ঘণ্টাখানেক পরে মামাবাবু বললেন, কী ব্যাপার? একটা লোকেরও গলার আওয়াজ পাচ্ছি না যে! চল তো দেখে আসি।
সমুদ্রতীরে এসে আমরা থ।
বেলাভূমি খাঁ-খাঁ করছে। জনমনিষ্যি নেই। গা একেবারে ফাঁকা নয় অবশ্য। কয়েকজন বুড়োবুড়িকে দেখলাম পাথরের খাঁজে, গাছের তলায় লুকিয়ে বসে। কিন্তু বাকিরা কই!
এবার নজর পড়ল। একটাও নৌকো নেই। ডিঙি ছিপ সব উধাও, দেখি অনেক দূরে সমুদ্রের জলে কালো কালো বিন্দুর মতো সার সার নৌকো, ভেসে চলেছে উপকূলের দিকে।
যাব্বাবা! সুনন্দ বলে, এ যে গুষ্টিসুদ্ধ হাওয়া! যাক ভালোই হল, এখন থেকে আমরাই দ্বীপের রাজা।
হুঁ রাজা বটে! তবে নির্বাসিত। মামাবাবু মন্তব্য করলেন।
কেন?
বাঃ, সবকটা নৌকো যে নিয়ে গেছে। দ্বীপ থেকে বেরোবার রাস্তা বন্ধ।
তাইতো! আমরা একটু মুষড়ে পড়ি।
এরা আর ফিরবে না? আমি জিজ্ঞেস করি।
ফিরতে পারে। অগ্নিদেবের ধ্বংসলীলা কতদূর গড়ায় দেখেশুনে হয়তো ফিরবে। তবে কবে ফিরবে কে জানে! যাহোক, সুনন্দ অসিত তোমরা পালা করে সমুদ্রতীরে পাহারা দাও। আমার ধারণা শব্দ উপকূল অবধি পৌঁছেছে। কিংবা দ্বীপের রিফিউজিদের কাছ থেকে খবর পেয়েও উপকূল থেকে খোঁজ নিতে আসতে পারে–ব্যাপারখানা কী!
পরদিন সকালে আরও দুটি ডিনামাইট ফাটানো হল। সেই বিকট বজ্রনিনাদ দ্বীপের চারপাশের জলবেষ্টনীর তরঙ্গে তরঙ্গে কাঁপুনি জাগিয়ে ছুটে গেল দূর দিগন্তে। মহাভয়ে পশুপাখিরা দিভ্রান্ত হয়ে পালাতে লাগল। মানুষ তো আগেই পালিয়েছে।
বন্দী মাঝি দুজন আবদুল ও রশিদ মহানন্দে দ্বীপময় চষছে। কতদিন পরে তারা স্বাধীনভাবে ঘুরছে। একটা নতুন খবর দিল তারা–শুধু কিছু বুড়োবুড়ি নয়, কয়েকজন জোয়ান পুরুষও নাকি রয়েছে দ্বীপে। কী কারণে তারা পালাতে পারেনি জানি না। হয়তো ভয় পেয়ে বনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, অন্যরা তখন ভেগেছে।
মাঝিরা বলল, বনের মধ্যে হঠাৎ দুটো লোক তাদের সামনে পড়ে। অমনি তারা তোক দুটোকে লাঠি বাগিয়ে তাড়া করে। দ্বীপের লোকের ওপর তাদের ভীষণ রাগ। লোক দুটোও তৎক্ষণাৎ ভোঁ দৌড়।আবদুলরা খুব বাহাদুরি নিল, ব্যাটারা ভিতুর একশেষ। সঙ্গে তির-ধনুক ছিল, কিন্তু দেখেই পালাল। একবার ধরতে পারলে
আমাদের ধারণা ওরা মোটেই ভীতু নয়। আকস্মিক দুর্যোগে বেচারারা ঘাবড়ে গেছে। হয়তো ভেবেছে–বিস্ফোরণের পিছনে ভারতীয় জাদুকরদের কোনো কারসাজি আছে। কারণ কাল থেকে দ্বীপের কোনো লোক আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষেনি। দেখলেই লুকিয়ে পড়েছে।
দুপুর বারোটা নাগাদ।
আমি ও সুনন্দ সমুদ্রতীরে রাউন্ড দিচ্ছি। সুনন্দের চোখে দূরবিন। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে ওঠে, লঞ্চ! একটা লঞ্চ আসছে এদিকে!
