উইলিয়াম হার্ডি আমাদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, আপনারা সার্ভেতে বেরিয়ে যদি কেনিয়া যান, দীনের কুটিরে একবার পদার্পণ করবেন।
ডক্টর হাইনে পরদিন মাফিয়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আর তার পরের দিন মামাবাবু বেরলেন লেকচার-টুরে। ব্যস, আমি সুনন্দ তখন বাঁধন-ছাড়া মুক্ত জীব। হাইনের জিপগাড়িটা চালিয়ে আমরা শহরের বাইরে লম্বা লম্বা পাড়ি জমাতে লাগলাম। ওকেলোকে বললাম, রাখো তোমার মিউজিয়াম। তোমার বস্ ফিরে এলে যত ইচ্ছে ডিউটি কোরো। আপাতত আমাদের ক-দিন আফ্রিকা দেখাও। একটু গাই-ই করে সে রাজি হয়ে গেল।
শহর ছাড়িয়ে অনেকখানি গেলে আরম্ভ হয় পথের দু-পাশে দিগন্তবিস্তৃত তৃণভূমি। সেখানে অজস্র তৃণভোজী জন্তু দলে দলে চরে বেড়ায় নানা জাতের হরিণ, লম্বা গলা জিরাফ, সাদা-কালো জার্সি আঁটা জেব্রারা। অস্ট্রিচদের কৌতূহল বেশি। অন্য জন্তুদের মতো গাড়ির আওয়াজে দূরে সরে যায় না। গলা বাড়িয়ে চোখ পাকিয়ে দেখে–এমন বদখৎ শব্দ করতে করতে আসছে, কে হে বটে?
একদিন দূরে কয়েকটা বুনো মোষ দেখেছিলাম। ওকেলো কাছে যেতে বারণ করল। বড় বদমেজাজী প্রাণী। তবে সিংহ দেখা হল না। ওকেলে বলল, সেরেনগেটি রিজার্ভ ফরেস্টে যাও, যত খুশি সিংহ দেখবে। একেবারে পোযমানা হয়ে গেছে! মানুষ দেখলে কেয়ার করে না। সেরেনগেটি অনেক দূরে, ঠিক হল মামাবাবু ফিরে এলে যাব।
কটা দিন তোফা কাটল। সারাদিন টো-টো করি; সন্ধেবেলা বাড়ি এসে রাঁধনে ইসমাইলের অমৃত সমান গরম খানা। তারপর টেনে ঘুম।
.
০৩.
মামাবাবু ডার-এস-সালাম ফিরলেন ছ-দিন পরে। আমি ও সুনন্দ তখন বারান্দায় বসে।
ট্যাক্সি থেকে নেমে মামাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সব ভালো তো? উঃ, খুব ঘুরেছি। একেবারে হারিকেন টুর। তারপর ডক্টর হাইনের খবর কী? ফিরেছেন?
না। সুনন্দ জবাব দেয়।
কোনো চিঠিপত্র?
কয়েকটা চিঠি আছে আপনার নামে। একটা এসেছে মাফিয়া থেকে, হয়তো হাইনের চিঠি।
বেশ চল, দেখছি।
জিনিসপত্র রেখে হাত-মুখ ধুয়ে, পোশাক পাল্টে মামাবাবু খাবার ঘরে ঢুকে হাঁক দিলেন, ইসমাইল, এককাপ গরম কফি দাও। বড্ড টায়ার্ড।
সুনন্দ তাকে তিনটে চিঠি দিল।
একটা খাম বেছে তুলে নিয়ে মামাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এই তো ঠিকানায় দেখছি হাইনের হাতের লেখা। অন্য দুটি চিঠিতে একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি খামটা খুললেন।
চিঠি জর্মন ভাষায় লেখা। মামাবাবু গভীর আগ্রহে তার পাতার ওপর ঝুঁকে পড়েন। আমরা দুজন উৎসুক চিত্তে তার মুখপানে চেয়ে থাকি।
পড়তে পড়তে হঠাৎ মামাবাবু বলে ওঠেন, বাঃ, জোর খবর দিয়েছে ডেয়ারিং বিল।
সুনন্দ তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করে, কী লিখেছেন হাইনে? ফসিলটা কীসের, কিছু বুঝতে পেরেছেন?
