এত খুঁজেছেন কিন্তু এই দ্বীপটা বাদ দিলেন কেন? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।
রাইট, এ-দ্বীপে আমি খুঁজতে আসিনি। এত দূরে এসে পড়বেন ভাবিনি। তবে একেবারে খোঁজ নিইনি বলতে পারেন না। কিছুদিন আগে এই দ্বীপের অধিবাসীরা যখন উপকূলে এসেছিল তাদের জিজ্ঞেস করা হয়–ঝড়ে কোনো নৌকো কি তাদের দ্বীপে গিয়ে পড়েছে?–কোনো ভারতীয় ছিল নৌকোয়? তারা বলল–না।
তাহলে আমাদের খোঁজ পেলেন কী করে! ডিনামাইটের শব্দে? শব্দ তীরে পৌঁছেছিল, তবে খুব ক্ষীণ। কীসের শব্দ বোঝা মুশকিল। তারপরই হুড়মুড় করে দ্বীপবাসীরা কুলে হাজির হল। তাদের মুখে বিস্ফোরণের কাহিনি শুনে লোকেদের সন্দেহ হল অগ্ন্যুৎপাত নয়, কারণ সবাই জানে ওটা প্রবাল দ্বীপ। অতএব মানুষের হাত আছে। বারুদের কাণ্ড। আদিবাসীরা তো বারুদের ব্যবহার জানে না।–কোনো বিদেশি গেছে দ্বীপে? তারা উত্তর দেয়–না।
তবে খবর পেলেন কী করে?
শুধু একটা ছেলে, এই ষোল-সতের বছর বয়স হবে, খবর দিল তিনজন ভারতীয় নাকি বেশ কিছুদিন ধরে তাদের দ্বীপে রয়েছে। ঝড়ে তাদের নৌকো গিয়ে দ্বীপে পড়েছিল। ছেলেটা লুকিয়ে এসেছিল। বলে গেল–কাউকে বলবেন না আমি বলছি, তাহলে সর্দার কেটে ফেলবে তাকে।
টোটো, নিশ্চয় টোটো। আমি বলে উঠলাম।
টোটো কে? হাইনে বললেন।
একটি ছেলে, আমাদের ভারি ভালোবাসে।
ডক্টর হাইনে বলেন, সব্বাইকে বলা ছিল আপনাদের সন্ধান পেলেই যেন আমাকে খবর দেওয়া হয়। গতরাত্রে ট্রাঙ্ককল পেলাম। সকালে পৌঁছেই লঞ্চ জোগাড় করে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু আশ্চর্য, ওরা বার বার আপনাদের কথা চেপে গেল কেন?
কারণ ওরা চাইছিল না আমরা এখান থেকে চলে যাই।
কেন?
তাহলে হোমার খপ্পর থেকে ওদের বাঁচাবে কে?
মানে? হাইনে বিভ্রান্ত। সে আবার কে?
মামাবাবু তখন সংক্ষেপে বললেন, আমরা কেমন করে নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি সেই কাহিনি।
সমস্ত শুনে হাইনে প্রথমে একচোট হাসলেন হো হো করে, বেশ হয়েছে, যেমন হাতুড়ে বদ্যি তেমনি নাছোড়বান্দা পেসেন্ট। আচ্ছা জব্দ। যাক খুব সময়ে এসে পড়েছি,
এখন লঞ্চে আরাম করে ফিরে চলুন।
ওকেলো ফোড়ন কাটল, কিন্তু সুনন্দ আসিটের কি এমন নিরামিষ প্রস্থান পছন্দ হবে? অ্যাডভেঞ্চার কই? ওরা বরং আমাদের জালিবোটটা নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিক। আমরা প্রোফেসরকে নিয়ে লঞ্চে চলে যাই।
আমরা দুজন সরবে আপত্তি জানাই, নেভার।
খেয়াল করলাম মামাবাবু তার গল্পের মধ্যে মুঙ্গু অর্থাৎ ফসিলের বিবরণ বেমালুম চেপে গেলেন।
ডক্টর হাইনে ব্যস্ত হয়ে বললেন, তবে আজই ফেরা যাক। আপনাদের জিনিসপত্র নিয়ে আসি? বেড়াতে এসে কী দুর্ভোগ! এতগুলো দিন আপনাদের নষ্ট হল।
মামাবাবু বললেন, দুর্ভোগ কিছুটা হয়েছে বটে, কিন্তু দিনগুলো নষ্ট হয়েছে বলতে পারি না। একেবারে শূন্য হাতে ফিরছি না। অনেক অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে এবং মুঙ্গু। এই আমাদের পুরস্কার!
