ছ-সাত দিন লাগবে মামাবাবুর বক্তৃতা শেষ করতে। তারপর আমরা টাঙ্গানিকার একটা বিশেষ জায়গায় গিয়ে ক্যাম্প ফেলব। ডক্টর হাইনে সেখানে নাকি একটি অতি প্রাচীন গুহার সন্ধান পেয়েছেন। তাতে নাকি প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কিছু কিছু চিহ্ন তিনি দেখেছেন। কাজেই সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি হবে, আদিম পৃথিবীর মানবজাতির ইতিহাস আবিষ্কারের চেষ্টা চলবে।
আমি এই সুযোগে ডার-এর-সালাম ভালো করে ঘুরে দেখে ফেললাম। মাঝে মধ্যে সনন্দ মামাবাবুর সাকরেদিতে ফাঁকি দিয়ে সঙ্গে জোটে। আমাদের গাইড হচ্ছে ডক্টর হাইনের অ্যাসিস্ট্যান্ট-সাড়ে ছফুট লম্বা কাফ্রি যুবক ওকেলো।
মাঝারি শহর। জাহাজঘাটায় অগুন্তি নৌকো, লঞ্চ ও ছোট-বড় জাহাজ সর্বদা গিসগিস করছে। শহরে পাঁচমিশেলি জাতের ভিড়। আফ্রিকান ছাড়াও এখানে কিছু ইউরোপীয় এবং বহু ভারতীয় ও আরবদেশীয় লোকের বাস। বাঙালি অতি অল্প। ব্যবসা বা খেতখামার করে তারা অনেকেই পূর্ব আফ্রিকায় কয়েক পুরুষ ধরে বাস করছে। পূর্ব আফ্রিকার অন্যান্য জায়গার মতো এখানকার প্রধান ভাষা সোয়াহিলি। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষিত লোকেই অল্প-বিস্তর ইংরেজি জানে।
আসার আগে আমি ও সুনন্দ মামাবাবুর কাছে সোয়াহিলি ভাষায় কিছুটা তালিম নিয়েছিলাম। ভাষাটা আরও রপ্ত করতে আপাতত ওকেলোকে পাকড়ালাম। আমরা ওকেলোর সঙ্গে সমস্ত বাক্যালাপ চালাতে লাগলাম সোয়াহিলিতে। সেই দুর্বোধ্য সোয়াহিলি শুনতে শুনতে বেচারা ভালোমানুষ একেবোর প্রাণ ওষ্ঠাগত। অর্ধেক মর্ম উদ্ধার করতে পারে না। ক্রমাগত ভুল শুনে তার নিজেরই মাতৃভাষা গুলিয়ে যেতে লাগল।
.
০২.
আরও দুদিন কেটেছে।
আমরা প্রত্যেকদিন ডক্টর হাইনের সঙ্গে সকালবেলা একটা ঝাকড়া বাদামগাছের নিচে চেয়ার-টেবিল পেতে প্রাতরাশ করি। তৃতীয় দিন চায়ের আসরে যোগ দিতে গিয়ে দেখি একজন অপরিচিত ব্যক্তি বসে হাইনের সঙ্গে গল্প করছেন।
হাইনে বললেন, আসুন আলাপ করিয়ে দিই–ইনি হচ্ছেন–
আগন্তুক তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ইয়া চওড়া একখানা পাঞ্জা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার নাম উইলিয়াম হার্ডি।
না না, বলুন ডেয়ারিং বিল। যে নামে আপনাকে সারা পূর্ব আফ্রিকা চেনে–হাইনে বললেন।
উইলিয়াম হার্ডি ওরফে ডেয়ারিং বিল, অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, তা বটে, তা বটে, ও-নামটা বড্ড চালু হয়ে গেছে। আসল নামটা বোধহয় ভুলেই গেছে লোকে।
হাইনে বললেন, মিস্টার হার্ডি একজন বিখ্যাত শিকারী। দেশ-স্কটল্যান্ড। তবে আফ্রিকাতেই স্থায়ীভাবে আড্ডা গেড়েছেন। বোধহয় আর দেশে ফেরার ইচ্ছেও নেই। কী বলেন–মিস্টার হার্ডি?
