজ্ঞানিক তার মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন, জানি। কী চমৎকার লোক ছিলেন! অত বড় পণ্ডিত, অথচ কোনো অহঙ্কার নেই। ইস, কী কাণ্ড যে হয়ে গেল!

আমি সুনন্দর দিকে অর্থপূর্ণভাবে চাইলাম। অর্থাৎ মামাবাবুর অনুমান ঠিক। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ তার চেয়ে অনেক দূরে গিয়েছিলেন। নইলে তাঁর টুপি আর টাই ওই সর্দার পেল কী করে?

মামাবাবু নির্বিকার। বললেন, মিসেস কেন্ট, ফেরার সময় দয়া করে ছবিটার কথা আমায় মনে করিয়ে দেবেন। নইলে লজ্জায় পড়ব রূপার কাছে।

কথায় কথায় মামাবাবু ডাক্তারকে বললেন, শুনেছি আপনি রেড-ইন্ডিয়ান উপজাতিদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদের চিকিৎসা করেন?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ করি। কারণ সরল আদিবাসীদের আমি ভালোবাসি। আর আমি মনে করি, এটা আমার কর্তব্য। আমার শ্বেতাঙ্গ পূর্বপুরুষরা এখানকার আদিবাসীদের অনেক অত্যাচার করেছে। তাদের ক্রীতদাস করে, পশুর মতো ব্যবহার করেছে। আমি কলঙ্ক মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। অনেকে আমায় পাগল বলে। বলুকগে। আমি নিজে কী ভাবি জানেন? ইংকা। আমার দেহে ইংকা-রক্ত আছে। আমার ঠাকুরমা ছিলেন ইংকা-রমণী। অমন সুসভ্য জাতির লোক হওয়া আমি গৌরবের বিষয় মনে করি। স্প্যানিয়ার্ডরা অস্ত্রের জোরে এক বিরাট সভ্যতাকে ধ্বংস করে ফেলেছিল। ইংকাদের বহু জ্ঞানভাণ্ডার হারিয়ে গেল। শ্বেতাঙ্গরা যদি সেসব বিদ্যা শিখে নিত তবে মানুষের অনেক অনেক উপকারে লাগত।

ডাক্তার বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। হঠাৎ অতিথিদের সামনে বক্তৃতা দেবার লজ্জায় চুপ মেরে গেলেন। আমাদের কিন্তু এই আদর্শবাদী মানুষটির ওপর বড় শ্রদ্ধা জাগল।

সেদিন বিকেলে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।

মার্কো আর মামাবাবু শহরে গেছেন। সুনন্দ একটা বইয়ে ডুব দিয়েছে। ডাক্তারকে দেখছি না। মিসেস কেন্ট রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমি বেরিয়ে পড়লাম বাগানটা এক ঘুরে দেখতে।

অনেকটা জায়গা জুড়ে ডাক্তার কেন্টের বাগান। ফুল-ফলের গাছগুলি কিছু চেনা, কিছু অচেনা। কয়েকজন দেশি মালি কাজ করছিল বাগানে। একধারে পরপর কয়েকটা তামেন জালে তৈরি ঘর। জালে লতা উঠে ছেয়ে গেছে। কোনো ঘরে বাঁশের কঞ্চির বেড়ায় তৈরি দেওয়াল বা ছাদ। কাছে গিয়ে বুঝলাম গ্রিনহাউস। যার মধ্যে আলো, বাতাস, উত্তাপকে নিয়ন্ত্রণ করে নানারকম ফুলগাছ রাখা হয়। প্রথম ঘরের দরজা একটু ফাঁক। ভিতরে ডাক দিলাম। সবই অর্কিড গাছ। ছাদ থেকে তারে বাঁধা কাঠ বা শুকনো গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলছে নানা জাতের অর্কিড। কয়েকটা গাছসুদ্ধ টব ঝোলানো রয়েছে ছাদ থেকে। শুনেছি এই ধরনের বায়বীয় অর্কিড বৃষ্টির জল, রোদ, হাওয়া থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। মাটিতে টবে কিছু গাছ রয়েছে। ফুল ফুটেছে কোনোটায়। ভালো করে দেখতে ভিতরে ঢুকলাম।

পিছনে পায়ের শব্দ। ফিরে দেখি দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার কেন্ট। থমথমে মুখ। রুক্ষ গলায় প্রশ্ন করলেন, কী করছেন এখানে?

উত্তর দিলাম, এই দেখছিলাম, কত রকম অর্কিড?

রীতিমতো আদেশের সুরে ডাক্তার বললেন, এখন যান। পরে আমি দেখিয়ে দেব।

অপ্রস্তুত হয়ে বাংলোয় ফিরলাম। এ-ঘটনা বললাম না কাউকে।

.

০৩.

পরদিন সকালে দেখলাম ডাক্তারের আবার দিব্যি হাসিখুশি মেজাজ। আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন, চলুন অর্কিড দেখবেন।

গ্রিন-হাউসের দিকে যেতে যেতে বললেন, অর্কিড আমার নেশা। মেরি রাগ করে। বলে, বৃথা সময় আর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আবার নতুন কোনো ফুল ফুটলে যখন ডেকে দেখাই, তখন রাগ ভুলে যায়। অর্কিড গাছে বড় যত্ন লাগে। ফুল ফুটতে অনেক সময় নেয়। সাত-আট বছরও লেগে যায়। তবে হ্যাঁ, একবার ফুটলে সে-ফুল থাকে অনেক দিন। দু-তিন সপ্তাহ থেকে তিন-চার মাসও কোনো কোনো ফুল গাছে তাজা থাকে। তখন মনে হয় পরিশ্রম সার্থক।

সুনন্দ প্রশ্ন করল, অর্কিড ফুলের বিশেষত্ব কী?

মামাবাবু বললেন, প্রধানত ফুলের গড়ন। ফুলের একটি পাপড়ির গড়ন অন্য ফলের চেয়ে আলাদা হয়। একটু বড় হয় সাধারণত।

ডাক্তার বললেন, “আমি সাধারণত দক্ষিণ আমেরিকার ট্রপিকাল অঞ্চলে যত বকা অর্কিড পাওয়া যায় তাই জোগাড় করি। অবশ্য অন্য দেশের অর্কিডও আছে।

একটা গ্রিন-হাউসের ভিতর ঢুকে ডাক্তার ঘোষণা করলেন, এর মধ্যে আছে প্রধানত ক্যাটলিয়া প্রজাতীয় অর্কিড। এদের আদি বাস মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর অংশে।

ডাক্তার গাছগুলির কখনও ল্যাটিন নাম কখনও বা চলতি নাম বলতে লাগলেন।–ওই ছোট ছোট লাল ফলগুলি মিলটোনিয়া। ওই যে সাদা ফুল, মধ্যিখানে গোলাপি হলুদ মেশানো একটি পাপড়ি, ওটি ব্রাজিলের ক্যাটলিয়া ট্রিয়ানাল।

ওইসব নাম-গোত্র আমার মাথায় ঢুকছিল না।

ক্রমে গ্রিন-হাউস দেখা শেষ হল। আমার মনটা খচখচ করছে। কাল একটা অর্কিড দেখেছিলাম, সেটা আজ আর নেই। কোথায় গেল? দেখছি না তো! খোলা বাগানেও কি অর্কিড গাছ রয়েছে। গাছের ডালে ঝুলছে, মাটিতে জন্মেছে। একটা লতা দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, এই হচ্ছে ভ্যানিলা লতা। এও একরকম অর্কিড।

ঝাঁকড়া লতা একটা বড় গাছে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে। তাতে শিমের মতো ফল। চ্যাটাল সবুজ পাতা, আর হালকা সবুজ ফুল।

যে ভ্যানিলা আইসক্রিম বা চকোলেটে দেয়? আমি আশ্চর্য হয়ে বলি।

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ। ওই ফলের বীচি থেকে ভ্যানিলার গন্ধ তৈরি হয়। ভ্যানিলা কিন্তু আধুনিক মানুষের আবিষ্কার নয়, পাঁচশো বছর আগে মেক্সিকোর আজটো চকোলেটে ভ্যানিলা মিশিয়ে খেত।

একটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, এই অর্কিড আমার সৃষ্টি। চার রকম অর্কিডের মিশ্রণে এটা তৈরি। এরকম আরও কটা নতুন ফুল আমি তৈরি করতে পেরেছি।

একটু গর্বের সঙ্গে বললেন ডাক্তার, তাছাড়া পাঁচ রকম নতুন অর্কিড আমি আবিষ্কার করেছি, কুড়ি বছর দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেরিয়ে।

কুড়ি বছরে মাত্র পাঁচ! সুনন্দ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

ডাক্তার বললেন, আমি তো সৌভাগ্যবান। অনেকে সারা জীবনে একটাও নতুন অর্কিড আবিষ্কার করতে পারে না।

ঘণ্টা দুই পরে ফিরলাম।

সুযোগ পাওয়া মাত্র মামাবাবুকে জানালাম, কাল একটা ফুল দেখেছিলাম, সেটা আজ আর কোথাও দেখলাম না। একটু আশ্চর্য লাগছে।

কাল? মানে?

মামাবাবুকে গতকালের ঘটনাটা খুলে বললাম। ডাক্তার কেন্টের অদ্ভুত ব্যবহারের কথাটাও বাদ দিলাম না। বললাম, চমৎকার ফুলটা। ঢুকেই আমার চোখে পড়েছিল। গাঢ় নীলরঙা পাপড়িগুলি। মাঝের একটা পাপড়ি শিঙার মতো মাথা উঁচু করে রয়েছে, তার গায়ে গোলাপি আভা। আজ সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কোনো গ্রিন-হাউসে নেই।

মামাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, রঙ ঠিক মনে আছে?

হুঁ আছে। গন্ধও মনে আছে। চমৎকার মিষ্টি সুবাস।

সুনন্দ বলল, কোণের গ্রিনহাউসটা তালা মারা ছিল। আমরা ঢুকিনি। সেটায় রাখা হয়েছে হয়তো।

মামাবাব গম্ভীরভাবে বললেন, আজ সন্ধেবেলা সেটা জানার চেষ্টা করব। অসিত কাউকে বোলো না কিছু এ-বিষয়ে।

ব্যাপারটা মামাবাবু এত সিরিয়াসলি নেবেন ভাবিনি।

সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই মামাবাবু হুকুম দিলেন–চলো। ডাক্তার রুগী দেখতে বেরিয়েছেন, মার্কো ক্যামেরা নিয়ে খুটখাট করছে। এই সুযোগ।

হালকা জ্যোৎস্না ফুটেছে। দূরে মালিদের কুটিরের সামনে আগুন জ্বেলে রান্না হচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে সেই বন্ধ গ্রিনহাউসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মামাবাবু জালের ভিতর দিয়ে টর্চের আলো ফেললেন ভিতরে। ওই তো সেই গাছ! সেই নীল ফুল। আমি উত্তেজিতভাবে দেখাই।

মামাবাবু প্রায় আধ মিনিট ফুলটা লক্ষ করলেন। তারপর চিন্তিতভাবে বাড়ির দিকে ফিরে চললেন।

আমরা দুজনও তার পাশাপাশি চলেছি, হঠাৎ অন্ধকারে বিদ্যুতের মতো কী এক প্রাণী লাফিয়ে পড়ল সামনে। সঙ্গে সঙ্গে টর্চ ফেলে ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। একটা জাগুয়ার। প্রকাণ্ড আকার। হলদের ওপর কালো ছোপ ছোপ, দেহটা টান টান। ওৎ পেতে বসে দন্ত বিকশিত করে গরগর করছে আমাদের দিকে চেয়ে। তার লেজ অল্প অল্প নড়ছে, সবুজ চোখ দুটো জ্বলছে হিংস্র রাগে।

এবার দেবে লাফ। আমার গলা শুকিয়ে এসেছে, বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে। কিন্তু বাঘটা দেরি করছে কেন? সহসা কানে এল ডাক্তারের গলা–মাংকো।

অমনি বাঘটা পিছন ফিরে দেখল একবার। পরমুহূর্তে দীর্ঘ লাফে অদৃশ্য হয়ে ঝোঁপের আড়ালে।

দৌড়ে এলেন ডাক্তার। একি, অন্ধকারে বেরিয়েছেন কেন? খুব ভয় পেয়েছেন তো?

মামাবাবু প্রথম কথা বললেন, ওটা কি আপনার পোষা বাঘ?

হ্যাঁ, আক্রমণ করে না কাউকে। তবে অচেনা মানুষ দেখলে ভয় দেখায়। দিনেও ছাড়া থাকে। আপনারা আছেন বলে শুধু রাতে ছাড়ছি। আমার বলে রাখা উচিত ছিল।

বুক ধড়ফড়ানি কমতে বেশ কিছুটা সময় নিল। আজকের ঘটনার পর ডক্টর কেন্টকে আরও রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে।

পরদিন আমরা ম্যালডোনাডো ছাড়লাম। লঞ্চে মামাবাবু আমাদের দুজনকে আড়ালে বললেন, ওই নীল অর্কিড বড় ভাবিয়ে তুলল যে!

কেন?

বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ তাঁর মেয়েকে লিখেছিলেন–একটা নতুন অর্কিড পেয়েছি। অপূর্ব নীল রঙের ফুল। তারপর যা বর্ণনা দিয়েছেন তা হুবহু এই ফুলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। প্রশ্ন হল- সর্বজ্ঞর আবিষ্কার ডাক্তার কেন্টের হাতে এল কী করে? কেনই-বা উনি এ-ফুল। আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চান?

বললাম, “হয়তো সর্বজ্ঞ ডাক্তারকে গাছটা উপহার দিয়েছেন।

মামাবাবু বললেন, তাহলে এত লুকোচুরির দরকার কী?

সুনন্দ বলল,ডাক্তারকে তো প্রথমে দেখে খুব ভালো লোক বলেই মনে হয়েছিল।

মামাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, পৃথিবীতে এমন অনেক সৎ লোক আছেন যাঁরা তাঁদের শখের জিনিস সংগ্রহ করতে এমন সব কাণ্ড করে বসেন যা সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তাই করা যায় না! রূপা বলেছে, অর্কিড ফুলে নীল রঙ দুর্লভ! আর সর্বজ্ঞ লিখেছেন যে, এমন চমৎকার নীল অর্কিড আগে নাকি কখনও পাওয়া যায়নি।

আমি বললাম, ডাক্তারকে ওই ফুল সম্বন্ধে প্রশ্ন করলেন না কেন?

মামাবাবু বললেন, তাতে লাভ হত না। কারণ প্রমাণ কী? যদি বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর হদিস পাই তখন এ-রহস্যের কিনারা হতে পারে। আর তা না হলে বাধ্য হয়ে ডাক্তারের মুখ থেকে জোর করেই ওই অর্কিড এবং সর্বজ্ঞ সম্বন্ধে কথা আদায় করতে চেষ্টা করব।

বেশ চওড়া নদী মাদ্রে দ্য দিওস। দুপাশে ঘন উদ্ভিদরাজি। লোকালয় প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের লঞ্চ বেশ বড়, তাতে যাত্রীও অনেক। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, তাম্রবর্ণ রেড-ইন্ডিয়ান ইত্যাদি নানা জাতের মানুষ রয়েছে। আর রয়েছে কিছু গরু, ছাগল, মুরগি।

নানা বাণিজ্যসম্ভার উঠেছে লঞ্চে। কাঁদি কাঁদি কলা, রবারের গোলা, আখ, পেঁপে, ভুট্টা ইত্যাদি। তাছাড়া আধুনিক জগতে তৈরি টিনের খাবার, জামা-কাপড়, ওষুধপত্র। বনভূমিতে নিঃসঙ্গ খামারগুলির এসব জিনিস বড় দরকার।

এখানে লোকগুলো কেমন বেপরোয়া। কেমন যেন একটা গা-ছাড়া ভাব। সময় কেউ যেন ব্যস্ত নয়। লঞ্চ থামলে ধীরেসুস্থে ওঠে নামে, কথায় কথায় তর্ক বাধে। প্রায় কাছে পিস্তল বা ছুরি থাকে, যখন তখন টেনে বার করে। আবার দেখেছি পরস্পরের ভাবও হয়ে যায় চট করে! আমরাও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েছি। তবে মার্কোর ভাষায় শুধু আত্মরক্ষা এবং খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে। অরণ্য-অভিযানে উপস্থিত বুদ্ধি এবং দৃঢ় নার্ভই প্রধান হাতিয়ার।

এই লঞ্চেই বুড়ো পেড্রো লোপেজ আমার ও সুনন্দর নজরে পড়ে। ছোটখাটো মানুষটি নোংরা পোশাক পরে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে। মুখে অজস্র ভাঁজ। হুড দেওয়া জকি টুপি মাথায়। দাঁতে পাইপ কামড়ে চক্ষু মুদে ঝিমুচ্ছে।

একজন খালাসি চেঁচিয়ে বলে উঠল, “কী গো পেড্রো লোপেজ! যাচ্ছ কোথায়? নতুন কোনো খোঁজ-টোজ পেলে নাকি?

বৃদ্ধ তির্যক দৃষ্টিতে চাইল খালাসির দিকে, উত্তর দিল না।

খালাসি আবার বলল, এই বয়সে বেশি ঘোরাঘুরি কিন্তু ভালো নয় বুড়ো।

চকিতে খাড়া হয়ে উঠল বৃদ্ধের দেহ। ভাঙা গলায় হুঙ্কার ছাড়ল, খবরদার, বুড়ো বলবি নে! জানিস আমার হাতের টিপ এখনও কেমন? দেখবি নাকি পরীক্ষা করে?

ছোকরা খালাসি চট করে আড়ালে সরে গিয়ে মন্তব্য করল, উঃ, কী রাগী বুড়ো রে বাবা!

একজন বয়স্ক লোক পেড্রোকে কী জানি কী বলতেই সে তেড়ে উঠল। থাক, আর উপদেশ দিতে হবে না। আমার ভালো-মন্দ আমি বুঝব। জেনে রাখ–লোপেজ বংশের কেউ বিছানায় শুয়ে মরে না। মূখের দল! আমায় ঠাট্টা করা! হু-বরাত যদি ভালো হয় তো প্রমাণ করে দেব ফার্দিনান্দ লোপেজের কথা সত্যি কিনা।

পেড্রো সবার মুখের পানে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে তাকাল। মামাবাবু ও মার্কো অবশ্য ও-দৃশ্য দেখেননি।

হিথ নদীর সঙ্গমস্থলে আমরা লঞ্চ থেকে নামলাম।

গ্রামের ঘাটে পেড্রো লোপেজকে আবার দেখলাম। শুধু দেখা নয়, কথাও হল। পেড্রো। নিজেই এসে আমাদের বলল, তোমরা কোন দেশের লোক?

সুনন্দ বলল, ইন্ডিয়া।

উত্তরটা শুনে পেড্রো কিছুক্ষণ আমাদের দিকে চেয়ে থেকে আবার প্রশ্ন করল–তোমরা যাচ্ছ কোথায়?

সুনন্দ জবাব দিল, হিথ নদীতে ঘুরব। ছবি তুলব।

হুঁ…

পেড্রো ভুরু কুঁচকে বলল, “তোমাদের দেশ থেকে আরেকজন এসেছিল এখানে, তোমরা তার কেউ হও কি?

আমরা অবাক। কী উত্তর দেব ভেবে পাই না।

বুড়ো কিছুক্ষণ আমাদের দিকে চেয়ে থেকে উল্টোদিকে ঘুরে চলে গেল।

এবার আমরা টমকে খুঁজে বের করলাম। টম অল্পবয়সী আধা-ইন্ডিয়ান। ভালো মাঝি! দুটো ক্যান জোগাড় হল। ক্যানু হচ্ছে একরকম হালকা ছোট নৌকো। টম ছাড়া আরও তিনজন দেশি মাঝি নিলাম সঙ্গে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে নৌকো বোঝাই করে আমরা দুদিন পরে জলে পড়লাম। ক্রমে হিথ নদীতে প্রবেশ করলাম। শুরু হল আমাদের আসল অভিযান।

.

০৪.

নিবিড় অরণ্যময় আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। গত তিন দিনে একটিমাত্র অন্য নৌকোর দেখা পেয়েছি। দুজন স্পেনীয় ব্যবসায়ী উপজাতিদের গ্রাম থেকে রবার সংগ্রহ করে ফিরছিল।

হিথ নদী চওড়া নয়, কিন্তু খরস্রোতা। দুধারে ঘন উদ্ভিদের রাজ্য। এ-বনের মজা হচ্ছে পাখি বা কীটপতঙ্গ ছাড়া বড় জীবজন্তুর দেখা সহজে পাওয়া যায় না। তবে কান পাতলে নানারকম ডাক শোনা যায়। আমাদের মাঝিদের তীক্ষ্ণ চোখ অবশ্য গাছের পাতার আড়ালে অনেক অদৃশ্য জীবের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। আর যেটা সকলেই দেখতে পায় সেটা হল বাঁদরের দাপাদাপি।

পাখি আর প্রজাপতি কত রকমের! সন্ধ্যার মুখে ঝাঁকে ঝাকে ওড়ে হলদে-সবুজ টিয়াপাখিরা। কর্কশ কলরবে নদীতট মুখর করে তোলে। দক্ষিণ আমেরিকার বড় জাতের টিয়া, যাদের বলে ম্যাকাও, সেগুলির পালকের রঙ দেখবার মতো। সবুজ, হলদে, লাল ও নীল মেশানো বিচিত্র বর্ণ। ঝড়ের মতো উড়ে যায় জোড়ায় জোড়ায়।

জলের মধ্যে ছোঁ মারে মাছরাঙা। বেনেবউয়ের মিষ্টি ডাক শোনা যায়। জলের ধারে লম্বা পা ফেলে পায়চারি করে সারস। কখনও দেখি ধ্যানমগ্ন বক। টুকটুকে লাল আইবিস সবুজের ভিতর চমৎকার দেখায়।

ধীরে ধীরে এগোই! কখনও নৌকো থামিয়ে তীরে উঠে বনে ঢুকি। মার্কো ছবি তোলে। পশু-পাখির। খোঁজে উপজাতি বসতি। মামাবাবু খোঁজেন নতুন প্রাণীর স্পেসিমেন। নদীতীরে যাও-বা কিছু পশুপাখি চোখে পড়ে, বনে ঢুকলে সব মিলিয়ে যায়, মিশে যায় গাছপাতার আবরণে।

এ-বনে পায়ে হেঁটে ঘোরা বড় কঠিন কাজ। বিশাল বিশাল মহীরুহের তলায় দিনের বেলাতেও সন্ধ্যার অন্ধকার। গাছের গুঁড়িকে পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠে গেছে মোটা মোটা লতা সূর্যালোকের সন্ধানে। মাথার অনেক ওপরে ডাল-পাতার ঘন আচ্ছাদন। কদাচিৎ একফালি রোদ এসে তিরের মতো মাটিতে পড়ে। বড় গাছের তলায় ঝোঁপঝাড়। কাটাগাছে গা ছড়ে যায়।

গাছপালা বেশিরভাগ অচেনা। মার্কো চিনিয়ে দেয়। কটন-উড, ব্রেজিল-নাট, নানা জাতীয় পাম। কোথাও দেখি জংলা পেঁপে আর কলা বন। একদিন মার্কো বলল, কাছেই নিশ্চয় রবার গাছ আছে। ওই শোন সেরিংগারো পাখির ডাক। ওই পাখি রবার গাছের গায়ে পোকা খায়।

প্যাচপ্যাচে কাদা জমিতে পুরু পাতার আস্তরণ। আমাদের বুট বসে যায়। মার্কো সাবধান করে দিল, দেখে শুনে পা ফেল। গর্তের মধ্যে পাতা জমে দিব্যি মরণফাঁদ হয়ে থাকে। ভুল করে ডুবে যাবে।

সবুজ, সবুজ আর সবুজ! রঙিন ফুল বনের ভিতর খুব কম। শুধু কখনও দেখিস গাছ উঁচু কোনো গাছের ডালে দুলছে। লম্বা উঁটির মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ নানা রঙের ফুল। চোখ-কান সজাগ রেখে এগোই।

একদিন বনের মধ্যে দিয়ে চলেছি, হঠাৎ আমার মাথায়, মুখে মাকড়সার জাল জড়িয়ে গেল। ছাড়াতে পারি না। মনে হচ্ছে যেন একটা মাছধরার জাল। স্থির হয়ে দাঁড়াও অসিট। মার্কোর কণ্ঠস্বর। তারপরই লাঠির আওয়াজ পাই–সপাং! চোখ পরিষ্কার করে দেখলাম মাটিতে মস্ত এক কোঁকড়ানো মাকড়সা। মার্কো বলল, আপাজাইকা স্পাইডার। ভাষণ বিষাক্ত এর কামড়।

প্রত্যেকের হাতে লাঠি থাকে। বিষাক্ত সাপের ভয়।–জারারাকা, বুস মাস্টার, ব্যাটল সাপ।

একটা জলাভূমিতে ফোটো তুলতে গিয়েছিলাম মার্কোর সঙ্গে। জলাতে প্রচুর এলিগেটর-কুমির ছিল। বেশ বড় কিন্তু অগভীর জলা। কুয়ারানা গাছ জন্মেছে জলার ভিতর। কুয়ারানা অনেকটা বাংলাদেশের সুঁদরী গাছের মতো। ছবি কিন্তু বেশিক্ষণ তোলা গেল না। কারণ প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিতে হল। না, কুমিরের তাড়া নয়, জোঁক। অসংখ্য জোঁক লাফাতে লাফাতে এল তেড়ে। আঙুলের মতো মোটা আর বিঘৎ খানেক লম্বা জোঁকগুলো। বাপরে, ওদের খপ্পড়ে পড়লে আর রক্ষা ছিল না।

নদীপথে ছোট ছোট জলপ্রপাত পড়ে প্রায়ই। দুরন্ত গতিতে জল ছুটেছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথরের চাইয়ের পাশ দিয়ে। লাফ দিয়ে পড়ছে কয়েক হাত নিচের পাথরের ওপর। মাঝিরা কী নিপুণ কৌশলে পাথর কাটিয়ে নৌকো নিয়ে যায়! কখনও জলে নেমে হাতে নৌকো টেনে পার করে জলপ্রপাতের বাধা। আমি ও সুনন্দ সুযোগ পেলেই নৌকো চালানো অভ্যেস করি। মার্কো অবশ্য এ-বিদ্যেতে ওস্তাদ।

রাতে বেশির ভাগসময় শুই তীরে গাছের ডালে হ্যামক বা দড়ির দোলনা-বিছানা টাঙিয়ে। কখনও শুই নৌকোয় বা তীরে তাঁবু খাঁটিয়ে। ভোরবেলা প্রায়ই বাঁদরের উৎপাতে মেজাজ বিগড়ে যায়। চকচকে লাল-রঙা মাইসিটি জাতের বাঁদরের গর্জনে কঁচা ঘুম যায়। ভেঙে। উঃ, কী বিকট চিৎকার! মনে হয় একদল উন্মাদ রণহুঙ্কার দিচ্ছে। আসলে কিন্তু মাত্র একটি বা দুটি পুরুষ-বাঁদরের গলা। কালো রঙের মেরিমোলে নামে বাঁদরগুলোও কম শয়তান নয়। হ্যামকের দড়ি ধরে এমন ঝাঁকায় যে ভয় হয় বুঝি ছিটকে পড়ব মাটিতে। ইচ্ছে হতো দিই বেটাদের গুলি মেরে খতম করে।

হ্যামকে শুয়ে মাথার ওপর দেখি গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঝকঝকে নক্ষত্রখচিত টুকরো টুকরো আকাশপট। শুনি কানে তালা-ধরানো ঝিঁঝির ডাক। ব্যাঙের কর্কশ গম্ভীর গলার গান। ঝক ঝক জোনাকির আলোয় একটি একটি গাছ কেমন ভুতুড়ে লাগে। অবাক হয়ে ভাবি, এ কোথায় আমি? যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা অভিযানে বেরিয়েছি তা সফল হবে। তো? ডক্টর সর্বজ্ঞকে খুঁজে পাব কি আমরা? তিনি কি বেঁচে আছেন, না সত্যিই তার সলিলসমাধি হয়েছে?

চারদিনের দিন মার্কো জানাল যে এক উপজাতি গ্রাম আছে সামনে তীরের কাছে বনের মধ্যে। আমরা গিয়ে দেখি একটু ফাঁকা জায়গায় তিন-চারটে বড় বড় কুটির। চারজন অচেনা বিদেশির আবির্ভাব প্রথমে কিছু আদিবাসী স্ত্রীলোক এবং ছোট ছেলেমেয়েদের নজরে পড়ল। অমনি দুড়দাড় করে সবাই দিল ছুট। সঙ্গে ছুটল তাদের পোষা কুকরগুলো। মানষে পশুতে পায়ে পায়ে জড়িয়ে কেউ পড়ল গড়িয়ে। চেঁচামেচি করতে করতে লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন পুরুষ। তাদের হাতে তির, ধনুক, বর্শা।

মার্কো চিৎকার করে দেশি ভাষায় বলতে লাগল–আমরা বন্ধু, আমরা বন্ধু। তখন গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এল। ওরা আমাদের সর্বাঙ্গ চাপড়ালো। আমরাও তাই করলাম। দেখতে দেখতে তাদের সন্দেহ কেটে গেল, আমাদের তারা বন্ধু বলে মেনে নিন

রেড-ইন্ডিয়ানদের চেহারা অনেকটা আমাদের দেশের নাগাদের মতো। খালি গায়ে নানা রঙের নকশা। মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম, মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের সাজসজ্জার বহর কিঞ্চিৎ বেশি। ছেলে বা মেয়েদের পরনে গাছের ছাল বা সুতির পোশাক। আধুনিক প্যান্ট বা পেটিকোটও পরেছে কেউ কেউ।

এই উপজাতিরা চাষ করে, মাছ ধরে। আমাদের উপহার দিল–কলা, ভুট্টা, ম্যানডিওকা। ম্যানডিওকা রাঙালুর মতো উদ্ভিদমূল। তার আটা বানিয়ে রুটি করে খায় এখানকার আদিবাসীরা। আমরা পরিবর্তে দিলাম পুঁতির মালা, লোহার বঁড়শি, রঙিন কাপড়।

মার্কো ওদের পিয়ানো একর্ডিয়ান বাজিয়ে শোনাল। ওরা তো মুগ্ধ। কেবল বলে, আরও বাজাও। শব্দ বের হলেই সবাই হেসে কুটিপাটি। এমন অদ্ভুত আওয়াজ তারা। কস্মিনকালেও শোনেনি।

আরও দু-তিনটে উপজাতি গ্রামে গিয়ে ছবি তোলা হল। সবার মেজাজই যে নরম তা নয়। কেউ কেউ বেশ উগ্র, বিদেশিদের পছন্দ করে না।–মার্কো কিন্তু ঠিক তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল।

একদিন নদী তীরে তাঁবু ফেলে বিশ্রাম করছি। দুপুরবেলা। মার্কো হঠাৎ প্রশ্ন করল, প্রোফেসর ঘোষ, এইভাবে খুঁজে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর হদিশ পাবেন কি?

চমকে গেলাম মার্কোর কথা শুনে। মামাবাবুও অবাক। বললেন–আপনি জানলেন কী করে যে আমি বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর খোঁজ করছি?

মার্কো হাসল। আমার চোখ ও কান আছে। ডক্টর কেন্টকে অত প্রশ্ন করলেন আপনি। ইন্ডিয়ানদের গ্রামে গিয়ে সর্বজ্ঞর ফোটো দেখিয়ে খোঁজখবর করছেন। সব আমি লক্ষ করেছি। জানি বৈজ্ঞানিক সর্বত্তর কেস রহস্যজনক। কিন্তু সঠিক কোনো ক্লু পেয়েছেন কি?

মামাবাবু খানিক চুপ করে থেকে বললেন, পেয়েছি।

কী?

মামাবাবু সমস্ত বললেন। ভিক্টরের তোলা সেই ফোটো, দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে সত্যনাথ সর্বজ্ঞর হ্যাট ও টাই পরা উপজাতি সর্দারের ছবি। এ-বিষয়ে মামাবাবুর অনুমান।

শুনে মার্কো উত্তেজিত হয়ে উঠল–ইস, আগে বলতে হয়! মিছিমিছি কটা দিন নষ্ট হল। চলুন সোজা সর্দারকে ধরিগে।

সেইদিনই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।

আমি আর সুনন্দ বনে ঢুকেছি। ইচ্ছে সজারু বা এগুটি পেলে শিকার করব। প্রকাণ্ড একটা গাছের কাছে গিয়ে শুনি কেমন বিচিত্র আওয়াজ হচ্ছে। কড়মড় মড়মড় জাতীয়। কীসের শব্দ? আবিষ্কারের চেষ্টায় ওপরে চেয়ে আছি, দেখলাম এক দঙ্গল টিয়াপাখি গাছ থেকে বেরিয়ে উড়ে পালাল। হঠাৎ সামনে আমাদের দুজনকেই চমকে দিয়ে আবির্ভূত হল আমাদের এক চেনা লোক।-পেড্রো লোপেজ। সে হুঙ্কার ছাড়ল–সরে এসো ওখান থেকে–এক্ষুনি।

অবাক হয়ে দেখছি তাকে। পেড্রো খ্যাঁক করে আমাদের জামা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল। ওঃ, বুড়োর গায়ে তো আচ্ছা জোর!

বেশ খানিকটা যাবার পর নিজেদের ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বললাম, কী ব্যাপার।

উত্তরের আগেই এক কর্ণভেদী শব্দে শিউরে উঠলাম। সেই বিশাল গাছটা সমস্ত অরণ্যটাকে কাঁপিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আর আধ মিনিট ওখানে থাকলে আমরা ওই গাছের তলায় চাপা পড়ে পিষে যেতাম।

পেড্রো পাইপে টান দিয়ে বলল, বৃষ্টির জলে শিকড় আলগা হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে পড়ছিল গাছটা। জঙ্গলের জ্ঞান নেই মূর্খ। মরতে এক্ষুনি!

কী বলে ওঁকে ধন্যবাদ দেব ভাবছি, এমন সময় পেড্রো বলল–ম্যাপটা পেলে কোথায়?

বললাম, ম্যাপ! কীসের ম্যাপ?

পেড্রো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। বটে, বলবে না? চেপে যাচ্ছ? দেখ, একজন ভারতীয় মরেছে। তোরাও মরবি। লোপেজ বংশের হক্কের ধন গাপ মারা অত সোজা নয়। বুঝলি?

পেড্রো হন করে বনের ভিতর অদৃশ্য হল।

স্তম্ভিত হয়ে থেকে বললাম, লোকটা পাগল নাকি?

সুনন্দ বলল, হতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর বিষয়ে কি ও কিছু জানে? ওর কোনো হাত আছে নাকি? শুনলি ওর কথা? এমন খ্যাপাটে লোক অনেক সময় ডেনজারেস হয়।

তাঁবুতে ফিরে মামাবাবু ও মার্কোকে পেড্রোর কথা জানালাম। দুজনেই একটু চিন্তিত হলেন। মার্কো বলল, খেয়াল রেখো, লোকটাকে আবার দেখলে ধরব। জানতে হবে সর্বত সম্বন্ধে ও কী জানে!

দুঃখের বিষয় আমরা আর পেড্রোর দেখা পেলাম না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, পেডো ঠিক আমাদের অনুসরণ করছে লুকিয়ে লুকিয়ে।

.

০৫.

নৌকো চলেছে। দুপাশে সেই একঘেয়ে বনভূমি, সেই একই প্রাণিজগৎ। নতুনত্বের মধ্যে একটা বিশাল আনাকোন্ডা দেখলাম। জলের কিনারে গাছের ডাল পাকে পাকে জড়িয়ে মাথা ঝুলিয়ে ওৎ পেতে ছিল, দক্ষিণ আমেরিকার এই অজগর। ভাগ্যিস দেখতে পেয়েছিল। মাঝিরা, কোনোরকমে একটা গাছের ঝুরি আঁকড়ে নৌকো থামিয়ে ফেলল। তারপর অনেকখানি সরে এড়িয়ে গেল সেই মহাসর্পের উদ্যত আলিঙ্গন।

আর সুনন্দ একদিন ইলেকট্রিক ইল মাছের শক খেল। ইল আমাদের দেশের বান মাছের মতো দেখতে। লম্বাটে গড়ন। মাঝিরা জাল পেতে মাছ ধরছিল নদীতে। একটা ছোট ইলেকট্রিক ই আটকা পড়েছিল তার মধ্যে। সুনন্দ মাছ বের করতে জালের ভিতর হাত ঢোকাতেই শক খেয়ে কুপোকাৎ। বেচারার শরীর অনেকক্ষণ অসাড় হয়ে ছিল। মার্কো প্রাণপণে ম্যাসাজ করে সুনন্দকে সুস্থ করে তুলল। তারপর শুরু হল তার ঠাট্টা।–কী হে বীরপুরুষ, বুঝছো তো কী ডেনজারেস এই দেশ! এখনও ভেবে দেখ ফিরে যাবে কিনা?

শুনলাম বড় ইলেকট্রিক ইল-এর শকে নাকি মানুষের জীবনহানিও ঘটতে পারে।

আমরা এক ব্যারাকায় উপস্থিত হলাম।

এদেশে চাষ বা পশুপালন খামারকে বলে ব্যারাকা। নদী থেকে মাইলখানেক দূরে বনের ভিতর অনেকখানি জমি পরিষ্কার করে খামার তৈরি হয়েছে। মালিক এক জার্মান, নাম মুলার। কাঠের বাংলোবাড়িতে বৃদ্ধ একা থাকে, সঙ্গে থাকে কয়েকজন দেশি পরিচারক। চাষবাস করে, গরু, ছাগল পোষে, উপজাতীয় লোকে শ্রমিকের কাজ করে। এমন গহন বনে সভ্য মানুষের বাস কল্পনা করিনি। মার্কো বলল, আমাজন অববাহিকার। অরণ্যে এমন অনেক ব্যারাকা আছে।

মুলার আমাদের পেয়ে ভীষণ খুশি। অনেক কষ্টে জোগাড় করা মহা মূল্যবান বিস্কুট এবং কফি খাওয়াল। রাঁধুনিকে অর্ডার দিল, অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য আজ কচ্ছপের স্যুপ আর টেপিরের মাংস বানাও।

মুলার গল্প করল যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সে ছিল একজন মেজর। হিটলারের মতবাদ পছন্দ না হওয়াতে একবার পেরুতে জাহাজ আসতে সোজা নেমে পালিয়ে যায় আমাজনের বনে। যুদ্ধের শেষে দেশে গিয়ে দেখে আপনজন প্রায় সবাই মারা গেছে, তাই আবার ফিরে আসে দক্ষিণ আমেরিকায়।

মুলার খুব দাবার ভক্ত। বলল, দাবা খেলার লোভে মাঝে মধ্যে শহরে যাই। বেশিদিন টিকতে পারি না কিন্তু।

মুলার অনুরোধ করেছিল, আরও কিছুদিন থেকে যাবার জন্য, কিন্তু আমাদের তাড়া ছিল তাই বিদায় নিলাম।

মলারের ব্যারাকা ছাড়ার সময় দুজন লোক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হিথ নাতে একখানা ডিঙিনৌকোয় বসে তারা চুরুট টানছিল এবং আমাদের লক্ষ্য করছিল।

মার্কো বলল, ডাক্তার বলেছে, এ-অঞ্চলে কয়েকজন পলাতক বিদ্রোহী সেন্য আর নিয়েছে। তারা লুটপাট ছিনতাই করছে। এ লোক দুটোর হাবভাব সন্দেহজনক। দেখ, কোমরে আর্মি বেল্ট।

আরও দুদিন নদীপথে যাত্রার পর আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম। তীরে কয়েকজন রেড-ইন্ডিয়ান ঘোরাঘুরি করছিল। মার্কো তাদের ডাকল। এরা বেশ সপ্রতিভ, ডাকতেই কাছে এল। আমরা চারজনে ওদের সঙ্গে ওদের গ্রামে চললাম।

সর্দারকে চিনতে অসুবিধা হল না। অবিকল সেই ফোটোর মুখ। তবে হ্যাট বা টাই নেই। কিছু নুন উপহার দিতে সে বেজায় খুশি, কারণ জঙ্গলে নুনের বড় অভাব। বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর ফোটো এবং ভিক্টরের তোলা সর্দারের ফোটো দেখিয়ে মার্কো সর্দারের সঙ্গে কিছু আকার-ইঙ্গিতে, কিছুটা ভাষার সাহায্যে আলাপ শুরু করল।

সর্দার মন দিয়ে নিজের ফোটোখানা দেখল। তারপর হঠাৎ উঠে এক কুটিরের মধ্যে ঢুকে গেল। কী ব্যাপার!

অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার আবির্ভূত হল সর্দার। এবার তার মাথায় সেই গোল শোলার টুপি, গলায় সেই টাই বাঁধা। দু-বগলে দুই সঙ্গীকে চেপে ধরে সে ইশারা করল, ছবি তোলো।

মার্কো তৎক্ষণাৎ ছবি তুলে সর্দারের সঙ্গে আরও কিছু কথা বলে মামাবাবুকে জানাল, সর্দার সর্বজ্ঞকে চিনেছে। এখানে এসেছিলেন। পাথরে লেগে তার নৌকো ফুটে হয়ে যায়। ইন্ডিয়ানরা তার নৌকো মেরামত করে দেয় তাই পুরস্কারস্বরূপ সর্দার ওই টুপি এবং টাই চেয়ে নেয়। পরদিন সকালে দেখে বৈজ্ঞানিক চলে গেছেন। কোন দিকে গেছেন তা সে জানে না।হ্যাঁ, বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে একজন ইন্ডিয়ান অনুচর ছিল। সে অন্য জাতের লোক।

মামাবাবু খুব নিরাশ হলেন। তিনি আশা করেছিলেন এখানে সর্বজ্ঞ সম্বন্ধে সঠিক কোনো খবর পাবেন।

নির্জন নদীতীরে বিকেলবেলা।

নদীর ওপরে গাছের মাথায় ঘন সবুজ পল্লবগুচ্ছের গায়ে রাঙা রোদ পড়ে চকমক করছে। ছুটন্ত জলের বুকে থিরথির করে কাঁপছে বাঁশ আর তালগাছের ছায়া। মামাবাবু আর মার্কো গেছেন উপজাতিদের গ্রামে। মাঝিরা বনে ঢুকেছে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করতে। সুনন্দ তাঁবু খাটাবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ কী হে ছোকরারা?

বিষম কর্কশ গলায় স্প্যানিশ ভাষা শুনে চমকে ফিরলাম।

সেই দুই মূর্তিমান মুলারের খামারের কাছে যাদের দেখেছি, তাদের একজনের হাতে উদ্যত পিস্তল। পিস্তলধারী গর্জন করে উঠল, “খবরদার, নড়লেই গুলি করব। মাথার ওপর হাত তোলো।

মাটিতে বসে ছিলাম। অগত্যা বসে বসেই হাত তুললাম।

পিস্তলধারী তার সঙ্গীকে বলল, র‍্যাপসো, দেখ তো হে মালকড়ি কী আছে?