মুঙ্গু কী?
দ্বীপের দেবতা। কিন্তু আমাদের কাছে তার পরিচয় মিসিং লিঙ্ক। সরীসৃপ ও পাখির মাঝামাঝি এক জীবের ফসিল। আরকিঅপটেরিক্স-এর পূর্বপুরুষ।
কী বললেন, মিসিং লিঙ্ক? ফসিল এখানে পেয়েছেন? হেঃ হেঃ প্রোফেসর ঘোষ, আমি কাটখোট্টা সায়ান্টিস্ট হতে পারি, কিন্তু অল্পস্বল্প রসিকতা বুঝি।
রসিকতা নয়, সিরিয়াসলি।
অ্যাঁ সত্যি? কোথায়?
ক্যাম্পে রয়েছে।
তবে চলুন, দাঁড়িয়ে কেন? ইস, এতক্ষণ আজবাজে বকে সময় নষ্ট করছেন। উত্তেজিত হাইনে মামাবাবুর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারলেন।
আহা অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? মামাবাবু কাতর কণ্ঠে জানান, পালাচ্ছে না তো?
পাতলা কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় একটা বক্সের মধ্যে ফসিলটা শোয়ানো ছিল। কাপড় সরাতেই হাইনে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
কখনো খালি চোখে, কখনো ম্যাগনিফাইং গ্লাস লাগিয়ে দেখছেন। বাহ্যজ্ঞানশূন্য, তন্ময়ভাবে। আমরা দুরুদুরু বক্ষে ভাবছি–মামাবাবুর ধারণা সত্যি হবে তো?
প্রায় আধ ঘণ্টা পর হাইনে লাফিয়ে উঠলেন, প্রোফেসর ঘোষ, কনগ্রাচুলেসনস! আপনি ঠিক ধরেছেন–মিসিং লিঙ্ক। জীবটা না-পাখি, না-সরীসৃপ। আরকিঅপটেরিক্স-এর চেয়ে পুরনো। এর গায়ে পালক খুব সামান্য, সবে বেরিয়েছে ছোট ছোট। এখন দয়া করে বলুন এই মহামূল্যবান আবিষ্কারটি করলেন কী করে! এ যে সাত রাজার ধন মানিক! প্রাণিবিজ্ঞানীদের স্বপ্ন। এরকম আবিষ্কারের জন্যে আমি একবার কেন, সাত-সাতবার টাইফুনে পড়তে প্রস্তুত আছি।
মামাবাবু বললেন, সুনন্দ কফি বানাও, জমিয়ে বসা যাক। জানলে ডক্টর হাইনে, এরকম বিচিত্র কাহিনি অ্যাডভেঞ্চারের বইয়ে পড়া যায়। কিন্তু সত্যি সত্যি নিজেদের জীবনে তেমনি এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হব কে জানত?
প্রথমেই বলে রাখি এই ফসিল আবিষ্কারের অনেকখানি কৃতিত্ব ডেয়ারিং বিলের। বিল অবশ্য বুঝতে পারেনি, কিন্তু আমার তখনই সন্দেহ হয় যে ও যে-বিগ্রহটা দেখেছিল সেটা আসলে একটা ফসিল। তারপর এখানে সেই মূর্তি দেখে ভালো করে নজর করি। তখন না শুনলে হয়তো এই মূর্তি নিয়ে এত মাথাই ঘামাতাম না।
তাছাড়া ফসিলটা কোথায় পাওয়া গেছে ভেবেও কূলকিনারা পেতাম না। পরে টোটোর কথায় আমি নিঃসন্দেহ হই। কারণ এ-দ্বীপে এত পুরনো ফসিল পাওয়া অসম্ভব।
মামাবাবু মুঙ্গু আবিষ্কার কাহিনি আরম্ভ করেন।