ব্যাজার মুখে বলল, যত শক্ত কাজ দেখছি আমার ঘাড়ে। ঐ ভারী পাথরখানা বয়ে নিয়ে অতটা পথ হাঁটা! বাপরে! দেশি-বিদেশি যত জানা দেবদেবী আছেন সবাইকে স্মরণ করছি। হে মা, হে বাবা, ভালোয় ভাসোয় পার করে দিও।
সত্যি বলতে কি একটু উৎসাহও লাগছে। অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়েছি কত। এবার একেবারে হাতেনাতে এক্সপেরিমেন্ট। যেমন বিচিত্রভাবে আমাদের এই দ্বীপে আগমন, তেমনি রোমাঞ্চকর প্রস্থান (পলায়নও বলতে পারেন। দেশে ফিরলে নির্ঘাত হিরো বনে যাব। খবরের কাগজে ছবিটবি বেরিয়ে যাবে। অবশ্য যদি ফিরি।
সেদিন রাতে টোটোর সঙ্গে গল্প হচ্ছিল তাঁবুর সামনে বসে। ছেলেটার ওপর মায়া পড়ে গেছে। বেচারা হঠাৎ জানবে তার বন্ধু মাহিণ্ডিরা পালিয়েছে। পেটুক মানুষ, ভালো-মন্দ বিদেশি খানা আর জুটবে না।
টোটো বলছিল তাদের জাতির অতীত গৌরবের কাহিনি।
বাবা-জ্যাঠারা বলে, দূর দূর এ কী জীবন? শিকার নেই। যুদ্ধ নেই। তোরা ছাগল বনে গেছিস। কী সব দিন ছিল আমাদের সেই জঙ্গলের দেশে। বর্শা দিয়ে সিংহ শিকার দেখেছিস? তির ছুঁড়ে প্রকাণ্ড দাঁতাল হাতিকে পেড়ে ফেলতাম। হায়, সেসব দিন গেল কোথায়! এইটুকু দ্বীপে বন্দী হয়ে আছি। কাজের মধ্যে কেবল নৌকো চড়া। ছছাঃ ছেঃ! যতসব মেয়েলিপনা! তার চেয়ে তির ছুঁড়ে নারকেল পাড়া ঢের শক্ত।
এ-দ্বীপে তোমরা এলে কেন? আমি প্রশ্ন করি।
বাধ্য হয়ে, যুদ্ধে হেরে। আমার তো এখানেই জন্ম। শুনেছি পাশের গ্রামের ওঙ্গামিদের সঙ্গে ছিল আমাদের দারুণ শত্রুতা। বার বার যুদ্ধ হত। ওঙ্গামিরা পারত না। শেষে একবার তারা অতর্কিতে আক্রমণ করল। আমরা প্রস্তুত হবার সুযোগটুকু পেলাম না। আমাদের বেশির ভাগ পুরুষ মরল। বাকিরা মেয়ে আর বাচ্চাদের নিয়ে পালালো। ওসামিরা সহজে ছাড়েনি। সমুদ্রতীর অবধি পিছন পিছন তেড়ে এসেছিল। একেবারে ঝাড়ে-বংশে শেষ করে দেবার মতলব আর কী! ওদের ভয়েই আমরা এই দ্বীপে পালিয়ে আসি। দেখ না, আজও ওপারে গিয়ে আমরা বেশিদিন থাকি না। ঐ ওঙ্গামিদের ভয়ে। তবে আবার ফিরব।
কবে?
সর্দার বলেছে। আমরা আরও সংখ্যায় বাড়ি। যুদ্ধ জানা যুবকে যখন আমাদের দল বেশ ভারী হবে তখন ফিরব সেই জঙ্গলের দেশে। ওঙ্গামিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে। কিন্তু ইদানীং সবাই খুব মুষড়ে পড়েছে। এই মারাত্মক কাঁপুনি জ্বরে আমাদের গায়ের জোর কমে যাচ্ছে। লোকও মরছে। ওঙ্গামিদের সঙ্গে লড়ব কী করে?
ওঙ্গামিদের সঙ্গে তোমাদের শত্রুতার কারণ কী?
কেন জানো? ওগামিরা ছিল ঐ অঞ্চলের প্রভু। আমরা গিয়ে জমিতে ভাগ বসাতে ভয়ানক চটে যায়। ফলে প্রাণপণে আমাদের তাড়াতে চেষ্টা করে।
ও তোমরা বুঝি অন্য দেশ থেকে এসেছিলে? কোথায় ছিলে আগে?