র‍্যাপসে হামলে পড়ল আমাদের ব্যাগগুলোর ওপর। টপাটপ খাবারের টিন ও প্যাকেটগুলো বের করতে করতে র‍্যাপসো খ্যাক খ্যাক করে হেসে মন্তব্য করল, “বুঝলে রস, আজ দারুণ কপাল। ঘুম ভেঙেই আর্মাডিলো দেখে তখনই বুঝেছি আজ দিন ভালো যাবে।

খুশির চোটে পিস্তলধারী রস একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। তার চোখ মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছিল লুটের মালের ওপর। দুই অর্বাচীন ভারতীয় ছোকরা সম্বন্ধে বিশেষ সতর্ক থাকার প্রয়োজনবোধ করছিল না। নয়তো ভেবেছিল এক ধমকই যথেষ্ট। আমি লক্ষ করলাম লোকটা মাটিতে বিছানো তাঁবুর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সুনন্দকে ইশারা করলাম। তারপর যেই লোকটা একবার আমাদের থেকে চোখ সরিয়েছে ঝট করে হাত নামিয়ে তাঁবুর কাপড় আঁকড়ে মারলাম এক হেঁচকা টান। একসঙ্গে দুজনেই কুপোকাৎ।

সঙ্গে সঙ্গে রসের পিস্তল সরব হয়ে উঠল। কিন্তু বেটাল হয়ে ফসকে গেল টিপ। পা হড়কে মাটিতে বসে পড়ল। পিস্তল ছিটকে গেল হাত থেকে। নিমেষে পকেট থেকে রিভলবার বের করে রসের মাথা তাক করে বললাম, এবার তোমাদের পালা। হাত তোলো। উঠে দাঁড়াও, নইলে–

ইতিমধ্যে সুনন্দ র‍্যাপসোকে লক্ষ্য করে রিভলবার বাগিয়েছে। মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়ানো দুই বন্দীর অবস্থা হল দেখবার মতো। রাগে লজ্জায় মুখ তাদের ভয়ঙ্কর হয়ে। উঠেছে।

মামাবাবুরা ফিরলেন একটু পরে। এই দৃশ্য দেখে তারা তো চমৎকৃত। মার্কো হেসে বলল, সাবাস ব্রাদার! নাঃ, তোমাদের যত নাবালক ঠাউরে ছিলাম তত নও। ঘুঘু দুটোকে আচ্ছা জব্দ করেছ।

মার্কো ওদের প্রশ্ন করল, “তোমরা নিশ্চয় জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর দলের পলাতক সৈন্য। বেড়ে ব্যবসা ধরেছ তো হে! টম, লোক দুটোকে বাঁধো।

মামাবাবুর আচরণে আমরা আশ্চর্য হলাম। তিনি র‍্যাপসের কাছে গিয়ে তার শার্ট পরীক্ষা করতে লাগলেন।

র‍্যাপসোর ছেঁড়া সস্তা খাকি প্যান্টের সঙ্গে অমন দামি নেভি-ব্লু শার্টখানা বেমানান বটে, কিন্তু তা নিয়ে অত মাথা ঘামাবার কী দরকার?

এ শার্ট কোথায় পেয়েছ? মামাবাবু কঠোর স্বরে প্রশ্ন করলেন।

কেন? র‍্যাপসো খেঁকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল।

দরকার আছে। ঠিক ঠিক জবাব দাও।

আমি কিনেছি।

বটে! বনের ভিতর দোকান আছে নাকি?

মামাবাবুর কণ্ঠে বিদ্রূপ–আবার পয়সা দিয়ে এত ছোট মাপের শার্ট কিনেছ! র‍্যাপসো নিরুত্তর।

মামাবাবু মার্কোকে বললেন, শার্টটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। ভীষণ চেনা-চেনা লাগছিল। বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ ফোটোতে ঠিক এমনি শার্ট পরে রয়েছেন। বুকের কাছে সাদা ফুল তোলা। তুমিও মিলিয়ে দেখ ফোটোর সঙ্গে।

মামাবাবু ব্যাগ থেকে ফোটো বের করলেন। আমরা দেখলাম–অবিকল সেই শার্ট।

মামাবাবু বললেন, আপাতত জানতে হবে এ শার্ট ও পেল কী করে এবং সর্বত্তকে ওরা কী করেছে? মনে হচ্ছে এরা সর্বজ্ঞর ওপর ডাকাতি করেছিল। দেখ চেষ্টা করে কথা বের করতে পারো কিনা।

মার্কো গম্ভীর বদনে ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর মোলায়েম গলায়। বলল–মিস্টার র‍্যাপসো, বড়ই দুঃখের বিষয় তুমি এমন অসময়ে বোবা হয়ে গেলে। যাক এই রোগের দুটো দাওয়াই আমার মনে পড়েছে। দেখ কোনটি তোমাদের পছন্দ হয়।

প্রথম নম্বর, তোমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাব এবং তারপর গভর্নমেন্টের হাতে সমর্পণ করব। বিদ্রোহী সৈন্য হিসেবে আশা করি তোমাদের ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হবে। দ্বিতীয় নম্বর, তোমাদের দুটিকে নদীর ধারের ওই দুটো গাছে বেঁধে রাখব। গাছগুলো নিশ্চয় চেনা। বন্দী করে নিয়ে যাওয়া ঝামেলা। তাই দ্বিতীয় ওষুধটাই প্রথমে এক্সপেরিমেন্ট করা যাক।

দুই বন্দী ঘাড় ফিরিয়ে গাছ দুটো দেখল। স্পষ্ট দেখলাম তাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কৌতূহল হল ওটা কী গাছ?

নদীতীরে কয়েকটি গাছ দাঁড়িয়ে। ছোট ছোট গাছ, সোজা সুরু গুঁড়ি। গুঁড়ির নিচের অংশে ডালপালা নেই। একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম যে, প্রত্যেক গাছের গোড়ার চারপাশে মাটিতে এক কণাও ঘাসের চিহ্ন নেই।

মার্কো এবার আমাদের উদ্দেশ্য করে বলল, ওই গাছের নাম পালো-সান্টো। দেখতে নিরীহ, কিন্তু আসলে অতি মারাত্মক। এই গাছের প্রত্যেকটি কাঠ হল কাঠপিঁপড়ের ডিপো। যে কোনো প্রাণী ওই গাছ স্পর্শ করলেই অগুনতি পিঁপড়ে তাকে তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করবে। কয়েক ঘণ্টা ওই গাছের গায়ে বেঁধে রাখলে বাছাধনদের মুখে আশাকরি বাক্য ফুটবে। ইন্ডিয়ানরা এইভাবে তাদের অপরাধীদের শাস্তি দেয়। শুনেছি প্রায় আসামী অসহ্য যন্ত্রণায় উন্মাদ হয়ে যায়। কেউ কেউ মারাও যায়।

র‍্যাপসো ও রস হাউমাউ করে উঠল। সেনর, দয়া করুন। সব বলছি।

বেশ, বলো। আমরা ওই শার্ট লুট করে পেয়েছি।

কতদিন আগে?

সাত-আট মাস হবে।

একে চেনো? মামাবাবু সর্বজ্ঞর ফোটো বের করলেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ, এই লোকেরই জিনিস।

কী করেছ তাকে? খুন?

না না। দুজনে সরবে আপত্তি জানায়। আমরা তার গায়ে হাত দিইনি। ও তখন ছিল । ওর জিনিস নিয়ে একজন ইন্ডিয়ান মাঝি নৌকোয় বসেছিল। তাকে ভয় দেখিয়ে আমরা কিছু খাবার আর পোশাক কেড়ে নিই।

সত্যি কথা? কড়া ধমক দেয় মার্কো।

সত্যি, মা মেরির দিব্বি।

তারপর? মামাবাবু প্রশ্ন করেন। তারা নৌকো নিয়ে কোন্ দিকে গেল?

তা জানি না। তবে মাঝিটা বলছিল, তারা নাকি পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের গ্রামের দিকে যাবে।

সে কোন দিকে?

এই নদীপথে কিছু এগিয়ে ডান পাশের এক শাখানদী ধরে গেলে পাহাড়ে পৌঁছনো যায়। তিন-চার দিনের পথ।

ওই দুজন আবার ফিরে এসেছিল এ-পথে? মামাবাবু জানতে চান।

না। পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের হাতে হয়তো মারা পড়েছে। ওই ইন্ডিয়ানরা দারুণ হিংস্র।

তোমরা ঠিক জানো?

হ্যাঁ। এই নদীতে আমাদের চোখ এড়িয়ে কেউ যাওয়া-আসা করতে পারে না। ডাক্তার কেন্ট ফিরেছিল, কিন্তু ওরা ফেরেনি।

মামাবাবু তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন-তোমরা চেনো ডাক্তারকে?

চিনি, তবে আলাপ নেই। ডাক্তারকে এ-অঞ্চলে সবাই চেনে। ওদের কণ্ঠে বেশ সমীহ ফুটে ওঠে।

ভক্তার এ-পথে গিয়েছিল? মামাবাবু জানতে চান।

হ্যাঁ।

কবে?

ওরা চলে যাবার দুদিন পরে।

ডাক্তার ফিরল কবে?

তিন-চার দিন পরে।

বন্দী দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হল।

মামাবাবু গম্ভীরভাবে একটা পাথরের ওপর বসলেন।

আবার সেই রহস্যজনক ডাক্তারের অস্তিত্ব। বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর সঙ্গে এই ডাক্তারটির যোগাযোগ বারবার আবিষ্কার করছি। কেন ডাক্তার এসেছিল সর্বজ্ঞর পিছনে পিছনে? কিন্তু এ-বিষয়ে সে কাউকে কিছু বলেনি তো! কেন এই লুকোচুরি? আমার মনে ডাক্তারের আচরণের একটাই ব্যাখ্যা খুঁজে পাই। ডাক্তার লুকিয়ে লুকিয়ে বৈজ্ঞানিককে অনুসরণ করে যায় পাহাড়ের দিকে। তারপর তাকে সরিয়ে দিয়ে হাত করেছে সর্বজ্ঞর আবিষ্কার সেই নীল অর্কিড। অর্কিড হয়তো সর্বজ্ঞর সঙ্গে ছিল। কিংবা ওটা ডাক্তারের কাছে গচ্ছিত রেখে তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ না থাকলে সেক্ষেত্রে ডাক্তার হবে ওই অর্কিডের মালিক। কারণ আর কেউ জানে না এই আবিষ্কারের কথা।

মামাবাবু মুখ তুললেন।–মিঃ মার্কো, মনে হচ্ছে ওই পাহাড়িদের গ্রামেই এই রহস্যের শেষ সূত্রটি লুকিয়ে আছে। আমি নিশ্চিত জানতে চাই ডাক্তারের সঙ্গে সর্বজ্ঞর ওখানে দেখা হয়েছিল কিনা? না অন্য কোনো দুর্ঘটনায় পড়েন সর্বজ্ঞ। যদি বুঝি ডাক্তার কেন্টই বৈজ্ঞানিকের মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাহলে–মামাবাবু দাঁতে দাঁত চাপলেন।

–এখন আমি ওই পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের কাছে যাব। আপনি কি যাবেন সঙ্গে? আপনার যা খুশি।

মার্কো উত্তর দিল, আলবৎ যাব। এমন মিস্ত্রির শেষ অধ্যায়ে আমি কি বাদ পড়ব? সে হতেই পারে না।

.

০৬.

পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের সম্বন্ধে মার্কো যে রিপোর্ট আনল তা বেশ ভয়ের। ওরা দুর্দান্ত জাত। অন্য উপজাতির সঙ্গে মোটে মেলামেশা নেই। বিদেশি কেউ ওদের এলাকায় যাওয়া পছন্দ করে না। অনেকে ওই অঞ্চলে গিয়ে আর ফেরেনি। কদাচিৎ ওদের নদীপথে দেখা যায়। হিথ নদীর পশ্চিম পাশে কয়েকটা জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় আছে, তারই একটায় ওদের বাস।

টম ও অন্য মাঝিরা অনিচ্ছা প্রকাশ করল ওই এলাকায় যেতে। ঠিক হল ওরা এইখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। শুধু আমরা চারজন যাব একটা নৌকো নিয়ে।

পরদিন সকালে আমরা যাত্রা করলাম। বিকেল নাগাদ ডান দিকের এক শাখানদীতে প্রবেশ করলাম। এই স্রোতধারাই আমাদের পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে যাবে।

ক্ষীণ জলধারা এঁকেবেঁকে চলেছে। জল কম, কিন্তু স্নোত প্রখর। দুধারে ঝুঁকে পড়েছে গাছপালা। যেন উদ্ভিদে তৈরি সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে চলেছি। ধারে কাছে জনমানবের চিহ্ন নেই। মানুষের কোলাহল, গাড়ির আওয়াজ, ইলেকট্রিক আলোর ঝলমলানি–এসব যেন স্বপ্নের বস্তু।

নিজেরা দাঁড বাইছি। বারবার জলপ্রপাতের বাধায় ভীষণ অসুবিধায় পড়তে লাগলাম। তখন আমরা জলে নেমে ধার দিয়ে ক্যানু ঠেলে নিয়ে চলতে লাগলাম।

প্রথম রাতে এক উপদ্রব ঘটল। ভোরবেলা হ্যামক থেকে নেমে ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখি ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। মার্কো পরীক্ষা করে বলল, এ ভ্যাম্পায়ার ব্যাট-এর কীর্তি। তাড়াতাড়ি এলাকাটা পেরিয়ে গেলাম।

পরদিন দুপুরে সুনন্দ এক কাণ্ড করে বসল। নদীতীরে ঘাসের ওপর শুয়ে চোখ বুজে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি সবাই, হঠাৎ সুনন্দর চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। মার্কো মুহূর্তে রাইফেল তুলেছে। পরক্ষণেই সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। দেখি একটা ভাল্লুকের মতো জন্তু, কিন্তু মুখে ছোট্ট শুড়, বনের মধ্যে পালাল। সুনন্দ স্তম্ভিতভাবে প্রশ্ন করল–কী ওটা?

অ্যান্টইটার। জানাল মার্কো।

“ওঃ, আমার আঙুল সুড়সুড় করে উঠল। আমি ভাবলাম বুঝি–

বুঝেছি, ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। কিন্তু জেনে রাখো, রক্তপায়ী বাদুড় দিনে বেরোয় না। নিশ্চয় পিঁপড়ে উঠেছিল তোমার পায়ে, এ-বেচারা লম্বা জিভ দিয়ে সেগুলো খাচ্ছিল। উপকার করতে গিয়ে তোমার লাথি খেয়েছে।

তিন দিন, তিন রাত কাটল। উঃ, কী কষ্টকর যাত্রা! বারবার জলে নেমে নৌকো টানতে গিয়ে পাথরে পা কেটে ক্ষতবিক্ষত হল। মশা-মাছির আক্রমণে হাত-মুখ উঠল ফুলে। চতুর্থ দিনে দেখলাম নদী দুই ধারায় ভাগ হয়ে গেছে। সোজা পথটা নিলাম বেছে। মাইলখানেক এগোবার পর বিরাট এক জলাভূমির ভিতর গিয়ে পড়লাম। অগভীর জলা। ওপারে পাহাড়, ঘন বনে ঢাকা। এই জলা পেরিয়ে পাহাড়ে পৌঁছনো যায় কিনা আলোচনা করছি, মার্কো চেঁচিয়ে উঠল–সাবধান, সাপ!

আশেপাশে লক্ষ করে শিউরে উঠলাম। জলে অগুনতি সাপ। ভয়ানক বিষধর জারারাকা সাপের বিচরণক্ষেত্রে এসে পড়েছি। নৌকোর চারধারে হিস হিস গর্জন। প্রকাণ্ড লম্বা কয়েকটা সাপ নলখাগড়ার গা বেয়ে নৌকোয় লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। সপাং সপাং লাঠি চালালাম। সাপগুলো লাঠির ঘায়ে একটু দূরে সরে যেতে কোনোরকমে নদীতে পালিয়ে গেলাম। মাত্র আধঘণ্টা কেটেছিল ওই জলায়, কিন্তু সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি কখনও ভুলব না।

পরদিন নদীর দ্বিতীয় ধারাটা অনুসরণ করে আমরা এগোলাম।

আমাদের জন্য এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা অপেক্ষা করছিল।

পরদিন সকালে সুনন্দকে নদীতীরে রেখে আমি, মার্কো ও মামাবাবু বনের ভিতরে গিয়েছিলাম। সুনন্দর ডান হাঁটু পাথরে ঘা লেগে ফুলে উঠেছিল। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, তাই যায়নি আমাদের সঙ্গে। মার্কো খাবার জন্য কয়েকটা পাখি শিকার করল। মামাবাবু একরকম ছোট্ট বাঁদর মারমোসেট-এর ধরন-ধারণ লক্ষ করলেন অনেকক্ষণ ধরে। এইভাবে ঘণ্টা দুই কাটিয়ে নৌকোয় ফিরে আমরা চমকে উঠলাম। নদীতীরে আমাদের জিনিসপত্র সব লণ্ডভণ্ড অবস্থায় ছড়ানো। নৌকোটা উল্টিয়ে পড়ে আছে পাড়ে।

আর সুনন্দ নেই!

সুনন্দ! সুনন্দ! অনেক ডাকাডাকি করলাম। কোনো সাড়া মিলল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম, কিন্তু সুনন্দকে পাওয়া গেল না।

মার্কো জমি পরীক্ষা করে বলল, “ইন্ডিয়ানরা এসেছিল নৌকো করে। ওরা নিশ্চয় সুনন্দকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। ধস্তাধস্তির চিহ্ন দেখছি। কিছু জিনিসও চুরি করেছে লোকগুলো। তবে রক্তের দাগ দেখছি না। সম্ভবত সুনন্দ তেমন আহত হয়নি। বন্দী করে নিয়ে গেছে ওকে।

মামাবাবুর মুখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠল। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, চলো, এখুনি বেরোই। ইন্ডিয়ানদের ধরতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে ওদের আস্তানা। হয়তো তাড়াতাড়ি করলে সুনন্দর প্রাণ বাঁচাতে পারব।

তখুনি নৌকো নামালাম জলে। প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগলাম। মার্কো একবার বাঁকা হেসে বলল, জানো অসিট, অনেকদিন শিকার প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। অকারণ প্রাণিহত্যা আর করি না। কিন্তু সুনন্দকে যদি ফিরে না পাই, ওই পাহাড়ি ইন্ডিয়ানগুলোকে আমি এমন শিক্ষা দেব! মার্কোর চোখ দুটো যেন দপ করে জ্বলে উঠল।

বুঝলাম, এই আমুদে রসিক লোকটির মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা দুর্দান্ত মানুষটা আবার জেগে উঠেছে।

তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ক্ষতি হল। হঠাৎ পাথরে ঠোক্কর লেগে নৌকোর তলা গেল ফেঁসে। এবার হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। মার্কো বলল, ফেরার সময় একটা ভেলা তৈরি করে নেব, অবশ্য যদি ফিরি।

নৌকো তীরে তুলে রাখলাম। ভারী জিনিস সব বাক্সবন্দী করে সেখানে রেখে দেওয়া হল। বাকি জিনিস পিঠে নিয়ে হাঁটা দিলাম। আমার মনে কেবল একটা চিন্তাই ঘুরছে–সুনন্দ নেই। কী হল সুনন্দর? আবার তার সঙ্গে দেখা হবে তো? সমস্ত ব্যাপারটা যেন ভারি অবাস্তব মনে হচ্ছে। ও কি সত্যি হারিয়ে গেল চিরকালের মতো? তাহলে। আমিই বা ফিরব কোন মুখে? সুনন্দর সঙ্গে বহু দিনের বন্ধুত্বের কত টুকরো টুকরো স্মৃতি ভেসে ওঠে মনে।

মামাবাবু একটা টিনের কৌটো কুড়িয়ে পেলেন। বায়ুশূন্য মাংস রাখার টিন। অর্থাৎ কোনো শহুরে মানুষের পদার্পণ ঘটেছিল কিছুকাল আগে। কে সে? হয়তো বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ। এই পথে গিয়ে তিনি হারিয়ে গেছেন, বুনো পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের খোঁজে। সুনন্দও পড়েছে তাদের খপ্পরে।

আমাদের অদৃষ্টেও জানি না কী অপেক্ষা করে আছে ওই অজ্ঞাত বনভূমির নিষিদ্ধ এলাকায়!

আরও দুর্ভোগ লেখা ছিল কপালে।

আকাশে কালচে মেঘ জমছিল সকাল থেকে। বিকেল নাগাদ ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে নামল প্রবল বৃষ্টি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নদী ফুলে-ফেঁপে কূল ছাপিয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে নদীতীর ছেড়ে বনের ভিতর সরে গেলাম।

বৃষ্টির ছাঁট আর সূর্যালোকে ভালো দৃষ্টি চলে না। প্রকৃতির এই তাণ্ডবে বনের সব। পশু-পাখি নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপন করেছে। শুধু বুঝি আমরা তিনটি মানুষ বাইরে বেরিয়েছি। ওয়াটারপ্রুফ মুড়ি দিয়ে সতর্কভাবে পা ফেলছি–ছপ ছপ ছপ। সামনে মার্কো, পিছনে মামাবাবু ও আমি। পায়ের নিচে কোনো চোরা গর্তে যে কোনো সময় তলিয়ে যেতে পারি। ফোঁস করে মাথা তুলতে পারে কোনো হিংস্র সরীসৃপ। লা-মন্টানার ট্রপিকাল অরণ্য যেন তার সমস্ত দুর্গমতা দিয়ে আমাদের বাধা দেবার চেষ্টা করছে। সুউচ্চ বৃক্ষকাণ্ডগুলিকে পাশ কাটিয়ে, ঝোঁপঝাড় সরিয়ে ধীরে ধীরে এগোই।

ক্রমে পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপস্থিত হলাম।

সন্ধ্যা নেমেছে, দিনের সব আলোটুকু গেছে মুছে। টর্চের আলোর রেখার দুপাশ থেকে জমাট অন্ধকার যেন চেপে আসে। ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝিলিকে আকাশ যাচ্ছে চিরে, সঙ্গে কানে তালা-ধরানো মেঘ-গর্জন।

পাহাড়ের তলায় ঘন বাঁশঝাড়। বাঁশের তীক্ষ্ণ ডগাগুলিকে সাবধানে এড়িয়ে চলি। মার্কো বলল, একটা গুহা খুঁজি, নইলে সারা রাত ভিজতে হবে।

পাহাড়ের গায়ে পিছল পাথরের ওপর দিয়ে খানিকটা উঠে সৌভাগ্যক্রমে একটা গুহা পেলাম। ভিতরে আলো ফেলতেই দুজোড়া সবুজ চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অপোসাম। খটাশ জাতীয় প্রাণী। জন্তু দুটো আমাদের দেখে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল। দুর্যোগের রাতে তারা আশ্রয় ছাড়তে চাইছে না। যা হোক টর্চের তীব্র আলোয় ভয় পেয়ে তারা বাইরে পালাল।

চট করে স্টোভ জ্বেলে কফি বানিয়ে ফেললাম। গুহার মধ্যে কয়েকটা পোড়া কাঠ পড়েছিল। কেউ আগুন জ্বেলেছিল। সেগুলো ধরিয়ে রাখলাম গুহার মুখে। যাতে বুনো জন্তু

ঢোকে। সবাই নীরব, অবসন্ন। প্রিয়জনকে হারানোর দুঃসহ আশঙ্কা ক্রমে চেপে বসছে বুকে। শুধু মার্কো মাঝে মাঝে উৎসাহ দিচ্ছিল আমায়। বলছিল, “আরে ভয় পেও না, সুনন্দকে ঠিক ফিরিয়ে আনব, দেখ। যদিও জানি, সত্যি সত্যি এমন ভরসা সেও করতে পারছিল না।

একটু পরে গুহার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে আকাশ দিব্যি পরিষ্কার। কিন্তু সারাদিন ঘুরেও পাহাড়ি উপজাতির দর্শন পেলাম না। সন্ধে নাগাদ একটা ছোট সমতল জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছি, পায়ে ব্যথা, শরীর অবসন্ন। সহসা খেয়াল হল অনেকগুলি ছায়ামূর্তি আমাদের ঘিরে ধরেছে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে কাঠ হয়ে গেলাম। বুনো রেড-ইন্ডিয়ান! প্রত্যেকে ধনুকে তির লাগিয়ে কান অবধি ছিলা টেনে আমাদের দিকে তাক করে আছে। আস্তে আস্তে মাথার ওপর হাত তুললাম।

মার্কো দেশি ভাষায় চেঁচিয়ে বলতে লাগল, আমরা শত্রু নই বন্ধু। কিন্তু তাদের ভাবগতিকে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হল না। তাদের মুখ কঠোর, চোখে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টি। একজন এসে আমাদের বন্দুক ও পিস্তলগুলি নিয়ে নিল। অর্থাৎ আগ্নেয়াস্ত্রের মহিমা এরা জানে। তারপর তারা আমাদের হাত-পা শক্ত করে বাঁধল দড়ি দিয়ে। নিরুপায় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম।

কয়েকজন রেড-ইন্ডিয়ান আমাদের পকেট পরীক্ষা করতে লাগল। কিছু কিছু পছন্দসই জিনিস তারা বাজেয়াপ্ত করে এক জায়গায় জড়ো করে রাখল। বাকি জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দিল। একজন মামাবাবুর ব্যাগ খুলেই এক চিৎকার। তার হাতে দেখি বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর ফোটোখানি।

এরপর তারা উত্তেজিতভাবে আলোচনা শুরু করল। হাতে হাতে ঘুরছে ফোটোটা। মামাবাবু বললেন, সর্বজ্ঞকে ওরা চিনতে পেরেছে। ইস, যদি কথা বলা যেত!

কিন্তু কোনো কথাবার্তা বলতে ওরা রাজি নয়।

একটু পরে একজন ভারিক্কি চেহারার লোক এসে উপস্থিত হল। তার গায়ে রঙচঙে সুতির আলখাল্লা, মাথায় পালকের মুকুট। হয়তো দলের সর্দার। সে ফোটোখানা হাতে নিয়ে দেখল। তারপর আমাদের তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে আবার ফিরে চলে গেল।

এইভাবে বন্দী হয়ে পড়ে রইলাম সারারাত। ইন্ডিয়ানরা আমাদের পাহারা দিতে লাগল। “কী গো বীরপুরুষেরা! লাগছে কেমন? মার্কোর চোখে হাসির ঝিলিক। তারপরই মার্কোর কণ্ঠে কেমন যেন আবেগ ফুটল,-ভাই অসিট, তোমাদের অনেক ঠাট্টা করেছি। কিন্তু সত্যি বলছি মনে মনে তোমাদের আমি বীরপুরুষ বলে স্বীকার করেছি। তোমরা সত্যি অসাধারণ। সাহস ও ধৈর্য দেখিয়েছ। ব্রেভ ইয়াংম্যান।

তারপর একটু থেমে মুচকি হেসে বলল, হয়তো আর অভিনন্দন জানাবার সুযোগ পাব না তাই বলে রাখছি। হাত ভোলা নেই, ফলে হ্যান্ডসেক করতে পারলাম না। সরি! আর বড় দুঃখ হচ্ছে, সুনন্দর সঙ্গে বুঝি আর দেখা হল না।

মার্কোর কথায় বুঝলাম আসন্ন বিপদের গুরুত্ব জিজ্ঞেস করলাম–এরা কী করতে চায় আমাদের নিয়ে?

ঠিক বঝছি না। মনে হয় মতলব ভালো নয়। জীবনে অনেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। মরণের ফাঁদ কেটে বেরিয়েও গেছি। যদি বুঝি সত্যি এরা আমাদের হত্যা করতে চায়, তা হলে এবারও চেষ্টা করব।

কীভাবে?

হাতের বাঁধন আমি ঠিক খুলে ফেলব। তারপর পা। ওই দেখ ঢিপির ওপরে আমাদের বন্দুক আর পিস্তলগুলো। প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে যদি একবার ওই গুলিভরা বন্দুক বা পিস্তল হাতাতে পারি তাহলে একচোট লড়ব। অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচব কিনা বলা শক্ত। এদের তিরের ফলায় থাকে মারাত্মক কুরারি বিষ। একবার রক্তে মিশলে আর রক্ষে নেই।

মামাবাবু যেন নির্বিকার। শুধু একবার মার্কোকে বললেন, এই ইন্ডিয়ানদের চেহারা আর পোশাক দেখেছ? অন্য উপজাতির থেকে আলাদা। বেশ সুশৃঙ্খল জাত।

মার্কো বলল, “হ্যাঁ। আপশোস হচ্ছে এদের ছবি তুলতে পারলাম না।

ভোরের দিকে একটু ঝিমুনি এসেছিল। অপরিচিত কণ্ঠে পরিষ্কার বাংলা কথা শুনে চমকে তাকালাম।–আরে প্রোফেসার ঘোষ আপনি!

একি, ভূত দেখছি নাকি!

সেই শীর্ণ মুখ, বড় বড় উজ্জ্বল চোখ। সেই টিয়াপাখির মতো বাঁকানো নাক, চিবুকে একগুচ্ছ দাড়ি। ফোটোতে এ-মুখ বারবার দেখে মনে গেঁথে গেছে। তাই লোকটিকে চিনতে ভুল হল না। ইনি স্বয়ং বৈজ্ঞানিক সত্যনাথ সর্বজ্ঞ।

.

০৭.

বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞকে দেখে আমাদের মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথা বেরোল না। তারপর মামাবাবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, আপনি বেঁচে আছেন!

সর্বজ্ঞ বললেন, সশরীরে এবং সুস্থ দেহে। কিন্তু আপনাদের এ কী অবস্থা! সর্বজ্ঞ ইশারা করা মাত্র রেড-ইন্ডিয়ানরা আমাদের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। মামাবাবু বললেন, আপনি এখানে কী করছেন? আপনি কি স্বেচ্ছায়–?

হ্যাঁ, আমি স্বেচ্ছায় এসেছি এখানে। বিশেষ কাজ। কিন্তু আমাকে প্রশ্ন করার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমি চাই।

বেশ, বলুন।

আমার এই ফোটো আপনাদের হাতে এল কী করে?

রূপা আমায় দিয়েছে।

ও, রূপা বুঝি আপনাকে আমার খোঁজ করতে বলেছে?

হ্যাঁ।

মেয়েটাকে ইঙ্গিত দেওয়াই আমার ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা প্রোফেসর ঘোষ, আমি যে এখানে আছি এ-সন্ধান আপনি পেলেন কীভাবে?

মামাবাবু, ভিক্টরের তোলা ফোটোয় সর্বজ্ঞর টুপি ও টাই-এর কথা, র‍্যাপসোদের মুখে এই পাহাড়ে সর্বজ্ঞর আগমনের খোঁজ পাওয়া ইত্যাদি সমস্ত বিবরণ অল্প কথায় জানালেন।

বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এত আঁটঘাট বেঁধে কাজে নেমেও দেখছি কতগুলো খুঁত থেকে গেছে।

মামাবাবু বলে উঠলেন, ডক্টর সর্বজ্ঞ, একটা কথা। আমার ভাগনে সুনন্দকে এই ইন্ডিয়ানরা ধরে এনেছে, দয়া করে ওদের জিজ্ঞেস করুন সে কোথায়, কেমন আছে?

সেকি! সর্বজ্ঞ তৎক্ষণাৎ ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। একটু পরে ফিরে মামাবাবুকে বললেন, বেঁচে আছে আপনার ভাগনে। ভালোই আছে। যদিও বন্দী। আমি তাকে এক্ষুনি এখানে আনতে বলেছি।

কয়েকজন ইন্ডিয়ান দেখলাম চলে গেল পাহাড়ের পথে। আঃ! আমাদের মনের ওপর। থেকে কী ভীষণ যে ভার নেমে গেল!

মামাবাবু বললেন, ডক্টর সর্বজ্ঞ, আপনার এই অজ্ঞাতবাসের কারণ জানতে পারি কি?

সর্বজ্ঞ বললেন, সবই আমি বলব, কিন্তু এখন এখানে নয়। আপনাদের আমার সঙ্গে যেতে হবে একটা জায়গায়। কিন্তু আপনাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমি যতদিন না নিজে থেকে আত্মপ্রকাশ করি, ততদিন আমার এই অজ্ঞাতবাসের বা এখানে যা দেখবেন এবং যা শুনবেন তার কণামাত্র খবর কাউকে জানাতে পারবেন না। মনে রাখবেন তাতে আমার গবেষণার ক্ষতি হবে। এব্যাপারে আপনি সম্মত কিনা বলুন।

রাজি, মামাবাবু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন, আপনি সুস্থ দেহে বর্তমান এইটুকু জেনেই আমি সন্তুষ্ট। আপনার সব খবর আমরা সম্পূর্ণ গোপন রাখব। মার্কো, আশা করি আমার কথায় আপনি সায় দেবেন?

আলবাৎ, বলল মার্কো। আমিও মামাবাবুকে সমর্থন জানালাম।

প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করলাম। সর্বজ্ঞ মামাবাবুর কাছে কিছু পরিচিত বিজ্ঞানীর খবরাখবর নিতে লাগলেন। সহসা বনের ভিতর কাদের পায়ের শব্দ? উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকি। পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন ইন্ডিয়ান এবং তাদের মাঝে সুনন্দ।

আমি লাফ দিয়ে গিয়ে সুনন্দকে জড়িয়ে ধরলাম। মামাবাবু তার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, অত্যাচার করেনি তো?

না। সুনন্দ উত্তর দেয়, তবে বড় জোরে বেঁধে রেখেছিল, হাতে-পায়ে কালশিরা পড়ে গেছে।

তোকে নিয়ে কী করত ওরা? আমি জানতে চাই।

সুনন্দ ক্ষীণ হেসে বলল, নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড দিত। তবে কী উপায়ে মারবে বোধহয় ঠিক করতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, তাই নিয়ে বেজায় তর্কাতর্কি চলছে।

মার্কো হ্যান্ডসেক করে বলল, “ব্রাদার সুনন্দ, আমাদের ফাঁকি দিয়ে একা বেড়াতে যাওয়া তোমার কিন্তু উচিত হয়নি। যাক, আপাতত এককাপ কফি খাবে নাকি?

“না না, শুধু কফি নয়, সুনন্দ কাতর স্বরে বলে ওঠে, কিছু খাবার দাও। কিচ্ছু খাইনি। কী একটা খেতে দিয়েছিল, খেতে পারিনি। বাপরে কী ঝাল!

সুনন্দর সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। সুনন্দ অনেক ধন্যবাদ জানাল তাকে।

গরম কফি খেয়ে আমরা বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর সঙ্গে রওনা দিলাম।

পাহাড়ের অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে প্রায় ঘণ্টা তিন চলার পর দুই পাহাড়ের মানে এক সমতলভূমিতে পা দিয়ে আমরা থমকে দাঁড়ালাম।

আশ্চর্য দৃশ্য। ছোট মালভূমিতে এক প্রস্তরনগরীর ধ্বংসাবশেষ। প্রাসাদ, প্রাচীর, বেদি, সোপানশ্রেণি মিলিয়ে প্রাচীন নগরীর কঙ্কালকে ঢেকে ফেলেছে আগাছা, লতা, আর বড় বড় গাছ। মামাবাবু বললেন, এ যে আর এক মাচুপিচু। অদ্ভুত ব্যাপার!

বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ বললেন, ঠিক ধরেছেন। মাচুপিছু থেকে যারা পালিয়ে এসেছিল খুব সম্ভব তারাই এ নগর তৈরি করে। মাচুপিচুর শেষদিনের ইতিহাস মনে করুন। ইংকা রাজা টুপাক আমারু স্প্যানিয়ার্ডদের তাড়া খেয়ে মাচুপিচু ত্যাগ করে পালাল। কিন্তু কিছু দূর এসে সে ধরা পড়ল। ধরা পড়েছিল বলা উচিত নয়, সে আত্মসমর্পণ করেছিল। স্প্যানিয়ার্ডরা তাকে কুজকোয় নিয়ে গিয়ে হত্যা করল। কিন্তু রাজার সঙ্গীরা সবাই নিশ্চয় বিদেশিদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তারা কেউ কেউ দুর্ভেদ্য আমাজনের বনে পালিয়ে যায়। আমার বিশ্বাস তারাই এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। গড়ে তুলেছিল এই নগর। জানি না কতকাল তারা এখানে বাস করেছিল? কীভাবে তারা লুপ্ত হয়ে গেল?

হঠাৎ সর্বজ্ঞ সুর পাল্টালেন।–দেখুন প্রোফেসর ঘোষ, একটা ইংকা ধ্বংসাবশেষ নিয়ে রিসার্চ করতে আমি এখানে পড়ে নেই। আমার উদ্দেশ্য অন্য। চলুন পাহাড়ের ওপাশে। সর্বজ্ঞ আমাদের সঙ্গে নিয়ে চললেন।

–ওই দেখুন, ওগুলো ছিল প্রাচীন ইংকা চাযের ক্ষেত।

কিছু দূরে পাহাড়ের গায়ে অনেকগুলো চাতাল কাটা রয়েছে। সর্বজ্ঞ সেই দিকে হাত বাড়িয়ে দেখালেন। চাতালে নানারকম গাছ ও ঝোঁপ জন্মেছে। সর্বজ্ঞ বললেন, এই ক্ষেত ছাড়াও পাহাড়ের পাদদেশে জঙ্গল সাফ করে ইংকারা কিছু ক্ষেত বানিয়েছিল। বাগান। করেছিল। এখন অবশ্য সব জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গেছে। আমি এদের সেইসব ক্ষেত এবং বাগান খোঁজ করে আট-দশ রকম সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ফল-মূল-তরকারি পেয়েছি।

প্রথমবার এসেই আমি ইন্ডিয়ানদের নানারকম নতুন ফল-মূল খেতে দেখি। তাদের প্রশ্ন করে আবিষ্কার করি এই ইংকা ক্ষেত এবং বাগানের সন্ধান। জানেন তো ইংকা জাতি ছিল আশ্চর্য প্রতিভাধর কৃষিবিজ্ঞানী। আধুনিককালে আমাদের প্রিয় অনেক ফল-মূল-শস্যই তাদের আবিষ্কারের দান। পেরুর পাহাড়-জঙ্গল থেকে খুঁজে এনে কত যে ফল-মূল-শস্য আর গাছপালাকে তারা মানুষের খাদ্য বা অন্য ব্যবহারে লাগিয়েছিল!

–কী কী? আমি কৌতূহল চাপতে পারি না। ব্যাপারটা খানিক জানলেও ভালো করে জানতাম না আমি।

সুনন্দ ভুরু কুঁচকিয়ে কড়া চোখে তাকায় আমার দিকে। ভাবখানা যেন, এই অতি সামান্য জ্ঞানটুকু নেই তোর! অযথা সময় নষ্ট করছিস।

বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ কিন্তু বিরক্ত হন না। হেসে বলেন, শুধু আপনি নন, অনেকেই ব্যাপারটা তেমন বিশদে জানে না। সব কটার নাম মনে পড়ছে না এখন। কয়েক কয়েকটা বলছি। এই যেমন– আল, টমেটো, ভুট্টা, আনারস, পেয়ারা, তামাক, সিঙ্কোনা, রবার, কাকাও মানে যার থেকে কোকো অর্থাৎ চকোলেট হয়…

মামাবার থামিয়ে দেন সর্বজ্ঞকে। বলেন, মনে হচ্ছে এখানেও ইংকারা তেমন নতুন কিছু আবিষ্কার করেছিল?

হ্যাঁ তাই, জানান সর্বজ্ঞ, পলাতক ইংকারা এই সুদূরে একরকম বন্দী জীবনযাপন করত। গবেষণার নেশায় তখন তারা আমাজনের বন থেকে নানারকম নতুন ফলমূল উদ্ভিদ সংগ্রহ করে সেগুলি মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করেছিল।

এখানকার ইন্ডিয়ানরা বঝি ইংকাদের আবিষ্কার করা ফল-মূল খায়? আমি প্রশ্ন কার।

হ্যাঁ খায়, তবে সব নয়। কয়েকটা মাত্র। সেগুলো তারা চাষও করে। বাকি আবিষ্কারগুলি প্রায় জংলি হয়ে গেছে। তবে ইন্ডিয়ানরা জানে কোন্ কোন্টা খাওয়া যায়। আমি এদের সাহায্যে সেইসব গাছপালা উদ্ধার করেছি। তাদের চারা তৈরি করেছি। আশা। করছি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবীর লোক অনেক নতুন ফল-মূলের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। তবে আমার সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার হবে কতকগুলি ভেষজ উদ্ভিদ। পাহাড়ি ইন্ডিয়ানরা ইংকাদের কাছে চিকিৎসার জন্য অনেক গাছ-গাছড়ার ব্যবহার শিখেছে, আর তাদের কাছ থেকে জেনেছি আমি। সেইসব উদ্ভিদ থেকে অনেক দুরারোগ্য রোগের ওষুধ তৈরি হবে ভবিষ্যতে।…এই হল আমার গবেষণা এবং এই জন্যই আমার অজ্ঞাতবাস।

এর জন্য অজ্ঞাতবাসের কী প্রয়োজন? মার্কো একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

কারণ জানিয়ে শুনিয়ে এখানে বেশিদিন থাকলে লোকে সন্দেহ করত। খবরটা রটে যেত। তখন দলে দলে বৈজ্ঞানিক এসে হাজির হত। এবং আমার আবিষ্কারে তারা ভাগ বসাত। এটা আমার পছন্দ নয়। এ-জায়গা আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজব, তারপর আমার আবিষ্কার সমেত আত্মপ্রকাশ করব। বৈজ্ঞানিক গর্বিত ভঙ্গিতে তাকালেন।

দুর্ঘটনার ব্যাপারটা তাহলে সাজানো? সুনন্দ জিজ্ঞেস করল।

“নিশ্চয়। প্রথমবার এখানে এসে দেখে শুনে ম্যালডোনাডায় ফিরে গেলাম। তারপর প্ল্যান করে আবার অভিযানে বের হলাম। পথে উধাও হলাম লোককে ধোঁকা দিয়ে। কিন্তু তাতেই বা সফল হলাম কই? এই তো ধরা পড়ে গেছি। বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ নিজের ওপর রাগ করে ভুরু কোঁচকালেন।

ফেরার পথে সর্বজ্ঞ দেখালেন, এই গাছ চেনেন? কোকা। যার পাতা থেকে কোকেন হয়। ইংকারা এনার্জি বাড়াতে এর পাতা চিবুত। এখানে ইন্ডিয়ানদেরও দেখছি সেই অভ্যেস।

আর একরকম গাছ দেখালেন সর্বজ্ঞ।–এই নগরের নির্মাতারা যে মাচুপিচু থেকে এসেছিল তার প্রমাণ এই হুলিকা গাছ। জানেন নিশ্চয় মাচুপিচুর আসল নাম ভিলকাপাম্পা। ভিলকাঁপা শব্দের অর্থ যেখানে হুলিকা গাছ জন্মায়। হুলিকা ফলের বীচি গুঁড়ো কত ইংকারা নস্যি নিত এবং তার ফলে নেশা হত। আফিং খেলে যেমন হয়। মাচুপিচু পাহাড়ে এই গাছ আছে। নিশ্চয় ইংকারা এই গাছ সঙ্গে এনেছিল। কারণ আমাজনের জঙ্গলে আর কোথাও হুলিকা গাছ নেই।

পাহাড়ের গায়ে বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞর ছোট কাঠের বাংলো। সামনে টুকরো টুকরো বাগান করা হয়েছে। একজন দেশি অনুচর থাকে তার সঙ্গে। এই লোকটিই সর্বজ্ঞর সঙ্গে এসেছিল।

সর্বজ্ঞ জানালেন, একরকম শাক পেয়েছি। মোটা উঁটা। খেতে খুব মিষ্টি। প্রচুর কার্বোহাইড্রেড আছে। নিংড়ে অনেক চিনি পাওয়া যায়। এই শাক আখের চেয়ে সহজে জন্মায়, তাড়াতাড়ি বাড়ে।

এমনি আরও ইংকাদের আবিষ্কৃত কিছু উদ্ভিদের বর্ণনা দিলেন তিনি। তার ল্যাবরেটরি দেখালেন। দেখলাম ভদ্রলোক অনেক যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।

দুপুরবেলা মার্কো ইংকা ধ্বংসাবশেষের ছবি তুলতে চলল। আমি, সুনন্দ আর মামাবাবুও সঙ্গে গেলাম। সর্বজ্ঞ কী একটা কাজ করছিলেন। বললেন, “আপনারা যান, আমি পরে আসছি। সাবধানে চলাফেরা করবেন, খুব সাপ আছে ওখানে।

ঘুরে ঘুরে দেখছি সেই মৃত নগরী, হঠাৎ পাহাড়ের গা বেয়ে একজনকে নেমে আসতে দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

–আগন্তুক, ডাক্তার জর্জ কেন্ট।

কেন্ট হাঁক দিলেন, হ্যালো প্রোফেসর? তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করতে করতে বললেন।–উঃ কী যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। পথে যদি বিপদে পড়েন!

