ডক্টর হাইনে ও ওকেলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন।
মামাবাবু শেষ করামাত্র হাইনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন।
ওয়ান্ডারফুল! এক নম্বর–অদ্ভুত তীক্ষ্ণ আপনার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি। বায়নোকুলারের ভিতর দিয়ে অতটুকু সময়ে চিনতে পারলেন কী করে?
না, ঠিক চিনতে তো পারিনি।
ঐ হল। আরকিঅপটেরিক্স ভেবেছিলেন। সেটাই বা ক-জনের মাথায় আসবে। দ্বিতীয় নম্বর–হাইনে মিটমিট করে আমাদের দিকে তাকাতে থাকেন–দুষ্টু বুদ্ধিতেও আপনি বড় কম যান না। আচ্ছা প্যাঁচ কষে বেচারা কামাউয়ের দেবতাটিকে হাতালেন। সব্বাইকে দেশছাড়া করে ছাড়লেন মশাই।
সমবেত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সবাই।
হাইনে মহাখুশি হয়ে বলেন, প্রোফেসর ঘোষ, চালিয়াত মিলার এবার চিৎপটাং।
.
১৪.
স্থির হল কাল আমরা ফিরে যাব। হাইনে দ্বীপটা দেখতে উৎসাহ প্রকাশ করলেন। মামাবাবু তাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন।
সকাল থেকে যাবার তোড়জোড় শুরু হল।
দফায় দফায় মালপত্র লঞ্চে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল। মামাবাবু বললেন, আমি একদম শেষে যাব স্পেসিমেনের বাক্সগুলি এবং ফসিল নিয়ে। আমরাও একে একে লঞ্চে উঠি। মাঝি চারজন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বাব্বাঃ, জংলিগুলোর খপ্পর থেকে বেঁচে বেরোলাম তাহলে?
হাইনের ইচ্ছে ছিল মামাবাবুর সঙ্গে যাবেন। কিন্তু মামাবাবু আপত্তি করলেন, না না আপনি আগে চলে যান। জিনিসগুলো গুছিয়ে রেখে স্পেসিমেন আর ফসিলের জন্য একটু ভালো জায়গা করে রাখবেন। ঢেউয়ের দোলায় কোনো ভারী জিনিস যেন ওদের ঘাড়ে গড়িয়ে না পড়ে।
লাস্ট ট্রিপ।
লঞ্চ চালক পেড্রো ইঞ্জিন চালু করেছে। ঘোর গর্জনে থরথর করে কাঁপছে লঞ্চ। মামাবাবু এলেই সে লঞ্চ ছেড়ে দেবে।
বালির ওপর শোয়ানো মুঙ্গুকে মামাবাবু আস্তে আস্তে তুলে ধরলেন। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় ফসিলের গায়ে জড়ানো কাপড়ের টুকরোটা হুস্ করে উড়ে গেল। মুহূর্তে ডানা মেলে উধাও হয়ে গেল কাপড়টা। মামাবাবু বোকার মতো চেয়ে রইলেন। লঞ্চে আমরা খুব একচোট হেসে উঠি এই দৃশ্য দেখে।
আমাদের হাসি থামতে না থামতে শুনি এক চিৎকার। মামাবাবু বা খালাসিদের গলা নয়। অপরিচিত কণ্ঠস্বর। এক নয়, একাধিক।
সমুদ্রতীরে মামাবাবুর কাছ থেকে প্রায় শতখানেক গজ দূরে কিছু ঝোঁপঝাড়ের অন্তরাল থেকে যেন জাদুবলে আবির্ভূত হল দুটি কৃষ্ণকায় মূর্তি। তারা চেঁচিয়ে ওঠে, মুঙ্গু মুঙ্গু! তারস্বরে কী সব জানি বলতে লাগল।
হাইনে আশ্চর্য হয়ে বলেন, কে লোক দুটো? দ্বীপের আদিবাসী? এরা বুঝি পালায়নি? কী বলছে?