কই দেখি, দেখি। আমি তার হাত থেকে দূরবিন কেড়ে নিই। সত্যি তো লঞ্চ! কয়েকজন মানুষ রয়েছে। ঠিক চেনা যাচ্ছে না তাদের।
দে দে। সুনন্দ কাড়াকাড়ি করে। কিন্তু আমি শক্ত হাতে দূরবিন ধরে থাকি।
একটু একটু করে স্পষ্ট হতে থাকে লঞ্চ। দূরবিনের মধ্য দিয়ে মানুষগুলোকে দেখি।
সুনন্দ! ডক্টর হাইনে! ঐ তো ওকেলো! আরও তিন-চারজন লোক দেখছি, বোধহয় খালাসি।
সুনন্দ দূরবিন কেড়ে নিল। তারপর বলে চলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। হাইনে, ওকেলো।
সুনন্দ তার শার্টটা খুলে প্রাণপণে নাড়তে লাগল। আর গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, ও-কে-লো! হাইনে!
দুম্দুম্। লঞ্চ থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। অর্থাৎ তারা আমাদের দেখেছে।
দাঁড়া মামাবাবুকে ডেকে আনি। সুনন্দ পাই-পাঁই করে দৌড়ল।
.
১৩.
লঞ্চ থামল দ্বীপ থেকে প্রায় দুশো গজ দুরে। তীরের কাছে কাছে জলের মধ্যে অজস্র শিলাস্তূপ, প্রবাল প্রাচীর। লঞ্চের ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা। একটা ছোট বোট জলে নামানো হল। তাতে চাপলেন ডক্টর হাইনে এবং ওকেলো। দুজন খালাসি দাঁড় বাইতে লাগল।
হাইনে লাফ দিয়ে ডাঙায় নেমে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন মামাবাবুকে।
ওঃ প্রোফেসর ঘোষ। আপনারা জীবিত!
কেন সন্দেহ আছে নাকি? কী দেখছেন সামনে? ভূত? মামাবাবু হাসেন। হাত দিয়ে অনুভব করুন খাঁটি রক্তমাংসের শরীর। আরও সাচ্চা প্রমাণ ঐ দেখুন ছায়া পড়েছে মাটিতে।
উঃ কী মনোকষ্টে যে দিন কাটাচ্ছিলাম! অনুতাপে পুড়ে যাচ্ছিল বুক। আমারই জন্যে এই দুর্ঘটনা! কেন আপনাদের মাফিয়া আসতে লিখলাম! কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার, কী করে বোঝাই। পাষাণ-ভার নেমে গেল মন থেকে।
আমি ও সুনন্দ তখন আনন্দে উন্মত্ত ওকেলোর অক্টোপাস-সম ভীমবাহুপাশের আলিঙ্গনে দমবন্ধ হয়ে ছটফট করছি। প্লিজ ওকেলো, ভাই এবার ছেড়ে দাও। এবার কিন্তু সত্যি সত্যি অক্কা পাব।
হাইনে বললেন, মাফিয়ায় আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি। চারদিন কেটে গেল, দেখাই নেই। আবার খবর পাঠাই, কই, চটপট চলে এসো।
ওকেলো টেলিগ্রাম করল, আপনারা রওনা দিয়েছেন চারদিন আগে! কী ব্যাপার? সঙ্গে সঙ্গে ডার-এস-সালাম ফিরলাম। তারপর জানি, রুফিজি নদীর মোহনা থেকে আপনারা রওনা হওয়ার কয়েক ঘন্টা পরে প্রবল ঝড় ওঠে। বুঝলাম ঝড়ে পড়েছেন। মোহনার দুইপাশ, কাছাকাছি সমুদ্রতীর সব তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। নাঃ, কোনো পাত্তা নেই। জীবিত ফিরে পাবার আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, মৃত দেহগুলোও যদি পাই। কিন্তু কোনো চিহ্নই পাচ্ছিলাম না। এমনকি ভাঙা নৌকো বা জিনিসপত্রগুলোরও কোনো সন্ধান নেই। ভাগ্যিস এখনও আপনাদের দেশে খবর পাঠাইনি। ঠিক করেছিলাম, আপনাদের কোনো চিহ্ন না পেয়ে, স্থির নিশ্চিত না হয়ে আপনাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে এই মর্মান্তিক সংবাদ পাঠাব না।