মার্কো বলল, ডাক্তার, আপনি বুঝি আমাদের ফলো করেছেন?

বাধ্য হয়ে। কারণ আপনারা চলে যাবার পর ভেবে ঠিক করলাম, আপনারা নিশ্চয় স্যায়ান্টিস্ট সর্বজ্ঞর খোঁজে বেরিয়েছেন। তাই আপনাদের পিছনে পিছনে রওনা দিলাম। কিন্তু একটা উপজাতি গ্রামে কদিন আটকে পড়ে গেলাম। সেখানে ইয়োলো ফিভার লেগেছে। লোক মরছে। বেচারাদের ছেড়ে আসি কী করে? নইলে আগেই আপনাদের ধরে ফেলতাম। যাক এখন নিশ্চিন্ত।

বঝলাম কেন্ট যখন এখানে এসে পড়েছেন, তখন তার দৃষ্টি থেকে সর্বজ্ঞকে আর লুকানো যাবে না। হয়তো ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে সর্বজ্ঞর হদিসও জেনে ফেলেছেন।

আমি দু-পা এগিয়ে গেলাম। ম্যালডোনাডায় কেন্ট আমাকে যে অপমান করেছিলেন তার জ্বালা আমি ভুলিনি। ভারি মোলায়েম কণ্ঠে বিদ্রূপ মিশিয়ে বললাম, জানেন ডক্টর কেন্ট, আমরা বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞকে আবিষ্কার করে ফেলেছি, একবারে সশরীরে এবং সুস্থ দেহে।

কেন্ট কেমন থমকে গেলেন। বললেন, “ওঃ, তাই নাকি! ভেরি গুড, ভেরি গুড়।

সুনন্দ ফট করে বলল, বড় হতাশ হলেন তাই না ডাক্তার?

ডাক্তার কেন্ট ভারি অবাক মুখ করে বললেন, হতাশ? আমি? কেন?

কারণ আপনি খুব আশায় ছিলেন সর্বজ্ঞ আর ফিরবেন না। ভেবেছিলেন দুর্ঘটনায় নদীতে ডুবে নির্ঘাত অক্কা পেয়েছেন। আহা, ব্যাপারটা সত্যি হলে আপনার কত সুবিধে হত।

হাঃ হাঃ হাঃ…। একটা প্রচণ্ড হাসির গমকে আমরা চমকে পিছনে ফিরলাম। হাসছেন বৈজ্ঞানিক সর্বজ্ঞ। কখন তিনি আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। আমরা থতমত খেয়ে চেয়ে থাকি। এই অট্টহাসির কারণ ধরতে পারি না। কোনো রকমে হাসি থামিয়ে সর্বজ্ঞ বললেন, “আরে, আপনারা মস্ত ভুল করেছেন। ডাক্তার আমার সব খবর জানে। ওর সঙ্গে প্ল্যান করেই তো এখানে এসেছি। আর ওই তো আমাকে এই পাহাড়ে নিয়ে আসে।

অ্যাঁ! আমরা অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকাই।

সর্বজ্ঞ বলে চলেন, কেন্টের সঙ্গে এই পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের ভাব হয়। হিথ নদীর তারে সাপের কামড়ে মৃতপ্রায় এই উপজাতির একজনকে চিকিৎসা করে কেন্ট বাঁচিয়ে তোলে। তারপর এদের গ্রামে আসত মাঝে মাঝে। ডাক্তারকে এরা খুব শ্রদ্ধা করে। আমার সঙ্গে ওর হঠাৎ দেখা হয় হিথ নদীতে। আমাদের আগে থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। তখন ডাক্তার ফিরছিল এই পাহাড় থেকে। সেইবারেই সে আবিষ্কার করেছে এই ইংকা নগর। খুব উত্তেজিত। আমায় বলল সব। আমি তক্ষুনি ডাক্তারকে নিয়ে পাহাড়ে এলাম ধ্বংসাবশেষ দেখতে। ডাক্তার না থাকলে অবশ্য আমি এই পাহাড়ে ঢুকতেই পারতাম না।

কেন? আমি জানতে চাই।

কারণ এই ইন্ডিয়ানরা বিদেশিদের এখানে আসতে দিতে চায় না। কিছু স্প্যানিয়ার্ড নাকি একবার অযথা গুলি চালিয়ে ওদের অনেক লোককে মেরে ফেলে। বিদেশিদের ওপর তাই এদের ভীষণ রাগ। অবশ্য যাদের বন্ধু বলে মনে করে তাদের কথা আলাদা।

এই ইন্ডিয়ানরা কারা? এদের সঙ্গে কি ইংকাদের কোনো সম্পর্ক ছিল? এতক্ষণে মামাবাবু কথা বললেন।

বোধহয় ছিল। বললেন সর্বজ্ঞ। মনে হয় এই উপজাতি ছিল সুসভ্য ইংকাদের অনুগত রক্ষী। ইংকাদের সঙ্গে এদের মেলামেশাও হয়েছিল কারণ এদের মধ্যে অনেক প্রাচীন ইংকা আচার-ব্যবহার আমি লক্ষ করেছি। জানেন, এরা প্রতিদিন ভোরে প্রাচীন ইংকাদের মতো সূর্য দেবতার বন্দনা করে–ও ভিরাকোচা (সূর্যদেব), ও পাচাকামাক (আলোর দেবতা)।

মামাবাবু ডাক্তার কেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, তার হাত ধরে বিনীত স্বরে বললেন। “ডক্টর আপনার কাছে আমি মাফ চাইছি। আপনাকে আমরা অন্যায়ভাবে সন্দেহ করেছিলাম।

“কেন? কীজন্যে সন্দেহ? ডাক্তার রীতিমতো অবাক হয়ে বলেন।

মামাবাবু এবার সর্বজ্ঞকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম আw নিখোঁজ হওয়ার জন্য ডাক্তারই দায়ী। আপনাকে উনি কোনো কায়দায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। পরে এখানে এসে ভাবলাম ডাক্তার হত্যাকারী নয়, কিন্তু আর পাঁচজনের মতো বিশ্বাস করেছেন আপনি দুর্ঘটনায় মারা পড়েছেন।

কিন্তু সায়ান্টিস্ট মারা গেলে আমার লাভ? কারণটা দয়া করে বলবেন কি? কেন্ট অধৈর্যভাবে বলে ওঠেন।

লাভ সেই মহামূল্যবান ব্লু-অর্কিড। আমরা সন্দেহ করেছিলাম সর্বজ্ঞর অবর্তমানে তার আবিষ্কার ব্লু-অর্কিড আপনি অধিকার করতে চান।

কেন্ট আঁতকে উঠলেন, মাই গড, ব্লু-অর্কিডটা আপনার চোখে পড়েছে? ঠিক এই ভয়েই আমি ওটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। পাছে লোকে আমায় সন্দেহ করে?

ব্লু-অর্কিড সম্বন্ধে আপনি জানলেন কী করে? সর্বজ্ঞ মামাবাবুকে প্রশ্ন করলেন।

রূপার চিঠি পড়ে। মামাবাবু জবাব দিলেন।

ওঃ, মনে পড়েছে। বড় কাঁচা কাজ করেছি আমি। মেয়েটা অর্কিড ভালোবাসে, তাই ভাবলাম খুশি হবে। তা ডক্টর, আপনার অত লুকোচুরির দরকার কী ছিল?

কেন্ট বললেন, কারণ আমি চাইছিলাম, আপনি আত্মপ্রকাশ করার পর লোকে এই অর্কিড আবিষ্কারের খবর জানুক। নইলে আপনার এত বড় আবিষ্কার আমার হেফাজতে রেখে আপনি নিখোঁজ হয়েছেন জানলে লোকে স্বাভাবিকভাবে আমায় সন্দেহ করত, আমাকে জেরা করত। ফলে আমি বাধ্য হতাম আপনার অজ্ঞাতবাসের কাহিনি বলে দিতে।

তা বেশ, ওটা আপনার আবিষ্কার বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। আমি তো বারবার বলেছি ও ফুলের প্রকৃত আবিষ্কারক হওয়া উচিত আপনি, আমি নয়।

ডাক্তার বললেন, “তা হয় না। কেন হয় না?ওই অর্কিড পাওয়া গেছে এই পাহাড়ে। এ-পাহাড়ে আপনি আমায় নিয়ে এলেন। দৈবাৎ আমার চোখে পড়ে গেল ফুলটা। নইলে ও-ফুল আপনি পরে ঠিক আবিষ্কার করতেন। আপনি নিয়ে না এলে এখানে আমার আসার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং এ-ফুলের প্রকৃত আবিষ্কারক ডক্টর জর্জ কেন্ট।

ডাক্তার দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন।–না-না।

সর্বজ্ঞ খিঁচিয়ে উঠলেন, জানেন ঘোষ, এই ডাক্তারের সব ভালো। শুধু বড় এঁড়ে তর্কের বাতিক। সোজা যুক্তি মাথায় ঢোকে না। ঠিক আছে, প্রোফেসর ঘোষ আপনি পণ্ডিত ব্যক্তি। তৃতীয় পক্ষ। আপনি স্থির করে দিন এই ব্লু-অর্কিডের আবিষ্কারকর্তা কে হবে? আমরা তা মেনে নেব।

মামাবাবু সর্বজ্ঞকে বললেন, আপনি এই ফুল প্রথম পেয়েছিলেন?

হ্যাঁ। দৈবাৎ।

তারপর কী করলেন?

কয়েকবার গন্ধ শুঁকে ফুলটা আমার জামার পকেটে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম ডাক্তারকে উপহার দেব। ও অর্কিড ভালোবাসে।

তারপর?

ডাক্তার তো ফুলটা দেখেই উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল। এ-ফুল যে এত মূল্যবান এবং নতুন ধরনের তা আমি ধারণাও করিনি। ডাক্তারের সঙ্গে অনেক খুঁজে ফের বের করলাম। ওই অর্কিডের গাছ।

মামাবাবু বললেন, যদি ডাক্তার না থাকত তাহলে ওই ফুল নিয়ে কী করতেন?

নির্ঘাত ফেলে দিতাম। শৌখিন ফুল বা অর্কিড নিয়ে আমি কোনোকালে মাথা ঘামাই । তাছাড়া আমার মাথায় তখন ঘুরছে অন্য এক বিরাট আবিষ্কারের চিন্তা।

মামাবাবু বললেন, “আমার মতে এই নীল অর্কিডের আবিষ্কারক হবেন আপনারা দুজনে একসঙ্গে। জয়েন্ট ডিসকভারার।

সর্বজ্ঞ ভুরু কুঁচকে বললেন, বেশ, ডাক্তারের সঙ্গে যদি আমার নামটা জুড়ে দিতে চান, তাই হোক। হ্যাঁ, ডাক্তার রাজি তো? এ-শর্তে ও রাজি না হলে আমি কিন্তু সত্যি চটে যাব।

ডাক্তারের মুখ লাল। আবেগরুদ্ধ স্বরে বললেন, উত্তম। আপনাদের বিচার আমি মেনে নিলাম। এত বড় আবিষ্কারের ভাগ দিলেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ।

সর্বজ্ঞ তেডে উঠলেন, “বিনয় দেখানো হচ্ছে? বটে! আমার আবিষ্কারে যখন সবাই থ মেরে যাবে, তখন সারা জগৎকে জানিয়ে আমিও ধন্যবাদ দেব ডাক্তার কেন্টকে। মনে থাকে যেন।

মার্কো বলে উঠল, ঝগড়া নয়। ওং শান্তি! শান্তি! দুজনে এবার হাত মেলান।

ডাক্তার ও সর্বজ্ঞ পরস্পরের হাত চেপে ধরলেন। অমনি ক্যামেরার ক্লিক।

সর্বজ্ঞ রেগে বললেন, ছবি তুললেন যে?

মার্কো বলল, ভয় নেই। এ-ফোটো ছাপা হবে আপনার আত্মপ্রকাশের পর।

সর্বজ্ঞ মামাবাবুকে বললেন, রূপাকে বলবেন, তার বাবা তোফা আছে। বছরখানেক পরে ফিরবে। তবে এ-খবর যেন সে গোপন রাখে। ব্যস। কোথায় আছি, কী করছি বলার দরকার নেই।

গল্পের ফাঁকে ডাক্তার সুনন্দকে বললেন, শুনলাম তোমরা দুই ইয়াংম্যান নাকি ভারি ওস্তাদ। র‍্যাপসো বলছিল। ওদের আচ্ছা জব্দ করেছ।

সুনন্দ বলল, সেই দুই বিদ্রোহী সৈনিক? আপনার সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে বুঝি?

হ্যাঁ, ওদের আস্তানায় গিয়ে আমিই দেখা করেছি। একটা জরুরি খবর জানাতে।

কী খবর?

বললাম যে জেনারেল ফ্রাঙ্কো এবং তার বিদ্রোহী সৈন্যদের বলিভিয়া সরকার ক্ষমা করেছে। শুনে ওরা খুশি হয়ে দেশে রওনা দিল।

দুদিন বিশ্রাম নিলাম। সঙ্গে ডাক্তার রয়েছে, সুতরাং ফেরার ব্যাপারে আমরা নির্ভাবনা। ডাক্তারের দুই অনুচর নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছে নদীতে। তারা আমাদের নৌকো মেরামত করে দেবে।

হিথ নদীর সঙ্গমের কাছে পৌঁছেছি। দেখি একটা ক্যানুর ওপর দাঁড়িয়ে একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই রহস্যময় পেড্রো লোপেজ।

আমি বললাম, ডাক্তার কেন্ট, এই লোকটি আমাদের অনুসরণ করছিল।

বুঝেছি। ডাক্তার মাথা নাড়েন। তারপর চেঁচিয়ে ডাকেন, ওহে পেড্রো, কেমন আছ? নাঃ, তুমি আবার ভুল করেছ। এরা গুপ্তধনের খোঁজে যায়নি। পাহাড়ি ইন্ডিয়ান গ্রামে ফোটো তুলতে গিয়েছিল। খুব বিপদে পড়েছিল। তুমি যেও না ওদিকে।

পেড্রো আমতা আমতা করে বলল, তবে যে ওরা বলল?

কী বলল? কারা?

লঞ্চের খালাসিরা। এরা নাকি একটা প্রাচীন নগর আবিষ্কার করতে যাচ্ছে। একটা ম্যাপ পেয়েছে।

ঠাট্টা করেছে। বুঝতে পারোনি। বললেন ডাক্তার।

অ্যাঁ? ঠাট্টা! আমার সঙ্গে? দাঁড়াও, হতচ্ছাড়া শয়তানগুলোকে দেখাচ্ছি মজা। পেড়ো ঘুঁষি পাকাল। তারপর ধপ্ করে নৌকোর মধ্যে বসে পড়ল।

আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার ডক্টর?

ডাক্তার হেসে বললেন, সে এক বিচিত্র কাহিনি। প্রায় দেড়শো বছর আগে পেড্রোর এক পূর্বপুরুষ এই অঞ্চলের জঙ্গলে পাহাড়ের ওপর নাকি এক নগর আবিষ্কার করে। সেখানে ইংকাদের বাস। তাদের অঢেল সোনাদানা। পেড্রোর পূর্বপুরুষ লুকিয়ে দেখেছিল তাদের। কিন্তু সোনা আনতে পারেনি। জংলি ইন্ডিয়ানদের তাড়া খেয়ে কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচে। কাউকে বলেনি সে-খবর। শুধু তার ডাইরিতে লিখে রেখেছিল সব কথা। তার কিছু পরে সেই পূর্বপুরুষ এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এতকাল পরে তার ডাইরি পেয়েছে পেড্রো। ডাইরির পাতা ছেঁড়া, লেখা ধেবড়ে গেছে। তাতে ইংকা নগরীর কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তবু পেড্রো ক্ষেপে উঠেছে। সে আবিষ্কার করবে সেই নগর এবং ইংকাদের ধনরত্ন। পেরুর মন্টানা প্রদেশের কত পাহাড়-জঙ্গল যে সে চষে বেড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। লোকে ওকে খ্যাপায়, তাতে ওর আরও জেদ বাড়ে।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ডাক্তার বললেন, এবার কিন্তু পেড্রো ঠিক লোককেই ফলো করেছিল। অবশ্য জানি না, ওই পাহাড়ে খুঁজলে ইংকাদের ট্রেজার সত্যি পাওয়া যাবে কিনা?

ম্যালডোনাডোয় ডাক্তারের বাড়িতে তিনদিন থাকলাম। তারপর গেলাম কুজকো।

কুজকোয় বিদায় নিল মার্কো। এয়ারপোর্টে সে হাত নেড়ে চিৎকার করে বলল–আদিওস (বিদায়) প্রোফেসর। আদিওস অসিট। আদিওস সুনন্দ। সামনের বছর ইন্ডিয়ায় যাচ্ছি, তখন দেখা হবে।

ঠিক তের মাস পরে একদিন সংবাদপত্রের পাতায় চোখ আটকে গেল। দেখলাম বড় বড় হরফে ছাপা–নিখোঁজ বৈজ্ঞানিক সত্যনাথ সর্বজ্ঞর বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন।

 

ফেরোমন

পর্ব আফ্রিকার ডার-এস-সালাম শহর থেকে সমদ্রপথে লঞ্চে চেপে আমরা রুফিজি নদীর মোহনার দিকে চলেছি। আমরা মানে প্রাণিতত্ত্ববিদ নবগোপাল ঘোষ অর্থাৎ আমাদের মামাবাবু, আমার বন্ধু সুনন্দ, আমি শ্রীমান অসিত ও বিল হার্ডি। আমরা তিনজন ভারতীয় বেশ কিছুদিন ধরে ডার-এস-সালামের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের কিউরেটর ডক্টর হাইনের আতিথেয়তা ভোগ করছি। ইতিমধ্যে আমাদের একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেছে! রুফিজি নদীর মোহনার কাছে একটা দ্বীপে মামাবাবু সরীসৃপ ও পাখির মাঝামাঝি কোনো জীবের এক দুর্লভ প্রস্তরীভূত কঙ্কাল আবিষ্কার করেন এবং ঘটনাচক্রে সেই ফসিলটা আবার সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যায়। দ্বীপের অধিবাসীরা টাঙ্গানিকার এক গ্রাম থেকে ফসিলটা দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের এই দ্বিতীয় অভিযানের উদ্দেশ্য হল, যে গ্রামে ফসিলটা পাওয়া গিয়েছিল, তারই আশেপাশে ওই রকম আরও অন্য ফসিলের অনুসন্ধান করা। মামাবাবুর বিশ্বাস ছিল, বিল হার্ডি ওই গ্রামে যাবার একটা সহজ রাস্তা বাতলে দিতে পারবেন, কারণ সে ওই গ্রামে গিয়েছিল। সেই রকমই অনুরোধ করে একটা চিঠি পাওয়ামাত্র বিল ডার-এস-সালামে চলে আসেন এবং তার পরদিনই আমরা রওনা হয়ে যাই। এখানে বলা দরকার–হ্যার্ডি নামক এই শ্বেতাঙ্গ শিকারী পর্যটকটি সারা পূর্ব আফ্রিকায় ডেয়ারিং বিল নামে খ্যাত। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়টাই তিনি আফ্রিকা মহাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। দীর্ঘ ঋজু বলিষ্ঠ চেহারা, বয়স পঞ্চাশের উপর, কিন্তু কানের পাশে সামান্য কয়েকটা পাকা চুল ছাড়া কোথাও প্রৌঢ়ত্বের ছাপ নেই।

মামাবাবু এতক্ষণ ডেকে বসে ভারি মনোযোগ দিয়ে জুওলজি পত্রিকা পড়ছিলেন, এখন সেটা বন্ধ করে প্রায় আপন মনেই বলে উঠলেন, আশ্চর্য আবিষ্কার..ফেরোমন!

বিল হার্ডি কিছুদূরে ঠোঁটে পাইপ কামড়ে চোখ বুজে লঞ্চের রেলিং-এর উপর পা তুলে বসে আছেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। মামাবাবর সঙ্গে নানান জায়গায় নানান অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে জড়িত থাকার ফলে আমাদের দুজনের মধ্যেই সেটা বেশ বেশি পরিমাণেই সঞ্চারিত হয়েছে, তাই জিজ্ঞেস না করে পারলাম না–

ফেরোমন কী জিনিস, মামাবাবু?

মামাবাবু তার চশমার কাঁচটা রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, ফেরোমন গড়ে প্রাণিদেহ-নিঃসৃত একরকম রাসায়নিক বস্তু। অনেক প্রাণী এর সাহায্যে পরস্পরের মধ্যে। নানারকম যোগাযোগ করে।

আমি আর সুনন্দ পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করলাম।

পরিষ্কার হল না? মামাবাবু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “বেশ, আরো সহজ করে। বলছি। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর দেহকোষ থেকে এক বা একাধিক রকম লালা বা রস . বেরোয়। যে জিনিসটা বেরোয়, সেটা হল কয়েকটা রাসায়নিক পদার্থের সংমিশ্রণ। এগুলোর প্রত্যেকটির গন্ধ বা স্বাদ একটা বিশেষ সংকেত বহন করে। সেই সংকেতের ভাষা কেবল ওই প্রজাতির প্রাণীরাই বুঝতে পারে। যে রাসায়নিক বস্তুর সাহায্যে এই সাংকেতিক যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে, তাকেই বলে ফেরোমন। কোনো কোনো উন্নত প্রাণী, যাদের মখের ভাষা আছে, তাদের মধ্যেও বিশেষ প্রয়োজনে ফেরোমনের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন, হরিণের মৃগনাভি বা কস্তুরী একরকম ফেরোমন। পুরুষ কস্তুরীমৃগ এর তীব্র সুবাস বাতাসে ছড়িয়ে তার হরিণীকে ডাকে। তবে কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি নিম্নশ্রেণির জীবের ব্যাপারে বলা চলে যে তাদের সামাজিক জীবনটা একেবারে পুরোপুরি ফেরোমন নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন পিঁপড়ে, পিঁপড়ে নিয়েই গবেষণা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। পিঁপড়েরা চোখে দেখে না সেটা জানো বোধ হয়। বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়ের মধ্যে অন্তত দশ রকম ফেরোমন আবিষ্কার করা গেছে। কোনোটার গন্ধে তারা বিষাদের সংকেত দেয়, কোনোটার সাহায্যে তারা মৃত সঙ্গীকে আবিষ্কার করে। কোনোটা তাদের সার বেঁধে পথ চলতে সাহায্য করে, আবার কোনো ফেরোমনের সাহায্যে তারা সাথীকে কাছে ডাকে।

ফেরোমনের বৃত্তান্ত শুনে সত্যিই আমাদের অবাক লাগছিল। মামাবাবু কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে আবার বলে চললেন, অনেক জাতের পোকা ক্ষেতের শস্য নষ্ট করে। কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করেও তাদের ধ্বংস করা যায় না। মনে করো, কোনো পোকা ধান নষ্ট করে। আবিষ্কার করা গেল যে ওই জাতের স্ত্রী পোকা ফেরোমনের সাহায্যে পুরুষ পোকাকে কাছে ডাকে। তারপর ল্যাবরেটরিতে ওই ফেরোমনের রাসায়নিক মিশ্রণ আবিষ্কার হল। তৈরি হল কৃত্রিম ফেরোমন। ব্যস, এইবার কৃত্রিম ফেরোমন ধানক্ষেতের একপাশে ছড়িয়ে রেখে দাও। তখন কী হবে? পুরুষ পোকারা ছুটে আসবে কৃত্রিম ফেরোমনের গন্ধ পেয়ে আর সেই সুযোগে তাদের ধ্বংস করে ফেলা যাবে। আমেরিকায় এই উপায়ে প্রতি বছর হাজার হাজার জিপসি মথ ধ্বংস করে শস্য বাঁচানো হয়।

ফেরোমনের বর্ণনা হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলত, কিন্তু বাধ্য হয়ে থামাতে হল। সামনেই শহর দেখা যাচ্ছে। নদীর মোহনায় ছোট্ট শহর, নাম মোহোরা। এই মোহোরা। থেকেই আমাদের হাঁটা-পথে এগোতে হবে ফসিলের সন্ধানে। আমরা উঠে পড়লাম।

সাফারির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ডার-এস-সালাম থেকে নিয়ে এসেছিলাম। বিল একটা রাইফেল ও পিস্তল এনেছিলেন। তাছাড়া ডক্টর হাইনের বন্দুকটা আমরা চেয়ে এনেছিলাম। বিল বলেছিলেন, শিকার আমি ছেড়ে দিয়েছি। অযথা প্রাণিহত্যা করতে আর ভালো লাগে না তবে আমাদের মাংসের দরকার হবে, টাটকা মাংস। তাই মাঝে মাঝে টোটা খরচ। করব।

মোহোরা থেকে বিল চারজন চাম্বা পোর্টার ভাড়া করলেন। এরা মালপত্র বইবে। দরকার মতো মাটি পাথর খুঁড়বে। একজন কিছুটা রান্নাও জানে। শহর ছেড়ে পরদিন আমরা উন্মুক্ত প্রকৃতির রাজ্যে পদব্রজে যাত্রা করলাম।

বেশি তাড়াতাড়ি এগোতে পারছিলাম না। একে খারাপ পথ, তার উপর মামাবাবুর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান। পথে যেতে যেতে তিনি মাঝে মাঝে আমাদের অপেক্ষা করতে বলছিলেন। নতুন ধরনের পোকা-মাকড়, সরীসৃপ ইত্যাদি দেখে তিনি দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। চোখে দূরবিন লাগিয়ে গভীর মনোযোগে লক্ষ করছিলেন। কখনও স্পেসিমেনটি জীবিত বা মৃত অবস্থায় সংগ্রহ না করে ছাড়ছিলেন না। নিজেই দেরি করছিলেন, আবার তারপরই আমাদের চলো চলো, এগোও, বলে তাড়া লাগাচ্ছিলেন।

বিল পথ চলতে চলতে আমাদের নানারকম গাছপালা চেনাচ্ছিলেন। আফ্রিকার বনভূমিতে পথ চলার কায়দা-কানুন রপ্ত করাচ্ছিলেন। ছোট-বড় জীবজন্তু দেখিয়ে বোঝাচ্ছিলেন তাদের বয়স, মেজাজ ইত্যাদি।

প্রায় পনেরো মাইল পথ চললাম। একবার মাত্র দপরে খেতে থেমেছিলাম। তারপর টানা হন্টন। সন্ধে নাগাদ তাঁবু ফেললাম। সবাই বেশ ক্লান্ত, রান্নার জোগাড় হতে থাকে। বিল বললেন, কাল আমরা নদীর কাছ ছেড়ে বাঁ দিকে বেঁকে যাব। প্রথমে একটা? স্টেপ অর্থাৎ তৃণভূমি পড়বে। সেটা পেরিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ের সারি। ওইখানেই সেই গ্রাম ছিল। এতদূর অবধি আসতে অসুবিধা হয়নি, তবে স্টেপের মধ্যে দিয়ে দিক নির্ণয় করা একটু কঠিন। যা হোক, মনে হয় ঠিকঠাক পৌঁছে যাব। কতগুলো চিহ্ন আমার মনে আছে।

মামাবাবু একটা প্যাকিং বাক্সকে টেবিল বানিয়ে কিছু পোকামাকড়ের স্পেসিমেন পরীক্ষা করতে লাগলেন। আমি ও সুনন্দ বিলের কাছে বসে রইলাম গল্প শোনার আশায়।

বিল একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে আরাম করে পা ছড়িয়ে একমনে কিছুক্ষণ পাইপ টানতে টানতে দূরে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আফ্রিকার প্রকৃতিতে মায়া আছে বুঝলে, আজ রাতে চাঁদ উঠবে। তখন দেখবে কি অদ্ভুত রহস্যময় দেশ। এই বিশাল মহাদেশের কতটুকুই বা আজ পর্যন্ত আমরা জেনেছি–এখানকার অসংখ্য জীবজন্তু, গাছপালা, এ দেশের উপজাতিদের রীতিনীতি।

প্রশ্ন করলাম, আপনি প্রথম কবে আফ্রিকায় আসেন?

আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, মাত্র বাইশ বছর বয়সে।

কী করতে এসেছিলেন? শিকার?

দূর দূর! তখন আমি ভালো করে বন্দুক চালাতেই জানতাম না। এলাম স্রেফ খেয়ালে পড়ে।

যাঃ! স্কটল্যান্ড থেকে এত দূরে অকারণে? সুনন্দ প্রতিবাদ জানাল।

সত্যি বলছি, কিছু ভেবে আসিনি। এসেছিলাম নিছক অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। আফ্রিকা সম্বন্ধে আমার তখন ধারণা ছিল অতি সামান্য, শুধু জানতাম এ এক বিশাল অজানা। রহস্যময় দেশ। ঠিক করলাম, যেমন এ দেশের অধিবাসীরা প্রায় খালি হাতে মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়, আমিও তেমনি বেড়াব। তারপর একটু একটু করে আফ্রিকান চিনলাম। উবসক নামে আমার প্রথম উপজাতি যুবক গাইডটি হল আমার গুরু। বন্ধও বলতে পারো। জানো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার দু-বছর পরও আমি জানতে পারি যে, এমন এক সর্বনাশা যুদ্ধ চলছে! মোম্বাসা থেকে কিছু দরকারি জিনিস আনতে একজন পোর্টার পাঠিয়েছিলাম। জিনিস এল খবরের কাগজের মোড়কে। সেই কাগজ পডে জানলাম ওয়ালর্ড-ওয়র লেগেছে।

বলেন কি! কোনো শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে আপনার দেখাই হয়নি এই দু-বছর? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না। কোনো শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে দেখা হয়নি! রেডিও শুনিনি, খবরের কাগজ পড়িনি। এই বিরাট দেশের কয়েকটি শহর এবং বাঁধা পথঘাটের বাইরে বিদেশি লোক বড় একটা পা বাড়ায় না। আর আমি ঘুরতাম অজানা প্রকৃতি-রাজ্যে। পশু শিকার করে, ছাল বা দাঁত উপজাতির কারো হাতে শহরে পাঠাতাম চিঠি দিয়ে। সে দাম নিয়ে আসত কিংবা বদ জিনিস কিনে আনত। কখনও শিকারের মাংস বা ছালের বিনিময়ে উপজাতিদের গ্রাম থেকে প্রয়োজনীয় খাবার জোগাড় করতাম। আর আমার জীবনধারণের প্রয়োজন ছিল অতি সামান্য। শুধু ঘুরতাম, প্রাণভরে দেখতাম। শিকার করতাম।

.

০২.

পরদিন খুব ভোরে উঠে রওনা দিলাম। সারাদিন হাঁটলাম। কয়েকটা বড় বড় তৃণভূমি পেরোলাম। দেখলাম অজস্র জন্তুর ভিড়–নানারকম অ্যান্টিবোপ হরিণ, জিরাফ, জেব্রা, উটপাখি। একটা গাছের ছায়ায় দেখি কর্তা-গিন্নি দুই বাচ্চা নিয়ে এক সিংহ পরিবার। সিংহ-সিংহী পা ছড়িয়ে দিবানিদ্রা দিচ্ছে, দুটো বাচ্চা পাশে লুটোপুটি করছে। তাদের মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে কতগুলো জেব্রা নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খাচ্ছে। বিল বললেন, সিংহদের এখন খিদে নেই। তাই জেব্রারা নির্ভয়। সিংহ অযথা শিকার করে না।

সমতল তৃণভূমির মাঝে মাঝে এক-একটা ছোট পাহাড়। পাহাড়ে গাছপালা খুব কম। ক্ষীণস্রোতা কয়েকটি নদী দেখলাম। উপজাতি গ্রামেরও দেখা পেয়েছিলাম। মাত্র কয়েকটি গ্রামের কাছে আমরা যাইনি।

তৃতীয় দিন ভূপ্রকৃতির চেহারা বদলে গেল। রুক্ষ উঁচু-নিচু মাঠ। পাথুরে জমি। নেড়া ছোট পাহাড়। বাবলাজাতীয় কাটাবন। দু-একটা বাওবাব গাছ বেঁটে মোটা শরীরের ওপর ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাসবন কম।

সকাল ৯টা নাগাদ বিল একজায়গায় থামলেন। চারদিক দেখে বললেন–এইখানে এক গ্রাম ছিল। আমি যে গ্রামে গিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে এই গ্রামের লোকেরই যুদ্ধ হয়। দেখছি এ গ্রামও ধ্বংস হয়ে গেছে।

চারদিকে উঁচু-নিচু মাটির ঢিপি। শুকনো গর্ত। এগুলি কোনো পরিত্যক্ত গ্রামের চিহ্ন সন্দেহ নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা চলে গেল কেন?

বোধ হয় জলের অভাবে। গ্রামের পাশ দিয়ে একটা খাল ছিল। দেখ তার শুকনো খাত। টাঙ্গানিকার এ অঞ্চলে জলের বড় অভাব।

যে জায়গায় যাচ্ছি সেটা আর কদ্দূর? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

কাছেই। মাত্র মাইল তিনেক।

আমরা আবার এগোলাম।

লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। এখানেও জনবসতির চিহ্ন ছড়ানো রয়েছে। বিল দেখালেন–ওই যে কিছু দূরে এ্যানিটের স্তূপ দেখা যাচ্ছে, ওর পাদদেশে আমি কার্লো পাথরের স্তর দেখেছিলাম।

শিলাস্তূপের কাছে গেলাম। স্কুপের পূর্বদিকে এক বড় গোল চত্বর। চত্বরের পাথরে রঙ কালচে। মামাবাবু দেখে বললেন, মনে হয় বহু যুগ আগে এখানে জলাশয় ছিল। কাদামাটি জমে শ্লেট-পাথর হয়ে গেছে। এ ধরনের শ্লেট-পাথরে নানা রকম ফসিল পাওয়া যায়। হঠাৎ কাদায় ডুবে গিয়ে প্রাণিদেহ অবিকৃত অবস্থায় ক্রমে ফসিল হয়ে যায়।

চত্বরের মাঝখানে বেশ বড় ফাটল। অনেকখানি গভীর। এইখানেই বোধহয় সেই অতি প্রাচীন পাখির ফসিল পাওয়া গিয়েছিল।

ঠিক হল আমরা গ্রামের কাছে তাঁবু ফেলব। কারণ ওখানে জল ছিল। একটা বড় পাথরের গর্তে পরিষ্কার টলটলে জল জমে ছিল। কাল থেকে খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ হবে। মামাবাবু চলে গেলেন খাদটা ভালো করে পরীক্ষা করতে। আমরা তাব খাটালাম, রান্নার জোগাড় করলাম। তারপর কফি খেতে খেতে গল্প শুরু হল।

বিল বললেন, আমি যখন কুড়ি বছর আগে এসেছিলাম, তখন জায়গাটা এত রুক্ষ অনুর্বর ছিল না। বেশ ঘাস আর গাছ ছিল।

কেন এমন হল? সুনন্দ বলল।

ঠিক জানি না। তবে উপজাতিরা অতিরিক্ত গরু-ছাগল চরিয়ে অনেক সময় ওপরের মাটি আলগা করে ফেলে। বৃষ্টি হলে সেই মাটি ধুয়ে পাথর বেরিয়ে পড়ে।

বিকেলের দিকে বিল রাইফেল নিয়ে বেরোলেন। মাইল দুই-তিন ঘুরে তিনি একটা মস্ত শুয়োর মারলেন। পোর্টাররা শুয়োরটার ছাল ছাড়িয়ে খণ্ড খণ্ড করে কেটে তাঁবুতে এসে আগুনে ঝলসাতে শুরু করে দিল। বিল বড় একখণ্ড মাংস নিয়ে নিজের হাতে রোস্ট করলেন। আমরা খেলাম। চমৎকার স্বাদ হয়েছিল।

মামাবাবু, আমি, সুনন্দ এবং তিনজন পোর্টার সকালে সেই কার্লো পাথরের চত্বরে হাজির হলাম। আমাদের সঙ্গে পাথর খোঁড়ার জন্য গাঁইতি, শাবল, ছেনি ইত্যাদি সরঞ্জাম ছিল। মামাবাবু ফাটলের মধ্যে একটা জায়গা দেখিয়ে দিতে পোর্টাররা পাথর খসাতে শুরু করল। মামাবাবু মাঝে মাঝে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কয়েক জায়গায় এইভাবে খোঁড়াখুঁড়ি চলল। কয়েকটা শামুকের ফসিল বের হল। মামাবাবু বললেন, সাবধানে কাজ করতে হবে। সময় লাগবে। এ যাত্রায় আমরা যা খুঁজছি পাব কিনা জানি না। তবে জায়গাটায় নানা রকম ফসিল আছে সন্দেহ নেই। এবার না পাই পরে আবার আসব।

সারাদিন কাজ করে আমরা ফিরে এলাম।

বিল বেরিয়েছিল চারিদিকটা একটু দেখতে। পুরনো গ্রামের চারপাশ ঘরেছে। একটা ছোট হরিণ মেরে এনেছিল। আমাদের সঙ্গে নানারকম টিনের খাবার আছে কি পোর্টারদের টাটকা মাংস চাই। সেদিনও বিল নিজের হাতে মাংসের রোস্ট তৈরি করে খাওয়ালেন। বুঝলাম ডেয়ারিং বিল কেবল নামকরা শিকারী নন, পাকা রাঁধনিও বটে। বললেন, বছরের পর বছর বনে-জঙ্গলে মাঠে-ঘাটে ঘুরেছি। শিকারের মাংসই চল একমাত্র খাদ্য। সবরকম জন্তুই খেতাম। আর উপজাতির লোকদের কাছে শিখতাম কোন মাংস কী করে রাঁধতে হয়। তার সঙ্গে সভ্য জগতের মশলাপাতি লাগিয়ে জিভে স্বাদ আনতাম। কেমন হয়েছে রান্না?

পরদিন সকাল দশটা নাগাদ।

মামাবাব পোর্টারদের নিয়ে খাদের ভিতর। আমি ও সুনন্দ ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম, শিলাস্তপের পাশ দিয়ে একজন শ্বেতাঙ্গ এই দিকে আসছে। আশ্চর্য হলাম। হঠাৎ এ কোত্থেকে? ভ্রমণকারী না শিকারী? চাপাস্বরে ডাকলাম–মামাবাবু, এক সাহেব এদিকে আসছে।

মামাবাবু তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলেন।

লোকটি ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল।

বেশ লম্বা। বয়সে যুবক। সুপুরুষ। শক্ত জোয়ান চেহারা। পরনে খাকি ফুলপ্যান্ট। রঙচঙে হাফশার্ট। মাথায় শোলার টুপি। লোকটি দরাজ গলায় হেঁকে বলল, “আপনাদের দেখতে এলাম। এখানে বিদেশি কাউকে দেখব ভাবিনি। খোঁড়াখুঁড়ি করছেন? কিছুর সন্ধান পেয়েছেন নাকি?

মামাবাবু জবাব দিলেন, হ্যাঁ, একটু পরীক্ষা করছি জায়গাটা। এখনও কিছু পাইনি। আপনি?

লোকটি হেসে উঠল। তাই তো, এখনও পরিচয় দিইনি। অভদ্রের মতো প্রশ্ন করছি। অনেক দিন সভ্যজগতের বাইরে কাটাচ্ছি কিনা, ভব্যতা ভুলে গেছি। হ্যাঁ, আমার নাম টেলর। ব্রুস টেলর। পেশা প্রাণিবিজ্ঞান চর্চা।

মামাবাবু একটু ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন। তার মুখ দেখলাম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। উৎসাহিত হয়ে বললেন, আচ্ছা, আপনিই কি ফেরোমন বিশেষজ্ঞ ব্রুস টেলর? যাঁর প্রবন্ধ এই সেদিন পড়লাম জুওলজি পত্রিকায়?

ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, লেখাটা আমারই বটে। পড়েছেন? কেমন লেগেছে?

মামাবাবু রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এ লেখাটা তো দারুণ হৈ-চৈ ফেলেছে বিজ্ঞানীমহলে। ফেরোমন নিয়ে এত গভীর গবেষণা কেউ করেনি। আপনার আর একটা লেখা বোধহয় বছরখানেক আগে জুওলজি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। সেটাও আমি পড়েছি। ফেরোমন যে জীবজন্তু, বিশেষত কীটপতঙ্গের জীবন-যাত্রাকে এতখানি নিয়ন্ত্রিত করে, আগে কেউ ভাবতে পারেনি। অন্তত ভাবলেও, আপনিই প্রথম প্রমাণ দিয়েছেন। আচ্ছা, আপনি লিখেছেন যে, কয়েক রকম শস্যরক্ষায় কৃত্রিম ফেরোমন দ্বারা পেস্ট কনট্রোল সম্ভব। আপনি কি ল্যাবরেটরিতে তেমন কৃত্রিম ফেরোমন তৈরি করেছেন?

ঢেলর মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, করেছি। তাদের ফলাফল মোটামুটি সন্তোষজনক। তবে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।

মামাবাবু বললেন, যদূর জানি, কয়েকটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু আপনি যাননি। লোকের ধারণা, আপনি একজন রহস্যময় এবং দাম্ভিক ব্যক্তি। যাক, আমার ভুল ভাঙল। আর আপনি যে বয়সে এত নবীন, সেটাও ভাবতে পারিনি।

টেলর বললেন, আমার পরিচয় তো পেলেন। এবার আপনাদেরটা জানতে পারি কি? মনে হচ্ছে, আমরা একই লাইনের লোক।

মামাবাবু বললেন, প্রায় তাই। আমি ভারতীয়। কলকাতায় প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপনা করি। যদিও বিদ্যা অতি সামান্য। নাম–নবগোপাল ঘোষ। এটি আমার ভাগনে সুনন্দ। আর এই ছেলেটি সুনন্দর বন্ধু অসিত। আমাদের সঙ্গে আরও একজন আছেন। আমাদের গাইড। বিখ্যাত শিকারী মিস্টার হার্ডি। তিনি আপাতত বন্দুক নিয়ে কিঞ্চিৎ খাদ্য-সংগ্রহ করতে বেরিয়েছেন।

টেলর চোখ বড় বড় করে বললেন, “বাপরে, আপনি প্রোফেসর! তবে তো বুঝে-শুনে কথা বলতে হবে।

মামাবাবু বললেন, আপনি তো আমার ছাত্র নন যে, নম্বর কাটব। বরং আমি আপনার ছাত্র হতে রাজি আছি।

টেলর বললেন, দলবল বেঁধে এসেছেন যখন, তখন এখানে কিছু পাবার আশা আছে মনে হচ্ছে। কীসের ফসিল? অবশ্য ওই ব্যাপারে আমার বিশেষ উৎসাহ নেই।

মামাবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, না, না, সঠিক কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বেরোই্নি। আফ্রিকায় এসেছিলাম কয়েকটা লেকচার দিতে। স্রেফ কেতাবি বক্তৃতা। হাতে ক-দিন সময় পেলাম তাই বেরিয়ে পড়লাম। আফ্রিকা দেখা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সামান্য অনুসন্ধান। যদি লেগে যায় বরাতে, নাম-টাম হয়ে যায়! এত বয়সেও তো তেমন কিছু করে উঠতে পারলাম না। এই পাথরের স্তরটা দেখে মনে হল ফসিল থাকতে পারে। তাই খুঁড়ছি। আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে কত বৈজ্ঞানিক প্রাগৈতিহাসিক যুগের জীব-জন্তুর ফসিল পেয়েছে। তবে আমার আসল লক্ষ্য প্রস্তরচিত্র। আদিম মানবের আঁকা ছবি।

মামাবাবুর আসল লক্ষ্য শুনে ব্রুস টেলরের মতো আমরাও চমকালাম, এ উদ্দেশ্য তো কখনও টের পাইনি। সুনন্দ ও আমি চোখাচোখি করলাম। বুঝলাম, টেলরের কাছে তার আগমনের উদ্দেশ্য চেপে যাচ্ছেন মামাবাবু।

টেলর চিন্তিতভাবে বললেন, রক-পেন্টিং? রকপেন্টিং তো উত্তরে আছে শুনেছি। টাঙ্গানিকার কলডোয়া, কিলোসা, ফেঙ্গা পর্বতে অনেক প্রাচীন চিত্র আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু এধারে কই–

মামাবাবু বলে ওঠেন, হ্যাঁ, এধারে পাওয়া যায়নি, সেই জন্যেই তো খুঁজছি। পেলে নাম হবে।

পেন্টিং আর কোথায় খুঁজছেন? আপাতত তো দেখছি ফসিলের সন্ধানে লেগে গেছেন। টেলরের কণ্ঠে যেন সামান্য রহস্য।

মামাবাবু হাসেন।দেখি কয়েকটা দিন এখানে কাজ করে। কিছু না পাই তো চলে যাব।

কোন দিকে যাবেন? টেলর বলেন।

ভাবছি দক্ষিণ-পশ্চিমে যাব।

দক্ষিণ-পশ্চিমে? টেলর যেন আঁতকে ওঠেন। তেসি বেল্টের মধ্য দিয়ে যাবেন? সাধ করে বিপদ ডেকে আনবেন? তাছাড়া ওদিকে কোনো রক-পেন্টিং আছে বলে তো জানি না। বরং সোজা পশ্চিমে যান। ওদিকে অনেক ছোটখাটো পাহাড় আছে। হয়তো পেন্টিং দেখতে পাবেন।

দক্ষিণ-পশ্চিমে বুঝি তেসি মাছির এলাকা? হুঁ। তাহলে তো বিপজ্জনক রাস্তা। মামাবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, আপনি ও-এলাকাটা চেনেন?

