.
মুঙ্গু
০১.
পূর্ব আফ্রিকার টাঙ্গানিকা প্রদেশের প্রধান বন্দর হল ডার-এস-সালাম। অনেক কালের শহর। শহরের কিছু কিছু অংশে যেমন আদ্যিকালের নোংরা গলিখুঁজি, পুরনো আমলের ঘর-বাড়ি রয়েছে, তেমনি অন্যান্য অংশে গড়ে উঠেছে অতি আধুনিক অট্টালিকা, হোটেল, আলো ঝলমল রাজপথ, দোকানপাট।
মিউজিয়ামটি শহরের বাইরে। নগর-বন্দরের কোলাহল থেকে দূরে। প্রায় চার-একর জমি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে বড় বড় গাছ ও বাগান। মাঝখানে মিউজিয়ামের বাড়ি।মিউজিয়াম মানে লম্বা লম্বা পাঁচ-ছটা একতলা হলঘর। কম্পাউন্ডের একপ্রান্তে ডক্টর হাইনের বাংলো প্যাটার্নের কোয়ার্টার। একজনের পক্ষে যথেষ্ট বড়। তারই একাংশ তিনি আমাদের জন্য ছেড়ে দিলেন।
ডক্টর হাইনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আশ্বস্ত হলাম। ভয় ছিল অমন ঘোরতর পণ্ডিত ব্যক্তি, কে জানে যদি গোমড়ামুখো বদমেজাজী হন! মামাবাবুর খাতিরে মুখে কিছু না। বললেও হয়তো আমার মতো এক উটকো ছোকরার আগমন মোটেই সুনজরে দেখবেন না। সুনন্দ না হয় প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু আমি তো এ-লাইনে স্রেফ মুখ। মিউজিয়াম ঝাট দেওয়া ছাড়া আমার দ্বারা তাদের কোনো উপকার হবে না।
কিন্তু দেখলাম, এ এক যুবক বৃদ্ধ।
মাঝারি লম্বা। দাড়ি-গোঁফ কামানো গোল মুখখানা ভারি হাসিখুশি। মাথায় চুল আর টাক সমান সমান জায়গা অধিকার করেছে। একটু ব্যস্ত মানুষ। প্রচুর এনার্জি। হন্ হন্ করে চলেন। লাফ দিয়ে টপকে টপকে সিঁড়ি ভাঙেন। যখন তখন দরাজ গলায় হো-হো করে কী হাসি! ভদ্রলোক বেশ ইংরেজি জানেন, কাজেই কথা বলতে অসুবিধা নেই।
প্রথম আলাপেই আনন্দের আতিশয্যে হ্যাল্লো বলে আমার পিঠ এমন চাপড়ে দিলেন যে বেশ কিছুক্ষণ ব্যথা ছিল।
মিউজিয়ামের ইতিহাস শুনলাম।
মিউজিয়ামটি ছিল এক লক্ষপতি জর্মন কফিবাগিচার মালিকের। জীবজন্তুর স্পেসিমেন সংগ্রহ করা ছিল ফন স্লীমান-এর নেশা। বহু কষ্টে ও অর্থব্যয়ে বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের দূর দূর প্রান্ত থেকে তিনি হাজার হাজার জীবজন্তুর মৃতদেহ জোগাড় করে এনে মিউজিয়াম তৈরি করেন। এছাড়াও আফ্রিকার আরও অনেক বিচিত্র দুর্লভ জিনিস তিনি জোগাড় করেছিলেন। বছর পাঁচেক হল স্লীমান মারা গেছেন। উইলে তিনি তার সাধের মিউজিয়াম ও তৎসংলগ্ন বাড়িঘর বাগান সরকারকে দান করে যান। তারপর থেকে মিউজিয়ামটি তালাবন্ধ অবস্থাতেই পড়ে ছিল। তেমন যোগ্য কাউকে পাওয়া যায়নি মিউজিয়ামের ভার দেবার মতো। এমন সময় মাত্র কয়েক মাস ডক্টর হাইনে টাঙ্গানিকায় আসেন নিজের গবেষণার কাজে। ডক্টর হাইনে শুধু বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী নন, মিউজিয়াম পরিচালনার কাজেও তার প্রচুর অভিজ্ঞতা। টাঙ্গানিকা সরকার এমন সুযোগ হাতছাড়া করেনি। সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর হাইনেকে অনুরোধ জানানো হয় অন্তত কিছুদিনের জন্য মিউজিয়ামটির দায়িত্ব। নিতে। মিউজিয়ামকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাজিয়ে গুছিয়ে আরও বড় করে দিতে।
