দেখলাম, আকাশের কোণে একখণ্ড জমাট কালো মেঘ। বাতাসের বেগও বেশ বেড়েছে।
দেখতে দেখতে ঘোর কালো মেঘে সারা আকাশ অন্ধকার করে ফেলল। তারপরই হঠাৎ হু হু করে ছুটে এল দমকা ঝড়। আরম্ভ হল বৃষ্টি। বড় বড় জলের ফোঁটা তিরের মতো গায়ে বিধতে লাগল। নিমেষে কী আশ্চর্য পট পরিবর্তন। সেই শান্ত রোমান্টিক সমুদ্র হয়ে উঠল ভয়াল উত্তাল। নীল সাগরের রঙ পাল্টে হয়ে যায় আলকাতরার মতো মসিঘন। ঘন ঘন বিদ্যুতের কশাঘাতে আকাশ যাচ্ছে চিরে। ঢেউয়ের পর ঢেউ ধেয়ে আসছে। বিশাল পর্বতপ্রমাণ। জলের ফসফরাসের অস্পষ্ট সবজে আভায় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে ক্ষ্যাপা সমদ্রের। রূপ। প্রাণের আশঙ্কা না থাকলে এ-সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
বিক্ষুব্ধ জলরাশির মধ্যে আমাদের নৌকো মোচার ভোলার মতো একবার ঢেউয়ের। চূড়ায় লাফিয়ে ওঠে, তারপরই তলিয়ে যায়। আবার ওঠে ভেসে। দিকদিশাহীনভাবে নৌকো অন্ধবেগে ছুটে চলেছে।
আমরা তিনজন পাটাতন আঁকড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। লোনা জল ঢুকছে চোখে-মুখে। মৃত্যুর আশঙ্কায় ভগবানের নাম জপছি আর প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছি, এই বুঝি শেষ।
কিন্তু অদ্ভুত সেই মাঝিদের সাহস ও ক্ষমতা। প্রকৃতির ঐ প্রচণ্ড তাণ্ডবের মধ্যে তারা। মরণপণ লড়াই চালিয়ে চলেছে। আর্তস্বরে আল্লার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে আর। প্রাণপণ চেষ্টায় টাল সামলে নৌকো ভাসিয়ে রাখছে।
একটা তীব্র কাতর আর্তনাদ ঝড়ের গর্জন ছাপিয়ে কানে এল। বিদ্যুতের ক্ষণিক দীপ্তিতে দেখলাম দুজন মাঝি নেই। ঢেউয়ের ঝাঁপটা তাদের সমুদ্রগর্ভে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। বাকি চারজন তখনও নিশ্চিত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষায় মত্ত। বিলীন সঙ্গী দুটির জন্য শোক প্রকাশের সময় নেই তাদের।
কতক্ষণ এইভাবে কেটেছিল খেয়াল নেই। অকস্মাৎ নৌকোর তলদেশের সঙ্গে কঠিন কোনো বস্তুর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হল। নৌকোটা লাফিয়ে উঠল। সেই নিদারুণ ঝাঁকুনিতে আমার মুঠো গেল আলগা হয়ে। সজোরে ছিটকে পড়লাম শুন্যে। তারপর আছড়ে পড়লাম–জলে নয়, শক্ত মাটিতে। আর আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালাম।
ধীরে ধীরে চোখ মেলোম! চোখের পাতা দুটো ভীষণ ভারী, তাকাতে কষ্ট হয়। চাইতেই উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল, আবার চোখ বুজলাম।
ভাবতে চেষ্টা করি কোথায় আমি। চিন্তাটা জট পাকিয়ে যায়। মনে আবছা আবছা ভেসে ওঠে–নৌকোযাত্রা, সমুদ্র, ঝড়, সুনন্দ, মামাবাবু। ফের চোখ খুলি। টান টান করে চাই। আর দেখি কয়েকটা আবলুস-কালো মুখ আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই তাদের চকচকে সাদা দন্তপাটি বিকশিত হয়। হাসছে? সভয়ে আবার আমি চক্ষু মুদি।
বুঝেছি, আমি নির্ঘাত পটোল তুলেছি। সমুদ্রগর্ভে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। তারপর এসে উপস্থিত হয়েছি যমপুরীতে। আমার চারপাশে এরা সব যমদূত।
নাঃ, কী সব ভাবছি যা তা!