হ্যাঁ, কারণ আমি আপাতত তেসি ফ্লাই নিয়ে কিঞ্চিৎ গবেষণা করছি।

তাই নাকি? মামাবাবু উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।

টেলর গম্ভীর স্বরে বলেন, টাঙ্গানিকার এই অভিশাপকে তাড়ানো যায় কিনা চেষ্টা করছি। আর এ ব্যাপারে ফেরোমন কতটা সাহায্য করতে পারে পরীক্ষা করছি।

মামাবাবু হঠাৎ বললেন, আপনি এখানে কি কোনো রিসার্চের কাজে রয়েছেন? কাছাকাছি কোথাও উঁবু ফেলেছেন?

টেলর বললেন, না, তেমন কোনো কাজে আসিনি। শ-খানেক মাইল দূরে এক তেসি ফ্রাইবেল্ট থেকে ফিরছিলাম, পথে রেস্ট নিচ্ছি। আর আশপাশের ঝোঁপগুলো পরীক্ষা করছি। কালই পাততাড়ি ওঠাতাম, তবে ইচ্ছে হচ্ছে আপনাদের যখন পেয়ে গেলাম, কাল একবার আড্ডা মারতে আসব। কথা বলার লোক পাই না। পরশু পালাব।

আপনার তাঁবু কোন দিকে?

ওই দিকে। মাইল দুই দূরে। আচ্ছা, আজ চলি। কাল আসব। টেলর যেন একটু ব্যস্ত। হয়ে পা বাড়ালেন। বোধহয় কোনো কাজের কথা মনে পড়ে গেল।

লম্বা লম্বা পা ফেলে টেলর ফিরে চললেন। শিলাস্তূপের গা ঘেঁষে বাঁক নেবার আগে একবার ফিরে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়লেন। তারপর পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

সুনন্দ বলে উঠল, এর লেখাই সেদিন পড়ছিলেন, না মামাবাবু?

হ্যাঁ। অদ্ভুত লোক। দু-এক বছর আগেও কেউ এর নাম জানত না। পর পর কয়েকটা লেখায় বৈজ্ঞানিক মহলে আলোড়ন তুলে দিয়েছে। ভালো করে এর পরিচয়টা অবধি কেউ জানে না। তবে লেখা পড়ে মনে হয়, লোকটি অতি পণ্ডিত। দীর্ঘ সাধনা আছে। পঙ্গপালের ফেরোমন যে তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য দায়ী, এ এক আশ্চর্য আবিষ্কার। আরও কয়েকটি কীটপতঙ্গের জীবনযাত্রায় তাদের ফেরোমন কীভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়, টেলর লেখায় তার উল্লেখ করেছেন। তবে বিশদভাবে কিছু বলেননি। লিখেছেন, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এক্সপেরিমেন্ট শেষ হলে বিষয়টির ওপর একটি প্রামাণিক বই লিখবেন। পথিবীর অনেক বৈজ্ঞানিক টেলরের গবেষণার ফলাফল জানার জন্য সব অপেক্ষায় আছেন।

তাঁবুতে ফিরে দেখলাম, বিল আরাম করে কফি খাচ্ছেন। আমাদের দেখে চোরে উঠলেন।হ্যালো সায়ান্টিস্টস, তারপর, পাখির গ্রেট গ্রেট গ্রেট অ্যানসেসটরের ফসিলের হদিস মিলল?

মামাবাবু বললেন, অত সোজা নাকি? সময় লাগবে। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

একটা রাউন্ড মেরে এলাম মাইল কয়েক।

বিলকে টেলরের কথা বলা হল। কালকে আবার টেলর আসবেন শুনে বিল বললেন, খেয়েছে! ওসব বৈজ্ঞানিক আলোচনার মধ্যে আমি নেই। কাল আমি সন্ধের পর ফিরব।

আমরা আশ্বাস দিলাম, কোনো ভয় নেই। টেলর মোটেই খিটখিটে পণ্ডিত নন। দিব্বি হাসি-খুশি, আমুদে।

একা-একা ঘুরতে আপনার ভালো লাগে? একটা মতলব ছিল আমার প্রশ্নে। বিল বললেন, একজন সঙ্গী পেলে তো ভালোই লাগত। পাচ্ছি কই? তুমি আসবে?

মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আসলে আমারও রোদে দাঁড়িয়ে পাথর কাটা দেখতে আগ্রহ ছিল না। বিলের সঙ্গে ঘোরায় কত মজা!

সুনন্দ আর কী করে! কটমট করে আমাকে দেখে নিল। কিন্তু সে প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্র। আমার মতো ফাঁকি দেওয়া তার শোভা পায় না।

রাত্তিরে খাবার সময় মামাবাবু বললেন, সবাই মনে রেখো আমাদের এখানে আগমনের আসল উদ্দেশ্য যেন টেলর টের না পায়।

কেন? টেলরকে জানাতে আপত্তি কীসের? আমি প্রশ্ন করলাম, উনি তো অন্য বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। বললেন তো ফসিলের ব্যাপারে ওঁর আগ্রহ নেই।

মুখে বলছেন বটে, কিন্তু ওঁর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, বেশ আগ্রহ আছে। মিসিং-লিঙ্ক- এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ফসিল এখানে পাবার সম্ভাবনা আছে বলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমরা তো আপাতত কদিন পরে চলে যাব। হয়তো খালি হাতে ফিরতে হবে, তারপর উনি যদি এসে ফসিল খুঁজতে শুরু করেন?

বিল হো-হো করে হেসে উঠলেন। বাঃ, আপনারা বৈজ্ঞানিকরা তো সহজ মানুষ নন। কত লুকোচুরি!

হ্যাঁ,–-তা তো আছেই। বৈজ্ঞানিক জগতে জোচ্চুরির অভাব নেই। কত লোক অন্য লোকের গবেষণার ফল মেরে দিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করে বিখ্যাত হয়ে গেছে। তাই সাবধান হতে হয়।

.

০৩.

পরদিন বিলের সঙ্গে টই-টই করলাম। যেদিকে ব্রুস টেলরের তাঁবু, সেদিকে যাইনি। মামাবাবু বারণ করেছিলেন। নিজে থেকে যখন ডাকছেন না, তখন যাওয়া উচিত নয়। হয়তো ব্যস্ত থাকবেন, তাছাড়া বেড়াবার পক্ষে ওদিকটা সুবিধের নয়! উঁচুনিচু জমি। খাজ-খাঁজ চড়াই-উৎরাই। আমরা অন্য দিকে গেলাম। বিল একটা পায়ে-চলা পথ আবিষ্কার করলেন। বললেন, সারা আফ্রিকায় বন-প্রান্তরে এমনি অজস্র পায়ে-চলা পথ দেখতে পাবে। পথগুলির শেষে পাবে হয় কোনো গ্রাম কিংবা জলাশয়। ঝর্না বা নদী।

ঠিকই বলেছিলেন বিল। কয়েক মাইল এগিয়ে দেখলাম এক ছোট জলাশয়। কিন্তু কাছে। যেতে পারলাম না। কারণ একপাল হাতি সেখানে মহানন্দে জলকেলি করছে। একটা একাসিয়া গাছের পাশে দাঁড়িয়ে দূরবিন দিয়ে সেই মজার দৃশ্য দেখতে লাগলাম। মস্ত মস্ত প্রাণীগুলো ছোট ছেলের মতো এ ওর গায়ে জল ছিটোচ্ছে। কাদা ছুঁড়ছে। বেশ কয়েক ঘণ্টা সেখানে বসে রইলাম। ওখানে বসেই খেয়ে নিলাম। বিকেলে তাঁবুতে ফিরলাম। একটুক্ষণ পরে মামাবাবু ও সুনন্দর সঙ্গে এলেন টেলর। টেলরের সঙ্গে বিলের আলাপ হল। একটু পরেই দেখলাম দুজনে আফ্রিকার গল্পে মেতে উঠেছেন। টেলর আফ্রিকার বহু দুর্গম অঞ্চলে ঘুরেছেন। বহু উপজাতির রীতি-নীতি জানেন।

কিভু হ্রদের তীরবাসী ওয়াটুতসি উপজাতির কথা উঠতে দুজনে ভারি উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

বিল বললেন, ভারি শৌখিন জাতি। কী লম্বা! ওদের নাচ দেখেছেন?

দেখেছি। দারুণ জমকার্লো ব্যাপার। মাথায় সিংহের কেশর। পরনে হরিণের চামড়া। গায়ে রুপোর গয়না। পায়ে ছোট ছোট ঘণ্টা বাঁধা। নাচের তালে তালে কী বিরাট লাফ।

বিল বললেন, সত্যি, লাফাতে পারে বটে। ওদের ন্যাশনাল স্পোর্টস হলো হাইজাম্প। একবার দেখেছিলাম, ঘটা করে হাইজাম্প হচ্ছে। বিশ্বাস করুন, গ্রামের অর্ধেকের বেশি জোয়ান পুরুষ ছ-ফুট হাইট লাফ দিয়ে পেরিয়ে গেল। কায়দা-টায়দার বালাই নেই। স্রেফ ছুটে এসে বেড়া ডিঙোনো লাফ। ওদের ট্রেন করলে নির্ঘাত অলিম্পিক জিতবে।

হঠাৎ টেলর হো-হো করে হাসতে লাগলেন।

কী হল?

ওয়াটুতসি বৌদের কথা মনে পড়ে গেল। উঃ, কি মোটা!

বিলও হাসেন।রাইট। কেবল খাইয়ে খাইয়ে বৌদের মোটা করে। যত মোটা তত নাকি সুন্দরী। বেচারা বৌগুলো শেষে ভালো করে হাঁটতে পারে না। খেতে না চাইলে স্বামী শাশুড়ি পিটিয়ে, জোর করে খাওয়ায়! বুঝুন যন্ত্রণা!

আমি ও সুনন্দ মুগ্ধ হয়ে তাদের গল্প গিলছিলাম, তবে মামাবাবুর ইচ্ছে ছিল টেলরকে গবেষণা সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু টেলর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন। মামাবাবু বললেন, কখনও ইন্ডিয়ায় গেলে খবর দেবেন। দেখা করব।

নাঃ, এখন বিদেশে যাবার ইচ্ছে নেই। আফ্রিকায় অনেক কাজ বাকি। টেলর উঠে পড়লেন, চলি আজ। আর বোধহয় আপনাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না, কাল চলে যাচ্ছি। বড় আনন্দে কাটল বিকেলটা।

কোন দিকে যাবেন? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

মাইল দশ দূরে আমার এক আস্তানা আছে। সেখানে কদিন থাকব।

টেলর সেদিন একজন উপজাতীয় সঙ্গী এনেছিলেন। সে আমাদের পোর্টারদের সঙ্গে বসে খুব আড্ডা দিচ্ছিল। টেলর ডাকলেন–গোরো, চল।

সন্ধ্যা নেমে গেছে। গোয়রা একটা মশাল জ্বালল। দুজনে ফিরে চলল, ক্রমে পাথরের আড়ালে মশালের আলো অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিল মন্তব্য করলেন, আশ্চর্য লোক! ইনি চার দেওয়ালের মধ্যে দিনের পর দিন ঘোর গবেষণা করছেন, ভাবা শক্ত। বরং ভ্রমণকারী বা অ্যাডভেঞ্চারার বললে মানায় বেশি।

.

০৪.

টেলর চলে যাবার পর মামাবাবু নিশ্চিন্তে কাজ শুরু করলেন।

রাত্রে মামাবাবু বললেন, জানেন বিল, পোর্টারদের হাবভাব সুবিধের মনে হচ্ছে না।

কেন?

লোকগুলো মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল। পাথরের টিলাটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। কেমন ভয়-ভয় ভাব।

ভয়! কেন, স্তূপটাকে ভয় পাবার কী আছে? ওখানে কোনো বন্য জন্তু থাকার কথা নয়। বেশ, কাল আমি যাব। রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করব?

পরদিন বিল মামাবাবুদের সঙ্গে গিয়ে খাদের কাছে একটা পাথরে বসে পাইপ টানতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ একটা আর্তনাদ। তাড়াতাড়ি খাদের ভিতর উঁকি দিয়ে দেখি একজন পোর্টারের হাত থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। ফাস্ট-এড-এর বাক্স সঙ্গে ছিল। লোকটির হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। সামান্য কেটেছে।

মামাবাব জানালেন, একজনের হাত থেকে গাঁইতি ছুটে গিয়ে লেগেছে। ভাগ্যিস মাথায় লাগেনি। লোকগুলো কেবল নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। অসাবধান হয়ে কাজ করছে। তাই ফস্কেছে।

পোটাররা এদিকে কাজ বন্ধ করে খাড়া দাঁড়িয়ে গেল। কী ব্যাপার? তোমাদের তন লাগেনি, সাবধানে কাজ করো।

তারা মাথা নেড়ে বলল, “না, বানা (সোয়হিলি ভাষায়–হুজুর), এখানে আমরা খুঁডতে পারব না।

কেন?

এই পাহাড়ে এক পুণ্যাত্মা থাকেন। তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। এবার অঙ্গের ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটেছে। এরপর বিষম বিপদে পড়ব।

পুণ্যাত্মা? তিনি আবার কে? বিল বললেন।

আছেন বানা। তিনি গোসাপের রূপ নিয়ে আছেন। বহুকাল এই জায়গায় বাস করছেন। তার দয়ায় এ অঞ্চলে বৃষ্টি হয়। বিষাক্ত মাছিরা এখানে আসে না।

কে বলল তার কথা? তোমরা তো এ অঞ্চলের লোক নও।

গোরা, হুজুর।

বঝন কাণ্ডটা, বিল বললেন, টেলরের সঙ্গীটি কেমন উপকার করে গেছে। এরা খুব সাহসী, কিন্তু বড় সংস্কারাচ্ছন্ন। দেবতা, অপদেবতা সবাইকেই বেজায় ভয়। এখন এদের দিয়ে এখানে কাজ করানো খুব শক্ত ব্যাপার।

বিল অনেক চেষ্টা করলেন। ভয় দেখালেন। লোভ দেখালেন। কিন্তু পোর্টাররা অনড়। শেষে বললেন, বেশ, খুড়তে হবে না। আপাতত কদিন এখানে থাকো। আমি অন্য লোক খুঁজছি, তখন তোমাদের ছেড়ে দেব।

বিল আমাদের বললেন, দেখি কাল আর একবার চেষ্টা করব। ভালো পুজোটুজো দিলে যদি হয়।

কিন্তু পরদিন ভোরে উঠে আবিষ্কার করলাম সব ক-জন পোর্টার পালিয়েছে। বোধহয় মাঝরাতে সরে পড়েছে। এরা কিছু টাকা আগাম নিয়েছিল। হয়তো ভাবল, আমরা যদি জোর করে কাজ করাই, তাই পালিয়েছে।

আমরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। ভারী ভারী শাবল, গাঁইতি ইত্যাদি খোঁড়ার যন্ত্র। মাসখানেকের রসদ। মামাবাবুর বৈজ্ঞানিক জিনিসপত্র। এত মাল চারজনে বয়ে নিয়ে ফিরে যাওয়াও তো অসম্ভব। তাছাড়া এদূর এসে কিছু চেষ্টা না করে ফিরে যাব? এত আয়োজন বৃথা যাবে?

বিল রাইফেল ঘাড়ে বেরোলেন। যদি কাছাকাছি কোনো গ্রাম থেকে লোক জোগাড় করা যায়। ফিরলেন সন্ধের সময়।

নাঃ, পেলাম না। প্রায় দশ মাইল ঘুরে একটা গ্রাম পেয়েছিলাম, কিন্তু তারাও রাজি হল এখানে কাজ করতে।

পরামর্শসভা বসল, কী করা যায়?

বিল বললেন, এখন একমাত্র উপায় বৈজ্ঞানিক টেলর। উনি এ অঞ্চল ভালো করে চেনেন। হয়তো চেষ্টা করলে পোর্টার জোগাড় করে দিতে পারবেন। মানে, এরা যাতে এখানে কাজ করে তার ফন্দি বাতলে দিতে পারবেন।

আমাদের এত খোঁড়ার আগ্রহ দেখে টেলরের এই জায়গা সম্বন্ধে সন্দেহ বাড়বে না তো? আমি বললাম।

কী উপায়! মামাবাবু জানালেন। কিন্তু টেলরের আস্তানায় পৌঁছব কী করে? সুনন্দ বলল।

পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করব, বিল বললেন, কিছু কিছু ট্র্যাকারের বিদ্যে আমার জানা। আছে। মাত্র দুদিন আগে ওরা ফিরে গিয়েছে। চিহ্ন পাওয়া যাবে। কাল ওদের তাঁবু কোথায় ছিল খুঁজে বার করব। তারপর অনুসরণ আরম্ভ হবে। ওর আস্তানা তো বেশি দূরে নয়।

টেলরের তাঁবুর চিহ্ন খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। একটা বড় গাছের তলায় দেখলাম খুঁটি পোঁতার গর্ত, পোড়া কাঠ। কাছেই এক ছোট পাহাড়। বিল মাটির ওপর চোখ রেখে ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, চলুন, এগোনো যাক। ওদের ট্র্যাক পেয়েছি। তবে টেলর যাবার আগে আর একদল এখান থেকে একই পথে গিয়েছিল। পায়ের চিহ্ন কতগুলো কিছু পুরনো। রোদের তেজ বাড়ার আগে রওনা দিই। যতটা পারি জিনিস বয়ে নিয়ে যাই, বাকি কোনো গুহার মধ্যে লুকিয়ে রেখে যাই।

.

০৫.

বিল অনেকটা সামনে এগিয়ে চললেন। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মাটির ওপর। আমরা পিছনে চললাম। বিল বললেন, আমায় ট্র্যাকারের বিদ্যে শিখিয়েছিল এক ঝানু মাসাই। সে যে-কোনো পশু বা মানুষের পায়ের চিহ্ন ধরে তাকে মাইলের পর মাইল অনুসরণ করতে পারত। পাথর বা শক্ত মাটির বুকেও ঠিক তার চিহ্ন খুঁজে বের করত। চিহ্ন দেখে বলে। প্রাণীটির ওজন কত, বয়স ইত্যাদি খুঁটিনাটি। আমিও কিছুটা পারি, তবে তার মতো নয়।

ঘণ্টা দই এগোবার পর বিল সহসা থামলেন। মখে আঙুল দিয়ে আমাদের চুপ করতে ইঙ্গিত করলেন। কানে কতগুলো বিচিত্র শব্দ এল। খটখট, ধুপধাপ। নিঃশব্দে গিয়ে একটা। ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়ালাম। বন্য-প্রকৃতিরাজ্যের এক অদ্ভুত ছবি আমাদের সামনে ফুটে উঠল।

এক টুকরো সমতলভূমিতে দুটো প্রকাণ্ড পুরুষ-হরিণ মত্ত হয়ে যুদ্ধ করছে। খানিক দূরে সাত-আটটা মেয়ে-হরিণ ও তিন-চারটে বাচ্চা। মেয়ে-হরিণগুলো কৌতূহলী চোখে লড়াই দেখছে। কখনও আবার নির্বিকারভাবে ঘাস-পাতা চিবুচ্ছে।

বিল বললেন, ইলান্ড। কে দলপতি হবে তাই নিয়ে লড়াই লেগেছে। যতক্ষণ না একটা হেরে দল ছেড়ে পালাবে ততক্ষণ যুদ্ধ চলবে।

এই দ্বন্দ্ব কখন আরম্ভ হয়েছিল জানি না। আরও আধঘণ্টা চলল। ক্রমে একটা হরিণ। পিছু হটতে লাগল। সে অবসন্ন হয়ে পড়েছে। গা দিয়ে রক্ত ঝরছে। একবার গুঁতো খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। অন্য হরিণটা তাকে শিং-এর ধাক্কায় ঠেলে নিয়ে চলল। শেষে পরাজিত হরিণটি পিছন ফিরে দৌড় লাগাল। বিজয়ী কয়েক কদম তার পিছনে তেড়ে গিয়ে, দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।

ঠিক এই সময় আমাদের ডান ধারে এক ঝোঁপের ভিতর থেকে একজন বিচিত্র লোক মাথা তুলে দাঁড়াল। ঢেঙ্গা, রোগা, লম্বাটে মুখ। ঘাড় অবধি রুক্ষ কঁকড়া চুল। মুখভর্তি গোঁফ-দাড়ি। গায়ে ময়লা জামা ও কার্লো প্যান্ট। কাঁধে তিন-চারটে বড় বড় থলি। হাতে একটা মুভি ক্যামেরা। কে রে বাবা! হিপি নাকি? আফ্রিকার এই গহনে?

লোকটি নিশ্চয় আমাদের আসা দেখেছিল? একগাল হেসে হেঁকে বলল, “হাল্লো, কেমন দেখলে? ভয় হচ্ছিল, বেরসিকের মতো গুলি করে বসবে বুঝি। খুব লড়েছে। ফার্স্ট ক্লাস ছবি উঠল।

লোকটির গলা শুনে হরিণের দল চকিতে দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেল।

লোকটি আমাদের কাছে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিল—জুসেপি আন্তোনিও। শখের ফোটোগ্রাফার। তোমরা? শিকারী নাকি?

আমরাও নিজেদের পরিচয় দিলাম। বিল বললেন, অতগুলো ঝুলি কেন কাঁধে। পোর্টার নেই?

ছিল একজন। পালিয়েছে। একজনকে ধার দাও না তোমরা।

আরে আমাদেরও তো পালিয়েছে। পোর্টারের খোঁজেই তো চলেছি।

শুনে আন্তোনিওর কি হাসি–বাঃ বাঃ! বেশ বেশ! তা তোমাদের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানো যাক, আপত্তি আছে? তোমাদের লোক জোগাড় হলে আমারও হয়ে যাবে। তাছাড়া অনেকদিন কথা বলার লোক পাইনি। একটু আড্ডা দেওয়া যাবে। তবে আমি কিন্তু বাপু আইন মেনে চলতে পারব না, বলে রাখছি।

মানে?

মানে, ঠিক সময় খাওয়া, শোওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশে ভালো চাকরি করতাম। সময়মতো অফিস যেতে হত বলে কাজ ছেড়ে দিলাম। আগে অবসর সময়ে ফোটোগ্রাফি করতাম, এখন মনের সুখে দিনরাত ওই নিয়ে মেতে আছি। এ দেশটাও চমৎকার। সাবজেক্টের অভাব নেই। কতরকম জন্তু-জানোয়ার, কীটপতঙ্গ।

আন্তোনিও বয়সে যুবক। তার হাতমুখ নেড়ে চুল ঝাঁকিয়ে কথা বলার ধরন ভারি মজার। বোঝা যায়, লোকটি বেজায় দিলখোলা। সুনন্দ রসিকতা করল–আপনার নিশ্চয় অনেক পয়সা! চাকরি ছেড়ে দিলেন।

মোটেই না।

তাহলে চলে কী করে?

মাঝে মাঝে দেশে ফিরে ছবি বিক্রি করি। আরে, হলিউডের সিনেমা কোম্পানিগুলো তো আমার ছবি কেনার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। জীবজন্তুর এমন অ্যাকশন ফোটোগ্রাফি কি সহজে পাওয়া যায়?

সুনন্দ বলল, মিস্টার আন্তোনিও, প্রথম আলাপে আপনি আশা করি আমাদের একটা ছবি তুলবেন। অসিতের চেহারাটা পছন্দ না হলে আমার তুলন। বলেন তো পোজ করি।

আন্তোনিও গম্ভীরভাবে বলল, সরি! মানুষের ছবি তুলে আমি ফিল্ম নষ্ট করি না।

সুনন্দর দমে যাওয়া মুখ দেখে আমি সুযোগ বুঝে ফোড়ন কাটলাম, মিস্টার আন্তোনিও। আপনি অনায়াসে ওর ছবি নিতে পারেন। ওকে মানুষ ভাববার কোনো কারণ নেই।

মামাবাবু ও বিল হো-হো করে হেসে উঠলেন। আন্তোনিও আমার কথা শুনে যেন কথাটা যাচাই করবার জন্যে সুনন্দকে একবার আপাদমস্তক জরিপ করে নিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ছবি তুলল না।

আবার চললাম। বিল সামনে, আমরা তাকে অনুসরণ করছি। আন্তোনিও প্রায়ই দলছাড়া হয়ে পড়ছিল। কখনো গাছের ওপর বাঁদরের দাঁত খিঁচুনি দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। কখনো বিচিত্রবর্ণ প্রজাপতি দেখে ক্যামেরা তাক করছিল। আবার ছুটতে ছুটতে এসে আমাদের সঙ্গ ধরছিল।

আট-নয় মাইল যাবার পর বিল দাঁড়ালেন। বললেন, ওই দূরে ছোট ছোট ঝোঁপের ঘন জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, ওখানে নিশ্চয়ই তেসি ফ্লাই আছে। দেখ, বনের চারপাশের জমির ঘাস পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সমস্ত ঝোঁপঝাড় কেটে ফেলা হয়েছে। তেসি মাছি ওই রকম বনে আড্ডা গাড়ে। বড় পাতাবহুল গাছের বন বা ছোট ছোট ঘাসবনে থাকে। এখানকার লোকে তাই তেসি ফ্লাই এলাকার চারপাশের বড় ঘাস পুড়িয়ে, ঝোঁপঝাড় কেটে দেয়। যাতে এই মাছি ছড়িয়ে না পড়ে। টেলর দেখছি বনটা এড়িয়ে ডান পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে।

আমরা চক্রাকারে তেৎসি মাছির এলাকাটা ঘুরে বনের উল্টো দিকে উপস্থিত হলাম। দূরে বড় বড় গাছে ছাওয়া একখণ্ড সবুজ বন দেখা যাচ্ছিল। বিল সোজা সেই দিকে এগিয়ে গেলেন।

বনের মধ্যে এক পায়ে-চলা পথ ধরে মাত্র পঞ্চাশ গজ মতো ঢুকেই দেখি বন শেষ হয়ে গেছে। সামনে ছোট ছোট ঘাসে ঢাকা পরিষ্কার এক টুকরো জমি এবং তার ভিতর উঁচ পাঁচিলে ঘেরা একটি মাটির বাড়ি। মনে হল, বড় বড় গাছের বেড়া দিয়ে বাড়িটিকে যেন ইচ্ছে করেই লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

বিল বললেন, টেলর ওই বাড়িতে ঢুকেছে।

প্রাচীর-সংলগ্ন মস্ত কাঠের গেটটা একটু ফাঁক করা ছিল। আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বাড়ির দরজায় কয়েকবার করাঘাত করতে শুনলাম ভিতরে খটখট আওয়াজ। দরজা খুলে একটি মুখ উঁকি মারল। সে-মুখ টেলরের নয়।

পুরু চশমার কাঁচে ঢাকা দুটো বিস্ফারিত রাগী চোখের সামনা-সামনি হয়ে আমরা চমকে দু-পা পিছিয়ে গেলাম।

মুখখানা এক বৃদ্ধের। মাথাজোড়া টাক। টিয়াপাখির মতো নাক। তার বাঁ গালের ওপর এক বীভৎস চিহ্ন। পোড়ার দাগ। গালের মাংস কুঁচকে মুখের রূপ বিকৃত করে। তুলেছে।–কাকে চাই? বৃদ্ধ কড়া গলায় প্রশ্ন করল।

এখানে মিস্টার টেলর থাকেন?

হ্যাঁ, কিন্তু সে এখন নেই।

কোথায় গেছেন?

জানি না।

কবে ফিরবেন? আমাদের বিশেষ দরকার।

ও। বৃদ্ধ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দেখল। তারপর বলল, বোধহয় দু-একদিনের মধ্যে। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? বৃদ্ধ দরজার ফাঁকটা কমিয়ে আনল।

বলবেন, ঘোষ এসেছিল, আর বিল। একটু দরকার।

বেশ, বলব। জাম্বো কোথায় গেলি। যত উটকো লোক ঢুকে পড়ে–বলতে বলতে সে দরজাটা বন্ধ করে দিল। চকিতে দেখলাম লোকটির হাতে একটি লাঠি। সে লাঠিতে ভর দিয়ে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে।

আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। টেলরের আস্তানায় এ কোন বদমেজাজি বুড়ো? টেলরের কোনো অ্যাসিস্টেন্ট নাকি? মনে হয়, লোকটার মাথার গোলমাল আছে। যা হোক, টেলর ফেরা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।

পাঁচিলের বাইরে একটি উপজাতীয় লোকের সঙ্গে দেখা। এই বোধহয় জাম্বো। সে আমাদের অবাক হয়ে দেখছিল। বিল বলল, “তুমি টেলরের কাছে কাজ করো?,

হ্যাঁ, বানা।

টেলর কবে ফিরবেন?

দু-একদিনের মধ্যে।

আচ্ছা, এখানে খাবার জল কোথায় পাওয়া যাবে, কাছাকাছি?

ওই দিকে একটা ঝর্না আছে। সে বাড়ির পিছন দিকে দেখাল।

বেশ। টেলর এলে বলবে তার বন্ধুরা ওখানে অপেক্ষা করছে। আমরা তাঁবু ফেলছি।

লোকটি ঘাড় নেড়ে জানাল–বলব।

হঠাৎ–কোত্থেকে আন্তোনিও হাজির হল। সে কখন সটকে পড়েছিল খেয়াল করিনি।পোর্টারের ব্যবস্থা হল?

বললাম, টেলর নেই। দু-একদিন অপেক্ষা করতে হবে।

বেশ বেশ। জায়গাটা খাসা। অনেক সাবজেক্ট পাওয়া যাবে। সে উৎসাহিতভাবে চারদিক দেখল।

ঝর্না খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। বাড়ির আধ মাইলের মধ্যেই। কয়েকটা বড় বড় পাথরের চাঙড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে ক্ষীণ জলস্রোত। পরিষ্কার টলটলে জল নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। স্রোত ক্রমশ চওড়া হয়ে এঁকেবেঁকে কিছু দূরে ঘন বনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। উৎসের কাছেই আমরা তাঁবু ফেললাম।

মামাবাবু বেজায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। কথাবার্তা নেই, কী জানি ভাবছেন। তাঁবু খাঁটিয়ে, রান্নার জোগাড় করছি, হঠাৎ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন–মনে পড়েছে–কার্লো! ডক্টর ফিলিপ কার্লো!

কার্লো কে?

ওই বৃদ্ধ। কেবল ভাবছি, কোথায় দেখেছি। সেই নাক। কথা বলার ভঙ্গি। গলার স্বর। বড্ড চেনা। তবে দশ বছর আগে দেখেছিলাম। তখন মাথায় অনেক চুল ছিল; আর গালের পোড়া দাগটা ছিল না। এখন ভীষণ বড়োটে হয়ে গেছেন। কিন্তু কা্ররলো এখানে কী করছেন?

কার্লো কে? বিল বললেন।

একজন প্রাণিবিজ্ঞানী। ট্রপিকাল অঞ্চলের পোকামাকড-বিশেষজ্ঞ। কলকাতায় এক কনফারেন্সে দেখেছিলাম। বেজায় রাগী। তবে অসাধারণ পণ্ডিত। শুনেছিলাম, তান ট্রপিকাল অরণ্যে প্রচুর ঘোরেন। কয়েক বছর ওঁর কোনো লেখা আমার চোখে পড়েনি। কার্লো কি টেলরের সঙ্গে রিসার্চ করছেন?

বদরাগী বুড়ো কার্লোর রহস্য আমাদের সবার মনে কৌতূহল জাগাল। কিন্তু টেলরের সঙ্গে দেখা না হলে এ-রহস্য সমাধানের উপায় নেই।

.

০৬.

ব্রুস টেলর পরদিন ভোরেই হই-হই করে হাজির হলেন।

কী ব্যাপার? আপনারা? বললেন যে পশ্চিমে যাবেন?

বিশেষ প্রয়োজনে এলাম। আপনার সাহায্য দরকার।

কিন্তু এলেন কী করে?

আপনার পদচিহ্ন অনুসরণ করে।

বিল নিয়ে এসেছেন।

বটে, বটে! তা দরকারটা কী শুনি?

মামাবাবু আমাদের পোর্টারদের কাহিনি শোনালেন।

শুনে টেলর বেজায় হাসলেন। একটা বুড়ো গোসাপ ওই পাহাড়ে থাকে জানি, কিন্তু সে যে দেবতা জানতাম না। তিনি গোরোর ওপর চটে উঠলেন, ব্যাটারা বড় বাজে বকে। এখন বুঝুন ঠেলা! ঠিক আছে, আমি আজই তোক পাঠাচ্ছি কাছের গ্রামে। তবে ভয় হয়, সংস্কার বড় মারাত্মক জিনিস। ওখানে কাজ করতে কেউ রাজি হবে কিনা জানি না। যা হোক, আমি সবরকম চেষ্টাই করে দেখব।

টেলর কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “আমি কাল ছিলাম না। অতিথি সৎকার করতে পারলাম না। তা আমি নেই খবরটা দিল কে?

এক বৃদ্ধ। বিল জানালেন।

আলাপ হল তার সঙ্গে?

আলাপ! বিল আঁতকে ওঠেন, “বাপরে কী মেজাজ! বলল–নেই। শিগগিরি ফিরবে। ব্যস! মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। দুটোর বেশি প্রশ্ন করলে মেরেই বসত।

টেলর লজ্জিতভাবে বললেন, ছিঃ ছিঃ, কী কাণ্ড!

মামাবাবু এবার প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, বৃদ্ধটির নাম কি ফিলিপ কার্লো?

টেলর অবাক। আপনি চেনেন কার্লোকে? আলাপ আছে?

না। একবার মাত্র দেখেছিলাম। অনেক দিন আগে। উনি কি আপনার সঙ্গে কাজ করছেন?

হুঁ, কাজ করছেন বটে, কিন্তু তাতে লাভ না হয়ে বরং আমার ক্ষতিই হচ্ছে।

কেন? অমন পণ্ডিত লোক।

তা ঠিক। কিন্তু ডক্টর কার্লো এখন রুগ্‌ণ। ওঁর শরীর মন কোনোটাই সুস্থ নয়। দেখলে তো, আপনাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করলেন!

ব্যাপারটা কী?

ব্যাপার খুবই দুঃখজনক। এত বড় প্রতিভার ওই পরিণতি হবে ভাবিনি। টেলর বিষণ্ণভাবে একটু চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন, প্রায় আড়াই বছর আগে ডক্টর কার্লোর সঙ্গে আমার আলাপ হয় এক উপজাতি গ্রামে। বিষাক্ত পোকার কামড়ে আদিবাসীরা কী কী টোটকা ব্যবহার করে তিনি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছিলেন। কয়েকদিন পর আমি সে-গ্রাম ছেড়ে চলে যাই। মাত্র তিন দিন পরে ওই গ্রামের একজন এসে আমায় খবর দিল কার্লোর গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে তার কুটিরে আগুন লাগে। জ্বলন্ত পোশাকে উদভ্রান্ত অবস্থায় দৌড়ে পালাতে গিয়ে তিনি এক খাদের মধ্যে পড়ে যান। পায়ে আঘাত লাগে। গ্রামের লোক তাঁকে তিরিশ মাইল দূরে এক মিশনারি হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি হাসপাতালে গেলাম। কার্লো মাস দুই ভুগে সুস্থ হলেন, কিন্তু একটা পা জখম হয়ে গেল। তাছাড়া মুখটা পুড়ে গিয়ে বিকৃত হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করলাম–ফিরে যান। কিন্তু কার্লো রাজি হলেন না। উনি জেদ ধরলেন আমার সঙ্গে যাবেন। আমি একটু সাহায্য করলে এখানে রিসার্চ চালাতে পারবেন।

বাধ্য হয়ে সঙ্গে নিয়ে এলাম। ল্যাবরেটরিতে এনে রাখলাম। দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পরে বুঝলাম কার্লো ভীষণ মানসিক শ পেয়েছেন। কোনো কঠিন গবেষণা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দিনের পর দিন গুম্ হয়ে থাকেন। কারো সামনে বেরোতে চান না। রাতে ঘুম হয় না। অকারণে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

ওঁকে ডাক্তার দেখালেন না কেন? মামাবাবু বললেন।

চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হলেন না। মনে হয়, ধারণা হয়েছিল, ওঁকে পাগলা গারদে রাখা হবে।

কোনো আত্মীয়কে যদি খবর দিতেন।

তেমন কারও ঠিকানা পেলাম না। ডারবান থেকে ওঁর পরিচিত এক ভদ্রলোককে ডেকে এনেছিলাম, কার্লো তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। জোর করতে সাহস হল না। যদি স্ট্রোক হয়ে যায়! ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এত বড় ব্রেন, সত্যি কি পাগল হয়ে যাবে? তাই আমার কাজের মধ্যে ওঁকে ডাকতে লাগলাম। আমার গবেষণা নিয়ে আলোচনা করতাম। একটু একটু করে দেখি উনি ফেরোমন সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তখন ভালোই লেগেছিল। যদি এত বড় পণ্ডিতের সাহায্য পাই! আমিই প্রস্তাব দিই, আসুন আমরা একসঙ্গে কাজ করি। পরে বুঝলাম, নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। কার্লো ফেরোমন নিয়ে মেতে গেলেন এবং ল্যাবরেটরি অধিকার করে বসলেন। আমাকে একা কিছুতেই কাজ করতে দেবেন না। সব সময় আমার ওপর সর্দারি করবেন। কার্লোকে পেয়ে আমার কোনো উপকার হল না। কারণ, কোনো সমস্যা নিয়ে টানা কাজ করার মতো শরীর বা মনের অবস্থা উনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিষয়টা ওঁর কাছে নতুন। শুধু নানারকম উদ্ভট কল্পনা করেন আর আমাকে তার কল্পনামাফিক কাজ করতে বলেন। আজ বছরখানেকের ওপর এই অবস্থা চলছে। আমার কাজের খুব ক্ষতি হচ্ছে। যতটা পারি ওঁকে লুকিয়ে কাজ করি। উনি উপস্থিত থাকলে বড় ডিসটার্বেন্স হয়। মহা সমস্যায় পড়েছি। কী যে করি–

টেলর মাথায় হাত দিয়ে হতাশভাবে বসে রইলেন। সত্যি, এত নামী বৈজ্ঞানিকের এই শোচনীয় পরিণতি ভাবতে কষ্ট হয়।

মামাবাবু বললেন, যদি অনুমতি করেন তো ডক্টর কার্লোর সঙ্গে আমি একবার আলাপ করব। চেষ্টা করব ওঁকে শহরে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে।

খুব ভালো কথা। যদি পারেন তো মহা উপকার হয়। আমার অবস্থাটা তো বুঝছেন। তবে দয়া করে ওঁর কাছে ফেরোমন প্রসঙ্গ তুলবেন না।

কেন?

কারণ, এটা হল টপ সিক্রেট, মানে কার্লোর ভাষায়। উনি স্থির করেছেন, ফেরোমন নিয়ে কয়েকটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করবেন। কিন্তু যতদিন না রিসার্চ কমপ্লিট হয়, আমায় বারণ করেছেন যেন এ-বিষয়ে কেউ জানতে না পারে। তাহলেই নাকি অন্য বৈজ্ঞানিকরা এই লাইনে রিসার্চ শুরু করে দেবে। হয়তো আমাদের গবেষণার সূত্র চুরি করার ষড়যন্ত্র। হবে।

কিন্তু জুওলজি পত্রিকায় যে আপনি পেপার পাবলিশ করেছেন? সুনন্দ একটু মজা করে।

লুকিয়ে। জানতে পারলে বৃদ্ধ কেলেঙ্কারি করবে। আচ্ছা বলুন তো প্রোফেসর, আমার এত দিনের সাধনা কি ওঁর খামখেয়ালিপনার জন্য বৃথা যাবে? এতটা আত্মত্যাগ কি সম্ভব? কেন আমি আমার গবেষণার ফল প্রকাশ করব না? কেন আমি আমার একান্ত নিজস্ব পরিশ্রমলব্ধ গবেষণায় অন্যকে ভাগ বসাতে দেব? আমার লেখায় অন্যের নাম যুক্ত করব?

মামাবাবু সায় দিলেন, আপনি ঠিকই বলছেন। আপনার কোনো অন্যায় হয়নি। আপনি যথেষ্ট করছেন। কিন্তু এভাবে চললে তো আপনাদের দুজনেরই ক্ষতি। আমি একবার চেষ্টা করবই। আপনি কার্লোর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন?

নিশ্চয়! তবে সুযোগ বুঝে, যেদিন ওঁর মন বেশ শান্ত থাকবে।

টেলর বিদায় নিলেন। আমরা কীভাবে টেলরকে কার্লোর কবল থেকে উদ্ধার করা যায় তাই নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিলাম। মামাবাবু বারবার বলতে লাগলেন, এত বড় বৈজ্ঞানিক প্রতিভাকে এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া কক্ষনো উচিত নয়। চেষ্টা করতেই হবে। ওঁকে ভালো করে তোলার।

.

পরদিন সকালে মামাবাবু, সুনন্দ ও আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ল্যাবরেটরির কাছে টেলরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। টেলর বললেন, প্রভাতে বায়ুসেরন ও কিঞ্চিৎ পদচারণ। আমার অভ্যাস। চলুন ভিতরে।

কার্লো? আমি সভয়ে প্রশ্ন করি।

ঘুমোচ্ছেন। ঘুম আসছিল না, তাই মাঝরাতে ঘুমের বড়ি খেয়েছেন। চলুন ল্যাবরেটরি দেখাব।

ল্যাবরেটরিতে ঢুকে আমরা অবাক। শহর থেকে এত দূরে, গহনে এমন আধুনিক নানা জায়গায় আমার আরও কয়েকটা ল্যাবরেটরি আছে। তবে এটাই সেরা।নিজনে কাজ করতে আমার ভালো লাগে।

মামাবাবু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। কতগুলো লেবেল-আঁটা শিশি দেখিয়ে বললেন, এগুলোর মধ্যে কি ফেরোমন আছে?

