বইটা খুলে পাতা জোড়া কিম্ভুত আকৃতির এক প্রাণীর ছবি খুলে ধরে বললেন, এই দেখ, ব্রাকিওসরাস। বৈজ্ঞানিকরা কঙ্কালের ওপর অনুমান করে এই চেহারা এঁকেছেন।
দেখলাম অনেকটা জিরাফের আকৃতি। লম্বা গলা, দেহের তুলনায় ছোট মাথা, মোটা লম্বা লেজ মাটিতে লুটোচ্ছে। বিরাট বপু। থামের মতো চারটে পা। সামনের পা দুটো পিছনের পায়ের চেয়ে লম্বা।
মামাবাবু বললেন, আদিম পৃথিবীতে অনেক বিশাল বিশাল প্রাণীর বাস ছিল। ডাঙার জন্তুদের মধ্যে ব্রাকিওসরাস বোধহয় ছিল সবচেয়ে বৃহৎ। এই বিরাট দেহটা নিয়ে ডাঙায় ঘোরাফেরার অসুবিধা হত বলে এরা সাধারণত জলাভূমিতে বাস করত।
কফিতে চুমুক মেরে মামাবাবু ডক্টর হাইনের লিস্টটা মেলে ধরলেন। আমার মাথায় তখনও ব্রাকিওসরাস পাক খাচ্ছে। দুম করে আর একখানা প্রশ্ন ছাড়ি, ওটা মাফিয়া দ্বীপে গেল কী করে? সাঁতরে?
লিস্ট থেকে চোখ সরিয়ে মামাবাবু বললেন, এরা অবশ্য কিছুটা সাঁতার জানত কিন্তু সাঁতারের দরকার হয়েছিল কিনা সন্দেহ আছে।
মানে?
মানে হয়তো হেঁটেই গিয়েছিল। স্রেফ চার পায়ে হেঁটে। মামাবাবু মুচকি হাসেন।
জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে কি? আমি হতভম্ব।
তখন ওখানে সমুদ্র ছিল কে বলেছে? গণ্ডোয়ানা ল্যান্ড থিওরির কথা শোননি? অনেকে মনে করেন আদিম যুগে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ভারতবর্ষ, অস্ট্রেলিয়া সব জুড়ে এক প্রকাণ্ড মহাদেশ ছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছে গণ্ডোয়ানা ল্যান্ড। জুরাসিক যুগের কিছু আগে এই মহাদেশে ফাটল ধরে। কয়েকটি বড় বড় খণ্ডে ভাগ হয়ে যায় এবং ক্রমে খণ্ডগুলি পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তাদের মাঝখানে সৃষ্টি হয় সমুদ্র। ব্যাপারটা ঘটতে বেশ সময় লেগেছিল। প্রায় দশ-বারো কোটি বছর ধরে একটু একটু করে সরে গিয়ে ভূ-খণ্ডগুলি এখনকার পজিশনে এসে দাঁড়ায়।
কোনো মানে হয় আলাদা হয়ে যাবার! আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বলি। তাহলে আর সমুদ্র-টমুদ্রের ঝামেলা থাকত না, দিব্বি ডাঙাপথে ভারত থেকে আফ্রিকা আসা যেত।
হুঁ, জাহাজে চড়তে হত না, কত সুবিধে। হাওড়ায় ট্রেনে চড়ো, সোজা ডার-এস-সালামে এসে নামো। সুনন্দ পাশের ঘর থেকে একটি মন্তব্য ছাড়ে।
তার লক্ষ্যস্থল আমি। জাহাজে আসতে একদিন আমি ঢেউয়ের দোলায় গা গুলিয়ে সামান্য অসুস্থ হয়েছিলাম। তাই এই বিদ্রূপ।
কিন্তু প্রমাণ স্যার? কী করে বুঝল লোকে এ-দেশগুলো জোড়া ছিল? ওকেলোর বিশ্বাস হয় না।
প্রমাণ অনেক আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদের চিহ্ন। এমন কিছু একই জাতের বিশেষ ধরনের প্রাণী এবং উদ্ভিদের অস্তিত্ব এইসব সুদূর দেশগুলিতে পাওয়া গেছে, যাদের পক্ষে আজকের দিনের বিশাল জলপথের বাধা পেরিয়ে কিছুতেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া সম্ভব নয়। এরা নিশ্চয়ই স্থলপথেই ছড়িয়ে পড়েছিল।