আমরা আগে ছিলাম আরও গভীর বনের রাজ্যে। আকাশছোঁয়া এক পাহাড়ের গায়ের কাছে আমাদের গ্রাম। সেই তো আমাদের আসল দেশ।
সেখান থেকে এলে কেন?
ভয়ে।
কীসের ভয়?
মোটো। মালিমা ইয়া মোটো।
মামাবাবু! সুনন্দ ডাকে।
কি? মামাবাবু বই থেকে মুখ তোলেন।
মোটো। মালিমা ইয়া মোটো মানে কী?
মোটো মানে আগুন। মালিমা ইয়া মোটো মানে হচ্ছে আগ্নেয়গিরি বা অগ্ন্যুৎপাত। কোথায় শুনলে কথাটা?
টোটো বলছে, ওদের আদি বাসস্থান নাকি ছিল গভীর জঙ্গলে। পাহাড়ের কোলে। সেখান থেকে পালিয়ে আসে আগুনের ভয়ে।
তাই নাকি? মামাবাবু কৌতূহলী হলেন, ব্যাপারটা কী হয়েছিল টোটো?
টোটো বলল, আমি ঠাকুমার মুখে শুনেছি। উঃ, সে এক ভীষণ ব্যাপার। আমার বাবা তখন ছোট, এই আমার মতো। ঠাকুমার মুখে সে-গল্প শুনলে বুঝতে কী সাংঘাতিক কাণ্ড! আমি তেমন জমিয়ে বলতে পারব না। কিন্তু ঠাকুমাকে আর পাবে কোথা? ঠাকুমা তো মরে গেছে।
বেশ তুমিই বলো শুনি।
টোটো বলল, ঐ পাথরের মধ্যে ছিল অগ্নিদেবতার বাস। মাঝে মাঝে গুড়গুড় আওয়াজ উঠত। চোঙার মতো মাথা দিয়ে বেরতো কালো ধোঁয়া। গরম হাওয়া। শব্দটা বাড়তে লাগল। সবাই বলল, দেবতা রেগেছে। ভালো করে পুজো দিতে হবে। কিন্তু পুজো দেবার আর সময় পাওয়া গেল না। সেদিন রাত্তিরে পাহাড়ের মাথা থেকে ঝলকে ঝলকে অগ্নিদেবের গরম নিশ্বাস বের হতে লাগল। মাটি তেতে উঠল। আকাশে ধোঁয়া, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সবাই বলল, পালাও। এক্ষুনি। দেবতার রোষে নইলে কেউ রক্ষা পাবে না। গ্রামসুদ্ধ পালিয়ে চলল। পালাতে পালাতে আরম্ভ হল আগুনবৃষ্টি। জ্বলন্ত পাথর ছুটতে লাগল। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এল শত শত আগুনের ধারা। মানুষ পশুপাখি সবাই ছুটল দিশেহারা হয়ে, প্রাণের ভয়ে। অনেকে মরল পাথরের ঘায়ে। আমার ঠাকুর্দা এক হাতে ঠাকুমাকে অন্য হাতে বাবাকে ধরে হিচড়াতে হিচড়াতে টেনে নিয়ে চলল। উঃ! কী ভীষণ রাত্রি! যারা বাঁচল, কোনোরকমে গিয়ে উঠল দূরে এক পাহাড়ে।
পরদিন দুপুর নাগাদ এক বিকট শব্দ। সে কী কান-ফাটানো আওয়াজ! মনে হল সৃষ্টি বুঝি ভেঙে গুঁড়িয়ে উড়ে গেল। প্রচণ্ড আলোর ঝলক ও ভয়ঙ্কর শব্দে অনেকক্ষণ সবাই হতবুদ্ধি হয়ে রইল। সম্বিত ফিরতে দেখল আগুন দেবতার বাসা সেই উঁচু পাহাড়ের ডগাটা ফেটে চুরচুর হয়ে উড়ে গেছে। আর সেই মাথাভাঙা পাহাড়ের ভিতর থেকে নেমে আসছে অজস্র জ্বলন্ত স্রোত। মস্ত মস্ত পাথর ছিটকাচ্ছে। আবার ছোট ছোট। অনেক দূরে এক সমতলে এসে সবাই থামল। সেখানে তৈরি করল নতুন গ্রাম। জায়গাটা চমৎকার ছিল। প্রচুর শিকার। কিন্তু জুটল এক নতুন হাঙ্গামা,–ওঙ্গামি। তাদের সঙ্গে ঝগড়া আর কিছুতেই মিটল না।