হ্যাঁ। কৃত্রিম উপায়ে বানিয়েছি।

টেলর জাম্বোকে ডেকে কফি বানাতে বললেন। বিদায় নেবার সময় আশ্বাস দিলেন, আশা করছি আপনাদের পোর্টারের খবর শিগগিরি পাবেন।

রাত্রে আন্তোনিও জানাল, প্রোফেসর ঘোষ, আজ পাগলা বৈজ্ঞানিককে দেখলাম।

কে, কার্লো?

হ্যাঁ! পাঁচিলের বাইরে একটা পাথরের ওপর বসেছিলেন। আমায় দেখেই চট করে ভিতরে ঢুকে গেলেন। জানেন, ওঁকে আমি আগে দেখেছি।

কোথায়?

লিবিয়ায়। চার বছর আগে। সাহারার প্রান্তে এক মরূদ্যানে। আলাপ হয়নি। দূর থেকে দেখেছিলাম। সেদিনও ওই এক ভঙ্গিতে বসেছিলেন। বেদুইন শেখরা বলেছিলেন–সাহেব বেশ কিছুদিন ওই মরূদ্যানে আছে। পোকামাকড় নিয়ে কী সব পরীক্ষা করে। বেজায় রাগী।

আর কোনো শ্বেতাঙ্গ ছিল সেখানে?

না। তখন অবশ্য কার্লোর গালে পোড়া দাগ ছিল না। তবে আমার ফোটোগ্রাফারের চোখ ঠিক চিনেছে।

.

০৭.

টেলর সেদিন এলেন না। পরদিন সকাল আটটা নাগাদ দেখা করতে এলেন। বললেন। কয়েকজন পোটার জোগাড় হয়েছে, কিন্তু মুশকিল হল, তারাও পাহাড়ের কাছে পাথর কাটতে রাজি হচ্ছে না। আপাতত না হয় এদের নিয়ে রকপেন্টিং-এর খোঁজে বেরিয়ে পড়ুন! ফসিল উদ্ধার পরে করবেন।

মামাবাবু চিন্তা করতে থাকেন।

এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আন্তোনিও হাজির হল। কোন কাকভোরে সে ক্যামেরা ঘাড়ে বেরিয়েছিল। এসেই বলল, চা খাব। ওঃ, আজ দুটো জব্বর সাবজেক্ট পেয়েছি।

কী সাবজেক্ট? এক নম্বর, একপাল বুনো কুকুর। কী গ্রেসফুল! একটা প্রকাণ্ড জেব্রার পিছনে তাড়া করে ছুটছিল। অনেক ছবি নিয়েছি।

বিল তাড়াতাড়ি বললেন, আন্তোনিও, এমন কর্ম কক্ষনো করবেন না। বুনো কুকুর আফ্রিকার সবচেয়ে হিংস্র জীব। অকারণে শিকার করে। বাগে পেলে মানুষকেও ছাড়ে না।

তাঁর কথায় কান না দিয়ে আন্তোনিও বলল, দু-নম্বর হল পিঁপড়ে। লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ে একটা গাছে বাসা বেঁধেছে। গাছের অর্ধেকটা পর্যন্ত থিকথিক করছে, পিঁপড়েতে গুঁড়ি ও ডালগুলো ঢেকে গেছে। মাইলখানেক দূরে ওই বনের মধ্যে। হ্যাঁ, একটা ওয়াটার-হোল আবিষ্কার করেছি। বিল, যাবেন নাকি? দুজনে পাশে লুকিয়ে থাকব। জন্তুদের জল খাবার ছবি তুলব। রাতেও থাকব, দেখব। উঁহু, আর কেউ নয়। ভিড় হলে জন্তুরা আসবে না। বিল, যাবেন?

যাব। বিল সম্মতি জানাল।

আন্তোনিও হুড়হুড় করে কথা বলে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে টেলরের দিকে চাইল, মশাইকে তো আগে দেখিনি!

তাকে টেলরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

ও, আপনাকে চিনি। মানে নাম শুনেছি, দারুণ বৈজ্ঞানিক। আপনিই তো আমাদের পোর্টার জোগাড় করে দেবেন?

টেলর বলল, চেষ্টা করছি। আপনার পেতে অসুবিধা হবে না। প্রোফেসরের জন্যই ভাবনা। হ্যাঁ, প্রোফেসর, ভেবে দেখলাম আপনার ওই জায়গাটা অনুসন্ধান না করে চলে যাওয়া উচিত হবে না। আমি অন্য গ্রামে চেষ্টা করি। কটা দিন ধৈর্য ধরুন। কোথাও যাবেন না। এখানেই থাকবেন। আচ্ছা বিদায়।

দুপুর একটা নাগাদ টেলর গোরোকে নিয়ে আবার হাজির হলেন। সঙ্গে তাঁবু ও কিছু জিনিস। বললেন, এক জায়গায় রকপেন্টিং-এর সন্ধান পেয়েছি। লাঞ্চ হয়ে গেছে তো? তবে যান, দেখে আসুন। গোয়রা আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। মাত্র দু-মাইল পথ। সন্ধের আগে ফিরে আসতে পারবেন।

বেশ যাচ্ছি। কিন্তু তবু নিয়ে বেরিয়েছেন যে?

আজ ঝর্নার কাছে কাটাব। ল্যাবরেটরিতে ফিরছি না। কার্লোর মেজাজ অত্যধিক খারাপ। আমার সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। কী করব, মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুতি হয়। যাহোক, এখন ওর সামনে না যাওয়াই ভালো। কাল সকালে ওর মেজাজ ঠাণ্ডা হলে ফিরব। বনের মধ্যে একটা মস্ত মৌচাক আছে। বসে বসে মৌমাছি দেখি। আপনারা ফিরে এলে গল্প হবে।

দুই নয়, অন্তত চারমাইল হাঁটতে হল। চৌকো বড় একটা পাথরের গায়ে লাল-কালো রেখায় কয়েকটা জিরাফ ও হরিণ আঁকা। একটা কাগতাড়ুয়া গোছের মানুষের ছবি। দেখলে মনে হয় ছোট ছেলে এঁকেছে।

মামাবাবু একটু পরীক্ষা করেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, বাজে খাটলাম। চলো ফিরি।

একটু জিরিয়ে ফিরতি পথে হন্টন দিলাম।

টেলর আমাদের তাঁবুর কাছে অপেক্ষা করছিলেন।

বললেন, কেমন দেখলেন?

ঠকেছি, এগুলো তেমন প্রাচীন নয়। মামাবাবু জানালেন।

ইস, লোকটা দেখছি বাজে খবর দিল। টেলর কাঁচুমাচুভাবে বললেন। টেলর তার তাঁবুতে আমাদের কফি খেয়ে যেতে ডাকলেন। কিন্তু মামাবাবু আর গেলেন না। বড্ড ক্লান্ত।

আন্তোনিও একটা বাঁদরছানা ধরেছিল। তাঁবুর খুঁটিতে সেটা বাঁধা থাকত। আবিষ্কার করলাম সেটা ইতিমধ্যে পালিয়েছে।

.

০৮.

অঘোরে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনলাম মামাবাবুর কণ্ঠস্বর, সুনন্দ, অসিত। ওঠো, ওঠো।

ধড়মড় করে উঠে বসলাম–কী ব্যাপার?

কেমন শব্দ হচ্ছে শুনতে পাচ্ছ? মামাবাবু বললেন।

গভীর রাত। বাইরে হালকা চাঁদের আলো, অগ্নিকুণ্ডের কাঠগুলো নিবুনিবু। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। কান পাতলাম। হ্যাঁ, কতগুলো অস্বাভাবিক শব্দ। খড়-খড়, মড়-মড়। বনের ভিতর কারা যেন ছুটোছুটি করছে। মাঝে মাঝে ভীত বাঁদরের কিচিমিচি। পাখির ডাক। শব্দগুলো যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কে বা কারা আসছে? কোন জানোয়ার? রহস্যময় আফ্রিকায় এ কোন্ অজ্ঞাত বিপদের পদধ্বনি? বন্দুক এগিয়ে রাখি। বিল নেই তাই অসহায় লাগছিল।

অগ্নিকুণ্ডের ক্ষীণ আলোয় দেখলাম, কয়েকটা মেঠো ইঁদুর লাফাতে লাফাতে পালাল। সঙ্গে সঙ্গে দুটো শেয়াল ও পরেই একটা হায়না দ্রুত তাঁবুর গা ঘেঁষে ছুটে গেল। এরা ভয় পেয়েছে। কিন্তু কেন?

মামাবাবু নিশ্চল। সর্ব ইন্দ্রিয় উন্মুখ। একদৃষ্টে বনের দিকে চেয়ে আছেন। সহসা তিনি টর্চ জ্বাললেন। কয়েক মুহূর্ত টর্চের জোরালো আলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হল। তারপরই তিনি সভয়ে বললেন, ওই দেখো!

দেখলাম, অদুরে বনের প্রান্তের মাটির ওপর একটা চওড়া কালো দাগ। ও কি, দাগটা যে সচল। যেন প্রকাণ্ড এক আলকাতরার স্রোত বনের মধ্য থেকে বেরিয়ে ধীরে গড়িয়ে আসছে। স্রোতের মুখ অন্তত দশ গজ চওড়া, বস্তুটি যে কী বুঝতে পারছিলাম না।

মামাবাবু উত্তেজিতভাবে দ্রুত বলতে লাগলেন-আর্মি-অ্যান্ট। বুঝতে পারছ না? লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পিঁপড়ের বাহিনী। ঠিক সৈন্যবাহিনীর মতো সারিবদ্ধভাবে মার্চ করে চলে। হিংস্র মাংসাশী ক্ষুধার্ত এই পিঁপড়েদের খপ্পড়ে পড়লে দুনিয়ার ছোট-বড় কোনো প্রাণীর নিস্তার নেই। সামনে যাকে পায় আক্রমণ করে। প্রাণভয়ে তাই সবাই পালায়। মনে হয় আন্তোনিও এই বাহিনীটাকেই গাছের গায়ে বিশ্রাম নিতে দেখেছিল। কিন্তু এরা এদিকে এল কেন? আশ্চর্য! এরা বনের ছায়া বা বড় ঘাসবনের মধ্য দিয়ে চলে। উন্মুক্ত প্রান্তর, শুকনো মাটি, পাথরের ওপর দিয়ে চলে না। দেখ দেখ, পিঁপড়ের ঝাক সোজা তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে। চল পালাই, সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত!

তাঁবু ছেড়ে বেরোব, হঠাৎ মামাবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। সুনন্দ, বাঁদর বাচ্চাটা কি দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে?

না, দড়ি খুলে। অত শক্ত গেরো কী করে যে খুলল!

হুম! চল। বিলের পিস্তলটা সঙ্গে নাও! মামাবাবু অন্ধকারে চলতে শুরু করলেন। একবার জিজ্ঞেস করলাম–কোথায় যাচ্ছেন?

টেলরের তাঁবুতে। কথা বোলো না।

নিঃশব্দে আমরা টেলরের তাঁবুর কাছে এসে দাঁড়ালাম। দেখি অত রাতেও টেলর জেগে। তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। মামাবাবু যে কাণ্ড করলেন তাতে আমরা তে স্তম্ভিত। টেলরের পিছনে গিয়ে বন্দুক তাক করে বলে উঠলেন, কী শুনছেন মিস্টার টেলর?

টেলর বিদ্যুৎবেগে ফিরে দাঁড়াতেই মামাবাবু বললেন, “উঁহু, এগোবেন না, তাহলে গুলি করতে বাধ্য হব। সুনন্দ, তুমি একে পিস্তল নিয়ে পাহারা দাও। নড়লেই গুলি করবে। অসিত, খেয়াল রেখো–গোরো আছে কি না। আমি আসছি–

টেলর রাগে অগ্নিশর্মা। চিৎকার করে উঠলেন, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে প্রোফেসর ঘোষ! মামাবাবু ভ্রূক্ষেপ না করে টেলরের তাঁবুর ভিতর ঢুকলেন।

একটুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা বড় শিশি। মিস্টার টেলর, আর্মি-অ্যান্ট-এর ফেরোমন-এর শিশি এখানে কেন? আর শিশিটা খালি কেন?

তার জন্যে কি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? আমাকে যেতে দিন। টেলর অপমানে ফুলছে।

যাদের পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে মারবার চেষ্টা করেছিলেন, তারা কৈফিয়ত দাবি করতে পারে বৈকি!

কী যা-তা বলছেন!

ঠিকই বলছি। বোগাস রকপেন্টিং দেখেই বুঝলাম আপনার কোনো মতলব আছে। তাঁবু থেকে কিছুক্ষণ আমাদের সরিয়ে রাখলেন। কোনো ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের আভাস পেলাম। তাই সতর্ক ছিলাম। যাক, আপনি এখন আমাদের বন্দী। ষড়যন্ত্রের কারণ কাল অনুসন্ধান করব। সুনন্দ ওর হাত বাঁধো।

টেলর জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মামাবাবুকে দেখতে লাগলেন। কোনো কথা বললেন না।

বন্দী টেলর সমেত আমরা আমাদের তাঁবুর কাছে আশ্রয় নিলাম। টর্চের আলোয় দেখলাম, তাঁবু এবং তার চারপাশে থিকথিক করছে পিঁপড়ে। যেন কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে জায়গাটা।

মামাবাবুর নির্দেশে টেলরের পা-ও বাঁধলাম। বলা যায় না যদি দৌড়ে পালায়। তারপর ভোর হওয়ার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

পুবের আকাশ সামান্য ফর্সা হবার সঙ্গে সঙ্গে পাখ-পাখালির কলতান শুরু হল। ঠিক তখুনি কানে এল আন্তোনিওর শিস। মেজাজে সুর ভাঁজতে ভাজতে আসছে। চেঁচিয়ে ডাকলাম, আন্তোনিও, মিস্টার হার্ডি, আমরা এখানে।

আমাদের ওই অবস্থায় দেখে বিল অবাক। কী ব্যাপার, টেলরকে বেঁধে রেখেছেন?

কারণ উনি আমাদের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিলেন!

কীভাবে?

পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে।

অ্যাঁ, পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে! লোকটা যাদুবিদ্যা জানে নাকি? বিস্ময়ে বিলের চোখ গোল হয়ে ওঠে। আন্তোনিও মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ, উইচ-ক্রাফট। আমি শুনেছি। উপজাতীয় ওঝারা মন্ত্রের সাহায্যে সিংহ লেলিয়ে দিতে পারে।

না, জাদু নয়। অতি সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক কৌশল। এই শিশিটা দেখছেন, এর মধ্যে ফেরোমন ছিল। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি। শিশির গায়ে লেখা রয়েছে আর্মি-অ্যান্ট। তার নিচে লেখা দেখুন–Trail Substance। আর্মি-অ্যান্ট অন্ধ। প্রত্যেক পিঁপড়ে চলার সময় পিছনের। দিকের একটি শুড়ের সাহায্যে মাটিতে একরকম ফেরোমন লাগাতে লাগাতে যায়। এই ফেরোমন-এর নাম Trail Substance। সেই ফেরোমন-এর গন্ধ শুঁকে পিছনের পিঁপড়ে সামনের পিঁপড়েকে অনুসরণ করে দলবদ্ধভাবে এগোয়। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে টেলর আন্তোনিওর দেখা আর্মি-অ্যান্ট-এর আস্তানা থেকে আমাদের তাঁবু অবধি এই ফেরোমন ছড়িয়ে রেখেছিল। রাতে পিঁপড়ের ঝক চলতে শুরু করে গন্ধ অনুসরণ করে। আমাদের তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসে।

উঃ, খুব বেঁচে গেছেন। টের পেলেন কী করে! ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বুঝি? বিল বললেন।

আমি জেগেছিলাম। সুনন্দ, অসিত ঘুমোচ্ছিল। নানা কারণে টেলরের ওপর আমার সন্দেহ দানা বাঁধছিল। আজ রক-পেন্টিং দেখেই বুঝলাম, হয়তো আজই বিপদ আসবে।

কেন, রক-পেন্টিংয়ে কী ছিল?

বাজে ছবি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আঁকা। হয়তো টেলরের নিজস্ব শিল্পচর্চা। বুঝলাম, আমাদের কায়দা করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুম আসছিল না। মন কোনো বিপদের আশঙ্কা করছিল। তবে আক্রমণ যে এমন বিচিত্র উপায়ে হবে তা অবশ্য আন্দাজ করতে পারিনি! টেলর আঁটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিলেন। বাঁদরটাকে অবধি ছেড়ে দিয়েছিলেন, পাছে সে চিৎকার করে আমাদের জাগিয়ে দেয়। আমার আর একটা সন্দেহ হয়, আমাদের খাবার জলে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন টেলর। খুব সম্ভব ঘুমের ওষুধ। টেলর, সত্যি করে বলুন তো কী করেছিলেন?

টেলর কোনো উত্তর দিল না।

মামাবাবু বললেন, রক-পেন্টিং দেখতে বেরোবার আগে আমি তাঁবুর জিনিসপত্র ভালো করে পরীক্ষা করে যাই। ফিরে এসে তাঁবুতে ঢুকে লক্ষ করে দেখলাম মাটিতে বসানো খাবার জলের জগটা যেন একটু সরানো হয়েছে। জলের রঙও কেমন সামান্য ঘোলা। কোনো রিস্ক না নিয়ে জলটা ফেলে দিই।

অর্থাৎ ওই জল খেলে? আমি সভয়ে বলে উঠি।

হ্যাঁ, আমাদের ঘুম আর কোনো দিনও ভাঙত না।

আমার ইচ্ছে হচ্ছে শয়তানটাকে এক্ষুনি গুলি করে মারি। বিলের ক্রুদ্ধ গর্জনে টেলর যেন শিউরে উঠল। কিন্তু প্রোফেসর, একটা রহস্য বুঝতে পারছি না। আপনাদের হত্যা করে ওর লাভ কী? বিল প্রশ্ন করলেন।

সেটা বোধহয় ডক্টর কার্লোর সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারব। সুনন্দ, আন্তোনিও, তোমরা টেলরকে পাহারা দাও। বিল, অসিত আমার সঙ্গে এসো।

গেট বন্ধ ছিল। পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে ঘরের দরজায় করাঘাত করলাম। গোরা কবাট খুলে দিল। তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিল গোরোকে কঠোর গলায় বললেন, চালাকির চেষ্টা করলেই গুলি খাবে। বিল তাকে একটা খালি ঘরে পুরে শিকল লাগিয়ে দিলেন। তারপর কার্লোর খোঁজে আমরা ল্যাবরেটরি ঘরে হাজির হলাম।

.

০৯.

কার্লো একটা চেয়ারে বসে চিন্তামগ্ন ছিলেন। আমাদের দেখে চমকে উঠলেন।–একি, রিপোর্টার! তোমরা এখানে কেন? না, ফেরোমন রিসার্চ সম্বন্ধে আমি এখন একটি কথাও বলব না। কাজ শেষ না হলে কাউকে কিছু জানাব না। কার্লো প্রায় মারতে আসেন আর কি!

মামাবাবু শান্ত গলায় বললেন, “আমরা রিপোর্টার, কে বলেছে?

কেন, টেলর।

টেলর আপনাকে ভুল বুঝিয়েছে। আমি একজন প্রাণিবিজ্ঞানী। আপনার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করি। আমি জানতে এসেছি, ফেরোমন নিয়ে কে গবেষণা করছে? আপনি, না টেলর? না, দুজনে একসঙ্গে?

ফুঃ! টেলর ফেরোমন-এর কী বোঝে? কোনো মৌলিক গবেষণা করার মতো ওর মাথাই নেই।

কিন্তু জুওলজি পত্রিকায় টেলর নিজের নামে ফেরোমন-এর ওপর দুটি প্রবন্ধ লিখেছে। আমি নিজে পড়েছি। একেবারে মৌলিক গবেষণা। প্রথমটা পঙ্গপালের বংশবৃদ্ধিতে ফেরোমন-এর প্রভাব। দ্বিতীয়টি কৃত্রিম ফেরোমন তৈরি সম্বন্ধে।

কার্লোর দৃষ্টি বিস্ফারিত। সর্বনাশ! তার মানে সে আমার লেখা চুরি করেছে। গবেষণা সংক্রান্ত আরও অনেক মূল্যবান পেপারস্ একসঙ্গে ছিল। ওর কাজ ছিল আমার লেখা টাইপ করে এখানে গুছিয়ে রাখা। উঃ কী বিশ্বাসঘাতক, কী শয়তান! কোথায় সে

কার্লোর চেহারা ক্ষিপ্ত ব্যাঘ্রের মতো।

আচ্ছা, টেলরের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয় কীভাবে? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

কার্লো কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর বললেন–প্রথম পরিচয় এক উপজাতি গ্রামে। তারপর অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে হাসপাতালে থাকার সময় ও আমায় দেখতে আসে। সেবাযত্ন করে। হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর টেলরই আমাকে এই নির্জনে ল্যাবরেটরি বানিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেয়। দুর্ঘটনায় আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেছিল। লোকে হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে থাকত। ফলে লোকজনের ভিড় আমার কাছে তখন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তার প্রস্তাব তাই সানন্দে গ্রহণ করি। ও আমাকে নিজের পয়সা খরচ করে ল্যাবরেটরি বানিয়ে দিয়েছিল। দরকারমতো নানা জায়গায় সঙ্গে করে নিয়ে যেত।

টেলর আফ্রিকায় কী করছিল? বিল জিজ্ঞেস করল। ঠিক জানি না। বলেছিল, ও একজন প্রাণিবিজ্ঞানী। বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়ের তালিকা তৈরি করছে। খুব ভদ্র ছিল। কৃতজ্ঞতাবশে ভেবেছিলাম আমার আবিষ্কারে ওর নামটাও জুড়ে দেব। ভাবতে পারিনি আমায় ঠকাবে। আমার এতদিনের সাধনা চুরি করবে! ওঃ!

মনকে শক্ত করুন ডক্টর কার্লো। আপনার কাগজপত্র আশা করছি উদ্ধার করতে পারব। মনে হয় ও অপেক্ষায় ছিল আপনার গবেষণা শেষ হলে, আপনাকে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে সমস্ত গবেষণা নিজের নামে প্রকাশ করে বিখ্যাত হবে। কেউ টের পেত

তার জোচ্চুরি। দৈবাৎ আমি আপনাকে চিনে ফেলাতে তার প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হল। তখন আমাদের খতম করার পরিকল্পনা করল।

সে কি! হ্যাঁ, আপনারই তৈরি কৃত্রিম ফেরোমন-এর সাহায্যে! আচ্ছা ডক্টর কার্লো, কয়েকদিন আগে টেলর একটা ছোট পাহাড়ের কাছে তাঁবু ফেলেছিল। সেখানে কি আপনিও ছিলেন? আপনার জুতোর ছাপ যেন আমি লক্ষ করেছি। বিল কার্লোর জুতোর দিকে চেয়ে বললেন।

হ্যাঁ, ছিলাম। আমি আগে চলে আসি। টেলর পরে এল। ওখানে কী করছিলেন? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন। আমি ওই পাহাড়ের গুহায় কিছু আদিম মানবের পাথরের অস্ত্র-শস্ত্র দেখতে পাই। টেলরকেও দেখিয়েছিলাম। জিনিসগুলো পরীক্ষা করছিলাম হঠাৎ টেলর বলল, বৃষ্টি নামবে। আপনি এখুনি ফিরে যান, আমি কয়েকদিন পরে যাচ্ছি।

হুম্। ঠিক আছে। আপনি বিশ্রাম করুন, উত্তেজিত হবেন না। আমরা চললাম।

আমার পেপার্স? কার্লো আর্তনাদ করে উঠলেন।

দেখি, কী করতে পারি।

বাইরে এসে মামাবাবু বললেন, টেলরের ওপর আমার প্রথম সন্দেহ জাগে কখন, জানো? আন্তোনিওর কথা শুনে।

কী কথা?

সেই যে আন্তোনিও বলল, লিবিয়ায় এক মরূদ্যানে সে কার্লোকে দেখেছিল। একা। অথচ টেলরের প্রবন্ধে ছিল সে ঠিক ওই সময়ে এবং ওই জায়গায় পঙ্গপাল নিয়ে রিসার্চ করে। ফলে আমার ধোঁকা লাগল–কে গবেষণা করছিল? টেলর না কার্লো? টেলর কি তবে কার্লোর কাজ চুরি করেছেন? আমার অনুমান দেখলাম সঠিক।

বন্দী গোলোর ঘরের শিকল খুলে মামাবাব ভিতরে ঢুকলেন। গোরো মাটিতে বলে চিল। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। মামাবাব ধমক দিয়ে বললেন, “আমাদের পোটারদের দেবতার গল্প বলে ভয় দেখাতে কে তোমায় নির্দেশ দিয়েছিল? সত্যি কথা বলবে, নইলে–

টেলর সাহেব, বানা।

মামাবাবু আর কথা না বলে শিকল তুলে দিয়ে বেরিয়ে এলেন।টেলর কেন এখানে আমাদের কাজ বন্ধ করতে চেয়েছিল বুঝতে পারছ?

হ্যাঁ, পাছে আমরা ওই গুহার সন্ধান পাই।

অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। মামাবাবু মন্তব্য করলেন।

.

১০.

মামাবাবু টেলরকে প্রশ্ন করলেন, কার্লোর পেপার্স কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?

আমি লুকোইনি। টেলরের মিষ্ট ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়েছে। চোখে ক্রুর হিংস্র দৃষ্টি।

ও, ভালো কথায় কাজ হবে না। বেশ আপনার দাওয়াই আপনারই ওপর প্রয়োগ করব। দেখি, কথা বেরোয় কিনা? সুনন্দ অসিত, টেলরকে ওই গাছটার সঙ্গে বাঁধে।

ফেরোমন-এর শিশিতে সামান্য তলানি পড়েছিল। মামাবাবু তাতে খানিক জল মেশালেন। তারপর আমাদের তাঁবুর কাছে গেলেন।

তখন তাঁবুতে খোলা খাবার একটুকরোও অবশিষ্ট ছিল না। বিল একটা হরিণ মেরে। গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। শুধু কঙ্কালটা দুলছে। তাঁবুর কাপড়টা অবধি কেটে কুটিকুটি করেছে ক্ষুধার্ত পিপীলিকারা।

মামাবাবু সাবধানে তাঁবুর কাছে গিয়ে পিপীলিকা ব্যুহের গা থেকে ফেরোমন ঢালতে ঢালতে পিছিয়ে এলেন। থামলেন টেলরের সামনে। তারপর সরে আমাদের কাছে এসে বললেন, দেখা যাক।

গভীর আগ্রহে লক্ষ করি। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম কয়েকটা পিঁপড়ে ফেরোমন-এর গল্প শুঁকে শুঁকে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। দেখতে দেখতে চারদিক থেকে দলে দলে পিঁপড়ে ছুটে এসে তাদের অনুসরণ করতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে এক বিশাল বাহিনী ফেরোমনের গন্ধ বেয়ে সড়সড় করে এগিয়ে চলল। আন্তোনিও চট করে তার ক্যামেরা বাগিয়ে ধরল।

মামাবাবু বেশ দার্শনিকভাবে বলতে লাগলেন–বুঝলে অসিত, আর্মি-অ্যান্টরা হল যাযাবর। দল বেঁধে কেবল ঘোরে। দিনের বেলায় গাছ বা পাথরের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। রাতে পথ চলে। এদের আর এক নাম ড্রাইভার অ্যান্ট।

আঁ-আঁ! চমকে উঠে দেখি টেলর প্রাণপণে বাঁধন ছেড়বার চেষ্টা করছেন। তার বিস্ফারিত দৃষ্টি আগুয়ান পিঁপড়ে বাহিনীর ওপর নিবদ্ধ।

মামাবাবু বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে বললেন, আমি-অ্যান্ট-এর এই প্রজাতির নাম ডরিলাস। এদের সাউথ আমেরিকান জাতিভাইদের নাম হল অ্যাকিটন। এদের সম্বন্ধে অনেক গল্প আছে।

আমায় ছেড়ে দাও! আমি বলছি। টেলর আর্তনাদ করে ওঠে। পিঁপড়ের স্রোত তখন মাত্র হাত কুড়ি দূরে।

কোথায়?

গুদোম ঘরে, মাটির নিচে সিন্দুকে।

উত্তম। সুনন্দ, ওকে খুলে সরিয়ে আনো।

সুনন্দ বলল, মিস্টার আন্তোনিও, তুমি কখনও আর্মি-অ্যান্ট-এর ভোজের ছবি তুলেছ? দারুণ সাবজেক্ট। টেলর যদি অনুগ্রহ করেন–

খুলে দাও! টেলর উন্মাদের মতো চেঁচালো। পিঁপড়ে বাহিনী তখন দশ হাত তফাতে। সুনন্দ দ্রুত তার বাঁধন খুলে সরিয়ে আনল।

মামাবাবু বাকি ফেরোমনটুকু গাছের চারপাশে গোল করে ছড়িয়ে দিলেন। টেলরকে বললেন, আশা করি সত্যি কথা বলছেন। মিথ্যে হলে কিন্তু এবার নির্ঘাৎ আপনাকে পিঁপড়ের ভোজে লাগাব।

একটা মজার ব্যাপার দেখলাম। সারিবদ্ধ পিঁপড়েরা এসে গাছের গুঁড়ির চারধারে ক্রমাগত গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। চক্কর খেয়েই চলেছে! কখন থামবে কে জানে!

গুদোমঘরের আবর্জনা সরিয়ে, মেঝের তক্তা উঠিয়ে সিন্দুক আবিষ্কার করতে দেরি হল । মস্ত সিন্দুক। অনেক খোপ। একটা খোপ খুলে মামাবাবু বললেন, এই যে পেয়েছি। তিনি ফাইলটা বাইরে-দাঁড়ানো কার্লোর হাতে দিলেন। ভিতরের কাগজপত্রে চোখ বুলিয়েই কার্লো, পেয়েছি, পেয়েছি বলে মামাবাবুকে আনন্দে জাপটে ধরলেন।

আমি দেখলাম, বিল সিন্দুকের অন্য খোপগুলো ঘাঁটছেন। কয়েকটা বড় বড় মোড়ক খুলে মন দিয়ে দেখলেন। ঘরের তাক ও কোণগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। একটু পরে আমরা বেরিয়ে এলাম।

টেলরকে ল্যাবরেটরিতে একটা চেয়ারে বসিয়ে আমরা ঘিরে বসলাম। টেলরের মুখ ভাবলেশহীন। যেন বেকায়দা অবস্থাটা সে খানিক সামলে নিয়েছে। বলল, “আপনাদের কার্যসিদ্ধি হয়েছে। এবার আমায় ছেড়ে দিতে পারেন। মনে রাখবেন, আমার বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগগুলো একটাও কোর্টে টিকবে না। বরং উল্টে আমি আপনাদের বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা আনতে পারি।

উঃ, সাংঘাতিক লোক! কী নার্ভ! একটু হকচকিয়ে গেলাম।

বিলের গম্ভীর গলা শুনলাম–মিস্টার টেলর, আইন-কানুন সম্বন্ধে আপনার বেশ জ্ঞান আছে দেখছি। কিন্তু চোরা কোকেন-কারবারিকেও কি আইন ছেড়ে দেবে? কী বলেন?

টেলরের মুখ দেখলাম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

মোহোরাতে আমার এক পুলিশ ইন্সপেক্টর বন্ধু বলেছিল, টাঙ্গানিকায় চোরা কোকেন। চালান খুব বেড়ে গেছে। দলটাকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। এদের ব্রেন একজন শ্বেতাঙ্গ। দলের খুব কম লোক তাকে চেনে। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক টেলর বোধহয় সেই লোক। কি, ঠিক বলছি?

টেলর রেগে বললেন, আমায় মিথ্যে মামলায় জড়াবার চেষ্টা করছেন।

বেশ বেশ, পুলিশ আসুক। গুদোম-ঘর সার্চ করুক। তারপর আমার কথার সত্যি-মিথ্যে তারা বিচার করবে। টেলর গোঁজ মেরে বসে রইল।

টেলরকে একটা খালি ঘরে বন্দী করে বাইরে থেকে তালা দেওয়া হল।

মামাবাবু কার্লোকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখন কী করবেন?

ভাবছি ফিরে যাব। আপনারা কবে ফিরছেন?

আপনি সঙ্গে গেলে এখুনি ফিরতে পারি।

বেশ তাই যাব। আমার কাজ প্রায় শেষ। বাকিটুকু না হয় নাইরোবিতে বসে করব। সেখানে মার্টিন নামে এক ছোকরা প্রাণিবিজ্ঞানী আছে। বহুবার সে আমার অধীনে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নেব। আচ্ছা ঘোষ, এই ল্যাবরেটরির কী হবে?

কেন, যা-যা দরকারি জিনিস আছে সঙ্গে নিয়ে চলুন।

কিন্তু এসব তো টেলরের সম্পত্তি।

তাতে কী হয়েছে? টেলর আপনাকে ঠকাতে চেয়েছিল। তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বৈকি! মামাবাবু নির্বিকারভাবে মন্তব্য করলেন।

পরদিন সকালে টেলরের ঘর খুলে দেখা গেল, পাখি পালিয়েছে। ঘর ফাঁকা। আবিষ্কার হল, ঘর থেকে পাঁচিলের বাইরে অবধি এক গোপন সুড়ঙ্গপথ। বিল আপশোস করলেন, ঘরটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত ছিল।

সুনন্দর মন খারাপ হয়ে গেল। ইস, লোকটাকে শাস্তি দেওয়া গেল না। এত বড় জোচ্চোর! তার ওপর আমাদের মারার চেষ্টা করেছিল।

বিল সুনন্দর পিঠ চাপড়ে বললেন, ব্রাদার, শাস্তি ও পাবে। আর কোনো দিন টেলর সভ্যজগতে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। জেলের ভয়ে পালিয়ে বেড়াবে। হয়তো ধরাও পড়বে। এও কি কম শাস্তি?

ঠিক হল, এখান থেকে আমরা যাব সেই খাদের কাছে। যে কদিন হাতে সময় অন্য ফসিলের অনুসন্ধান করব। বিল পোটার জোগাড় করে ফেললেন। গোসাপ দেবতার বাপারটা ছিল টেলরের কারসাজি। স্থানীয় লোকদের সে ভয় দেখিয়ে রেখেছিল, যাতে তারা খাদে খোঁড়াখুঁড়ি করতে রাজি না হয়। টেলর পালিয়ে যেতে তাদের ভয় ভেঙে গেল।

মামাবাবুর সঙ্গে কার্লোও মহা উৎসাহে ফসিলের সন্ধানে লেগে গেলেন। কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য ফসিল উদ্ধার হল কিন্তু দুঃখের বিষয়, মামাবাবু যে ফসিলটি খুঁজতে এসেছিলেন তা পাওয়া গেল না।

ছ-দিন পর আমরা ডার-এস-সালাম ফিরে যাবার জন্য তাঁবু ওঠালাম।

ফসিল পেলেন না বলে মামাবাবুর দেখলাম মোটেই দুঃখ নেই। আমি সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম। হেসে বললেন, আরে, এসব আবিষ্কার কি সহজে হয়! লাক চাই। কেউ সারা জীবন খুঁজেও পায় না, আবার কেউ দুদিনেই আবিষ্কার করে ফেলে। তবে হার মানছি না, পরের বছর আবার আসব। আর, শূন্য হাতে ফিরছি কে বলল? এত বড় একটা আবিষ্কার করে ফেললাম যে!

কী আবিষ্কার? আমার ধাঁধা লাগে।

কেন, ব্রুস টেলরের প্রকৃত পরিচয় আবিষ্কার করলাম। এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ফাস করে দিলাম। আর ফাউ হিসাবে কেমন এক অ্যাডভেঞ্চার জুটে গেল বরাতে।

তা বটে! সুনন্দ সায় দিল, আফ্রিকায় আমাদের দ্বিতীয় অ্যাডভেঞ্চারটা ভালোই হল! আমি বললাম, যদিও কিঞ্চিৎ বিপজ্জনক!

আন্তোনিও আমাদের অনেক দূর অবধি পৌঁছে দিল। তারপর একজন পোর্টার সঙ্গে নিয়ে বিদায় নিল। তাকে যেন একটু মনমরা দেখাচ্ছিল। যাবার আগে বিনা অনুরোধে আমাদের সবাইকার ফোটো তুলে সে একগাদা ফিল্ম নষ্ট করে ফেলল!

 

মিস্টার বাসুর ফরমুলা

মুখবন্ধ

অজেয় রায় হলেন প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক কিশোর উপন্যাসের জগতে একজন বিশিষ্ট লেখক। এঁর গল্পে সরস বাষায় প্রকৃত বৈজ্ঞানিক তথ্য পিরবেশন করা হয়। এগুলি পাঠ্যপুস্তকের চাইতে বেশি মূল্যবান, কারণ ছেলেমানুষরা আনন্দ এবং আগ্রহের সঙ্গে পড়ে। এঁর প্রচ্ছন্ন রসিকতাগুলিও পরম উপভোগ্য। আজগুবি গল্প লেখা বরং সহজ, কিন্তু তথ্যসমৃদ্ধ আনন্দের উপাদানের অনেক বেশি দাম।

এই বইটিকে আমি স্বাগত জানাই এবং আশা করি তরুণ পাঠকরাও পড়ে এক অন্য জগতের আস্বাদ পাবে। ইতি—

আঃ লীলা মজুমদার
১৫ জুন ১৯৮৮

.

০১.

সুনন্দ ও অসিত মনমরা। কারণ তাদের মামাবাবু অর্থাৎ প্রাণিবিজ্ঞানী প্রফেসর নবগোপাল ঘোষকে পাখিতে পেয়েছে।

পাখি নিঃসন্দেহে জীবজগতের এক অভিনব সৃষ্টি। সুনন্দ বা অসিতের পাখি সম্বন্ধে জানবার আগ্রহ নেই এমন নয়। বিচিত্র তাদের পালকের রঙ, আচার-আচরণ, আকৃতি। কোনো কোনো পাখির ডাক কী মধর! সৃষ্টির আদিমকালে কী আশ্চর্য কৌশলে সরীসৃপ থেকে বিবর্তনের ফলে এই খেচর গোষ্ঠীর উদ্ভব। শুধু ভারতবর্ষে আছে পঁচাত্তরটি পক্ষিপরিবার। তাদের প্রায় বারোশো গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়। এবং তাদের মধ্যে তিনশো রকম পাখি যাযাবর–বিদেশ থেকে উড়ে আসে এখানে শীত কাটাতে। এসব তত্ত্ব বিলক্ষণ আকর্ষণীয়। সুনন্দর কাছে না হলেও অসিতের কাছে খবরগুলো নতুন বটে। তাই প্রথমটা সে আগ্রহ নিয়ে শুনত। তবে কোনো বিষয়ে বাড়াবাড়ি কি ঠিক! কিন্তু মামাবাবুর ক্ষেত্রে। তাই যে ঘটছে!

মামাবাবুর স্বভাবের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তিনি অত্যন্ত বেঁকাল। যখন যা ধরেন, একেবারে চূড়ান্ত করে ছাড়েন।

পাখি সম্বন্ধে মামাবাবুর জ্ঞান যথেষ্টই ছিল। তবে এখন একেবারে কুঁদ হয়ে গেছেন। দিনরাত ওই নিয়ে পড়াশুনা করছেন, ভাবছেন ও আলোচনা করছেন। খাবার সময়ে পাখির কথা, বেড়াতে বেরোলে পাখির চিন্তা। চোখ দুটো তখন পায়ের কাছের জমি ছেড়ে সদাই আকাশে বাতাসে টেলিগ্রাফের তারে, জানলার কার্নিশে বা গাছের ডালে পাখি খুঁজে বেড়ায়। অন্য কোনো বিষয়ে কথাবার্তা বলা তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন।

মামাবাবুর ইদানীং কিছু নতুন বন্ধু জুটেছিল। সব পক্ষিপ্রেমিক। এদের হাবভাবই আলাদা। যখন তখন এদের আগমন। সবচেয়ে বেশি আসতেন বঙ্কিম হাজরা। অবশ্য তারা সুনন্দ অসিতের ধাত বুঝে ফেলেছিল। বুঝতে পেরেছিল এই দুইজনের পক্ষিপ্রীতি মোটেই গভীর নয়। তাই সুনন্দদের সামনে পড়লে সামান্য ভদ্রতা করা ছাড়া আলাপের আগ্রহ দেখাত না। তাদের আলোচনার বৈঠক বসত। কখনো সবাই বেরোতেন ফিল্ড স্টাডি করতে। অর্থাৎ মাঠেঘাটে দূরবিন দিয়ে নানান পাখির স্বভাব চরিত্র লক্ষ করা। এদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য পক্ষিবিদ হিসেবে বেশ নামী। তবে বঙ্কিমরাবু এ লাইনে নেহাত আনকোরা। সুনন্দ তার নাম দিয়েছিল ভক্ত বঙ্কিম। ভদ্রলোককে নিয়ে তারা হাসাহাসি করত।

মামাবাবু মাইশোর গিয়েছিলেন পক্ষিবিদদের এক সম্মেলনে মাস তিনেক আগে। সেখান থেকে মাদ্রাজে বেদনথঙ্গল পক্ষিনিবাস দেখতে যান। পথে বঙ্কিমবাবর সঙ্গে আলাপ হয়। কৌতূহলী বঙ্কিমবাবু দুটো দিন মামাবাবুর সঙ্গে পাখি দেখে কাটান। ক্রমে ক্রমে সমস্ত ব্যাপারটায় ভদ্রলোকের এমন দারুণ আগ্রহ জন্মায় যে কলকাতায় ফেরার পরেও তিনি মাঝে মাঝে প্রফেসর ঘোষের কাছে এসে পাখি সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করে চলেছেন।

বঙ্কিমবাবুর সর্বক্ষণই একটু ব্যস্তসমস্ত ভাব। যদিও ব্যস্ত হবার কারণ তার নেই। সুনন্দরা শুনেছে ভদ্রলোকের পয়সা এবং অবসর দুই-ই অঢেল। চাকরি বা ব্যবসা করেন না। বাড়ির ভাড়া, শেয়ার ইত্যাদি প্রচুর পৈতৃক সম্পত্তির আয়ে ভর করে দিব্যি কাটাচ্ছেন। স্ত্রী-পুত্রের ঝামেলাও নেই, কারণ তিনি অবিবাহিত। তবে ভারি অমায়িক লোক।

চেহারা সাধারণ। মুখ-চোখে খুত না থাকলেও বৈশিষ্ট্য নেই। অবশ্য রঙ ফর্সা। মাঝারি লম্বা। মাঝারি স্বাস্থ্য। মাথাভর্তি কাঁচা-পাকা চুল এলোমেলো হয়ে থাকে। কিন্তু ভদ্রলোক পোশাকের ব্যাপারে বেশ শৌখিন। চওড়া পাড়ের তঁতের ধুতি, পাঞ্জাবি, কাঁধে পাট করা চাদর, পায়ে পাম্প শু দিয়ে সর্বদা ফিটফাট থাকেন। ধূমপান করেন দামী ব্রান্ডের সিগারেট। দাড়ি-গোঁফ কামানো। পরিষ্কার মুখখানি হাসি-হাসি, তবে কিঞ্চিৎ বোকা-বোকা। লোকটির কথাবার্তাতেও মোটেই বুদ্ধির ছাপ নেই। যদিও মামাবাবুর কাছে হাজির হলেই তাঁর হাতে থাকে এক ভলম সেলিম আলির লেখা বার্ডস অফ ইন্ডিয়া এবং অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে তিনি অন্যদের, বিশেষত মামাবাবুর কথা শোনেন ও বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়েন।

তবে ভদ্রলোকের এক মহৎ গুণ আছে অস্বীকার করা যায় না। মামাবাবুর কাছে এলে প্রায়ই এক বাক্স উত্তম কড়া পাকের সন্দেশ উপহার দিয়ে যান। এ নাকি গুরুদক্ষিণা। বলা বাহুল্য, সন্দেশের ভাগ সুনন্দ অসিতেরও জোটে।

যাহোক মামাবাবুর এই নতুন নেশায় সুনন্দ অসিতের অবস্থা কাহিল হয়ে উঠেছে। আরও রাগের কারণ, মামাবাবু প্ল্যান করেছিলেন ভুটান বর্ডারে যাবেন অতি দুর্লভ গোল্ডেন লেসুর অর্থাৎ সোনালি হনুমান স্বচক্ষে দর্শনের চেষ্টায়। আপাতত সেকথা মনে করিয়ে দিলেও কানে তুলছেন না। বলছেন–হবে হবে। তাড়াহুড়োর কী?