অস্ট্রেলিয়া আর আফ্রিকা এক মহাদেশের মধ্যে?–ওকেলোর যেন তত্ত্বটা তবুও ঠিক হৃদয়ঙ্গম হয় না।
কেন হবে না? আদিম পৃথিবীর সঙ্গে আজকের জগতের মিল কতটুকু? তাছাড়া এই ছাড়াছাড়ি হতে বড় কম দিন লাগেনি ভেবে দেখ। অবশ্য এমনও হতে পারে, তখন দেশগুলো খুব কাছাকাছি ছিল আর স্থলপথের সেতু দিয়ে তাদের পরস্পরের সঙ্গে যোগ ছিল। মোট কথা, এদের মধ্যে যে ডাঙাপথে যোগ ছিল এ-কথাটা প্রায় সব বিজ্ঞানীই মেনে নিয়েছেন।
আমরা আরও প্রশ্ন তুলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মামাবাবু থামিয়ে দেন, আজ আর নয়, আর একদিন হবে। অনেক কাজ বাকি।
লিস্টটা পড়তে পড়তে মামাবাবু চেঁচিয়ে ওঠেন, সুনন্দ, হাইনের কাণ্ডটা দেখ। কী একখানা অর্ডার। লিখেছেন–আসার সময় কয়েকটা ডাইনামাইটের স্টিক সঙ্গে নিয়ে আসবেন। এ জায়গায় মাটির নিচে পাথরের স্তর খুব প্রাচীন। অনেক প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে জায়গাটা জুড়ে অনেকগুলো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথরের চাই পড়ে থাকায় খুঁড়তে অসুবিধা হচ্ছে। ব্লাস্টিং করে চাইগুলো ভেঙে ফেলব। ওকেলোকে বললে ডাইনামাইট জোগাড় করে এনে দেবে। অতএব বৎস ওকেলো, তোমার গুরুদেবের আদেশ তো শুনলে? এখন আজ্ঞা পালনে তৎপর হও। আমি বেরোচ্ছি, কিছু কেনাকাটা দরকার।
.
০৪.
আমরা রুফিজি নদীর মোহনায় এসে উপস্থিত হলাম। এখান থেকে একটা ধাওয়ে চেপে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মাফিয়া যাব। ধাও একরকম সমুদ্রগামী নৌকো। শত শত বছর ধরে এই নৌকোগুলি যাত্রী ও মালপত্র নিয়ে আফ্রিকা ও ভারতবর্ষের উপকূলে যাতায়াত করছে। মোহনায় একটি নৌকো নিয়ে ছজন আরব মাঝি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পালতোলা নৌকো। আজকাল অবশ্য মোটর-ইঞ্জিন বসানো ধাওয়ের চলন হয়েছে, কিন্তু তাড়াহুড়োয় ব্যবস্থা করার ফলে কোনো মোটরলঞ্চ বা মোটর-ইঞ্জিন চালিত ধাওয়ের বন্দোবস্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
মামাবাবু বললেন, কিছুটা সময় বেশি নেবে। এখন সকাল নটা, সন্ধের আগে পৌঁছতে পারব আশা করছি। তবে অনুকুল বাতাস পাব, তাই আরও তাড়াতাড়ি যাওয়া যেতে পারে। আমি আর সুনন্দ বেজায় খুশি। দিনটা একটু মেঘলা করেছে। কবিত্ব করতে করতে দিব্যি সমুদ্র-বিহার জমাব। মালপত্র তোলা হলে নৌকো ছেড়ে দিল।
প্রায় আধাআধি পথ পেরিয়েছি। মাঝিরা ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাতে লাগল। একজন বলল, হুজুর আকাশের গতিক বড় সুবিধের নয়। তুফান আসতে পারে। তারা তাড়াতাড়ি পালটা নামিয়ে ফেলল।