ডেয়ারিং বিলের ঠোঁটের কোণে একটা পাইপ কামড়ানো ছিল। পাইপটা হাতে নিয়ে বললেন, রাইট! ত্রিশ বছর আফ্রিকায় আছি। বনে বনে ঘুরে জংলি বনে গেছি। এখন আপনাদের সভ্য জগতে ফিরে গিয়ে আর খাপ খাওয়াতে পারব না। তাই এখানেই থেকে গেছি। ভালোবেসে ফেলেছি দেশটা। আমি একা মানুষ। কেনিয়ায় নাইভাসা হ্রদের কাছে। একটি ছোট্ট কুটির বানিয়ে বাস করছি। আজকাল অবশ্য শিকার ছেড়ে দিয়েছি। নেহাৎ প্রয়োজন না হলে রাইফেল ধরি না। অনেকদিন ঘুরেছি কিনা, তাই পা দুটোকে রেস্ট দিচ্ছি। বাড়িতে বসে খাই-দাই বই পড়ি। আত্মজীবনী লিখি। আর কুটিরের বারান্দায় বসে বসে দেখি আফ্রিকার রহস্যময় প্রকৃতি। হ্রদের নীল জল। দূরে পাহাড়-জঙ্গলের রেখা। অজস্র জীবজন্তু, পাখি। আর নমাসে ছমাসে দরকার পড়লে শহরে আসি। দিব্যি কাটছে।
ডেয়ারিং বিল-এর চেহারা রোদে-জলে পোড় খাওয়া দীর্ঘ পাকা বাঁশের মতো; বয়স ধরা যায় না। মুখের দিকে তাকালে প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঘন ভুরুর নিচে একজোড়া উজ্জ্বল নীল চোখ। দৃঢ় চোয়াল। উন্নত নাসা। মাথায় কোকড়া চুল, রগের কাছে সামান্য পাক ধরেছে।
মিউজিয়ামের অনেক সংগ্রহ বিলের পূর্বপরিচিত। স্পেসিমেনগুলি সংগ্রহের ইতিহাস তিনি বলতে থাকেন।
শেষ ঘরটায় ঢুকে সেই বিচিত্ৰদৰ্শন মূর্তিগুলোর সামনে বিল স্তব্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। ঘন ঘন পাইপ টানছেন। মুখ দেখে মনে হল যেন অতীত স্মৃতির রোমন্থনে তার মন তোলপাড় হচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এই মূর্তিগুলোর পরিচয় জানেন কি?
মনে হচ্ছে আফ্রিকার নানা উপজাতির শিল্প কাজ।–হাইনে বলেন।
হ্যাঁ। তবে শুধু শিল্পকর্ম বললে ভুল হবে। এদের মধ্যে অনেকগুলি ছিল আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতির উপাস্য দেবতা।
তাই নাকি? আমরা নতুন আগ্রহে মূর্তিগুলোকে দেখি।
বিল বলে চলেন, স্লীমানের এই এক অদ্ভুত খেয়াল ছিল। উপজাতিদের বিগ্রহমূর্তি ছলে-বলে-কৌশলে সংগ্রহ করা। এজন্য কয়েকবার তাকে ভীষণ বিপদেও পড়তে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, একটা মূর্তি সে জোগাড় করতে পারেনি। সেটা মিউজিয়ামে আনতে না পারার আপশোস সে কখনো ভোলেনি।
কীসের মূর্তি? প্রশ্নটা আমাদের সকলের গলা থেকে একই সময় বেরিয়ে এল।
সে এক অদ্ভুত বিগ্রহ। আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। পাইপে তামাক টানতে টানতে বিল বলেন, প্রায় সতেরো-আঠারো বছর আগেকার কথা। একবার ঘুরতে ঘুরতে আমি টাঙ্গানিকার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে উপকূলের কাছাকাছি এক উপজাতির গ্রামে গিয়ে হাজির হই। পৌঁছলাম যখন বিকেল। সেদিন গ্রামে কোনো উৎসবের আয়োজন হচ্ছিল। মস্ত অগ্নিকুণ্ড জ্বালাবার জোগাড়যন্ত্র চলেছে। গ্রামের সব মেয়ে-পুরুষ জড়ো হচ্ছে চারপাশে। একটু পরেই আরম্ভ হবে উৎসব। আমার একজন সঙ্গী ছিল। সেও আফ্রিকান, কিন্তু ভিন্ন উপজাতির লোক। আমরা দুজনেই বেজায় ক্লান্ত। ইচ্ছে ছিল রাতটা ওখানে আগুনের পাশে বসে নাচ-গান দেখে কাটিয়ে দিই। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। একটা ঢ্যাঙা মতো লোক, বোধহয় তাদের উইচ-ডক্টর–আমাদের বলল চলে যেতে। উৎসবের সময় তাদের বিগ্রহ উন্মোচিত করা হবে। সেই পূণ্য দেবমূর্তি দর্শন করা নাকি কোনো বিদেশির পক্ষে নিষিদ্ধ। স্বাভাবিক কৌতূহলবশে সেই দেবমূর্তির সন্ধানে চারদিকে চাইতে দেখি যেখানে অগ্নিকুণ্ড তৈরি হচ্ছে সেখানে কাঠের গাদার পাশে বেদির ওপর একখানা চৌকো বড় পাথর শোয়ানো। চামড়া দিয়ে ঢাকা। ঐ পাথরের গায়েই নিশ্চয় কোনো মূর্তি খোদাই করা আছে।