ক্ষুব্ধ সুনন্দ রাগে ফুঁসছিল। শেষে একদিন অসিতের বাড়ি এসে বলল, চ আমরা দুজনে কোথাও ঘুরে আসি। পাখি-পাখি শুনে বাড়িতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। আর তিষ্ঠনো যায় না।

হয়তো সত্যি তারা দুজনে কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত, যদি না সেদিন হঠাৎ কুণালের আবির্ভাব হত।

.

অসিতের বাড়ির বৈঠকখানায় একটি মুখ উঁকি মারল।

অসিত দেখল প্রথমে। ডাকল–আরে কুণাল যে! আয় আয় ভিতরে। অনেক দিন। পরে।

কুণাল মিত্র ছিল সুনন্দ ও অসিতের কলেজের সহপাঠী। চার বছর তারা একসঙ্গে পড়েছে। খুব ভাব ছিল তাদের। গ্র্যাজুয়েশনের পর তাদের ছাড়াছাড়ি হয়। কুণাল পড়তে যায় রসায়ন বিদ্যা। পাস করে সে বছর চারেক এক কারখানায় কেমিস্ট হিসেবে চাকরি করে, তারপর কাজ ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করে। নানারকম জিনিস তৈরি করতে থাকে। প্রথম দিকে সাবান, কলমের কালি, মাজন ইত্যাদি তৈরির পর এখন গোটা দুই ওষুধও বানাচ্ছে। শুধু অন্যের আবিষ্কৃত ফরমুলায় তৈরি জিনিস নয়, নিজেও সে গোটা কয়েক ছোটখাটো ওষুধ উদ্ভাবন করেছে। কুণালের সঙ্গে সুনন্দদের আজকাল দেখা হয় কম। তবে পুরনো টানটা বজায় আছে।

কুণাল ঘরে ঢুকল। ওর চেহারায় বেশ চেকনাই এসেছে। পরনে দামী জামা-প্যান্ট। অর্থাৎ দু-পয়সা কামাচ্ছে আজকাল। সুনন্দরা খুশি হল। বেচারা অনেক কষ্ট করেছে গোড়ায়।

অসিত বলল, চা খাবি তো? আর সঙ্গে সেইরকম আলুর চপ চলবে নাকি? না, ওসব ছেড়ে দিয়েছিস?

খুব চলবে। চেয়ারে বসতে বসতে বলল কুণাল–তরে বুঝলি কিনা ওসব বস্তু একা খেয়ে সুখ নেই। সঙ্গে জুতসই আড্ডার পাট তো ভাই উঠে গেছে। কতবার ভাবি আসব তোদের কাছে, মোটে সময় পাই না।

ভালো ভালো, সুনন্দ হাসল, মানে তোর ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। তোর মিত্র কেমিক্যালস-এর উইপোকা তাড়াবার ওষুধটা তো খুব নাম করেছে। বিজ্ঞাপন দেখলাম কাগজে।

হ্যাঁ, ওটা বেশ চলছে।

চা এবং গরম আলুর চপ এল।

সুনন্দ লক্ষ করল, কুণাল মাঝে মাঝে কেমন আনমনা হয়ে পড়ছে। ও যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু বলে উঠতে পারছে না। একসময় সুনন্দ বলে ফেলল, হারে কুণাল, স্রেফ আচ্ছা দিতে এসেছিস, না কোনো কাজ-টাজ আছে?

কুণাল একটু আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ, মানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। ভাবছিলাম তোদের পরামর্শ নিই।

কথাটা বলে কুণাল একটুক্ষণ চুপ করে রইল। বোধহয় মনে মনে গুছিয়ে নিল ঘটনাগুলো। তারপর বলতে শুরু করল–

মাসখানেক আগে আমি একটা চিঠি পাই। ইংরেজিতে লেখা। জনৈক মিস্টার বাসু লিখেছেন। বক্তব্য–তিনি ধানের রাক্ষুসে পোকা মারার একটি রাসায়নিক ওষুধ আবিষ্কার। করেছেন। উপযুক্ত দাম পেলে ওষুধের ফরমুলাটি তিনি বিক্রি করতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে আমি আগ্রহী হলে যেন তাকে জানাই।

চিঠি পেয়ে ধাঁধায় পড়লাম। বাজে ফরমুলা বিক্রি করে ঠকানোর চেষ্টা এ লাইনে নতুন নয়। প্রথমে ভেবেছিলাম দরকার নেই উৎসাহ দেখিয়ে। কিন্তু ধানের রাক্ষুসে পোকার উল্লেখে আমি মত বদলালাম। এগুলি একজাতীয় খুব ক্ষুদ্র কীট। চাষীরা নাম দিয়েছে রাক্ষুসে পোকা। ধানের শিষ একটু পুষ্ট হলেই এই পোকা তার শাঁস খেয়ে নেয়। ফলে শস্যদানা ছিবড়ে হয়ে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এই পোকার উৎপাত ভারতে আগেও কয়েকবার দেখা গেছে, একরকম কীটনাশক ব্যবহার করে তাকে দমন করাও সম্ভব। হয়েছে–কিন্তু এবার পুরনো ওষুধে কোনো কাজ দিচ্ছে না। রাক্ষুসে পোকা ভীষণ তাড়াতাড়ি বংশ বৃদ্ধি করে। ফলে হু-হুঁ করে ছড়িয়ে পড়ছে। পশ্চিম বাংলায়–চব্বিশ পরগনা-হুঁগলিতে ছড়িয়েছে। আবার শুনছি দক্ষিণ অরতেও কয়েক জায়গায় উপদ্রব শুরু হয়েছে। কোনো রকমে তাকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। উজাড় হয়ে যাচ্ছে ধান। এমন চললে নির্ঘাত দুর্ভিক্ষ লাগবে।

“এত খবর তুই পেলি কোথায়? কাগজে তো কিছু বেরোয়নি। জিজ্ঞেস করল সুনন্দ।

কাগজে কি আর সব খবর দেয়। এখন রোগটার সবে শুরু। আমি এসব খবর রাখি কারণ এখন আমি ফসলের ক্ষতিকারক রোগের ওষুধ তৈরির চেষ্টা করছি। এদেশে কোন ফসলের কী কী শত্রু, কী তাদের প্রতিকারের ওষুধ–এসব খবর রাখতে হচ্ছে তাই। মাস ছয় হল মিত্র কেমিক্যালস টমাটো গাছের শত্রু শুয়োলোকা মারার একটা নতুন কীটনাশক ছেড়েছে বাজারে। একজন কৃষি-বিজ্ঞানীর আবিষ্কার। আমার কারখানার ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ করেছেন। সুতরাং ভেবে দেখলাম মিস্টার বাসুর অফার একবার যাচাই করে দেখি। যদি সত্যি ওষুধটা কাজের হয় এবং বাসুর চাহিদা আমার সাধ্যে কুলোয়, তাহলে আমার বরাত ফিরে যাবে। অতএব আমার আগ্রহ জানিয়ে উত্তর দিলাম।

চারদিন পরে রেজিস্ট্রি পার্শেলে এক প্যাকেট পাউডার এল। নমুনা পাউডার জলে গুলে কীভাবে ক্ষেতে ছিটোতে হবে তার নির্দেশও রয়েছে ইংরেজি টাইপে। মিঃ বাসু লিখেছেন–ওষুধের ফলাফল পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে যেন আমি চিঠিতে জানাই। তারপর সাক্ষাতে ব্যবসায়িক কথাবার্তা হবে।

এক্সপেরিমেন্ট করে আশ্চর্য ফল পেলাম। তক্ষুনি জানালাম বাসুকে, আমি ফরমুলা কিনতে চাই।

মিস্টার বাসুর নির্দেশমতো চৌরঙ্গির কুতুব হোটেলে সতেরো নম্বর ঘরে দুপুর দুটোর সময় তার সঙ্গে দেখা করলাম। প্রথম দর্শনে বেশ হকচকিয়ে গেলাম। আশা করেছিলাম এক খোলামেলা বৈজ্ঞানিককে দেখব, কিন্তু তার বদলে দেখলাম রীতিমতো রাসরি সাহেবি কেতার এক মানুষ। গায়ের রং যদিও শ্যামবর্ণ কিন্তু পরনে নিখুঁত স্যুট টাই। কুচকুচে কার্লো চুল টেনে ব্যাকব্রাস করে আঁচড়ানো, মোটা গোঁফ, মুখে পাইপ, চোখে চওড়া ফ্রেমের চশমা। চশমার কাঁচের রং ঈষৎ নীল। উপরের পাটির সামনের দুটি দাঁত একটু বড় ও উঁচু। অল্প কুঁজো হয়ে সামনে ঝুঁকে হাঁটেন, কথা বললেন বেশির ভাগ ইংরেজিতে গম্ভীর গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে। হালকা গল্পের ধারকাছ দিয়েও গেলেন না। সোজা কাজের কথায় এলেন। একগোছা টাইপ করা কাগজ এগিয়ে দিলেন–সলিউশন বানানোর পদ্ধতি। ফরমুলার জন্য দর হাঁকলেন বিশ হাজার টাকা। টাকাটা একসঙ্গে দিতে হবে।

আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম ফরমুলার ওষুধের স্বত্ব বিক্রি করতে চাইছেন কেন? রয়ালটি রাখলে যারা এই ফরমুলায় ওষুধ বানাবে তাদের কাছ থেকে এই ওষুধ। বিক্রির আয়ের একটা ভাগ বরাবর পেয়ে যাবেন আপনি। মনে হয় তাতে মোট আরও বেশি অর্থ পেতে পারবেন ভবিষ্যতে।

উনি বললেন, আমার এখনই অনেক টাকার দরকার বছর বছর একটু একটু করে পেলে চলবে না। যদি এ ব্যবস্থায় আপনার আপত্তি থাকে তাহলে আর কথা বলে লাভ নেই।

আমি বললাম, আমার আর কী আপত্তি। এরপর আমি কাগজপত্রগুলো একটু দেখতে চাইলাম। ভদ্রলোক আমাকে ঘরে রেখে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন ঘণ্টাখানেক বাদে। লেখার একটা অংশ ঠিক বুঝতে পারছিলাম না–তাই জিজ্ঞেস করলাম।

বাসু ভুরু কুঁচকে পড়লেন জায়গাটা। তারপর বললেন, জায়গাটা উনি আরও পরিষ্কার করে লিখে পাঠাবেন পরে।

এরপর আরও কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। কিন্তু তখন একটাও প্রশ্নের জবাব দিলেন না। প্রশ্নের জায়গাগুলো দাগ দিয়ে নিলেন। বললেন, কয়েকদিন পরেই আমি উত্তর পাব। তারপর কাগজ-পত্ৰ গুটিয়ে সেদিন বিদায় নিলেন।

তিন দিন পরে আবার সেই কাগজ-পত্রগুলো এল আমার কাছে ডাক মারফত। প্রশ্নের জায়গাগুলো টুকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পাউডারটা হাতে-কলমে বানাতে আমার কোনো অসুবিধাই হয়নি। এবার হবে ফাইনাল কথাবার্তা।

ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। তবু তেমন রহস্যের ইশারা পাচ্ছিল না সুনন্দ বা অসিত। সুনন্দ বলল, অর্থাৎ সলিউশনের ফরমুলাটা তুই কিনছিস?

পাগল। অত টাকা আমি পাব কোথায়?

তবে আর কথা বলার দরকার কী? চিঠিতে তোর মত জানিয়ে দিলেই তো চুকে যায়।

কুণাল বলল, “আসলে আমি বাসুর সঙ্গে যোগাযোগটা নষ্ট করতে চাইছি না। তাই ঝুলিয়ে রেখেছি।

কেন?

মানে আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।

কী?

কীটনাশক ওষুধটার প্রকৃত আবিষ্কারক হয়তো মিস্টার বাসু নন; অন্য কেউ।

“কী করে বুঝলি? প্রশ্ন করে অসিত।

পাউডারটা বানাবার পদ্ধতি সম্পর্কে প্রথম দুটো প্রশ্ন আমি সত্যি ভালো বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু উনি একটারও জবাব দিলেন না। মানে, মনে হল যেন উনি ধোঁকায় পড়েছেন। কেমন খটকা লাগল আমার। তখন পরের প্রশ্নগুলো করলাম নেহাত সোজা সোজা।

এক্সপেরিমেন্টের বিভিন্ন স্টেজে কেমন রেজাল্ট পাওয়া গেছে? গ্রীষ্মে এবং শীতের ধানে কি একই ডোজ ওষুধ ব্যবহার করতে হবে? ধানের ক্ষতিকারক আর কী কী পোকার উৎপাতে এই ওষুধ কাজে দেবে ইত্যাদি। সেগুলোরও জবাব পেলাম না। যে লোক ওষুধের আবিষ্কারক তার পক্ষে ওসব প্রশ্নের তক্ষুনি উত্তর না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া এত দামী ওষুধের সর্বস্বত্ব অবধি বিক্রি করে দিতে চায় এ খুব অস্বাভাবিক। আর বৈজ্ঞানিক হিসাবে মিস্টার বাসুর নামও কখনো শুনিনি আগে।

অর্থাৎ বলতে চাস, বাসু কারো ফরমুলা চুরি করেছে? বলল সুনন্দ।

হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে আসল আবিষ্কারকর্তাটি কোনো বিশেষ কারণে আড়ালে থাকতে চায়। বাসু তার হয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছেন। মোট কথা আমি ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে চাই। কিন্তু কীভাবে এগোব বুঝতে পারছি না।

সুনন্দ অসিত এতক্ষণে বুঝল কুণালের আগমনের উদ্দেশ্য। তারা পরস্পরে চোখাচোখি করল। মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠল। অনেকদিন নিষ্কর্মা থেকে রোমাঞ্চকর কিছু একটা করার ইচ্ছেয় ছটফট করছিল দুজনে।

তোর সঙ্গে মিস্টার বাসুর আবার কবে দেখা হচ্ছে? জানতে চাইল অসিত।

আসছে কাল। বিকাল চারটে। স্থান হোটেল কুতুব। সতেরো নম্বর ঘর। মিস্টার বাসু চিঠিতে জানিয়েছেন।

ঘরের মধ্যে মিনিট তিনেক নিস্তব্ধতা। সবাই ভাবছে। অসিত একবার উঠে বাড়ির ভিতরে গিয়ে এক রাউন্ড চায়ের বন্দোবস্ত করে এল।

বাসু কি ওই হোটেলে থাকেন? সুনন্দ মুখ খুলল।

না। বলল কুণাল, আমি খোঁজ নিয়েছিলাম। উনি হঠাৎ হঠাৎ এসে ওঠেন এবং একদিনের বেশি থাকেন না কখনো।

ওকে চিঠিপত্র লিখতিস কোন ঠিকানায়?

ওই হোটেল কুতুব। কেয়ার অফ ম্যানেজার। মাঝে মাঝে উনি নিজে বা ওঁর লোক এসে ডাক নিয়ে যায়।

হুম! সুনন্দ মাথার চুল টানছে। অর্থাৎ ভাবছে। তারপর দৃঢ়স্বরে বলল, কাল আমরা ওকে ফলো করব। আমি আর অসিত। উনি হোটেল থেকে বেরোলেই। নিশ্চয় উনি বাড়ি ফিরবেন। একবার ওঁর আস্তানার খোঁজ পেলে তারপর ওর পরিচয় বা গতিবিধি জানা অসুবিধে হবে না। তখন জানা যাবে ওই ফরমুলার আসল আবিষ্কারকটি কে?

.

বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা।

হোটেল কুতুবের গেট থেকে শ-খানেক হাত দূরে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটা ছাইরঙা অ্যামবাসাডর, তার মধ্যে বসে আছে তিনজন–সুনন্দ, অসিত এবং তাদের বন্ধু মিন্টু।

গাড়িখানা মিন্টুর। মিস্টার বাসুকে ফলো করার জন্য গাড়িটা চাওয়া হয়েছিল মিন্টুর কাছে। বলা হয়েছিল কেবল গাহিটা পেলেই চলবে। সুনন্দ নিজেই ড্রাইভ করবে। বাসু যে ধরনের লোক, মনে হচ্ছে ট্রামে-বাসে ঘুরবেন না, ট্যাক্সি বা নিজের গাড়িতে যাওয়া-আসা করবেন। মিন্টু কিন্তু কেসটা শুনেই লাফিয়ে উঠল। সে বেজায় অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় ডানপিটে। বলল সে স্বয়ং হবে গাড়ির চালক। তার খুব ইচ্ছে ছিল একজোড়া নকল দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে আসে, কিন্তু সুনন্দ বারণ করল। হঠাৎ খুলে-টুলে গেলে বিশ্রী কাণ্ড হবে।

তিনজোড়া চোখ আটকে আছে হোটেল কুতুবের গেটে।

অধীর উত্তেজনায় ঘন ঘন সিগারেট টানছে মিন্টু। গেট দিয়ে কাউকে বেরোতে দেখলেই চট করে আঁকড়ে ধরছে স্টিয়ারিং হুইল। চারটে বাজতে ঠিক পাঁচ মিনিট আগে হোটেলে ঢুকেছে কুণাল। বেরিয়েছে চারটে পঞ্চাশে। গেটের বাইরে এসে একবার আড়চোখে দেখে নিয়েছে সুনন্দদের। তারপর হনহন করে চলে গেছে উল্টো পথে।

ভাগ্য ভালো তাই বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ছটা নাগাদ কুতুবের গেট দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল যে ব্যক্তি তাকে কুণালের বর্ণনা অনুযায়ী মিস্টার বাসু বলে চিনতে ভুল হল না। বাসুর হাতে একটা পেট-মোটা ফোলিও ব্যাগ। তিনি এদিক-ওদিক চেয়ে একটা ট্যাক্সি ডাকলেন এবং তাতে চড়ে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে মিন্টুর গাড়ি স্টার্ট দিল।

মিস্টার বাসুর ট্যাক্সি চলল চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউ ধরে। প্রায় পঞ্চাশ হাত পিছনে থেকে মিন্টুর গাড়ি তাকে অনুসরণ করল।

সামনের ট্যাক্সি সোজা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে পড়ল। তারপর টালা ব্রিজ পার। হয়ে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরল। অতএব বাসুর গন্তব্যস্থল কলকাতা শহরের বাইরে কোনো শহরতলি অঞ্চলে।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। দিন ছোট তাই তখনই সন্ধ্যা নেমে গেছে। মিন্টুর সুবিধেই হল। অন্ধকারের জন্য সামনের আরোহী টের পাবে না যে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। ট্যাক্সির পিছনের কাঁচের ভিতর দিয়ে মিস্টার বাসুর টুপি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চল হয়ে বসে আছেন তিনি। আরও দু-খানা একই রকম ট্যাক্সি বালুর ট্যাক্সির আগু-পিছু যাচ্ছিল। ফলে বাসুর ট্যাক্সি কোনটা খেয়াল রাখা শক্ত হচ্ছিল। সিথির মোড়ে ট্র্যাফিক কনস্টেবল হাত দেখাল গাড়ি থামাতে, একটা ট্যাক্সি বেরিয়ে যেতে পারল। মিন্টু গাড়ি থামাতে থামাতে হঠাৎ আবার এক্সিলারেটার চেপে গতি বাড়িয়ে পেরিয়ে গেল মোড়। এবং তড়িৎবেগে যে ট্যাক্সিটা এগিয়ে গিয়েছিল তার পিছু ধরল। সামনের গাড়ির নম্বর দেখে সুনন্দ বুঝল ওটা। মিস্টার বাসুর ট্যাক্সি। অদ্ভুত নজর মিন্টুর, ঠিক লক্ষ করেছে।

অসিত বলল, ট্রাফিক পুলিশটা কিন্তু আমাদের গাড়ির নম্বর টুকে নিল। ফাইন করবে।

করুক গে। মিন্টু নির্বিকার।

আরও প্রায় পনেরো মিনিট হু-হুঁ করে ছুটল গাড়ি সিধে রাস্তা বেয়ে।

একটা বড় চৌমাথা। চারপাশে দোকান। অনেক লোকের ভিড়। রাস্তার পাশে একটা সিনেমা হল। জায়গাটা ছাড়িয়েই মিস্টার বাসুর ট্যাক্সি থেমে গেল।

মিন্টুর গাড়ি তাকে পাশ কাটিয়ে খানিক এগিয়ে থামল পথের ধারে। গাড়িতে বসে তারা দেখল মিস্টার বাসু নামলেন–ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিলেন–এবং বাঁ পাশে একটা সরু পথ ধরে হেঁটে অদৃশ্য হলেন।

মিন্টু তার গাড়ি ঘুরিয়ে সেই রাস্তার কাছে গেল।

পাকা রাস্তার খানিকটা অংশ খোঁড়া। মেরামতি হচ্ছে। এই কারণেই বাসুর ট্যাক্সি ঢোকেনি। তারাও নেমে পড়ল।

অসিত বলল, কোথায় এসেছে বুঝছিস? এটা পানিহাটি। এ রাস্তাটা সোজা গেছে গঙ্গার ধার অবধি।

কী করে জানলি? সুনন্দ জিজ্ঞেস করল।

এ জায়গা আমি চিনি। একটু দূরেই যে আমার সেজমাসির বাড়ি। এর পরের বাস। স্টপেজে নামতে হয়। কতবার এসেছি।

তিনজনে পথটা ধরে এগোল। গাড়ি রইল বড় রাস্তায়।

পথ প্রায় অন্ধকার। অনেক দূরে দূরে এক-একটা ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে বটে, কিন্তু কুয়াশা ভেদ করে আলোর জ্যোতি খুব আবছা। শীতের রাতে দুধারের বাড়িতে জানলা-দরজা বন্ধ। নিস্তব্ধ লোকালয়। দু-একজন মাত্র পথিক আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে হনহন করে চলে গেল। তিনজনে দ্রুত পা চালাল–যতটা সম্ভব নিঃশব্দে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে চলল পথের ধারের বাড়িগুলো–সামনে কেউ যাচ্ছে কিনা।

অল্প এগিয়েই চোখে পড়ল মিস্টার বাসুর চলমান মূর্তি। তার জুতোর শব্দ উঠছে—খট্‌ খট্ খট্‌।

মিন্টু অসিত, সুনন্দ গা-ঢাকা দিয়ে এগোল।

রাস্তাটা অবশ্য সিধে নয়। অনেক এঁকেবেঁকে গেছে। হঠাৎ থামলেন বাসু। তরুনি সুনন্দরা গাছের ছায়ায় মিলিয়ে গেল। পুরনো লোহার গেট খোলার কর্কশ আওয়াজ। বাস ঢুকলেন একটা বাড়িতে।

তিনজনে গুটি গুটি এগোল।

যে বাড়িতে মিঃ বাসু ঢুকেছেন সেটা পাঁচিল ঘেরা একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেকখানি বাগান। বাড়ির যতটুকু অংশ চোখে পড়ছে, কোনো আলোর চিহ্ন নেই। কোনো লোকজনেরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তিনজনে গেটের সামনে থেকে সরে এল।

কী করা যায়?

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করা যাক।

বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল তিনজনে। কনকনে বাতাস বইছে। হাত-মুখ যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়? তাছাড়া বে-পাড়া। দৃশ্যটা কেউ দেখে ফেললে ফল মোটেই ভালো হবে না। অসিত বলল, বাড়িটা তো চিনে গেলাম, এখন চল আমার মাসির বাড়িতে রাত কাটাই। সকালে এসে খোঁজ-খবর করা যাবে।

প্রস্তাবটা মনঃপূত হল সবার। কিন্তু মিন্টু থাকতে পারবে না। তার কাজ আছে খুব সকালে। অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ মনে সে বিদায় নিল। কারণ তার ধারণা কাল একটা জোর অ্যাডভেঞ্চার জুটে যাবে সুনন্দের বরাতে। সে প্রস্তাব দিয়েছিল–চল ঢুকি পাঁচিল টপকে। বাড়িটা সার্চ করি। হয়তো সেই বৈজ্ঞানিককে বন্দী করে রেখেছে।

কিন্তু তার বন্ধুরা এমন বেআইনি কারবারে রাজি হল না। সত্যি যে কাউকে এখানে আটক করে রাখা হয়েছে তার প্রমাণ কই? হয়তো বাসু স্বয়ং সেই বৈজ্ঞানিক। অথবা বৈজ্ঞানিকের বন্ধু। অতএব সেক্ষেত্রে বিনা অনুমতিতে পরের বাড়িতে প্রবেশের অপরাধে নির্ঘাত হাজতবাস ভোগ করতে হবে। আপাতত মিস্টার বাসুকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। কাল বরং এসে খোঁজ করা যাবে।

পরদিন বেশ সকাল-সকাল সুনন্দ অসিত এসে মিস্টার বাসুর বাড়ির সামনে হাজির হল। কীভাবে বাসুর সঙ্গে আলাপ জমানো যায়, কোন্ ছুতোয় বাড়ি ঢুকবে ইত্যাদি যুক্তি করছে তারা, এমন সময় একজনকে বাগানের রাস্তা ধরে গেটের দিকে আসতে দেখে তারা ভীষণ অবাক হয়ে গেল। আগন্তুক–শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র হাজরা ওরফে ভক্ত বঙ্কিম।

বঙ্কিমবাবুও সুনন্দদের দেখতে পেয়েছিলেন। হাতজোড় করে বললেন–আরে কী ব্যাপার, আপনারা এখানে?

সুনন্দরা হকচকিয়ে গেল। কোনো রকমে সামলে নিয়ে অসিত বলল, “আমরা বেড়াতে এসেছি। এই কাছেই আমার মাসির বাড়ি। আপনি এখানে থাকেন নাকি?

পার্মানেন্টলি নয়। মাঝে মাঝে। বাড়িটা ভাড়া নিয়ে রেখেছি। গঙ্গার ধারে, দিব্যি খোলামেলা। কয়েকদিন কাটিয়ে যাই। আসুন ভিতরে।

অসিত একটু ইতস্তত করে বলল, আমরা ভেবেছিলাম বাড়িটা অন্য এক ভদ্রলোকের।

কেন? বঙ্কিমবাবু রীতিমতো অবাক।

মানে কাল সন্ধেবেলা ফিরছিলাম এই পথে। দূর থেকে দেখলাম কোট-প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক ঢুকলেন এই বাড়িতে, তাই।

ওঃ, বুঝেছি। মিস্টার বাসুকে দেখেছিলেন।বঙ্কিমবাবু হাসলেন। এ কিন্তু অন্যায়। যে কাউকে আমার এ বাড়িতে ঢুকতে দেখলে তাকে মালিক বলে ধরে নেবেন।

অসিত লজ্জিত হয়।–না মানে শীতের সন্ধে। এমন অসময়। বন্ধু-বান্ধবের কথা মনে হয়নি। ভাবলাম আপিস ফেরতা কেউ। এদিককার লোকদের তো চিনি না ভালো।

বঙ্কিমবাবু বললেন, মিস্টার বাসু আমার ঠিক বন্ধু নন, সামান্য পরিচিত বলতে পারেন।

ও তাহলে নিশ্চয় জরুরি কাজ ছিল। তাই অমন সময়ে। খুব পাক্কা সাহেব।

হুঁ, তা বটে। ভদ্রলোক আমায় বড় জ্বালাচ্ছেন।

কেন?

আমাকে বিজনেস পার্টনার করতে চান। তাই নিয়ে ঝোলাঝুলি। যত বলছি ওসব হাঙ্গামা আমার পোষাবে না। কালকেও অনেকক্ষণ বকবক করে গেলেন।

ভদ্রলোক থাকেন কোথায়?

কলকাতায়।

কীসের ব্যবসা? সুনন্দ জানতে চায়।

দু-তিন রকম প্ল্যান আছে ভদ্রলোকের। আপাতত গেঞ্জির কল করতে চান। কিন্তু ধরনটা ঠিক বুঝছি না।

ওনার ঠিকানাটা দিতে পারেন? বলল সুনন্দ।

কেন? হাজরাবাবু ভুরু কুঁচকোলেন।

মানে আমার এক বন্ধুর খুব ব্যবসার ঝোঁক। ছোটখাটো কিছু ফঁদতে চায়। পার্টনার খুঁজছে। মিস্টার বাসুর খবরটা ওকে দেওয়া যেতে পারে, সুনন্দ উৎসাহিত হয়ে বলল।

বঙ্কিমবাবু মাথা নাড়লেন। সরি। ওঁর ঠিকানা তো জানি না। শ্যামবাজারে কোথাও। দিয়েছিলেন অ্যাড্রেস, হারিয়ে ফেলেছি।

আবার যদি আসেন অ্যাড্রেসটা নিয়ে রাখবেন দয়া করে।

বেশ নেব। তবে আর আসবে বলে মনে হয় না। সাফ না করে দিয়েছি এবার। আপনার বন্ধুর নাম-ঠিকানা?

সুনন্দ তৎক্ষণাৎ যে নাম-ঠিকানাটা জানাল তা কুণালের নয়–অশোক নামে তাদের এক বন্ধুর। অশোক ইঞ্জিনিয়ার। সম্প্রতি বাড়ি বানাবার কনট্রাকটারি করছে।

বঙ্কিমবাবু বললেন, চলুন একটু চা-টা খাবেন। আমার অবশ্য এখানে লোকজন নেই। একটি বুড়ো মালি ভরসা।

ভিতরে যেতে যেতে সুনন্দ লক্ষ করল বাগানে যত্নের বড় অভাব। ভালো ভালো ফল-ফুলের গাছের পাশে আগাছা জন্মেছে।

বাড়ির কোলেই গঙ্গা। চওড়া বাঁধানো ঘাট নেমেছে ধাপে ধাপে।

নিচের তলায় একটা মস্ত হলঘরে সুনন্দরা বসল। ঘরে পুরনো আমলের কিছু টেবিল চেয়ার।

চা আর অমলেট খাওয়ালেন বঙ্কিমবাবু।

সুনন্দ অসিত একটু লজ্জিত হল ভদ্রলোককে বিব্রত করার জন্য। উনি কিন্তু ভারি খুশি। প্রফেসর ঘোষের ভাগনে, অতএব তারা খাতিরের লোক। খানিক পরে শুরু করলেন পাখির কথা।-উঃ ব্যাপারটা কিন্তু সাংঘাতিক ইন্টারেস্টিং, মশাই। নতুন একখানা বই কিনেছি পাখি সম্বন্ধে–দাঁড়ান দেখাচ্ছি–

অমনি অসিত তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। হেঁ হেঁ, আজ থাক। একটু কাজ আছে। আর একদিন আসব।

বঙ্কিমবাবু নিরাশভাবে বললেন, কিন্তু আমি যে আজই চলে যাচ্ছি দুপুরে।

কোথায়?

কলকাতা হয়ে রাজগীর, বুদ্ধগয়া, পাটনা, বেনারস লম্বা ট্যুর। বায়নাকুলার সঙ্গে নেব–বার্ড ওয়াচিং করা যাবে সুযোগমতো।

আপনি খুব বেড়ান?

হ্যাঁ, ওই আমার নেশা। বেশিদিন একজায়গায় টিকতে পারি না। দূরে যেতে না পারলে, অন্তত ধারেকাছেই ঘুরে আসি।

বিকেলে সুনন্দ অসিত ফিরল কলকাতায়।

বাসে যেতে যেতে অসিত বলল, “দেখ সুনন্দ, আমার মনে হচ্ছে বঙ্কিমবাবু মিস্টার বাসু সম্বন্ধে সত্যি কথা বলেননি।

কেন?

যথেষ্ট পরিচয় আছে অথচ তার ঠিকানাটা অবধি রাখেননি। এ ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

চেপে যাওয়ার কারণ?

তুই ফট্‌ করে বাসুর ঠিকানা চাইতে বোধহয় ঘাবড়ে গেলেন।

কেন?

বাইরে স্বীকার না করলেও হয়তো ওঁর মনে মনে বাসুর সঙ্গে ব্যবসা করার ইচ্ছে আছে। শুনেছি উনি ব্যবসাদার বাড়ির ছেলে। বাবার লোহা-লক্কড়ের দোকান ছিল। আপাতত বাজিয়ে দেখছেন বাসুকে। চট করে কথা দিচ্ছেন না। এদিকে তুই বাসুর জন্যে নতুন পার্টনার জোগাড় করতে চাস শুনে ঠিকানাটা চেপে গেলেন।

তা হতে পারে–বলল সুনন্দ। আবার আর একটা কারণও থাকতে পারে। ওষুধের ফরমুলা চুরির ব্যাপারে ওনার সঙ্গে বাসুর যোগাযোগ আছে। তাই–

ধুৎ! বঙ্কিমবাবু সে-টাইপের নয়। কাছাখোলা লোক। তাছাড়া, তাহলে তো উনি নিজেই পেটেন্ট নিয়ে বিজনেস ফঁদতে পারতেন। অন্যকে ফরমুলা বিক্রি করতে যাবেন কোন দুঃখে। ওর কি টাকার অভাব?

তা বটে! সুনন্দ সায় দিল।

কুণাল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল সুনন্দদের অভিযানের ফলাফল জানার আশায়। খবর শুনে সে মুষড়ে পড়ল। বলল, আমি মিস্টার বাসুর সঙ্গে ফরমুলার জন্য দরাদরি করেছিলাম। যদি তের-চোদ্দ হাজারে নামত, নিয়ে নিতাম। কে আসল বৈজ্ঞানিক তা নিয়ে আর মাথা ঘামাতাম না। এক পয়সাও কমাতে রাজি হল না। যাকগে, তক্কে তক্কে থাকি যদি ফের খোঁজ পাই বাসুর। বলেছি ওনাকে ভবিষ্যতে আবার এমনি কোনো ফরমুলা বিক্রি করতে চাইলে দয়া করে আমায় একটা চান্স দেবেন। হ্যাঁ, একবার কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার ল্যাবরেটরিটা কোথায়? অমনি বাসু কঠোর স্বরে উত্তর দিলেন–তা জেনে আপনার দরকার নেই। আমি ঘাবড়ে গিয়ে আর ও-প্রসঙ্গ তুলিনি।

.

০২.

পুরো একটা বছর কেটে গেছে। মিস্টার বাসুর দেওয়া ফরমুলার প্রকৃত আবিষ্কারক কে এ-রহস্যের সমাধান আজও হয়নি। কিন্তু ফরমুলাটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল সে খবর জোগাড় করেছিল কুণাল।

মিস্টার বাসুর পেছনে ধাওয়া করে পানিহাটি যাওয়ার মাস দুই পরে একদিন সে অসিতকে ফোন করে প্রশ্ন করে–অসিত, মনে আছে মিস্টার বাসুর ফরমুলা?

হা হা, কী হল সেটার?।

সেটা কে কিনেছে জানিস? ভারত কেমিক্যালস লিমিটেড, পাক্কা কুড়ি হাজার টাকায়। বড় ফার্ম তো, তাই টাকার জোর বেশি। সেই ফরমুলায় তৈরি ওষুধই এখন এফ ফোরটিন নামে বাজারে বেরিয়েছে। দারুণ কাটতি হয়েছে। আচ্ছা, হাজরাবাবুর কাছে কোনো খোঁজ পেলি মিস্টার বাসুর?

বঙ্কিম হাজরা মামাবাবুর কাছে আসেন বটে কিন্তু সুনন্দ বা অসিতকে একটু এড়িয়ে চলেন।

তবু একদিন তিনি এলে সুনন্দ তাকে ধরেছিল। এই যে বঙ্কিমবাবু, কেমন আছেন?

বঙ্কিমবাবু বিগলিত হেসে বললেন, এই কাটছে কোনো রকমে ঠাকুরের কৃপায়। প্রোফেসর ঘোষ বাড়ি আছেন?

হা আছেন। ওপরে যান। আচ্ছা, সেই মিস্টার বাসু আর এসেছিলেন আপনার কাছে?

না। আর আসেনি। কেন বলুন তো?

মানে ওনার ঠিকানাটা, আমার সেই বন্ধুর জন্যে…

ওহো, মনে পড়েছে। দেখা হলে নিশ্চয় চাইব।

বঙ্কিমবাবু এ বিষয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। হয়তো আর দেখা হয়নি মিস্টার বাসুর সঙ্গে।

জানুয়ারির শেষে মামাবাবু রাজস্থান গেলেন। ভরতপুরে কেওলাদেওখানা নামে এক পক্ষিনিবাস দেখতে। বঙ্কিমবাবুও মামাবাবুর সঙ্গ নিলেন। রাজস্থান থেকে পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি বেড়িয়ে কুড়ি-পঁচিশ দিন পরে ফিরলেন দুজনে। বঙ্কিমবাবুর উৎসাহেই এই বাড়তি বেড়ানোটুকু। মামাবাবু ফিরতেই আবার পক্ষিবিদদের আনাগোনা শুরু হল। মামাবাররা কী কী পাখি দেখেছেন তাই নিয়ে মহা উৎসাহে আলোচনা চলল।

মামাবাবু পক্ষিবিদদের আলোচনাসভায় সুনন্দ অসিতকে ডাকতেন না। মানে যোগ দেবার জন্যে জোর করতেন না। তবে একদিন সুনন্দকে ডেকে বললেন, কাল সন্ধেবেলা থেকো বাড়িতে। বিখ্যাত এক্সপ্লোরার স্যার ডেভিড ডানকান আসছেন। ওনার ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা শোনা যাবে। উনি ভোরে হংকং থেকে কলকাতা আসবেন আর পরদিনই চলে যাবেন আফ্রিকা। অসিতকেও আসতে বোলো।

স্যার ডেভিডের নামে সুনন্দ নেচে উঠল। এই দুর্ধর্ষ পর্যটক কত দেশ যে ঘুরেছেন তার ইয়ত্তা নেই। দুর্গম পাহাড়, বন, মরু, প্রান্তর চষে বেড়ানোই ওঁর নেশা। পক্ষিবিদ হিসেবে বেশি নামডাক থাকলেও নানান দেশের জীবজন্তু ফলমূল সম্বন্ধে ওঁর জ্ঞান অসাধারণ। স্যার ডেভিড নিউজিল্যান্ডার। নাইজার নদীর অববাহিকায় অনেক অজ্ঞাত অঞ্চল আবিষ্কারের সম্মানস্বরূপ তিনি স্যার উপাধি পেয়েছেন। স্যার ডেভিড নাকি অদ্ভুত ভালো গল্প বলেন। তার গল্পের বর্ণনায় অজানা দেশের ছবি চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে। পাঁচ বছর আগে সুইডেনের স্টকহোমে প্রকৃতি-বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে ডানকানের সঙ্গে মামাবারক বন্ধুত্ব হয়। সেদিনই দুপুরে কুণালের টেলিফোন এল।

আজ বিকেলে অসিতের বাড়ি চলে আয়, আমিও আসব। দরকারি কথা আছে।

কী ব্যাপার? সেই বাসু নাকি?

হ্যাঁ। আয় বিকেলে, বলব সব।

বিকেল নয়। সন্ধে ছটা নাগাদ কর।

কেন?

বিকেলে স্যার ডেভিডের লেকচার আছে আমাদের বাড়িতে। বিখ্যাত এক্সপ্লোরার। অসিতও আসবে শুনতে, তারপর যাব।

অল রাইট।

সুনন্দ উগ্রীব হয়ে উঠল। কী ব্যাপার? মিস্টার বাসুর কি খোঁজ পেয়েছে কুণাল? ফরমুলার প্রকৃত আবিষ্কারককে জানার সূত্র কি পেল কিছু? ডেভিডের লেকচার না থাকলে সে এখুনি ছুটে যেত কুণালের কাছে।

স্যার ডেভিড হাজির হলেন বিকেল চারটেয়। লম্বা পাতলা গড়নের মানুষটি। বয়স প্রায় ষাট ছুঁয়েছে, কিন্তু ইস্পাতের মতো দৃঢ়। যুবকের মতো চটপটে। হালকা লালচে দাড়ি, কপালে গালে অজস্ৰ ভাঁজ-বহু কষ্টকর দিন যাপনের সাক্ষ্য। ভীষণ আমুদে। হেঁড়ে গলায় যখন তখন হো-হো হাসিতে ফেটে পড়েন। লোকটির একটি বদভ্যাস–উচ্ছ্বাসের মাত্রা প্রবল হলে ফুর্তির চোটে কাছের লোকের পিঠ চাপড়ে দেন সজোরে। একবার সেই কড়া পড়া কঠিন হাতের চাপড় খেয়ে সুনন্দর কঁধ ঝনঝন করে উঠল। সে সভয়ে সরে বসল।

স্যার ডেভিড কথা বলছিলেন ইংরেজিতে।

গত দু-বছর তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বোর্নিও, জাভা, সুমাত্রা প্রভৃতি অঞ্চলে অরণ্যময় দ্বীপগুলিতে ঘুরেছেন। সেইসব অভিযানের গল্প শুরু করলেন–

ঘরে বঙ্কিমবাবুর মতো কয়েকজন পক্ষিবিদ উপস্থিত ছিলেন। তারা জানতে চাইলেন– ওইসব দেশে নতুন কোনো পাখি দেখেছেন কিনা স্যার ডেভিড।

হুঁ দেখেছি বৈকি। তাদের বর্ণনা নোট করা আছে। তারপর ডেভিড হাসতে হাসতে বললেন, গত বছর বোর্নিওর এক দুর্গম অঞ্চলে মাইগ্রেটারি বার্ড পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে যা বিপদে পড়েছিলাম!

কীরকম শুনি? সবাই উৎসুক আবেদন জানাল।

স্যার ডেভিড পাইপে লম্বা টান দিয়ে বলতে শুরু করলেন।

–খবরটা আমায় দেয় চিয়াং। সিঙ্গাপুরে চিয়াংয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলাম একজন পক্ষিবিদ। বিশেষত যাযাবর পাখি নিয়েই তার স্টাডি। চিয়াং বলল, উত্তর বোর্নিওর সারওয়াক অঞ্চলে কাপুয়াস শৈলশ্রেণির কোলে বনের মধ্যে এক গ্রামে যাচ্ছে সে। ছোট্ট প্রসঙ্গ গ্রাম। কেলাবিট উপজাতির বাস। কাছাকাছি লোকালয় নেই। গ্রামে আধুনিক সভ্যতার কোনো স্পর্শই লাগেনি। আদিম প্রথায় চাষবাস আর শিকার করে জীবনধারণ করে। কেউ লেখাপড়া জানে না, গুনতে পারে না, মাস বা বছরের হিসেবও জানে না। আবার জায়গাটা বিষুবরেখার খুব কাছাকাছি বলে সারা বছর আবহাওয়া গরম থাকে এবং বৃষ্টিপাত হয়। ফলে বিভিন্ন ঋতুর পার্থক্য বোঝা যায় না।

কেলাবিটদের প্রধান খাদ্য চাল। বন কেটে, ঝোঁপ-ঝাড় আগুনে পুড়িয়ে তারা ধানচাষের জমি তৈরি করে। কিন্তু ধান যখন তখন পোঁতা চলবে না। বছরের শেষের দিকে, অন্তত ডিসেম্বরের আগে পুঁততেই হবে। এই চাষের সময় ঠিক করতে তাদের প্রধান ভরসা কিছু যাযাবর পাখি। ওরাই তাদের ক্যালেন্ডার।

সেনসুলিট অর্থাৎ হলদে খঞ্জনের আবির্ভাব দিয়ে কেলাবিটদের বছর শুরু হয়। এই পাখিরা উত্তর চীন এবং সাইবেরিয়া থেকে বোর্নিও ইন্দোনেশিয়ায় শীত কাটাতে আসে। গ্রামে কেলাবিটরা তখন চাষের জন্য জোগাড় আরম্ভ করে।

এরপর আসে ব্রাউন ইক। মধ্য এশিয়া থেকে। গ্রামের লোক তখন ধান পোঁতা শুরু করে।

তারপর এক জাতের ছোট বাজপাখি জাপানি স্প্যারো হকদের পালা। এবং আরও কিছুদিন পরে ডিসেম্বর জানুয়ারি নাগাদ ছাইরঙা থ্রাশদের আগমন হয়। ব্যস, গ্রামের লোক ইতিমধ্যে ধান পোঁতা শেষ করে ফেলে।

ক্রমে ধানগাছ বড় হয়। ফসল কেটে নেওয়া হলে কেলাবিটরা ফের সেনসুলিটদের অপেক্ষায় থাকে।

আমি চিয়াংয়ের কাছে জানতে চাইলাম, ডিসেম্বরের মধ্যে ধান পুঁততে ওরা ব্যস্ত হয়। কেন? বৃষ্টিপাতের যখন তেমন হেরফের নেই। একটু দেরি হলেই বা ক্ষতি কী?