ডক্টর হাইনে রাজি হয়ে গেলেন। ভাবলেন মন্দ নয়। পরের পয়সায় একটা ভালো আস্তানা হবে। মিউজিয়ামের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের গবেষণাও চালিয়ে যেতে পারবেন। এখনো অবশ্য আসল কাজ কিছুই এগোয়নি। বাগান পরিষ্কার, ঘর-দোরের ধুলো ঝাড়তেই সময় কেটে গেছে।
মিউজিয়ামে ঢুকেই প্রথমে নজরে পড়ল দরজার দুপাশে দাঁড় করানো দুটি প্রকাণ্ড হাতির দাঁত। হাইনে বললেন, প্রত্যেকটা দাঁত লম্বায় ন-ফুটেরও বেশি এবং ওজন দুশো পাউন্ডের ওপর। ঘরগুলোর মধ্যে টেবিল, টুল এবং বড় বড় কাঁচ-ঢাকা শো-কেসে অজস্র জন্তু-জানোয়ার, পাখি, কীট-পতঙ্গের মৃতদেহ। জন্তু ও পাখিগুলির মধ্যে খড়কুটো কাঠের গুঁড়ো ভরে স্টাফ করা। নানা ভঙ্গিতে সাজানো। দেখলে মনে হয় জীবন্ত। ফর্মালিন ভর্তি বড় বড় কাঁচের বয়ামে ডোবানো পোকা-মাকড়, সাপ। শো-কেসে পিচবোর্ডের গায়ে পিন। আঁটা রকমারি প্রজাপতি, ফড়িং ইত্যাদি। এদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রাণী আমি কলকাতার মিউজিয়ামে দেখেছি। তবে সীমানের মিউজিয়ামের এক বিশেষত্ব আছে। ফন সীমান যেনতেন প্রকারে একটা স্পেসিমেন সংগ্রহ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল এই মিউজিয়ামের প্রতিটি সংগ্রহ হবে একেবারে সেরা।
আমি ও সুনন্দ যখন তৃতীয় হলঘরটায় ঢুকেছি, মামাবাবু ও ডক্টর হাইনে কিন্তু তখনো প্রথম ঘরটাই শেষ করে উঠতে পারেননি। প্রতিটি স্পেসিমেনের খুঁটিনাটি নিয়ে দুজনে আলোচনা করছেন, মাঝে মাঝে তর্ক হচ্ছে।
মিউজিয়ামের একেবারে শেষ ঘরটায় কোনো জীবজন্তু নেই। নানা ধরনের জিনিসে ঘর ভর্তি। বিভিন্ন উপজাতিদের পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, মুখোশ। কতকগুলো বিচিত্র কাঠ ও পাথরের মূর্তি। অদ্ভুত তাদের চেহারা, আশ্চর্য খোদাই কাজ।
ছোট এক শো-কেসের মধ্যে দেখি একটা প্রকাণ্ড ডিম। বাসরে কী পেল্লায়! অস্ট্রিচের ডিমের অন্তত সাত-আট গুণ বড়। সঙ্গে রাখা কার্ডে লেখা–ফসিল্ড এগ। এলিফ্যান্ট বার্ড। আঙুলে টোকা দিয়ে দেখলাম শক্ত পাথর। কেবলমাত্র মাদাগাস্কারে এই পাখির হাড় ও ডিম ফসিল অবস্থায় পাওয়া গেছে।
আপাতত মামাবাবু লেগে গেলেন ডক্টর হাইনের সঙ্গে মিউজিয়ামের স্পেসিমেনের ক্যাটালগিং করতে। দিন চারেক পরে মামাবাবু লেকচার-ট্যুরে বেরোবেন। এখানে বলে রাখি, মামাবাবুর বক্তৃতার বিষয় হচ্ছে মিসিং লিঙ্ক বা হারানো সূত্র। মানুষের পূর্বপুরুষ যে বাঁদর একথা সকলেই জানে। কিন্তু বাঁদর আর মানুষের মাঝখানে যে একটা নর-বানর অবস্থা, সেটার কোনো হদিস আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এটাকে তাই বলা হয় মিসিং লিঙ্ক। অবিশ্যি মামাবাবু যে মিসিং লিঙ্ক নিয়ে বক্তৃতা দেবেন, সেটা কিন্তু মানুষের ব্যাপার নয়। সেটা পাখির ব্যাপার। পাখি এসেছে সরীসৃপ থেকে! সবচেয়ে পুরনো যে পাখির ফসিল পাওয়া যায়, তাকে বলে আর্কিয়পটেরিক্স। এই পাখিতে সরীসৃপের কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু মামাবাবুর ধারণা, এর চেয়েও প্রাচীন পাখি নিশ্চয়ই ছিল, যেটাকে বলা যেতে পারে সরীসৃপ আর পাখির ঠিক মাঝামাঝি অবস্থা। এটাই পাখির মিসিং লিঙ্ক–আর এটার কোনো নমুনা বা ফসিল আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।