প্রাণপণ চেষ্টায় মাথাটা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করি। একটা জলের ঝাঁপটা খেলাম মুখে। কানে আসে কতকগুলো দুর্বোধ্য আওয়াজ, মানুষের কণ্ঠস্বর। কথা বলছে।
তাড়াতাড়ি চোখ খুলি। উঠে বসতে চেষ্টা করি। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। হাত-পা নাড়তে পারছি না। মাথাটা যেন বিশ-মনি পাথর। কোনোরকমে আধশোয়া অবস্থায় যতটা। সম্ভব চারপাশে চাই।
দেখলাম কোনো এক সমুদ্রসৈকতে এসে পড়েছি। আশেপাশে লম্বা লম্বা নারিকেল গাছ। সামনে নীল সাগর। অসীম জলরাশি। ঢেউগুলি একটানা নাচতে নাচতে এসে বেলাভূমিতে ভেঙে পড়ছে। মাথার ওপর প্রভাতী সূর্য। বেলা বোধহয় বেশি নয়। তবে পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশে রোদের বেশ তেজ। আমাকে ঘিরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। আরও প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন মেয়ে-পুরুষ তটভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। তারা সবাই কৃষ্ণকায়। পোশাক স্বল্প। পুরুষদের দেহের উধ্বাঙ্গ খালি। কেবল কোমরে জড়ানো উরু অবধি লম্বা একটুকরো জানোয়ারের বা গাছের ছাল। আবার কারও গায়ে দেখলাম রঙচঙে সুতির কাপড় রয়েছে। মেয়েদের পরনেও ঐসব জিনিস। গলার নিচ থেকে হাঁটু অবধি ঢাকা। মেয়ে-পুরুষ সবারই গায়ে নানারকমের বিচিত্র গয়নাগাঁটি। কড়ি, শঙ্খ ইত্যাদির মালা, বালা। লোহা, পিতল ইত্যাদির গয়নাও দেখলাম। অনুমান হল এরা আফ্রিকার কোনো আদিম উপজাতি।
তারা উত্তেজিত স্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। একটা কথা বার বার কানে এল–মাহিন্ডি, মাহিন্ডি। কথাটার মানে জানি। সোয়াহিলি ভাষায় মাহিন্ডির অর্থ ভারতীয়। পিছনে তাকিয়ে দেখি তীরভূমি ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠেছে। স্বল্প বালুরাশির শেষে নানারকম গাছগাছালির শুরু। উদ্ভিদরাজ্য ক্রমে ঘন হয়েছে। জায়গাটা যে কোথায় কিছু বুঝতে পারলাম না। আফ্রিকার কোনো উপকুলে? কিন্তু চক্রাকার তটরেখা এবং সমুদ্রবেষ্টনী দেখে সন্দেহ হল কোনো দ্বীপ। হঠাৎ মনে পড়ল, সুনন্দ? মামাবাবু?–কই তারা! দুঃসহ আশঙ্কায় চারদিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে দেখি।
ঐ তো!
কতগুলো লোকের ভিড়ের মাঝে মামাবাবু শুয়ে রয়েছেন। পাশে সুনন্দ বসে। নিচু হয়ে কী জানি করছে। ডাকলাম, সুনন্দ! ক্ষীণ স্বর বেরোল।
সুনন্দ চকিতে ফেরে। কে অসিত? উঃ, বাঁচালি বাবা! এখন কেমন লাগছে? উঠিস নে, আমি যাচ্ছি।
মামাবাবুর কী হয়েছে? শুয়ে কেন? নিজের হাত-পাগুলো আস্তে আস্তে নাড়াই।