চিয়াং বলল, তারও কারণ এক জাতের যাযাবর পাখি–লম্বা লেজ মুনিয়া। ঠিক মার্চ মাসের গোড়ায় ঝুঁকে ঝাঁকে মুনিয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষেতে। তার আগে ধান ঘরে তুলতে না পারলে একটি দানাও আর রক্ষা পাবে না।

চিয়াং বলল, আমি গত বছর গিয়েছিলাম ওই গ্রামে। খঞ্জনাদের আবির্ভাব দেখার পর চলে আসি। এবার অন্য পাখিগুলো দেখতে যাচ্ছি।

আমি তক্ষুনি চিয়াংয়ের সঙ্গে জুটে গেলাম।

দক্ষিণ চীন সমুদ্রতীরে কুচিং শহর থেকে রওনা হয়ে কিছুটা মোটরে চড়ে তারপর বাজার নদী বেয়ে শ-খানেক মাইল গেলাম সাম্পানে। এরপর নৌকো ছেড়ে পায়ে হেঁটে। তিনদিন হাঁটলাম গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। ঠাসা ট্রপিকাল অরণ্য। বিরাট বিরাট আকাশ-ছোঁয়া গাছ আর বাঁশঝাড়। দিনের বেলাও মাথার ওপর ঘন পাতার আচ্ছাদন ভেদ করে সামান্য আলো তোকে। প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা ও জলাভূমি। বিষাক্ত সরীসৃপ, পোকামাকড়, বনো শুয়োরের উৎপাত। আর এক ভয়, কখন হঠাৎ ওরাং ওটাংয়ের মুখোমুখি হব। উত্তর বোর্নিওর ঘন বনে এই বিশাল বানরদের বাস। এমনি লাজুক প্রকৃতির। কিন্তু বিরক্ত হলে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ক্রমে সেই গ্রামে পৌঁছলাম। বড় অধিত্যকায় মাত্র চল্লিশটি পরিবারের বাস। তিন-চারটে লম্বা লম্বা খড়ে ছাওয়া বাঁশের ঘরে তারা সবাই মিলে থাকে।

গ্রামের ধারে তাঁবু ফেললাম। চিয়াংয়ের সঙ্গে গ্রামের লোকের আগেই পরিচয় হয়েছিল। ফলে গ্রাম থেকে চাল, ডিম, তরকারি ইত্যাদি খাবার কিনতে অসুবিধা হল না। তবে একটা ভয় ছিল সাপ। সাংঘাতিক বিষাক্ত একজাতীয় ভাইপারের উপদ্রব। প্রতি বছর দু-একজন গ্রামের লোক মারা পড়ে সাপের কামড়ে।

দিন দশ দিব্যি কাটল।

ব্রাউন-শ্রাইকরা আসতে আরম্ভ করেছে। প্রথমে অল্প অল্প। তারপরে দলে দলে। চড়ুইয়ের চেয়ে সামান্য বড় পাখি। পেট সাদা, ডানার রং খয়েরি। ঝোপেঝাড়ে, জলের ধারে ধারে তারা পোকামাকড় খেয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকও ধান পুঁততে শুরু করেছে। হঠাৎ এক কাণ্ড!

ভোরে তাঁবুর বাইরে বসে কফি খাচ্ছি। চার-পাঁচজন কেলাবিট পুরুষ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। গ্রামের মোড়লও রয়েছে তাদের মধ্যে। লোকগুলোর হাব-ভাব মোটেই সুবিধের ঠেকল না। কয়েকজনের হাতে ছুরি ও বর্শা।

মোড়ল কড়া সুরে কী জানি বলল চিয়াংকে। চিয়াং কেলাবিট ভাষা জানত। দুজনে কথা শুরু হল। দুজনেই বেশ গরম হয়ে উঠল। অন্য লোকগুলোও কটমট করে চাইতে লাগল। আমি হতভম্ব। এ যাবত গ্রামবাসীদের তো বেশ ঠাণ্ডা বলে মনে হয়েছিল, কী আবার ঘটল?

চিয়াং একবার আমার দিকে ফিরে বলল,–এক ফ্যাসাদ বেধেছে। আমরা আসার পর গ্রামে এক রোগ দেখা দিয়েছে। দুজন লোক মরেছে। এরা আমাদের দায়ী করছে এই দুর্ঘটনার জন্য।

আমাদের কেন! আমি অবাক।

চিয়াং বলল, এদের দারুণ কুসংস্কার। ওদের ধারণা বিদেশিদের আগমনের ফলে গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চটে গেছেন, অভিশাপ দিয়েছেন, বিশেষত লাল দাড়িওয়ালা বিদেশির আগমন দেবীর কোপের কারণ। অর্থাৎ তুমি। আমি এত বোঝাচ্ছি, কান দিচ্ছেই না। বলছে, এখুনি আমাদের চলে যেতে হবে গ্রাম ছেড়ে।

চিয়াং বেজায় গোঁয়ার। এত কষ্ট করে এসে তাড়াতাড়ি ফিরতে কিছুতেই রাজি নয়। মোড়লের সঙ্গে অনেক তর্ক করল। বলল, চলো দেখি কোথায় তোমাদের রুগী। আমি ওষুধ দিয়ে সারিয়ে দেব।

গ্রামে গিয়ে একজন রুগী দেখলাম। লক্ষণ দেখে বিশেষ কিছু বুঝলাম না। মনে হল ঘোরালো ধরনের ফু। এ-জ্বর নাকি এখানে কখনো হয়নি আগে। আমাদের সঙ্গে কিছু জ্বর-জ্বালার ওষুধ ছিল। তাই একটা ঠুকে দিলাম আন্দাজে, কিন্তু ফল হল মারাত্মক।

দু-দিন পরে দুপুরে ক্যাম্পে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাৎ কুড়ি-পঁচিশ জন কেলাবিট এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ঘাড়ে। এবং তৎক্ষণাৎ আমাদের হাত-পা বেঁধে ফেলল।

শুনলাম আমাদের দাওয়াই খাটেনি। সেই রুগীটি পটল তুলেছে। সুতরাং গ্রামের লোক খাপ্পা। তারা আপাতত আমাদের বিচার করবে, ওই দেবীর সামনে শাস্তি দেবে। নইলে নাকি গোটা গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে দেবীর রোষে। আমাদের সঙ্গে বন্দুক ছিল। কিন্তু সেগুলো নাগালের বাইরে। অসহায় অবস্থায় মরতে হবে নাকি?

সেই দূর অরণ্যভূমিতে সভ্য জগতের আইন-কানন খাটে না। বিচারের নামে এরা আমাদের ওপর যে কী অত্যাচার চালাবে কে জানে! হয়তো হত্যাই করবে।

চিয়াং মোডলকে বোকাল, আমরা এখনি চলে যাচ্ছি। মোড়ল একটু নরম হল।ও ছোকরাগুলো রাজি হয় না। চিয়াংকে রেহাই দিলেও আমাকে তারা ছাড়বে না। শেষে চিত্রা এক প্যাঁচে ফেলল। মোড়লকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে ঘষের লোভ দেখাল। আমের লোক আমাদের মালপত্র বাজেয়াপ্ত করলে মোড়লের বিশেষ লাভ নেই। কারণ তা ভাগাভাগি হয়ে যাবে। কিন্তু ঘুষ সবটাই পাবে স্রেফ মোড়ল একা। ওতেই কাজ হল।

মোড়ল অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অন্যদের রাজি করল আমাদের ছেড়ে দিতে। মোড়লের পায়ে সর্বস্ব সমর্পণ করে প্রায় এক বস্ত্রে গ্রাম ছেড়ে পালালাম।

তারপর তিন-চার দিন কাটল অসহ্য কষ্টে। খাদ্য বলতে জংলি কলা বা আরস। তার ঝলসানো মাছ। খোলা আকাশের নিচে শয়ন। কেবল বৃষ্টিতে ভিজেছি।

হতভাগারা রাইফেল কেড়ে নিয়েছিল। দুটো ছোট ছুরি ছাড়া আত্মরক্ষার আর অন্য ব্যবস্থা ছিল না। ভাগ্যিস নদীতে দেশি মাঝিরা কথামতো তামাদের অপেক্ষায় ছিল, তাই রক্ষে। উঃ, খুব শিক্ষা হয়েছে সেনার বার্ড-ওয়াচিং করতে গিয়ে!

স্যার ডেভিড এক চোট অট্টহাসির সঙ্গে গল্প শেষ করলেন। শ্রোতারাও চমৎকৃত।

স্যার ডেভিড বললেন, সেই গ্রামে রহস্যময় জ্বরের কারণ কিন্তু আবিষ্কার করেছিলাম পরে। ব্যাপারটা অদ্ভুত।

কী? কী? সবাই জানতে চাইল।

কুচিংয়ে চেনা এক ডাক্তারের কাছে দিলাম ওই জ্বরের বর্ণনা। ডাক্তার অনেক ভেবে, বই-টই উলটিয়ে জানালেন, আশ্চর্য! এই রোগ তো মধ্য এশিয়ায় হয়। এদেশে শোনা যায়নি। কী করে ছড়াল ওই গ্রামে?

ঝট করে মনে পড়ে গেল একটা কথা। চিয়াং ফিরে আসার সময় একজোড়া খয়েরি শ্ৰাইক এনেছিল। গ্রামের কাছে ফাঁদ পেতে ধরেছিল পাখি দুটো। ইচ্ছে ছিল চিহ্ন দেওয়া। রিং পরিয়ে এই যাযাবর পাখিদের ছেড়ে দেবে। হঠাৎ পালাতে হল। তবু সে ছাড়েনি পাখি। বয়ে বয়ে এনেছিল পাখি দুটো।

ছুটে গেলাম চিয়াংয়ের হোটেলে। তার খুব জ্বর হয়েছে। তাই পাখিকে তখনও রিং পরানো হয়নি। খাঁচায় রয়েছে। পাখি দুটো নিয়ে গেলাম এক প্যাথলজিস্টের কাছে। লিটন পরীক্ষা করে বললেন, একটা পাখির ডানার পালকে ওই জ্বরের জীবাণু রয়েছে। অর্থাৎ মধ্য এশিয়া থেকে ওই পাখিগুলির কোনো কোনোটা বহন করে এনেছিল রোগের জীবাণ। চিয়াংয়ের জ্বরও সেই মধ্য-এশিয়ার মারাত্মক ব্যাধি। জ্বরের প্রকৃতি বুঝতে পেরে ঠিকমতো চিকিৎসা হতে সে সে-যাত্রা বেঁচে গেল।

গল্প শুনতে শুনতে হুঁশ ছিল না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর পড়তে সুনন্দ চমকে উঠল–সাড়ে ছটা। কুণাল এসে অপেক্ষা করবে অসিতের বাড়ি। অসিতেরও খেয়াল নেই, তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ে।

.

কুণাল অসিতের বাড়িতে অপেক্ষা করছিল।

কুণাল জানাল, শোন, মিস্টার বাসু টেলিফোন করেছিলেন আজ সকালে। তিনি নাকি গমের নেতানো রোগের একটা ওষুধ বের করেছেন। একটা সলিউশন। ফরমুলাটা বিক্রি করতে চান। পেটেন্ট-রাইট শুদ্ধ। আগের বারেই মতোই। তোরা বোধহয় জানিস না, গম গাছে একটা অদ্ভুত রোগ দেখা দিয়েছে আগের বছর থেকে। ব্যাকটিরিয়া অর্থাৎ জীবাণুঘটিত রোগ! এই রোগ পশ্চিম বাংলা এবং উত্তর ভারতের নানা জায়গায় খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে তাজা গম গাছ শিষ সমেত শুকিয়ে যায়। চাষীরা এর নাম দিয়েছে নেতানো রোগ। জানাশোনা কোনো জীবাণুনাশক ওষুধেও এ রোগ আটকানো যাচ্ছে না। আমি বলেছি ফরমুলা কিনতে চেষ্টা করব। কাল সকাল দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। হোটেল কুতুবে সতেরো নম্বর ঘর। এখন বল কী কর্তব্য?

সুনন্দ বলল, “কী আবার! বাসুকে ফের ফলো করতে হবে! ফরমুলা তুই কিনবি কিনা, সে তোের মাথাব্যথা। কিন্তু ওর আস্তানা জানতেই হবে। জানতে হবে ওর প্রকৃত পরিচয়। এমন সুযোগ ছাড়া যায় না।

কে ফলো করবে? আমরা? অসিত জিজ্ঞেস করল।

না। আগের ব্যাচের কেউ নয়। মিস্টার বাসু আগেরবার আমাদের খেয়াল করেছিলেন কিনা জানি না। তবু সাবধানের মার নেই। ফের সেই এক লোক পিছু ধরেছে দেখলে সতর্ক হয়ে যাবে। তাই এবার ওকে অনুসরণ করবে নতুন লোক–বাচ্চু।

মানে তোদের পাড়ায় শেষ লাল বাড়িটায় থাকে? কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের দোকান আছে?

হ্যাঁ। ও আগে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের কাজ করত। এসব কাজে খুব পোক্ত। পেশা পালটেছে কিন্তু ডিটেকটিভগিরির শখটা যায়নি। এককথায় রাজি হয়ে যাবে। বাসু প্রথমে হোটেল থেকে গিয়ে কোথায় ওঠে সেটা বের করুক। তারপর আমরা আছি।

পরদিন সকাল দশটা নাগাদ বাচ্চু সুনন্দর কাছে হাজির হয়ে রিপোর্ট দিল।

হোটেল থেকে বেরিয়ে মিস্টার বাসু ট্যাক্সি চেপে যান হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে লোকাল ট্রেন ধরে সপ্তগ্রাম। মেন লাইনে ব্যান্ডেলের পরেই ছোট এক স্টেশন। সপ্তগ্রামের কিছু দূর দিয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড গেছে। স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে বাস যান জি টি রোডের ধারে এক বাড়িতে। নিরালা জায়গায় মস্ত বাগানঘেরা ছোট দোতলা কোঠা বাড়ি। নাম–সুরভি নার্সারি। সারাদিন বাসুর আর দেখা পাওয়া যায়নি। বাড়িতে কে কে থাকে, স্থানীয় লোকজনের কাছে খোঁজ-খবর নিয়েছিল বাচ্চু। থাকেন তপন দত্ত বলে এক ভদ্রলোক। ইয়ংম্যান। তিন বছর হল বাড়িটায় নার্সারি করেছেন। নানারকম ফল, ফুল ও বীজ তৈরি করে কলকাতার বাজারে বিক্রি করেন। অতি অমিশুক। বাইরে বেরোন কদাচিৎ।

একাই থাকেন তপনবাবু। আর থাকে দুজন মালি এবং একটি বুড়ি-ঝি। সবাই বাইরের আমদানি। কেউ স্থানীয় লোক নয়। মিস্টার বার সঙ্গে ওখানকার কারো আলাপ হয়নি। তবে মুখ চেনে। আসা-যাওয়া করতে দেখেছে।

বাচ্চু বেশ রাত অবধি পাহারা দিয়েছিল বাড়িটা। অবশেষে শীতে কাবু হয়ে একটা জঘন্য নোংরা দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে কোনোরকমে রাত কাটায়। একজন ৬০কে লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখে স্থানীয় লোকদের একটু সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছিল বৈকি! তবে বাচ্চু বলেছে সে ইটের ব্যবসা করতে চায়, তাই জমি খুঁজছে। পরদিন সকালে সে খোঁজ করে শোনে যে বাসু খুব ভোরের ট্রেনে কলকাতার দিকে চলে গেছেন।

তপন দত্তকে দূর থেকে দেখছে বাচ্ছ। ময়লা রং। খুব রোগা ছোটখাটো চেহারা। নার্সারির এক বুড়ো মালির সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল বাচ্ছ। মালিটি জিনিস কিনতে এসেছিল। বাইরের দোকানে। মালি নিজের দেশ এবং স্ত্রী-পুত্রের সম্বন্ধে গাদাগুচ্ছের গল্প শোনালেও মিস্টার বাসু বা তপন দত্ত সম্পর্কে রহস্যজনকভাবে নীরব থেকেছে। ও-বিষয়ে কোনো আলোচনাই যেন করতে চায় না।

হ্যাঁ, একটা কথা মালি বেফাঁস বলে ফেলেছে, বাড়িতে ল্যাবরেটরি জাতীয় কিছু একটা আছে। ল্যাম্প জ্বেলে কীসব ওষুধ-টসুধ বানায় তপনবাবু।

কনগ্রাচুলেশনস, বাচ্চু! সুনন্দ অসিত চেঁচিয়ে উঠল। জব্বর খবর এনেছ ভাই। ওই তপন দত্তই নির্ঘাত আসল বৈজ্ঞানিক। পেট পুরে খাইয়ে দেওয়া হল বাচ্চুকে।

ঠিক হল আসছে কাল সুনন্দ ও অসিত সপ্তগ্রাম যাত্রা করবে তপন দত্তর উদ্দেশে। কুণালের ইচ্ছে ছিল সঙ্গে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে আটকে গেল ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে।

.

সুরভি নার্সারি।

সুনন্দ অসিত রিকশা থেকে নেমেই চট করে ঢুকল না ভিতরে। চারপাশে ঘুরে দেখতে লাগল। প্রধান দোতলা বাড়িটা ছাড়া বাগানের পিছনের অংশে আর একটা ইটের দেওয়াল ও টালির ছাদওলা বাড়ি নজরে পড়ল। এছাড়া রয়েছে আরো দুটো ছোট মাটির বাড়ি। একজন বুড়ো মতন লোক সামনে ফুলের বাগানে বসে কাজ করছে। দুজনে গেট খুলে গুটি গুটি ভেতরে ঢুকল।

তাদের দেখে মালিটি উঠে দাঁড়াল।

তপনবাবু আছেন? জিজ্ঞেস করল অসিত।

আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

কলকাতা থেকে। দরকার আছে। ফুলের বীজ কিনতে চাই।

ও দাঁড়ান। দিচ্ছি ডেকে। লোকটি বাড়ির দিকে চলে গেল।

লোকটি তাদের না ডাকলেও সুনন্দরা পায়ে পায়ে এগিয়ে একেবারে বাড়ির সামনে হাজির হল। সদর দরজা বন্ধ। মালি ঘুরে খিড়কি দিয়ে ঢুকেছে।

দরজা খোলার আওয়াজ। এবং তারপর যে যুবকটি তাদের মুখোমুখি দাঁড়াল, তাকে দেখে দুজনে থ। আগন্তুকও অবাক।

প্রায় পনেরো-ষোলো বছর বাদে দেখা হলেও তপনকে চিনতে ভুল হল না তাদের। স্কুলে এই তপন দত্ত ছিল সুনন্দ-অসিতের সহপাঠী। যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল তাদের।

খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিল তপন। ইংরেজি আর অঙ্কে খুব পাকা। কিন্তু বড় অভাবী। সব বই  কিনে পড়তে পারত না। স্কুল থেকে বেরোবার পর ছাড়াছাড়ি হয় তাদের। আর দেখা হয়নি!

“আরে তপন তুই? সুনন্দই প্রথমে সামলে উঠল।

অ্যাঁ, তোরা? তপন থতমত খেয়ে গেল।

তুই এই নার্সারি করেছিস?

হ্যাঁ ভাই। চাকরির বাজার তো জানিস। কিছু জোটাতে পারলাম না সুবিধে মতো। তাই–

কদ্দুর পড়েছিলি? শুনেছিলাম তুই আশুতোষে ভর্তি হয়েছিলি, আই. এস-সি. নিয়ে।

হ্যাঁ। তবে পড়া এগোল না বেশি। এই বি. এস-সি, অবধি টেনেটুনে। তাও ফি জোগাড় করতে পারলাম না, তাই পরীক্ষা দেওয়া হল না। হঠাৎ বাবা মারা গেলেন। এটা সেটা কয়েকটা চাকরি করলাম, টিকল না কোনোটাও। তারপর নার্সারি করেছি। তা মন্দ নয়, চলে যাচ্ছে একরকম। তপন জ্ঞান হাসল।

তুই এ বিদ্যে শিখলি কোত্থেকে?

শিখেছি। বলতে পারিস নিজের চেষ্টায়। আয় ভেতরে।

নিচের ঘরে বসল সবাই।

ঘরে কয়েকটি সস্তা কাঠের চেয়ার টেবিল বেঞ্চি। একগাদা কাঠের প্যাকিং বাক্স এককোনায় গা করা। দেওয়াল-তাকে সুরভি নার্সারির লেবেল মারা কিছু প্যাকেট। টেবিলে কাগজপত্র ফাইল সাজানো। মনে হল এটা অফিসঘর।

তোরা আমার ঠিকানা পেলি কী করে? তপন জানতে চাইল।

পাইনি তো, আবিষ্কার করলাম এই মাত্র। বলল সুনন্দ– এসেছিলাম এইদিকে। নার্সারি দেখে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হল। তাই বীজ কেনার নাম করে ঢুকলাম। তা আমরা কী জানি তোর নার্সারি! খাসা জায়গাটা কিন্তু।

চা-বিস্কুট খাওয়াল তপন।

সুনন্দরা লক্ষ করছিল, তপন কথা বলতে বলতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। পুরনো বন্ধুদের দেখে খুশি হয়েছে বোকা যায়, তবে নিজের সম্বন্ধে কিছু বলতে তার যেন উৎসাহ নেই। হয়তো নিজের দারিদ্র্য ও ভাগ্যহীনতা প্রকাশ করতে লজ্জা পাচ্ছে।

একফাঁকে অসিত বলল, “তপন তুই নাকি একটা ল্যাবরেটরি করেছিস?

কে বলল? তপন ভুরু কোঁচকালো।

মালি। সাফ মিথ্যে চালিয়ে দিল অসিত।

একটু হেসে তপন বলল, “হ্যাঁ আছে। বীজগুলো শোধন করে নিই। সংক্রামক রোগের হাত থেকে বাঁচাতে। সে অতি সামান্য আয়োজন। পুরোদস্তুর ল্যাবরেটরির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য নয়। আয় দেখবি।

অসিতদের পাশের ঘরে নিয়ে গেল তপন। দুটো টেবিলের ওপর একটা স্পিরিট ল্যাম্প ও একটা বার্নার। কিছু কাঁচের বাটি প্লেট টেস্ট টিউব। পাশে আলমারিতে কিছু শিশি–তাতে রাসায়নিক চূর্ণ ও তরল পদার্থ। দেখে বোঝা গেল তপনের কথা ঠিকই।

অনেকক্ষণ ধরে বলি-বলি করে যে প্রশ্নটা করতে চাইছিল দুজনে, সুনন্দ এবার সেই প্রসঙ্গ তুলল–

হ্যাঁরে, তোর কাছে মিস্টার বাসু নামে কেউ আসেন। গোঁফ আছে। সাহেবি পোশাক পরেন।

তপন কেমন চমকে উঠল।-কেন?

মানে একটু দরকার ছিল।

তপন জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইল। উত্তর দিল না।

সুনন্দ বলল, আসল ব্যাপারটা খুলে বলি। ওই ভদ্রলোক এক মেডিক্যাল ফার্মকে একটা ওষুধের ফরমুলা বিক্রি করেছেন আগের বছর। ধানগাছের শত্রু রাক্ষুসে পোকা দমন করার কীটনাশক। আশ্চর্য ফল দিয়েছে ওষুধটায়। আমাদের এক পরিচিত লোকের কেমিক্যালস ফ্যাক্টরি আছে। তিনি মিস্টার বাসুর সঙ্গে দেখা করতে খুব আগ্রহী। কারণ নানা শস্য রোগের কিছু ভালো প্রতিরোধক যদি বাসু আবিষ্কার করে থাকেন, মিস্টার পাকরাশি তা কিনতে চান। আসলে সেবার মিস্টার বাসু পাকড়াশিকেই প্রথমে অফারটা দিয়েছিলেন। কিন্তু অচেনা লোককে বিশ্বাস না হওয়ায় পাকড়াশি পিছিয়ে যান। তখন বাসু অন্য কোম্পানিকে ফরমুলাটা বিক্রি করে দেন। এখনও পাকড়াশি সেকথা ভেবে হা-হুঁতাশ। করেন। ইদানীং গমে নাকি একরকম নতুন রোগ ধরেছে। নেতানো রোগ। মিস্টার বাসু যদি এই রোগের কোনো প্রতিরোধক বের করতে পারেন–তাই মিস্টার পাকড়াশি তার খোঁজ করছেন।

কিন্তু মুশকিল হল মিস্টার বাসুর ঠিকানা কেউ জানে না। কীভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়? পাকড়াশি আমাকেও বলেছিলেন মিস্টার বাসুর কথা–যদি তার ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারি। অ্যাক্সিডেন্টলি গত পরশু হঠাৎ মিস্টার বাসুর দেখা পেয়ে গেলাম। বাসুকে আমি দেখেছি হোটেল কুতুবে। সেবার পাকড়াশি আমায় সঙ্গে করে নিয়ে বাসুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। অবশ্য তাদের কথাবার্তার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না।

যা হোক, গত পরশু এই পথ দিয়ে ব্যান্ডেলে যাচ্ছিলাম মোটরে। হঠাৎ দেখি মিস্টার বাসু সাইকেল রিকশা থেকে নেমে এই নার্সারিতে ঢুকলেন। তখন সময় ছিল না হাতে, অন্যের গাড়ি তাই। জায়গাটা চিনে রেখেছিলাম। তারপর আজ চলে এলাম।

তপন গম্ভীরভাবে শুনছিল। বাঁকা হেসে বলল-বুঝেছি, এই জন্যেই তোদের আগমন। কিন্তু ভাই আমিও মিস্টার বাসুর ঠিকানা জানি না।

বাসু এখানে আসেন?

আসেন মাঝে মাঝে। আসলে এই নার্সারির জমি আর বাড়ির মালিক হচ্ছেন মিস্টার বাসু। উনি কখনো কখনো এখানে আসেন। ভাড়া নিয়ে চলে যান। দু-একদিন বাসও করেন–ওই টালির ঘরটায়।

মনি অর্ডার বা চিঠি পাঠাসনি কখনো?

না, সে ব্যবস্থা নেই।

মিস্টার বাসু বোধহয় বায়োকেমিস্ট্রির লোক।

হুঁ, সায়েন্সের লোক।

আবিষ্কারটা ওর নিজের হলে বলতে হয়, আশ্চর্য প্রতিভা। অথচ অবাক ব্যাপার–সায়েন্টিস্ট মহলে কেউ ওঁর নাম জানে না। তোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলো করেননি কখনো?

না।

তপনের মুখ ক্ৰমে থমথমে হয়ে উঠছিল। হয়তো বাসু প্রসঙ্গ তার মনঃপূত হচ্ছিল না। অসিত তাই কথা ঘোরাল–বাদ দে তোর মিস্টার বাসু। চল তোর বাগান দেখি।

বাগানে ঘুরল তিনজনে।

পরিচ্ছন্ন নার্সারি। গাছপালার মধ্য দিয়ে সরু সরু কাকর বিছানো পথ। তপন বন্ধদের চিনিয়ে দিল নানা ফুলফলের গাছ। তবু আড্ডার সুর যেন আর তেমন জমল না। কেমন ভাসা-ভাসা দায়সারা ভদ্রতা দেখাচ্ছিল তপন। বোধহয় মিস্টার বাসুর প্রসঙ্গই তার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছিল। সত্যি বলতে কি, এতদিন পরে তপনের খোঁজ পেয়ে সুনন্দ অসিত খুব। খুশি হলেও মিস্টার বাসুর হদিশ ফের হারিয়ে যেতে তারা বেশ দমে গিয়েছিল।

একবার তপন জিজ্ঞাসা করল–আচ্ছা ধানের রাক্ষুসে পোকা আর গমের নেতানো রোগ সম্বন্ধে কী বলছিলি যেন? আমার অবশ্য লাইন আলাদা–এ ব্যাপারে বিশেষ ধারণা নেই।

কুণালের মুখে এ বিষয়ে যা যা শুনেছিল তাই বলল অসিত। তপন দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু সুনন্দরা রাজি হল না। সেখানে ঘণ্টা দুই কাটিয়ে ফিরল কলকাতা।

পথে অসিত বলল, “দেখ সুনন্দ, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তপন অনেক কথা চেপে গেল।

হুঁ, কিন্তু তাতে ওর স্বার্থ?

সেটাই তো ধরতে পারছি না। আচ্ছা তপন স্বয়ং সেই রহস্যময় বৈজ্ঞানিক নয়তো?

ধ্যেৎ! তপনের বিদ্যেতে এমন আবিষ্কার সম্ভব নয়।

কুণাল শুনে রেগে বলল–অদ্ভুত ব্যাপার! লোকটা বারবার যেন পিছলে যাচ্ছে। কেন বাস কাউকে তার ঠিকানা জানান না! এত লুকোচুরি কীসের?

সুনন্দ হেসে বলল, হয়তো তোদের মতো ফরমুলা-চোরদের হাত এড়াতে। বৈজ্ঞানিকের সাধনা গাপ মেরে দেবার মতো সৎ লোকের তো অভাব নেই দেশে। তাই তো এত সাবধানতা।

কিন্তু বৈজ্ঞানিকটি যে বাসু, এইখানেই আমার ঘোর সন্দেহ। কারণ ফরমুলা সংক্রান্ত কাগজ পরীক্ষা করে এবারও আমি একটা ফ্যাকড়া তুলেছিলাম। ওষুধটা সিসটেমিক অর্থাৎ প্রয়োগ করলে সলিউশনের রাসায়নিক বস্তু উদ্ভিদের শরীরে প্রবেশ করে। এবং তাকে আক্রমণকারী জীবাণুর পক্ষে বিষাক্ত করে তোলে। বললাম–সলিউশন ক্ষেতে স্প্রে করার পর তার প্রভাব দূর হতে কতদিন লাগবে সেটা তো লেখা নেই পরিষ্কারভাবে। পাকা গম কাটার অন্তত কতদিন আগে এ ওষুধ ব্যবহার করা উচিত? নইলে যে ফসল বিষাক্ত হয়ে থাকলে মানুষের ক্ষতি করবে।

বাস বললেন–সেসব ডিটেলস পরে দেব। সমস্ত নোট করা আছে। এখন ঠিক মনে পড়ছে না।

যে তোক হাতে-কলমে এই ওষুধ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছে তার পক্ষে এই তুচ্ছ প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য নোট কনসাল্ট করতে চাওয়া হাস্যকর। পরিষ্কার মনে থাকার কথা। তাই বাসু সম্বন্ধে আমার সন্দেহটা আরও বেড়েছে।

দিন চারেক পরে এক দুপুরে উদভ্রান্ত কুণাল অসিতের বাসায় এসে হাজির হল।

কী ব্যাপার?

কুণাল বলল, হরিধনকে পাওয়া যাচ্ছে না।

কে হরিধন?

মিত্র কেমিক্যালস-এর একজন সেলসম্যান। ঘুরে ঘুরে ওষুধ বিক্রি করে। খুব চালাক-চতুর ছেলে। ওকে গতকাল হোটেল কুতুবের সামনে পাহারায় বসিয়েছিলাম।

কেন?

দুদিন আগে কুতুবের ম্যানেজারের কাছে গিয়েছিলাম মিস্টার বাসুর খোঁজে। বললাম–ওঁর সঙ্গে আমার বিশেষ দরকার। প্রথমে স্রেফ এড়িয়ে গেল ম্যানেজার। শেষে অনেক পেড়াপীড়িতে মুখ খুলল। বাসুর সঙ্গে আমার দুবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে, তা তো সে দেখেছে। বলল, মিস্টার বাসু নাকি শিগগিরি আসতে পারেন হোটেলে। কয়েকখানা চিঠি এসেছে ওঁর নামে, সেগুলো নিয়ে যাবেন। বাসু ফোনে তাই জানিয়েছেন। ম্যানেজারকে অনুরোধ জানালাম–মিস্টার বাসুকে বলবেন, আমি ওঁর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই। কোথায় কখন দেখা হবে যেন চিঠিতে জানান।

ফিরে গিয়ে হরিধনকে বললাম যদি বাসুর ঠিকানা বের করে দিতে পারো তোমার প্রোমোশন হবে। হরিধন তক্ষুনি রাজি হয়ে গেল। গত রাতে হরিধন বাসায় ফেরেনি। আজ সারা সকাল থানা-হাসপাতাল চষে বেড়িয়েছি। হরিধনের পাত্তা নেই। ওর বাড়ির লোক কান্নাকাটি করছে। হয়তো আমার জন্যেই বিপদে পড়ল ছেলেটা?

কাল বাসু এসেছিলেন কুতুবে?

হ্যাঁ, বিকেল পাঁচটায় আসেন, খানিক পরে চলে যান।

কুণালের সঙ্গে বেরলো দুজন। অনেক খোঁজাখুঁজি করল বিকেল অবধি। হরিধনের খোঁজ পাওয়া গেল না। সন্ধেবেলা মামাবাবুর বাসায় ফিরতে বাধ্য হল সুনন্দ অসিত। কারণ স্যার ডেভিড ডানকান আসবেন আজ। সেই উপলক্ষে আরও কয়েকজন অতিথি আসবেন বাড়িতে। তাদের যত্নের ভার সুনন্দদের ওপর।

আবার আগামীকাল এক প্রোগ্রাম ঠিক হয়ে আছে। মামাবাবু ডানকানকে নিয়ে কলকাতার বাইরে যাবেন বেড়াতে। সুনন্দ অসিত যাবে সঙ্গে।

সুনন্দদের ইচ্ছে ছিল না কুণালকে ফেলে রেখে যায়। কুণালই জোর করল–তোরা আর থেকে কী করবি। মাঝ থেকে প্রোফেসর ঘোষের অসুবিধে হবে। তোরা যা–

ভাগ্যিস গিয়েছিল তারা। নইলে এক অতি জটিল রহস্যের জাল হয়তো কোনোদিনই ভেদ করা সম্ভব হত না।

রাতে সুনন্দ একবার ফোন করল কুণালকে–হরিধনের খোঁজ পেলি?

উত্তর এল–না।

.

০৩.

আফ্রিকা সফর সেরে হইহই করে উপস্থিত হলেন স্যার ডেভিড ডানকান। ডানকান গিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকায় অতি দুর্গম অরণ্য অঞ্চলে—ওকাপি নামে এক দুর্লভ প্রাণী দর্শনের আশায়। ওকাপি জিরাফের জ্ঞাতি। ১৯০০ সালে এই জন্তুটি প্রথম আবিষ্কার হয়। বন্য ওকাপির স্বভাবের বৈচিত্র্য আজও জানা যায়নি। তার কারণ শুদ্ধ গভীর জঙ্গল, অল্প সংখ্যা বা তাদের লাজুক স্বভাব নয়–ওই একই জঙ্গলে বাস করে বর্বর পিগমি বা বামন জাতি। তাদের বিষাক্ত তিরকে সবাই ডরায়।

স্যার ডেভিড লুকিয়ে ওকাপির ছবি তুলেছেন, পিগমিদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের সাথে নাচ-গান করেছেন এবং নিতান্ত উপস্থিতবুদ্ধির জোরে চিতাবাঘের কবল থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন। গোটা সন্ধে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনল তাঁর গল্প।

পরদিন খুব ভোরে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে রওনা হল পাঁচজন—মামাবাবু, ডানকান, সুনন্দ, অসিত এবং বঙ্কিম হাজরা। তিনি ঠিক ম্যানেজ করে ঢুকে পড়েছেন দলে। বীরভূমে যে ঝিল দেখতে যাওয়া হচ্ছে, শীতকালে সেখানে প্রচুর যাযাবর হাঁস নামে। ডানকানের ইচ্ছে পশ্চিমবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করবেন, সঙ্গে খানিক বার্ডওয়াচিং হলে তো সোনায় সোহাগা।

এই ঝিলে আগে কয়েকবার গেছেন মামাবাবু। উন্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যে জলাভূমি। কিছুদুর দিয়ে বইছে সরু পাহাড়ি নদী কোপাই। ঝিলের কাছে একটি মাত্র গ্রাম বৈকুণ্ঠপুর। গ্রামের লোকরা বৈষ্ণব, তারা ঝিলের পাখি মারে না, বাইরের কাউকেও মারতে দেয় না। অতএব ঝিলের জলে এবং আশেপাশে পাখিরা নির্ভয়ে চরে।

বোলপুর স্টেশনে সকাল এগারোটা নাগাদ ট্রেন থেকে নামল পাঁচজনে।

বৈকুণ্ঠপুরের শ্রীমন্ত বৈরাগী মামাবাবুদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল স্টেশনে। শ্ৰীমন্ত মামাবাবুর পুরনো পরিচিত। বছর চল্লিশ বয়স। ভারি বিনয়ী। সর্বদা মুখে মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে। মামাবাবুর সঙ্গে ঘুরে বার্ডওয়াচিং সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আছে শ্ৰীমন্তর।

তিনটে সাইকেল রিকশা ভাড়া করা হল। শ্ৰীমন্ত চলল বাইসাইকেলে। মাইল দুই যাবার পর রাস্তা খারাপ হয়ে উঠল। এই মেঠো রাস্তায় রিকশা চলে না–গরুর গাড়ি চলে। শুধু মালপত্র নিয়ে রিকশা চালকরা চলল গাড়ি ঠেলে ঠেলে।

শীতের রোদ্দুরে হাঁটতে কষ্ট নেই। গল্প করতে করতে এগোল সবাই। দুপাশে বিস্তীর্ণ ক্ষেতি জমি। বর্ষাকালে সারা মাঠে ধান চাষ হয়। শীতে অবশ্য অনেক জমি খালি পড়ে আছে। তবে যে জায়গায় জলসেচের সুবিধে আছে সেখানে টুকরো টুকরো জমিতে চাষ হয়েছে। কোথাও ধান কোথাও বা গম।

পথের ধারে এক ছোট্ট গ্রাম পড়ল। বট অশ্বত্থ আম জাম তেঁতুল গাছে ছায়াচ্ছন্ন। ঝুপড়ি চায়ের দোকানও রয়েছে একটা। একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানের বাইরে বেঞ্চে বসল সবাই। রিকশাওলারাও রিকশা রেখে এসে দোকানের পাশে ঘাসে বলে পড়ল।

দেখতে দেখতে ছোটখাটো এক ভিড় জমে গেল মামাবাবর পার্টিকে ঘিরে। ছোট ছেলেমেয়ে, অকর্মা লোক তো আছেই–যারা কাজে যাচ্ছিল তারাও হাঁ করে দাঁড়িয়ে গেল। রিকশাওলা ও শ্ৰীমন্তকে হাজারো প্রশ্ন করতে লাগল আগন্তুকদের সম্বন্ধে। ডানকান সাহেবই তাদের প্রধান আকর্ষণ। সাহেব নিজে কিন্তু বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করলেন না। বললেন–এ আমার অভ্যেস আছে। অচেনা জায়গায় এমনও হয়েছে যে কয়েকশো লোক গা ঘেঁষে বসে আমায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লক্ষ্য করেছে। শোওয়ার সময় অবধি রেহাই দেয়নি। আবার গায়ে আঙুল ঘষে যাচাই করে দেখছে রংটা আসল না নকল। একবার হয়েছিল কী জানো? ইস্টার্ন তুর্কিস্থানে গোবি মরুভূমির প্রান্তে মঙ্গোলিয়ানদের এক গ্রামে সন্ধের ঠিক আগে পৌঁছলাম আমি আর তেহেরান ইউনিভার্সিটির আর্কিওলজির প্রোফেসর ডক্টর বেন গাজি–

গেল গেল, নিয়ে গেল। ধর ধর! হেট হেট–ইত্যাদি বহু কণ্ঠের উত্তেজনাময় বাক্যস্রোতে ডানকানের গল্পে অকালে ছেদ পড়ল।

সচকিত হয়ে দেখল সবাই একপাল ছোট ছেলে তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে একদিকে ছুটে গেল। তারা ঘাড় তুলে কাছে এক বিরাট তেঁতুল গাছের ডালে তাকিয়ে দেখছে, উত্তেজিতভাবে অঙ্গভঙ্গি করছে এবং ঢিল ছুঁড়ছে ওপরে।

তাদের উত্তেজনার কারণ প্রথমে ধরা গেল না।

তারপরই শ্ৰীমন্ত লাফ দিয়ে উঠে ছুটল গাছের দিকে–হেই বাবা, সব্বনাশ হয়ে গেল।

মামাবাবুরাও হাজির হলেন গাছের নিচে। ব্যাপার বুঝে সবার চক্ষুস্থির।

এক মস্ত লালমুখো বাঁদর গাছের উঁচু ডালে গ্যাট হয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ব্যাগের মালিক-বঙ্কিমবাবু।

বাঁদরটা ব্যাগের স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ফেলেছে। এবং হাটকে হাটকে ব্যাগের ভিতরকার জিনিস বের করে প্রত্যেকটি চোখের সামনে একবার ঘুরিয়ে দেখে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। বোঝা গেল খাদ্যদ্রব্য ভিন্ন অন্য কিছুতে তার রুচি নেই।

বঙ্কিমবাবু তো এই দৃশ্য দেখে বিকট আর্তনাদ করে নৃত্য জুড়ে দিলেন।

গ্রামের একজন বলল, ভারি শয়তান বাঁদর, বাবু। কী উৎপাত যে করছে! একজন এনেছিল পুষবে বলে। বাগ মানেনি। বুনো হয়ে গেছে।

ধপ! এবার ব্যাগটা পড়ল মাটিতে। বাঁদরটা কী জানি চিবুচ্ছে। বঙ্কিমবাবু জানালেন– নিশ্চয় পিপারমেন্ট। ছিল এক বাক্স।

বঙ্কিমবাবু পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে তাঁর ফেলে দেওয়া জিনিস উদ্ধার করতে লাগলেন। সুনন্দ, অসিত, মামাবাবু, ডানকান সাহেব–আর গ্রামসুন্ধু লোক তাকে সাহায্য করতে লেগে গেল। যাহোক আধঘণ্টার মধ্যে হারানো জিনিস প্রায় সবই উদ্ধার হল। অবশেষে ফের রওনা দিল তারা।

বৈকুণ্ঠপুরের ঝিল সত্যি অপূর্ব।

অন্তত আধ মাইল লম্বা, হাত পঞ্চাশ চওড়া জলাশয়। চারিধারে উঁচু পারে তালগাছের সারি এবং শর ঝোঁপ। তীরের কাছে অগভীর জলে কিছু নলখাগড়া ও আগাছা জন্মেছে। ঝিলের তিন পাশে চাষের ক্ষেত। একপাশে উঁচু-নিচু লালচে রুক্ষ খোয়াই। খোয়াইয়ের পথে মাইল দেড় গেলে কোপাই নদী। ঝিলের পশ্চিম দিকে প্রায় দুশো গজ দূরে বৈকুণ্ঠপুর।

শীতের দুপুরে গাঢ় নীল জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে। আর জলের বুকে মনের আনন্দে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে অসংখ্য হাঁস। শুধু হাঁস নয়, আরও অনেক রকম পাখি–কেউ ভাসছে জলে, কেউ চরছে পারের কাছে ডাঙায়। কেউ ডানা মেলে উড়ছে আকাশে। এতগুলো মানুষের আগমনে তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। বোঝা গেল এরা মানুষকে ভয় করে না।

ডানকান তো দৃশ্য দেখে মুগ্ধ।

মামাবাবু, ডানকান এবং বঙ্কিম হাজরা চোখে দূরবিন লাগালেন পাখি দেখতে।

সুনন্দ অসিত, শ্ৰীমন্ত ও আরও কয়েকজন বৈকুণ্ঠপুরবাসীর সহায়তায় তিনটে তাঁবু খাঁটিয়ে ফেলল ঝিলের কাছে। গ্রামের লোক তাদের রাতে থাকার জায়গা দিতে চেয়েছিল কিন্তু মামাবাবু ও ডানকান এমন খাসা জায়গাটি ছেড়ে বদ্ধ ঘরে ঘুমোতে রাজি হলেন না। ডানকান হেসে বললেন, বুঝলে ব্রাদার, সত্যি বলতে কি ক্যাম্পে শুতে আমি নিজের বেডরুমের চেয়েও আরাম পাই। অভ্যেস!

