যাহোক বাধ্য হয়ে তখন আমরা বিদায় নিলাম। আমার মনে কিন্তু কৌতূহল চাড়া দিয়ে উঠল। মূর্তিটা দেখতে কেমন? গ্রামবাসীদের চোখের সামনে দিয়ে, তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে ঘাসবনের পথ বেয়ে অনেকখানি সোজা গিয়ে আমরা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। তারপর রাত্রি নামে অন্ধকার ঘন হয়। আমি আমার সঙ্গীকে অপেক্ষা করতে বলে ফের গ্রামের পথে ফিরলাম।
দূর থেকে সমবেত কণ্ঠের হুঙ্কার আর ঢাকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। ঘাসবন আর ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি গ্রামের কাছে এসে উপস্থিত হলাম। একটা ঝোঁপের আড়ালে গোপনে বসে দেখলাম–প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। আগুনের একধারে আরম্ভ হয়েছে উন্মত্ত নাচ। বড় বড় ঢাক বাজছে। আর অগ্নিকুণ্ডের পাশেই সেই বেদির গায়ে চৌকো পাথরের খণ্ডটা ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো। পাথরের গায়ে আঁকা মূর্তিটা ভালো করে দেখতে বায়নোকুলার চোখে লাগালাম।
যে অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম তা জীবনে ভুলব না।
হাত দেড়েক লম্বা, হাতখানেক চওড়া, ইঞ্চি চারেক পুরু একটা কালচে পাথরের খণ্ডের গা কেটে এক কিম্ভুত কঙ্কাল আকৃতির রূপ দেওয়া হয়েছে। মূর্তির রঙ কিন্তু কালো নয়। হালকা হলুদ রং করা। আফ্রিকার আনাচে-কানাচে বহু দুর্গম জায়গায় আমি ঘুরেছি। বহু উপজাতির গ্রামে গেছি, তাদের বিগ্রহ দেখেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুতদর্শন ভাস্কর্য কোথাও চোখে পড়েনি।
মামাবাবু হঠাৎ প্রশ্ন করেন, ওরকম কালচে রঙের পাথর ওরা পেল কোথায়? কাছাকাছি কোথাও ছিল নাকি?
হ্যাঁ। কাছে এক উপত্যকায় ঐরকম পাথর আমি দেখেছি। বোধহয় সেখান থেকেই পাথরের খণ্ডটা ওরা জোগাড় করে।
তারপর? তারপর কী হল? আমি ও সুনন্দ অধীর হয়ে পড়ি।
হ্যাঁ, তারপর ঘণ্টাখানেক ধরে গোপনে তাদের উৎসব এবং দেবতাকে দেখে আমি নিঃশব্দে ফিরে গেলাম।
এই কাহিনি হয়তো এখানেই ইতি হত, কিন্তু গোলমাল পাকালো স্লীমান। এ-ঘটনার চার মাস পরে তার সঙ্গে আমার দেখা। সেই অদ্ভুত বিগ্রহের গল্প শুনে সে ক্ষেপে উঠল, ঐ মূর্তি তার চাই।
এ-ব্যাপারে আমার মোটেই উৎসাহ ছিল না। জানতাম ও-মূর্তি জোগাড় করা রীতিমতো দুঃসাহসিক কাজ। কেন মিছিমিছি ঝাটে জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু স্লীমানের জেদ চেপে গেছে। তার অনুরোধে বাধ্য হয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে আবার সেই গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
গ্রামে পৌঁছে আমরা স্তম্ভিত। কুটিরগুলো ভাঙাচোরা; জনমানবশূন্য। যেন একটা প্রলয় ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। অনেক খুঁজে কয়েকজনকে আবিষ্কার করলাম–সবাই অথর্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। জানলাম পাশের এক উপজাতির সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। তারাই অতর্কিতে আক্রমণ করে গ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছে। অনেকে নিহত বা বন্দী হয়েছে। বাকিরা। পালিয়েছে। তাদের বিগ্রহের ভাগ্যে কী ঘটেছে তারা জানে না।