হুঁ, পেরেছেন। কোনো অতিকায় ডাইনোসরের। দাঁড়াও বলছি সব। আগে পুরোটা পড়ে নিই।
পশ্চিমের খোলা জানলাটা দিয়ে শেষ বিকেলের রশ্মি এসে ঘরে পড়েছে। বাইরে দেখা যাচ্ছে মিউজিয়ামের বাগানের একাংশ। ঘন পাতা ভরা বড় বড় ডালগুলোর ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো গোধূলির আকাশ। মস্ত ডাইনিং রুমে আমরা তিনটি প্রাণী। মাথার ওপরে ঝোলানো বৈদ্যুতিক আলোয় মেহগনি কাঠের কালো পালিশ করা টেবিলটা চকচক করছে। সামনে বসে মামাবাবু পত্র পাঠে নিমগ্ন। উল্টোদিকে আমি ও সুনন্দ পাশাপাশি বসে। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ। শুধু রান্নাঘর থেকে টুংটাং কাপ-ডিসের আওয়াজ ভেসে আসছে।
সুনন্দ প্রস্তুত হও। মামাবাবু চিঠি থেকে মুখ তুললেন। আমরা পরশু দিন মাফিয়া রওনা দেব। ডক্টর হাইনে অনুরোধ করেছেন, আমরা যেন যত শীঘ্র সম্ভব মাফিয়া গিয়ে তার সঙ্গে কাজে যোগ দিই। পুরো ফসিলটা উদ্ধার করতে হবে।
কিন্তু কী পেয়েছেন তিনি, বললেন না তো? সুনন্দ প্রশ্ন করে। পেয়েছেন কঙ্কালের খুলি এবং আরও কতকগুলো অংশ। একটা পাজরার হাড় পেয়েছেন প্রায় আট ফুট লম্বা। দেখো আমি বলে দিচ্ছি এ নির্ঘাত ব্রাকিওসরাস। এত বড় পাজরের হাড় আর কোনো প্রাণীর হতে পারে বলে তো জানি না। যাও তুমি এখুনি। গোছগাছ শুরু করে দাও। আমি কফিটা শেষ করি আর লিস্টটা পড়ে নিই। হাইনে পাঠিয়েছেন–যাবার সময় কয়েকটা জিনিস নিয়ে যেতে হবে।
সুনন্দ পাশের ঘরে যাওয়া মাত্র আমি জিজ্ঞেস করি, ব্রাকিওসরাস কী মামাবাবু?
শুনলে তো একধরনের অতিকায় ডাইনোসর। জুরাসিক যুগের অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় সতেরো-আঠারো কোটি বছর আগেকার সরীসৃপ। পূর্ব আফ্রিকায় ব্রাকিওসরাসের ফসিল পাওয়া গেছে।
কত বড় হতো এগুলো?
তা ধর একটা পূর্ণবয়স্ক ব্রাকিওসরাস সত্তর-আশি ফুটেরও বেশি লম্বা হত বলে অনুমান করা হয়।
আরে বাস, ওজন কত? মামাবাবুর সাড়া পেয়ে ওকেলো নিঃশব্দে এসে ঘরে ঢুকেছিল। সে বিস্ফারিত চক্ষে প্রশ্ন করে।
প্রায় পঞ্চাশ টন হত। একটা হাতির ওজন কত হবে, বলতে পার?
ওকেলো ভেবেচিন্তে বলে, ম্যাক্সিমাম ছ-সাত টন।
তবেই বুঝে দেখ এদের বপূখানা কীরকম ছিল? অনায়াসে একটা বাচ্চা হাতিকে ইনি জলযোগ করতে পারতেন। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, ব্রাকিওসরাস হাতি-টাতি খেত না। কারণ তখনও হাতি সৃষ্টি হয়নি এবং এরা ছিল উদ্ভিদভোজী।
কেমন দেখতে ছিল? এবার আমার পালা।
আমার পড়ার টেবিলের ওপর একটা বই দেখবে লাল মলাট, বেশ মোটা, নিয়ে এসো। মামাবাবু বলেন।