বৈকুণ্ঠপুরের ঝিলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে পিনটেল বা সূচ্যগ্রপুচ্ছ হাঁস। জলের মধ্যিখানটা তাদের দখলে। এরা যাযাবর। উত্তর এশিয়া ও ইউরোপ থেকে শীতকালে এদেশে আসে। বেশ বড় হাঁস।

ঝিলে আর এক জাতের হাঁস ছিল—নাক্‌টা। আকারে পিনটেলের চেয়েও বড়। নাকটা যাযাবর নয়। এখানে স্থায়ীভাবে বাস করে।

হাঁস ছাড়াও জলে সাঁতার কাটছিল কিছু পানকৌড়ি। তীরে গাছের ডালে বা মাটিতে বসেছিল কয়েকটি ধ্যানমগ্ন বক। থেকে থেকে জলে ছোঁ মারছিল মাছরাঙা। দূরে খোলা মাঠের আকাশে প্রকাণ্ড ডানা মেলে উড়ছিল শামুকখোল।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে আসা হয়েছিল স্টেশনে। এক রাউন্ড কফি খেয়ে সবাই চলল নদী দেখতে।

অগভীর ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনী। টলমলে জলে হাঁটু অবধি ডোবে না। তবে বর্ষায় নাকি এই নদীতেই বান ডাকেকূল ছাপিয়ে যায় জল। নদীতটে ঝোঁপ-ঝাড়, হালকা জঙ্গল। ভারি নির্জন। এই জায়গা নানা জাতের পাখির আদর্শ বিহারভূমি।

মামাবাবু উত্তেজিতভাবে ডানকানকে খোঁচা মারলেন ওই দেখুন একজোড়া ব্রাহ্মণী হাঁস।

অ্যাঁ, হাঁসেরও বামুন কায়েত আছে? আশ্চর্য হয়ে বললেন বঙ্কিমবাবু।

“না না, সে ব্রাহ্মণী নয়, হাঁসের নাম। চলতি বাংলায় যাদের বলি চকাচকী। বললেন মামাবাব। এরাও যাযাবর হাঁস। তুর্কিস্থান সিকিম তিব্বত ইত্যাদি দেশ থেকে আসে। সর্বদা জোড়ায় জোড়ায় ঘোরে।

মামাবাবু গ্রামের লোকের সাহায্যে ঝিল ও নদীর তীরে কয়েকটা পাখি ধরার ফাঁদ পাতলেন। পাখি ধরে তাদের পায়ে রিং পরানো হবে। রিং বের করে দেখালেন তিনি। ছোট ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বলয়। তাতে পাঞ্চ করে খুদে খুদে অক্ষরে ছেপে দেওয়া হয়–রিং পরানোর তারিখ, কে পরাচ্ছে, কোথায়, পাখির ওজন কত ইত্যাদি তথ্য। বিশেষ করে যাযাবর পাখিদের জানতে এই রিং পরানোর প্রয়োজন খুব বেশি।

শীতের শেষে যাযাবর পাখির দল আবার নিজের দেশে ফিরে যাবে। হয়তো দূর দেশে এখানের রিং পরানো কোনো পাখিকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় পাওয়া যাবে। পক্ষিবিশারদরা তখন ওর পায়ের রিং দেখে জানতে পারবেন পাখিটা কত দূরে গিয়েছিল, কবে, ইত্যাদি খবর।

দিনান্তের অস্পষ্ট আলো যখন যাই-যাই করছে, আকাশের পশ্চিমপ্রান্ত অস্তগামী সর্যকিরণের আভায় রাঙা হয়ে উঠেছে, তখন দেখা গেল এক আশ্চর্য দৃশ্য। পিনটেলরা ঝাঁকে ঝাকে উড়তে আরম্ভ করল জল ছেড়ে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে প্রথমে ঝিলের ওপরে কয়েক পাক ঘুরে তারা উঠে গেল বহু উঁচুতে। তারপর তীরবেগে অদৃশ্য হল দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে। তাদের ডানায় শনশন আওয়াজ হচ্ছিল যেন ঝড়ের বাতাস। নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে তারা এখন চরতে চলল–দূরে খাল-বিল-শস্যক্ষেতে। কারণ রাতের আঁধারে শিকারীর দৌরাত্ম্য নেই। আবার ওরা বৈকুণ্ঠপুরের ঝিলে ফিরবে খুব ভোরে। সূর্যের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে। এই ওদের দৈনিক রুটিন।

সকালে আবিষ্কার হল ঝিলের পাশে ফাঁদে পাঁচটি পাখি বন্দী হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনটি যাযাবর পিন্‌টেল। সাবধানে বের করা হল পাখিগুলোকে। যাযাবর পাখিগুলোর পায়ে রিং পরিয়ে দিলেন মামাবাবু। সুনন্দ অসিত বঙ্কিমবাবু ছাড়াও গ্রামের অনেক লোক গভীর আগ্রহে দেখল তার কাজ। ডানকান তখন নিজের মনে ফোটো তুলতে ব্যস্ত।

ঘণ্টাখানেক পরে এক ব্যাপার দেখে সুনন্দরা হেসে অস্থির।–গ্রামের একটি লোক দুটো পায়রা এনে দিল বঙ্কিমবাবুকে। স্রেফ গোলা পায়রা। যারা গেরস্ত-বাড়ির ঘুলঘুলিতে বাস করে, কাছাকাছি মাঠে-ময়দানে চরে বেড়ায়। বঙ্কিমবাবু লোকটির হাতে একখানা নোট গুঁজে দিলেন। তারপর চুপিচুপি পায়রা দুটো থলিতে ভরলেন।

অসিত হেঁকে বলল, “কী হাজরা মশাই, রোস্ট খাবেন নাকি?

বঙ্কিমবাবু জিভ কাটলেন। আরে ছি ছি। বৈকুণ্ঠপুরে পক্ষিবধ! গ্রামের লোক মনে করবে কী? এই পায়রা দুটোকে আমি রিং পরাব। মানে প্র্যাকটিস করব।

মামাবাবু হেসে বললেন, আপনার রিং পরানোর ইচ্ছে আছে বলেননি কেন? দুটো হাঁস তো এমনি ছেড়ে দিলাম। সেগুলোকে পরাতে পারতেন।

লাজুক হেসে বঙ্কিমবাবু বললেন, ঠিক আছে। আগে একটু প্র্যাকটিস করে নিই; নিজের হাতে পরিয়ে দেখাব আপনাকে। পায়রা দুটো নিয়ে বঙ্কিমবাবু খোয়াইয়ের ঢালে নেমে অদৃশ্য হলেন।

প্রথম পায়রাটির পায়ে পরানো অ্যালুমিনিয়াম বলয় পরীক্ষা করে মামাবাবু বঙ্কিমবাবুকে সার্টিফিকেট দিলেন–গুড! কেবল আর একটু টাইট হবে। হ্যাঁ, পয়সা দিয়ে পায়রা কেনার দরকার নেই। আপনি বরং নদীর তীরে চলে যান। শ্ৰীমন্ত বলেছে, একজোড়া বালি-তিতির পড়েছে ফাঁদে। ওরা অবশ্য যাযাবর নয়, তবু ওদের ওপর হাত পাকাতে পারেন। রিং পরিয়ে ছেড়ে দেবেন। বঙ্কিমবাবু বেজায় খুশি হয়ে চলে গেলেন।

সুনন্দ দুপুরের খাওয়ার আয়োজন শুরু করল। সে রান্নায় ভারি পটু। অসিতকে বলল, ভানকান বাঙালি রান্না খাবে। খিচুড়ি, ডিম ভাজা, আলুর দম বানাচ্ছি।

সুনন্দকে ব্যস্ত দেখে অসিত বলল, একটু ঘুরে আসি।

মামাবাবু তখন ঝিলের ধারে চোখে দুরবিন লাগিয়ে বসে আছেন। ডানকান গ্রামে গেছেন একটা প্রাচীন মন্দির দেখতে।

অসিত যখন ফিরে এল, সুনন্দর রন্ধনপর্ব সমাপ্ত।

সুনন্দকে ফিসফিস করে বলল অসিত–হ্যাঁরে ভক্ত বঙ্কিমের মাথার গোলমাল নেই

সুনন্দ অবাক।–কই, মনে তো হয় না। কেন?

অসিত একটু চুপ করে থেকে বলল–আমার মনে হয় আছে।

হঠাৎ?

একটা উদ্ভট ব্যাপার দেখলাম, তাই।

নদী পেরিয়ে ওপারে গেলাম। খানিক ঘুরে বায়নোকুলার দিয়ে দেখলাম চারধার। তারপর গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়লাম চিৎপটাং হয়ে। একটু বাদে পাশ ফিরেছি, চোখে পড়ল নদীর উল্টো তীরে ঝোঁপের আড়ালে বসে বঙ্কিমবাবু। তিনি–

হ্যাল্লো দেয়ার! ডানকানের গমগমে গলা শুনে দুজনে চমকে উঠল। ডানকান সাহেব পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন হাসি মুখে। এক কাপ কফি খাওয়াবে?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই-সুনন্দ তৎপর হয়ে ওঠে। ডানকান জুৎ করে বসলেন সামনের মোটা গাছের শিকড়ের ওপর। বোঝা গেল শুধু কফির তেষ্টা নয়, তার কিঞ্চিৎ আড্ডা দেওয়ার বাসনা জেগেছে।

জানো, খাবার-দাবার নিয়ে আমার কোনো বাছবিচার নেই। শুধু এই কফির ওপর একটু যা দুর্বলতা। এই যে ইচ্ছে করলেই কফি খেতে পাচ্ছি, এ যে কত বড় সৌভাগ্য সে তোমরা বুঝবে না। আমিও বুঝিনি আগে। প্রথম টের পেলাম উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার জঙ্গলে পথ। হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে। তখন কেবল গরম কফিতে চুমুক দেওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। নৌকাডুবি হয়ে আমার কফির প্যাকেট গেল ভেসে। তারপর পাক্কা চল্লিশ দিন কফি খেতে পাইনি।

ওখানে গিয়েছিলেন কেন? প্রশ্নটা দুজনের।

নাইজার নদীর গতিপথ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে। বড্ড ভুগিয়েছিল সেবার।

কী-কীরকম?

স্যার ডেভিড কফিতে চুমুক দিতে দিতে তার অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি আরম্ভ করলেন। রুদ্ধশ্বাসে শোনে দুই বন্ধু। বঙ্কিমবাবুর অদ্ভুত আচরণের কথা আপাতত মুছে গেল তাদের। মন থেকে। কথাটা অবশ্য সুন্দর মনে পড়েছিল–তবে অনেক–অনেক পরে।

সেই রাতে কলকাতার বাসায় ফিরে, শুতে যাওয়ার আগে সুনন্দর মনে পড়ল–তাই তো, হরিধনের খবর পাওয়া গেছে কি? আর বঙ্কিমবাবু সম্বন্ধে কী একটা রহস্যময় ঘটনা বলতে যাচ্ছিল অসিত? কিন্তু রাত সাড়ে এগারোটার সময় কাউকে বিরক্ত করা উচিত নয়। পরদিন সুনন্দ কুণাল ও অসিতকে টেলিফোন করল।

কুণাল জানাল–হ্যাঁ, ফিরেছে হরিধন। খুব বেঁচে গেছে। আমি এখুনি আসছি তোর কাছে।

অসিত বলল–সত্যি, বঙ্কিমবাবুর ব্যাপারটা ভুলেই গেসলাম। অদ্ভুত লোক।আম কিছু মাথামুণ্ডু বুঝলাম না। ফোনে বলা যাবে না সব গুছিয়ে। আমি যাচ্ছি। তবে একটু লাল হবে। কাজ আছে বাড়িতে।

.

০৪.

মিত্র কেমিক্যালস-এর সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হরিধনের রহস্যময় অন্তর্ধান সম্পর্কে কুণাল যা বলল তার সারমর্ম এই–

হোটেল কুতুবের সামনে এক পার্কের বেঞ্চে বসে হোটেলের ওপর নজর রাখাছল হরিধন। বিকেল পাঁচটা নাগাদ মিস্টার বাসু এলেন ট্যাক্সিতে। আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি বেরিয়ে আসেন। ট্যাক্সি ডাকলেন না। পাইপ ধরিয়ে ধীরে সুস্থে হাঁটতে শুরু করলেন চৌরঙ্গীর দিকে।

সুবিধেই হল হরিধনের। অফিস-ফেরতা জনস্রোতে গা-ঢাকা দিয়ে সে হাত কুড়ি পিছনে থেকে বাসুকে অনুসরণ করল।

চৌরঙ্গী ছাড়িয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে বাসু ঢোকেন চীনে পট্টিতে। পথে একবার মাত্র থেমেছিলেন–দেশলাই কিনতে।

একটা সরু গলি। দুপাশে পুরনো আমলের বড় বড় বাড়ি। পথচারী কম। মিস্টার বাসু টপ করে এক বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে গেলেন। মিনিট পনেরো গলির মোড়ে অপেক্ষা করে হরিধনও ঢুকল সেই বাড়িতে।

সরু প্যাসেজ–দুধারে সার-সার ঘর। নোনা-ধরা ইট বের করা দেওয়াল। প্যাসেজে মিটমিট করছে বৈদ্যুতিক আলো। কোনো ঘর তালাবন্ধ। কোনোটা খোলা–মানুষজনের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ভিতরে। দু-চার জন লোক ঢুকছে বা বেরুচ্ছে। ঘরগুলোয় লোক বাস করে না। গুদাম বা অফিস হিসেবে ব্যবহার হয়। খোলা দরজা পেলেই ভিতরে। উঁকি দেয় হরিধন।

প্যাসেজের শেষ প্রান্তে একটা লোক দাঁড়িয়েছিল। হরিধনকে দেখছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। হরিধন জিজ্ঞেস করল তাকে–একজনকে দেখেছেন যেতে? কোট-প্যান্ট পরা।

লোকটি আঙুল তুলে দেখাল-হ্যাঁ, ওই দিকে।

বাড়ির এ অংশ একেবারে নির্জন। হঠাৎ থামের আড়াল থেকে যেন মন্ত্রবলে আরি হল এক ব্যক্তি–দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ, পরনে রঙচঙে লুঙ্গি ও শার্ট। চোখের নিচে হতে মহেব বাকি অংশ রুমাল বেঁধে ঢাকা।

মুহূর্তে সে হরিধনের বুকের ওপর উঁচিয়ে ধরল একখানা লম্বা ঝকঝকে ছোবা। কর্কশ স্বরে বলল–খবরদার, চেঁচালেই মরবি।

আর তখুনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হরিধনের ঘাড় পেছন থেকে দৃঢ়মুষ্টিতে আঁকড়ে গত কেউ। এবং আর একখানা হাত ভিজে কাপড়ের টুকরো সমেত তার মুখ চাপা দিল। ঝাঝাল মিষ্টি গন্ধ ঢুকল নাকে। হরিধনের মাথা ঝিমঝিম করে উঠল এবং সে জ্ঞান হারান।

হরিধন যখন চেতনা পেল তখন বুঝতে পারল যে একটা দরজা-জানলা বন্ধু অন্ধকার ঘরে সে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে শুয়ে রয়েছে। মুখও বাঁধা, গালের ভিতর কাপড় ঠাসা। চেঁচাবার উপায় নেই। ঘুলঘুলি দিয়ে সামান্য আলো ঢুকছে।

দারুণ তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। গড়িয়ে গড়িয়ে দরজার কাছে গেল হরিধন। দুম দুম্ করে জোড়া পায়ে লাথি মারতে লাগল কবাটে। বাইরে তালা খোলার আওয়াজ। সেই মুখ-ঢাকা লোকটা ঢুকল ঘরে। হিংস্রভাবে দাবড়ানি দিল–টু শব্দ করলে গলা কেটে পুঁতে ফেলব।

হরিধন ইঙ্গিতে বোঝাল–জল।

লোকটা এক মগ জল এনে হরিধনের বাঁধন খুলল। হরিধন হাঁ করতে ঢেলে দিল জলটুকু। তারপর বেরিয়ে গিয়ে দরজায় তালা দিল। দরজার বাইরে আলো। দেখে হরিধনের মনে হয়েছিল তখন সকালবেলা।

খানিকক্ষণ পরে তার কানে এল দরজার বাইরে দুজন লোকের কথাবার্তা।

ফেউটাকে নিয়ে কী করব স্যার?

দেখি ভেবে।

খতম করে পাচার করে দিই। ঝামেলা চুকে যায়।

উহুঁ ব্যস্ত হয়ো না। আমি আসছি ঘুরে।

একজনের গলা চিনেছিল হরিধন–মুখ-ঢাকা গুণ্ডাটা। দ্বিতীয় জনকে চিনতে পারেনি।

ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল হরিধন। আর কোনো শব্দ করতে সাহস পায়নি। ঘণ্টার পর ঘন্টা ঠায় একভাবে পড়ে থেকে তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে গিয়েছিল।

আবার দরজা খুলল সেই গুণ্ডাটা। তখন নিশুতি রাত। হরিধনের মুখ খুলে দিয়ে এক গ্লাস দুধ দিল তাকে খেতে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। তাই বিনা আপত্তিতে দুধটুকু খেয়ে ফেলল হরিধন। একটুক্ষণ পরেই তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। অবশ অচেতন হয়ে পড়ল তন্দ্রায়।

কণাল বলল, ভোরবেলা হরিধনের দেহ আবিষ্কার হল। ওই বাড়িরই এক নোংরা উঠানে। প্রথমে লোকে ভেবেছিল মৃত। তারপর বুঝল অজ্ঞান। তখন ওকে হাসপাতালে পাঠাল। পরে ওর জ্ঞান হল। ডাক্তার বলেছে কড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল।

কিছু খোয়া গেছে হরিধনের? জিজ্ঞেস করল সুনন্দ।

হুঁ। ওর মনিব্যাগ এবং রিস্টওয়াচ। পুলিশ ওই বাড়ি সার্চ করেছে। কিন্তু হরিধনের আততায়ীর সন্ধান পায়নি। এমনকি কোন ঘরে বন্দী ছিল তাও ঠিক করে বলতে পারেনি হরিধন। কয়েকজনকে জেরা করে আপাতত হাল ছেড়ে দিয়েছে। কী করতে হরিধন ওই বাড়িতে ঢুকেছিল তার আসল কারণ অবশ্য পুলিশের কাছে চেপে গেছি। কে জানে, তাহলে হয়তো আমাদেরই অযথা হয়রানি করত পুলিশ।

অল্পক্ষণ নীরব থেকে কুণাল বলল, “আমার কিন্তু মনে হয় এ অর্ডিনারি ছিনতাই কেস নয়। মিস্টার বাসুই গুণ্ডা লাগিয়েছিল।

তোর ধারণার কারণ?

কারণ হরিধনের প্যান্টের পকেটে একটা চিঠি ছিল, সেটা উধাও হয়েছে। এমনি অফিস চিঠি। অফিসিয়াল প্যাডে আমি লিখেছিলাম হরিধনকে কিছু কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে। আমার সই ছিল তাতে। এ চিঠি সাধারণ গুণ্ডা নেবে কী করতে? তাছাড়া ওকে ফেউ বলাছল

হতে পারে। বাসু সন্দেহ করেছিল ওকে ফলো করা হচ্ছে, তাই। লোকটা তাহলে ডেনজারাস–

সদর দরজার কলিং বেল বাজল।

দরজা খুলে সুনন্দ দেখে বঙ্কিমবাবু।

বঙ্কিমবাবু বললেন, “নমস্কার। প্রফেসর ঘোষ আছেন?

না, বেরিয়েছেন। আপনি বসুন। ফিরবেন এবার।

ডানকান সাহেব কি চলে গেছেন?

হ্যাঁ।

ওঃ দুর্দান্ত লোক মশাই। এই প্রথম স্বচক্ষে একজন পর্যটককে দেখলাম। বইয়ে পড়েছি। কত।

সুনন্দ জবাব দিতে যাচ্ছিল–কেন, মামাবাবু? কিন্তু তার নজরে পড়ল বঙ্কিমবাবু হা করে চেয়ে আছেন বৈঠকখানার খোলা দরজা দিয়ে কুণালের দিকে।

সুনন্দ বলল, আমার বন্ধু কুণাল মিত্র।

ও, ইনিই বুঝি মিস্টার বাসুর খোঁজ করছিলেন? চাপা গলায় বললেন বঙ্কিমবাবু।

“না না, সে অন্য লোক।

ওঃ সরি। আচ্ছা আমি এখন চলি। পরে আসবখন। নমস্কার।

দরজা বন্ধ করে এসে সুনন্দ বলল, কুণাল, ভদ্রলোক কী বলছিলেন জানিস?

কী?

ইনিই কি মিস্টার বাসুর খোঁজ করছেন?

অ্যাঁ! কুণাল আঁতকে ওঠে।

ভয় নেই। আমি বলেছি সে অন্য লোক। সুনন্দ আশ্বাস দিল।

কে ভদ্রলোক?

বাবু বঙ্কিম হাজরা। মামাবাবুর চেলা। লোক খারাপ নয়, তবে মগজ কিঞ্চিৎ নিরেট।

সত্যি, বোকা লোকগুলো এক-একসময় এমন বেফাঁস কথা বলে ফেলে!

.

কুণাল বিদায় নেবার ঘণ্টাখানেক পরে এল অসিত।

সুনন্দ অসিতকে সংক্ষেপে জানাল হরিধনের অন্তর্ধান-কাহিনি। তারপর বলল, বল শুনি, বঙ্কিমবাবুর রহস্যময় আচরণ সম্বন্ধে কী জানি বলছিলি?

অসিত বলতে শুরু করে–কোপাই নদীর তীরে গাছতলায় শুয়ে আছি। খানিক পরে কাৎ হয়ে দেখি, অন্য পাবে ঝোঁপের আড়ালে বঙ্কিমবাবু। আমার দিকে একটু পাশ ফিরে বসেছেন। তার হাতে একটা পাখি,–তিতির। আমি ভাবলাম পাখিটাকে রিং পরাবেন, তাই কৌতূহল নিয়ে তাকিত রইলাম।

উনি কিন্তু কী করলেন জানিস? ব্যাগ থেকে ছোট একটা শিশি বের করলেন। তারপর আঙুল শিশির মধ্যে ঢুকিয়ে কী জানি তুলে পাখিটার ঠোঁটে, মুখে, ডানায়, পায়ে ঘষে দিতে লাগলেন। বারবার এমনি করলেন। এমনকি সেটা খাওয়ানোর চেষ্টাও করলেন। আমি তো হাঁ। করছেন কী? এরপর তিনি তিতিরটা উড়িয়ে দিলেন।

রিং পরালেন না? প্রশ্ন করল সুনন্দ।

না। আমি দুরবিন ফোকাস করে লক্ষ করেছি। রিং দেখতে পাইনি পাখির পায়ে। বঙ্কিমবাবু এরপর আর একটা তিতির নিলেন হাতে। এবং আগের মতোই উদ্ভট কাণ্ড করে সেটাকেও ছেড়ে দিলেন।

রিং?

উঁহু, তার পায়েও রিং ছিল না। বঙ্কিমবাবু এরপর চলে গেলেন উঠে। শিশিটা ফেলে দিয়ে গেলেন একটা গর্তে। আমি পরে গিয়ে শিশিটা তুলে নিলাম। কিন্তু শিশিতে যে কী ছিল ধরতে পারছি না।

কই দেখি শিশিটা।

অসিত পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাঁচের শিশি বের করল। চ্যাপ্টা ক্রিমের শিশির মতো সাইজ। স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি। প্লাস্টিকের ঢাকনা–তাতে সূক্ষ্ম কয়েকটি ছিদ্র। শিশির ভিতরে কাঁচের গায়ে পাতলা সরের মতো কী জানি লেগে রয়েছে জায়গায় জায়গায়।

সুনন্দ শিশিতে নাক লাগিয়ে শুকল। কেমন বোটকা গন্ধ। চোখের কাছে এনে পরীক্ষা করল। কিন্তু ভিতরে যে কী বস্তু ছিল আন্দাজ করতে পারল না। অবাক হয়ে বলল, “কী ছিল এতে? আশ্চর্য! এটা কী লেগে আছে?

জানিস, এই শিশিটা আমি আগেও একবার দেখেছিলাম। বলল অসিত।

কখন?

সেই যখন বাঁদরে বঙ্কিমবাবুর জিনিস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলল। আমি তার জিনিস খুঁজতে খুঁজতে এই শিশিটা পাই। ওটা হাতে পেয়ে একটুক্ষণ লক্ষ করেছিলাম। ঢাকনা খুলিনি। তখনও কিন্তু মনে হয়েছিল শিশিটা প্রায় খালি শুধু অল্প ক্রিম জাতীয় কী বস্তু রয়েছে ভিতরে।

দুই বন্ধু হতভম্ব হয়ে বসে থাকে শিশিটার দিকে তাকিয়ে।

সুনন্দ বলল, “আমি তো ভাই কিছু কূল পাচ্ছি না।

আমিও না।

একটা কাজ করব?

কী?

মামাবাবুকে বলি ব্যাপারটা। উনি যদি কোনো ক্লু—

হুঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম। তুই রাখ শিশিটা। মামাবাবুকে দেখাস।

তবে মামাবাবু পাখি নিয়ে যা মেতে আছেন। হয়তো কানেই তুলবেন না। দেখা যাক।

বিকেলে মামাবাবুর স্টাডিতে ঢুকল সুনন্দ। সামান্য ইতস্তত করে বলে ফেলল বঙ্কিমবাবুর শিশি-রহস্য।

মামাবাবু শিশিটা দেখলেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। বললেন-বেশ, দেখব পরীক্ষা করে। তবে তোমাদের বোধহয় নিরাশ হতে হবে। হয়তো শুনবে নেহাত ছেলেমানুষী ব্যাপার।

মামাবাবুর হাতে ওই শিশি তুলে দেওয়ার তিন দিন পরের ঘটনা।

সবে ব্রেকফাস্ট সেরে পড়ার টেবিলে এসে বসেছেন প্রোফেসর ঘোষ অর্থাৎ মামাবাবু। সামনে মুখোমুখি বসে সুনন্দ ও অসিত। টেবিলের ওপরে রাখা বঙ্কিমবাবুর সেই রহস্যময় শিশি।

এই শিশিতে কি ছিল জান? বললেন মামাবাবু।

কী?

একরকম ব্যাকটিরিয়া। জীবাণু।

সে কী!! মহা বিস্ময়ে অসিত ও সুনন্দ হতভম্ব। কীসের? প্রশ্ন করল তারা।

একে একে বলছি। মামাবাবু শিশিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, প্রথমে আমি শিশির ভিতরে কাঁচের গায়ে লাগা আঠাল বস্তু একটু নিয়ে স্লাইডসয়ে লাগিয়ে মাইক্রোস্কোপের তলায় পরীক্ষা করি, এবং একরকম ব্যাকটিরিয়ার অস্তিত্ব আবিষ্কার করি। ওই বস্তু বারবার বিশ্লেষণ করলাম নতুন করে নিয়ে। প্রত্যেক বারই পেলাম সেই একই জাতের ব্যাকটিরিয়া–প্রচুর পরিমাণে। অবাক হলাম। বুঝলাম, ওই সরের মতো আঠাল বস্তু কোনো কালচার মিডিয়া। এবং তার মধ্যে এই ব্যাকটিরিয়ার বংশ বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। কিন্তু এ-জীবাণু যে কী জাতীয় বুঝে উঠতে পারলাম না।

কালচার মিডিয়া কী? প্রশ্ন করল অসিত।

মামাবাবু জবাব দিলেন, একরকম রাসায়নিক পদার্থ। ল্যাবরেটরিতে যার মধ্যে জীবাণুকে কালচার অর্থাৎ পালন করা হয়।

হ্যাঁ, তখন গেলাম মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডক্টর আয়ারের কাছে। জীবাণু নিয়েই তার গবেষণা। ডক্টর আয়ারও ধরতে পারলেন না। তিনি আমায় নিয়ে গেলেন আর একজন বিশেষজ্ঞের কাছে–কৃষিবিজ্ঞানী ডক্টর সাহা।

ডক্টর সাহারও বেশ সময় লাগল জিনিসটা কী সেটা বুঝতে। তারপর যা রিপোর্ট দিলেন সেটা অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য।

ডক্টর সাহা বলেছেন–এই ব্যাকটিরিয়া হচ্ছে গমের নেতানো রোগের কারণ। গমের পাতা ও শিষের নরম অংশের কোষ থেকে এই জীবাণু খাদ্য আহরণ করে। ফলে পুষ্ট গাছ যায় শুকিয়ে। সাহা বলেছেন–এই গমের রোগ ভারতবর্ষে একেবারে নতুন। কৃষিবিজ্ঞানীরা এ-রোগ নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছেন। কিন্তু এখনো এর প্রতিরোধের কোনো উপায় বের হয়নি।

ডক্টর সাহা ভেবেছিলেন, কেউ বুঝি এই ব্যাকটিরিয়া নিয়ে রিসার্চ করছে। তিনি তার নাম জানতে চাইছিলেন।

গমের নেতানো রোগ। সুনন্দ লাফিয়ে ওঠে।

ঠিক এই রোগের ওষুধের ফরমুলা তো বিক্রি করতে চাইছেন মিস্টার বাসু।

কে মিস্টার বাসু? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

সুনন্দ ও অসিত পালা করে বলে গেল মিস্টার বাসুর কাহিনি–একেবারে শুরু থেকে। কুণালের কাছে গত বছর রহস্যময় মিস্টার বাসুর চিঠি–ফরমুলা বিক্রির প্রস্তাব–কুণালের সন্দেহ–প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের খোঁজে তাদের বারবার অভিযান এবং ব্যর্থতা—সমস্ত খুটিনাটি।

মামাবাবু ভুরু কুঁচকে শুনে গেলেন আগাগোড়া। সুনন্দদের বর্ণনা শেষ হলে উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন, “বটে বটে। শোনো, আমি কুণালের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওকে আসতে বলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

আধঘণ্টার মধ্যেই কুণাল হাজির হল।

মামাবাবু কুণালকে মিস্টার বাসুর ধরন-ধারণ ও তার ফরমুলাগুলি সম্পর্কে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। ধানের রাক্ষুসে পোকা বা গমের নেতানো রোগের ইতিহাসও জেনে নিলেন। সব শুনে গুম মেরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। অতঃপর সুনন্দকে ছক দিলেন–বঙ্কিমবাবুর বাড়ি যাও। ওনাকে ডেকে আনো আমার কাছে। তবে এ-ব্যাপারে কিছু ফাঁস কোরো না। বলবে, আমি বার্ড-ওয়াচিংয়ে বেরোচ্ছি। তাই ওঁর সঙ্গে প্রোগ্রাম করতে চাই।

বঙ্কিম হাজরার এন্টালির বাসায় আগে যায়নি সুনন্দ। ঠিকানা খুঁজে বের করল। মস্ত পাঁচতলা বাড়িতে তিন কামরার এক ফ্ল্যাট নিয়ে বাস করেন বঙ্কিমবাবু। নিজের বাড়ি নয়, ভাড়া।

দুঃখের বিষয় ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলছে।

দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে সুনন্দ জানল, বঙ্কিমবাবু কলকাতার বাইরে গেছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই।

সুনন্দর রিপোর্ট পেয়ে মামাবাবু আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। পরের দিন তিনি কোথায় কোথায় জানি ঘুরলেন। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরেই সুনন্দকে ডেকে বললেন, কাল ভোরে তোমাদের বন্ধু তপন দত্তর সঙ্গে দেখা করতে যাব। অসিতকেও নিয়ে চলো।

মানে সুরভি নার্সারি?

হুঁ। এই তপন দত্তর পরিচয় জানো? জান ওর ইতিহাস?

কেন, তপন কী করেছে?

ঠিক কী করেছে সেটাই জানতে চাই। যেটুকু জানতে পেরেছি তপন দত্ত ছিল প্রোফেসর তালকদারের রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট। বহুদিন কাজ করেছে ডক্টর তালুকদারের ল্যাবরেটরিতে। তালুকদার একবার তপন সম্বন্ধে ডক্টর সাহার কাছে খুব প্রশংসাও করেছিলেন।

ডক্টর তালুকদার মানে বিখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, যিনি বছর চারেক আগে আমেরিকায় ভিজিটিং প্রোফেসর হয়ে গিয়ে হঠাৎ মারা যান হার্ট অ্যাটাকে?

হ্যাঁ। ওঁর অকালমৃত্যুতে দেশের মস্ত ক্ষতি হয়েছে। ডক্টর তালুকদারের সাবজেক্ট ছিল মানুষের খাদ্যশস্য ও ফলমূলের নানান ক্ষতিকারক রোগের কারণ অনুসন্ধান এবং তাদের প্রতিরোধ করার উপায় আবিষ্কার। এই মানুষের কাছে যে অনেক দিন কাজ করেছে সে এসব রোগ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে বলেই আমার ধারণা।

.

সুরভি নার্সারির রূপ এর মধ্যে বিশেষ পালটায়নি। শুধু দেখা গেল প্রধান বাড়ি। দরজা-জানালা সব বন্ধ।

।মামাবাবুর সঙ্গে সুনন্দ ও অসিত নার্সারির গেট খুলে ঢুকতে চেনা সেই মালিটি এগিয়ে এল।

তপনবাবু আছে? জিজ্ঞেস করল সুনন্দ।

আজ্ঞে না। বাইরে গেছেন।

কোথায়?

আজ্ঞে জানি না।

থমকে গেল তিনজনে। এ-সম্ভাবনা কারো মনে জাগেনি। অসিত প্রশ্ন করল–কবে ফিরবেন?

তা জানি না হুজুর।

মামাবাবুর মুখের দিকে তাকাল ওরা, এবার কী করা?

মামাবাবু মালিকে প্রশ্ন করলেন, তোমার কাছে চাবি আছে বাড়ির?

মালি একটু ইতস্তত করে বলল–আছে।

শোনো আমরা এই বাড়ির ভিতরটা দেখতে চাই।

ভয়মাখা চোখে মালি বলল, “আজ্ঞে, হুকুম নেই। বাবু বকবেন।

কোন্ বাবু?

বাসু সাহেব।

ও, বাসু সাহেবের সঙ্গে বুঝি গেছে তপনবাবু?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তোমার নাম কী?

আজ্ঞে, বলরাম।

কদ্দিন আছ এখানে?

আজ্ঞে তিন বছর। নার্সারি খোলর গোড়া থেকে।

বাড়িতে আর কেউ আছে?

না। রাঁধুনি আর ধ্রুব মালি বাড়ি গেছে।

মামাবাবু বেশ অন্তরঙ্গ সুরে বললেন, শোনো বলরাম, আমি খবর পেয়েছি এই নার্সারি বিক্রি করে দেওয়া হবে। আমি নার্সারিটা কিনব ভাবছি। ঘরগুলো একটু দেখতে চাই। নইলে বুঝব কী করে কত দরে পোষাবে। অনেক দূর থেকে এসেছি। এজন্যে বারবার আসা অসুবিধে। তুমি একটু ইচ্ছে করলেই কাজটা আজ চুকে যায়। ভয় নেই বাসু সাহেব বা কেউ জানতে পারবে না একথা। এই নাও রাখো এটা, ছেলেদের মিষ্টি কিনে দিও। মামাবার মানিব্যাগ থেকে একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করে বলরামের নাকের সামনে ধরলেন।

বলরামের সসেমিরা অবস্থা। তক্ষুনি হাত বাড়াল বটে, কিন্তু লোভী জুলজুল চোখে দেখতে লাগল।

মামাবাব উৎসাহ দিলেন, “আরে কোনো ভয় নেই। তুমি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। একটিবার ঘুরে দেখে নেব। কোনো জিনিস নেব না। হ্যাঁ, নার্সারি যদি কিনি তোমাকে আমার চাই। তোমার মতো পাকা লোককে ছাড়ছি না। মাইনে এখন যা পাও তাতেই হবে তো? ঠিক আছে, তখন দেখা যাবে।

ব্যস ওতেই কেল্লা ফতে। বলরাম একগাল হেসে ঘাড় নাড়ল এবং নোটটি টেনে ট্যাঁকে গুঁজে বলল, আসুন বাবু।

বাড়িতে নিচের তলা সুনন্দরা আগে যেমন দেখে গিয়েছিল তেমনি রয়েছে—গুদাম, অফিস, বীজ পরীক্ষার সামান্য আয়োজন।

দোতলার সিঁড়ির মুখে তপনের শোওয়ার ঘর। তক্তপোশ খালি। কোনো বাক্স-প্যাঁটরা বা বিছানার চিহ্ন নেই। কেবল বুকসেলফে কতকগুলো ইংরেজি-বাংলা বই ও পত্রিকা। প্রায় সবই কৃষি বা রসায়ন বিদ্যার।

দ্বিতীয় ঘরে ঢুকে তিনজনে থ।

এ যে পুরোদস্তুর ল্যাবরেটরি!

বেশ বড় ঘর। দুধারে লম্বা টেবিল-লাগোয়া র‍্যাক। টেবিলে গ্যাসবার্নার। টেবিল ও র‍্যাকে রকমারি মাপের শিশি-বোতল, টেস্টটিউব, বিকার, বকযন্ত্র প্রভৃতি গবেষণার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। কাঁচ বা প্লাস্টিকের পাত্রে নানা রঙের চূর্ণ তরল পদার্থ, শস্যদানা, শুকনো পাতা ইত্যাদি। কোনোটা বা খালি। তবে বোঝা যায় এই গবেষণাগার গত কিছুদিন যাবৎ ব্যবহার করা হয়নি। কেমন এলোমেলোভাবে ছড়ানো জিনিসগুলো। ধুলো জমেছে। কয়েকখানা কাঁচের স্লাইড রয়েছে টেবিলে, কিন্তু মাইক্রোস্কোপ নেই। বড় আলমারি রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে। তাতে নিচের তাকে কয়েকটা খালি শিশি। ওপরের তাক সব ফাঁকা।

মামাবাবু টেবিল থেকে একটা শিশি তুলে নিলেন। বঙ্কিমবাবুর কাছে যে শিশিটা পাওয়া গিয়েছিল অবিকল সেরকম। আরও চার-পাঁচটা শিশি রয়েছে। অসিত তাকাল সুনন্দর। পানে। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিল–যে বৈজ্ঞানিকের খোঁজে তাদের অ্যাডভেঞ্চার শুরু, এতদিনে বুঝি তার হদিস মিলল। কিন্তু এত লুকোচুরির কারণ কী?

সুরভি নার্সারির বাড়িঘর বাগান ইত্যাদি ঘুরে দেখে ঘণ্টাখানেক পরে সকলে বিদায় নিলেন।

ট্রেনে মামাবাবু প্রায় কথাই বললেন না। কপালে চিন্তার ভাঁজ। সুনন্দরা তাকে কোনো প্রশ্ন করতে সাহস পেল না। এরকম মুডে থাকলে মামাবাবু কথাবার্তা পছন্দ করেন না। হাওড়া স্টেশনে যখন পৌঁছাল তখন বিকেল প্রায় তিনটে।

ট্রেন থেকে নেমেই মামাবাবু বললেন, পানিহাটি চলো। বঙ্কিমবাবুর সেই বাগানবাড়ি।

এখনই?

হুঁ। সময় নষ্ট করা চলবে না। অলরেডি লেট।

মামাবাবর স্বভাব এমনি। একবার ঝোঁক চাপলে নাওয়া-খাওয়া চুলোয় যায়। সুনন্দ অসিতও উত্তেজিত। টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি ক্রমে যেন একটি সূত্রে বাঁধা পড়ছে। ঘটনাপ্রবাহ ছুটে চলেছে কোন রহস্যময় পরিণতির দিকে, কে জানে?

পানিহাটির বাগানবাড়ি আগের মতোই নিস্তব্ধ। গেট খুলে ভিতরে ঢুকল তিনজনে। সুনন্দ অসিত লক্ষ করল গেট থেকে বাড়ি অবধি পথ চেঁছে পরিষ্কার করা হয়েছে। বাগানও আগের তুলনায় ছিমছাম। বঙ্কিম হাজরা কি বাড়ি আছেন? থাকার কথা নয়। কলকাতার বাইরে গেছেন। তাহলে, এখানে কী করতে এসেছেন মামাবাবু?

সদর দরজার কাছাকাছি পৌঁছে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে কারো দেখা পাবার আশায়। গেট খোলার শব্দ হল। এক ভদ্রলোক ঢুকলেন বাড়িতে। সন্দিগ্ধ চোখে দেখতে লাগলেন তাদের। লম্বা শুটকো, টাক মাথা, নাকের ডগায় চশমা-ঝোলা এক বৃদ্ধ। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। হাতে শৌখিন লাঠি।

কী চাই? তীক্ষ্ম সুরে প্রশ্ন করলেন তিনি।

নমস্কার। বঙ্কিমবাবু আছেন? মানে শ্রীবঙ্কিম হাজরা। বললেন মামাবাবু।

এখানে কোনো হাজরা-ফাজরা থাকে না। আমি থাকি। আমার নাম শ্রীদোলগোবিন্দ ঢোল।

ও। কিন্তু তিনি ছিলেন আগে। আমরা এসেছি একবার,বলল সুনন্দ।

হতে পারে। কত লোকই তো ছিল এখানে। একশো বছরের বাড়ি। আমি ছ-মাস হল ভাড়া নিইচি।

বঙ্কিমবাবু কোথায় থাকেন জানেন? জিজ্ঞেস করলেন মামাবাবু।

“আজ্ঞে না।

“আচ্ছা সেই পুরনো মালি আছে? সে হয়তো বলতে পারে।

ও, সেই আপিংখোর বুড়ো। তাকে ছাড়িয়ে দিইচি। বলল, পুরনো লোক তাই রেখেছিলাম গোড়ায়। দেখি, বেটা অকম্মার টেকি। কেবল বসে বসে ঝিমোয়। ওকে কী কত্তে যে পুষেছিল মাইনে দিয়ে?

অগত্যা তিনজনে ফিরে চলল।

দোলগোবিন্দ অতি অভদ্র। গেট অবধি পৌঁছে তো দিলই না, বরং পেছন থেকে খনখনে গলায় হেঁকে বলল, “ও মশাই, গেটটা বন্ধ করে যাবেন। নইলে গরু-ছাগল ঢুকবে।

ট্যাক্সিতে মামাবাবু চোখ বুজে চুপচাপ বসে রইলেন। একবার কেবল বলে উঠলেন, বুঝলে হে, তিনটে শয়তান ক্রিমিনাল। একসঙ্গে চ