গেলাম সেই আক্রমণকারী উপজাতির গ্রামে।
তারাও মূর্তিটার কোনো খবর বলতে পারল না। খুব সম্ভব যারা পালিয়েছে তারাই সঙ্গে নিয়ে গেছে।
মুর্তিটা সংগ্রহ করতে না পারায় স্লীমান অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল। আমি কিন্তু মনে মনে খুশি হই। চাইলে কেউ তাদের দেবতাকে দেবে না। অর্থাৎ চুরি করতে হত এবং নির্ঘাত এক ফ্যাসাদ বাধত। তাছাড়া বিগ্রহ চুরি ব্যাপারটা আমি ঠিক পছন্দ করতাম না, যদিও পাল্লায় পড়ে দু-একবার করেছি।
ডেয়ারিং বিল সেদিন আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেলেন।
প্রচুর রকমারি সুস্বাদু খাদ্যবস্তুর আয়োজন করা হয়েছিল। বিল পরম তৃপ্তিভরে খাওয়া শেষ করে বললেন, আঃ! দারুণ খাওয়ালেন। জংলি মানুষ, মাঝে মাঝে শহরে এলে গণ্ডেপিণ্ডে গিলে যাই। স্লীমানের কাছে যখন আসতাম সেও আমাকে ভূরিভোজ করাত। তার প্রতিদানে আমি প্রত্যেকবার তার মিউজিয়ামের জন্য কিছু-না-কিছু নিয়ে এসেছি।
বটে! তাহলে আমাদের বেলা শূন্য হাত কেন? ডক্টর হাইনে হেসে বললেন। কী দোষ করলাম আমরা। আমাদের নেমন্তন্নটা বুঝি হেয়? স্লীমানের স্ট্যান্ডার্ডে হয়নি?
আরে না না, কী যে বলেন! বিল প্রবল প্রতিবাদ করে। সত্যি চমৎকার হয়েছে রান্নাগুলো। তারপর একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বললেন, তাছাড়া আপনাদের জন্য যে খালি হাতে এসেছি জানলেন কী করে? একটা খবর আছে। তবে জানি না আপনাদের কতটা কাজে লাগবে।
কী খবর? বলুন শিগগির।
দেখুন, আমি পূর্ব উপকূলের কাছে মাফিয়া দ্বীপ থেকে আসছি। একটা কাজে গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকজন গ্রামবাসী রাস্তা তৈরির জন্য খুঁড়তে খুঁড়তে কয়েকটা অদ্ভুত আকৃতির পাথর পায়। দৈবাৎ আমি তখন সেখানে ছিলাম। পাথর কটা দেখে আমার সন্দেহ হয় এগুলো সাধারণ পাথর নয়, ফসিল। কোনো আদিম বিশাল জন্তুর হাড় জমে পাথর হয়ে গেছে। আমি গ্রামের লোকদের বলে-কয়ে রাজি করিয়েছি যেন তারা। পাথরগুলো যত্ন করে রেখে দেয়। আর খোঁড়াখুঁড়ি কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখে। আমি গিয়ে বিশেষজ্ঞদের এ-বিষয়ে বলছি। তারা এসে পরীক্ষা করে দেখুক।
ডক্টর হাইনে উত্তেজিত স্বরে বললেন, আপনি তো মশায় বেশ! এমন দামি খবরটা এতক্ষণ স্রেফ চেপে রেখেছিলেন!
বিল বললেন, আমি তো এ-ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই। ওগুলোর কোনো মূল্য আছে। কিনা কে জানে! আমার ভুল হতে পারে। তাই এসেই দুম করে ফসিলের খবর ঘোষণা করতে সংকোচ হচ্ছিল।
তারপর হাসতে হাসতে বললেন, খবরটা শুনেই আপনারা যেরকম ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সকালে বললে কী আর দুপুর অবধি আমার সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটাতেন! ব্রেকফাস্ট খাইয়েই হয়তো বিদেয় দিতেন। তা যাক, কয়েক ঘন্টা সময় নষ্টে কোনো ক্ষতি হবে না। ঠিকানা দিচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে যান।