আমরা দেখেই চিনেছি–সেই মানিকজোড়। ত্যাড়া-ব্যাঁকা। ত্যাড়াকে চিনতে না পারলেও ব্যাঁকার ধনুকের মতো পা ভুল হবার নয়। মুঙ্গুকে চুরি করতে দেখলে অন্য কেউ বোধ হয় খুশিই হত। কিন্তু এ দুটো কামাউয়ের চেলা। হয়তো বাধা দেবে।
আমরা বললাম, ওরা মুঙ্গুকে চিনতে পেরেছে। এতক্ষণ লুকিয়ে দেখছিল। মুঙ্গুকে ফিরিয়ে দিতে বলছে। শাসাচ্ছে।
ত্যাঁড়া-ব্যাঁকা দ্রুতবেগে বালির ওপর দিয়ে দৌড়ে আসতে লাগল।
মামাবাব মুহূর্তে হৃদয়ঙ্গম করলেন ব্যাপারটা। চটপট ফসিল বগলদাবা করে জলে নামলেন। ঝপঝপ করে ঢেউ ভেঙে এগোতে থাকেন। নৌকো রয়েছে প্রায় এক কোমর জলে।
নৌকোয় পৌঁছে ফসিলটি সাবধানে ভিতরে শুইয়ে তিনি লাফিয়ে উঠলেন। খালাসি দজন তৈরি ছিল। ঝপাং করে দাঁড় পড়ল। ঢেউ কেটে তীব্রবেগে বোট গভীর জলে এগিয়ে গেল।
লোক দুটো যখন জলের ধারে হাজির হল নৌকো অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সাঁতার কেটে ধরা যাবে না তাকে।
ওকি! হতবাক আমরা লক্ষ করি লোক দুটো ধনুকে তির বসিয়ে জ্যা টানছে।
উল্কাগতিতে তির ছুটল। অব্যর্থ নিশানা।
আ আ আ! একজন খালাসি কাতর আর্তনাদ করে উঠল। তার বাহুমূলে তির লেগেছে। ফলাটা গেঁথে গেছে মাংসে। তার সঙ্গী একটানে তিরটা তুলে নেয়। জামাটা লাল হয়ে ওঠে তাজা রক্তে। মুঠো আলগা হয়ে তার দাঁড়টা জলে ভেসে গেল।
আবার তির ছুটল।
মামাবাবুরা সাবধান হয়ে গেছেন। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন পাটাতনে। চালকহীন নৌকো পাক খেতে খেতে অন্ধের মতো ভেসে চলল।
আমরা প্রাণপণে চিৎকার করছি। ঘুঁসি দেখাচ্ছি–যদি লোকগুলো ভয় পায়। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। তারা মরিয়া। গুরুদেব কামাউয়ের দেবতাকে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না।
দেখলাম, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে, মাছের মতো সাঁতরে চলল নৌকোর দিকে।
মামাবাবু সাবধান! ওরা আসছে!
আমাদের চিৎকার তার কানে পৌঁছয়নি কিংবা তিরের ভয়ে খানিকক্ষণ মাথা তুলতে সাহস পায়নি। আমরা প্রাণপণে ডাকতে থাকি।
ত্যাঁড়া-ব্যাঁকা নৌকোর কাছে এসে পড়েছে–
বলি ব্যাপারখানা কী? পেড্রোর বাজখাঁই গলা শোনা গেল। সে এতক্ষণ ইঞ্জিনঘরে ব্যস্ত ছিল। ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দে কিছুই তার কানে ঢোকেনি। চিৎকার চরমে উঠলে শুনতে পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।
ওই জংলি দুটো বোট আক্রমণ করেছে। সাঁতরে আসছে। তির ছুঁড়েছে। একজন আহত।
তবে রে! দৈত্যাকার পেড্রো ব্যাঘ্রলম্ফ দিয়ে তার কেবিনে ঢুকল। পরমুহূর্তে ফিরে এল, হাতে বন্দুক।
বন্দুকে টোটা ভরে সে তাক করল।
হাইনে তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরলেন, আরে করছ কী? দেখছ না লোকগুলো আর নৌকো এক লাইনে। যদি নৌকোয় গুলি লাগে?
ওঃ! অসহায় রাগে পেড্রো সজোরে পা ঠুকতে লাগল।
মামাবাবু ও খালাসিরা মাথা তুলেছে কিন্তু নৌকো এগোয় না। একটা মাত্র দাঁড। ক্রমাগত পাশে সরে যেতে লাগল। ত্যাড়া-বাকা ধরে ফেলেছে নৌকো। তারা নৌকোর চারপাশে সাঁতরায় আর সুযোগ খোঁজে ওঠবার।