এই দ্বীপেও অগ্নিদেব আছে নাকি? মামাবাবু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করেন।
কে জানে, থাকতে পারে! তবে শুনিনি তো কখনও। থাকলে তো মরেছি। ঠাকুমা বলত, অগ্নিদেব ঘুমিয়ে থাকে মাটির নিচে, একদিন হঠাৎ জাগে। তখন তার মেজাজ হয় অগ্নিশর্মা। ধারে কাছে কারো তখন রক্ষা নেই।
টোটো, তুমি দেখছি বড্ড ভয় পাও অগ্নিদেবকে। মামাবাবু ঠাট্টা করতে লাগলেন।
ডরাব না? কী রাগী দেবতা! আমি আর কী ডরাই! আমার বাপ-জ্যাঠা, ঐ দারুণ সাহসী বীর সর্দার সব্বাই অগ্নিদেবের নামে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। একটা দড়াম করে শব্দ হোক, খানিকটা আগুন দেখা যাক, দু-চারটে পাথর ছুটুক–আর চেঁচিয়ে বলুন–অগ্নিদেব সাবধান! ঊর্ধ্বশ্বাসে সব পালাবে, অন্ধের মতো। একবার পিছন ফিরে দেখতে ভরসা পাবে, গাছ পড়ল না মশাল ছুঁড়ল কেউ। আমরা ছয় চাঁদ অন্তর একবার ঘটা করে অগ্নিদেবের পুজো দিই।
টোটো ফিরে যেতেই মামাবাবু বলে উঠলেন, আমাদের প্ল্যান কিছু বদলাতে হবে।
কীরকম? আমরা উদ্বিগ্ন হই।
পরশু আমরা সমুদ্রযাত্রা করছি না। সেদিন হবে শুধু এক অংশ-মুঙ্গু অপহরণ পর্ব।
তারপর?
তারপর সমুদ্রে ভাসছি, মানে ফাইনালি চম্পট দিচ্ছি যে কোনোদিন সুবিধা মতো।
সুনন্দ বলল, পরদিন কুটিরের দরজা খুলে যখন দেখবে মুঙ্গু নেই, তখন যদি আমাদের সন্দেহ করে?
দরজাই থাকবে না, তো খুলবে কী? মুঙ্গুর কুটির বা দরজার কোনো চিহ্নই থাকবে না।
সেকি! আমরা তো অবাক।
কী করে?
মাফিয়া-যাত্রার সময় ডক্টর হাইনের অর্ডারমাফিক কয়েকটা ডিনামাইট স্টিক সঙ্গে নিয়েছিলাম মনে আছে? মনে হয় স্টিকগুলো নষ্ট হয়নি, ফাটবে। পরশু উৎসবের শেষে যখন এরা অচেতন হয়ে ঘুমোবে, তোমরা দুজনে মুঙ্গুর কুটিরের দেয়াল ফুটো করে। ফসিলটা সরাবে। নিয়ে আসবে ক্যাম্পে। না, ক্যাম্পে রাখা ঠিক হবে না। কাছাকাছি কোনো গর্তটর্ত আছে, ফসিলটা লুকিয়ে রাখা যেতে পারে?
আছে। সামনের ঐ প্রকাণ্ড গাছটার গুঁড়ির ওপর দিকে একটা মস্ত গর্ত আছে। ফসিলটা পুরো ঢুকে যাবে।
বেশ। ভালো করে শুকনো পাতা চাপা দিয়ে রাখবে। তারপর আবার ফিরে যাবে মুঙ্গুর কুটিরে। কুটিরের নিচে একটা গর্ত খুঁড়ে তোমরা পয়লা নম্বর ডিনামাইটটা ফিক্স করবে। তারপর আরও দুটো লাগাবে কুটিরের পিছনে যে ঢিবি আছে তার নিচে। ঢিবির ওপর মস্ত একটা গাছ আছে। আমার আশা ডিনামাইট ফাটলে হয়তো উল্টে পড়বে। ব্যস, রাত্তিরে এই অবধি। কারণ বিস্ফোরণ ঘটবে সকালে। স্টিকের পলতেগুলো বেশ লম্বা নেবে আর ঘাস-পাতা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখবে, যাতে কারও চোখে না পড়ে।
পরদিন আমরা যাব রুগী দেখতে, আমি আর অসিত। সুনন্দ গোপনে গিয়ে ডিনামাইটের পলতেতে আগুন লাগাবে। তারপর চট করে আমাদের কাছে চলে আসবে। পলতের আগুন স্টিকে পৌঁছতে লাগবে বড়জোর চার-পাঁচ মিনিট। তুমি প্রথমে মুঙ্গর কুটিরের নিচে লাগানো ফিউজে আগুন দেবে, আর তার দশ-পনেরো সেকেন্ড পরে আগুন দিও বাকি দুটো পলতেয়। এরপর কী ঘটবে স্বচক্ষেই দেখতে পাবে।
সুনন্দ বলল, কিন্তু এত কষ্ট করার কারণ তো বুঝছি না? পরশুদিন সবাই মিলে কেটে পড়লেই তো হাঙ্গামা চুকে যায়।
কারণ শেষ রাতে সমুদ্রযাত্রাটা এড়াতে চাই। যদি মাঝপথে ধরা পড়ি? মুস্তুকে আগে থাকতে সরিয়ে রাখলে প্রথম রাতেই পালাতে পারব। অবশ্য ফেরা দু-একদিন পিছিয়ে যাবে। তাতে কিছু এসে যায় না, অনেক নিরাপদে ফিরব।
ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছিল না। ডিনামাইট ফাটিয়ে আমাদের কী উপকার হচ্ছে? বললাম, যদি ওরা বিস্ফোরণের জন্য আমাদের দায়ী করে?
না করবে না। মামাবাবু বলেন, কী শুনলে এতক্ষণ টোটোর গল্প? ভাববে অগ্নিদেবের কাণ্ড। কোনো মানুষ যে এমন ব্যাপার ঘটাতে পারে মাথায়ই আসবে না। বরং লেগে যাবে অগ্নিদেবের ক্রোধ নিবারণের জন্য ঘটা করে পুজো দিত। এই তালেগোলে আমরা পালাব।
উৎসবের রাতে আমি ও সুনন্দ কীভাবে মহামান্য মুলুকে অপহরণ করলাম, কীভাবে ডিনামাইটগুলি বসালাম, তার বিশদ বিবরণ দেবার দরকার নেই। শুধু বলে রাখি, সে-রাতে ঘুম আমাদের ভাগ্যে জোটেনি এবং কাজ শেষে তাঁবুতে যখন ফিরেছি হাত-পিঠ টনটন করছিল, সারা গায়ে ঘাম।
পরদিন সকালে চত্বরে গিয়ে দেখি অনেকেই তখনও নাক ডাকাচ্ছে বা ঝিমুচ্ছে। গত রাত্রের ফুর্তির ধকল সামলে উঠতে পারেনি। রুগী দেখা হল। মামাবাবু সর্দারের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দিলেন। কামাউকে দেখলাম এক কোণে বসে ঢুলছে।
সুনন্দ একটু পরেই এল।
মামাবাবু বাংলায় বললেন, কি, সব রেডি?
হ্যাঁ।
বেশ এখন কথা বলতে বলতে গাছের আড়ালে সরে যাও। পাথর ছিটকাতে পারে।
গুড়ম্-ম্-ম্।
ঘড়ির ওপর চোখ রেখে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম, তবু এত কাছে ডিনামাইট ফাটায় চমকে কান চেপে বসে পড়লাম। মাটি, পাথর, বাঁশের টুকরো ছিটকে পড়ল চারপাশে। দেখলাম মুঙ্গুর কুটির বেমালুম নিশ্চিহ্ন।
প্রথম কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব অবস্থা। তারপরই শুরু হল চিৎকার দৌড়াদৌড়ি। সদ্য ঘুমভাঙা লোকগুলো দিশাহারার মতো এদিক সেদিক ছুটল। তাদের বিপর্যস্ত স্নায়ু ধাতস্থ হবার আগেই আবার বিস্ফোরণ দু-দুটো।
ছোট-বড় পাথরের খণ্ড দুমদাম্ করে পড়ল চারপাশে। একটা গাছ মড়মড় শব্দে মুখ থুবড়ে পড়ল। কয়েকজন দেখলাম আহত হয়েছে।
আতঙ্কে সবাই প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল। মালিমা ইয়া মোটো–মালিমা ইয়া মোটো বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সবাই উর্বশ্বাসে দৌড়ল। আমরাও ছুটলাম সঙ্গে-বাবাগো মাগো, বলে চিল্লাতে চিল্লাতে। তারপর টুক করে একসময় কেটে পড়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়লাম। দ্বীপের লোকেরা ছুটে চলল সমুদ্রের তীরে। প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে শুনলাম সমুদ্রতীর থেকে ভেসে আসছে তুমুল হট্টগোল হইচই। আস্তে আস্তে কোলাহল শান্ত হল।