সেকি! আমরা তিনজনেই অবাক।
কামাউয়ের দেবতা, কিন্তু তোমাদের নয়? আশ্চর্য। কামাউ কি তোমাদের জাতের লোক নয়? মামাবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
নয়ই তো, ও ভিন্ন জাতের লোক। সাদা মানুষেরা ওকে ধরে নিয়ে যায়। দাস করে রেখে, খুব খাঁটিয়েছিল। অত্যাচার করেছিল। তারপর একদিন সে পালায়। আমাদের গায়ে এসে আশ্রয় চায়। তখন থেকে আমাদের সঙ্গে আছে।
তা বাইরের জাতের লোক কামাউ তোমাদের মাহুঙ্গা হল কী করে?–মামাবাবু গভীর আগ্রহে প্রশ্ন করেন।
ও কিনা অনেক ওষুধ-টষুধ জানে। আর ম্যাজিক দেখাত। তাই আমাদের জাতে ওর খুব খাতির হল। তারপর আমাদের পুরনো মাহুঙ্গা মরে গেলে ও হল নতুন মাহুঙ্গা।
মাহুঙ্গা কী? আমি বলি।
উইচ-ডক্টর! ওঝা। মামাবাবু উত্তর দিলেন।
অ্যাঁ! ওঝা হয়ে গেল, কেউ আপত্তি করল না? আমি বললাম।
ও বাব্বা, কার অত সাহস! কামাউ ভীষণ লোক। সবাই ওকে ভয় করে। তাছাড়া অসুখ-বিসুখ হলে, সাপে কাটলে, জানোয়ারে কামড়ালে বা দুষ্ট অপদেবতা ভর করলে ও ছাড়া আমাদের গতি নেই।
তুমি এত কথা জানলে কী করে? মামাবাবু বলেন।
ঠাকুমার মুখে শুনেছি। ইস, কী ভালো যে গল্প বলত ঠাকুমা, যদি শুনতে, কত রকম কথাই জানত। কিন্তু কী করে শুনবে, ঠাকুমা আমার মরে গেছে চার বছর হল।
টোটো তার ঠাকুমার আরও কিছু প্রশস্তি গাইতে যাচ্ছিল, মামাবাবু থামিয়ে দিলেন—
আচ্ছা এই মূর্তি কামাউ কোত্থেকে পেয়েছে? সঙ্গে নিয়ে এসেছিল?
মোটেই না। আমাদের গ্রামে আসার কিছুদিন পরে কামাউ হঠাৎ মুহূকে পায়। গ্রামের কাছে ছিল একটা পাথুরে খাদ। কামাউ খাদের পাশে একদিন বসে আছে, এমন সময় চড়চড় করে পাথর ফেটে গেল, ভিতর থেকে আবির্ভূত হলেন মুঙ্গু। কামাউ তখুনি পাথর কেটে তাকে নিয়ে এল।
বাঃ চমৎকার, মিলে যাচ্ছে। মামাবাবু আমাদের উদ্দেশ করে বললেন। ডেয়ারিং বিলও দেখেছিল গ্রামের কাছে এক উপত্যকা, সেখানে কালো রঙের পাথরের স্তর।
এ কদ্দিন আগের ঘটনা? মামাবাবু টোটোকে জিজ্ঞেস করলেন। কদ্দিন হবে? টোটো গালে হাত দিয়ে ভাবল। ঠাকুমা বলেছিল এখানে আসার বেশ কিছু বছর আগে।
কিন্তু কামাউয়ের দেবতার সামনে তোমরা নাচগান করো কেন? সুনন্দ কিঞ্চিৎ উত্তপ্ত হয়ে বলল।
আজ করছি, প্রথমে করতাম না। ঠাকুমা বলেছে, প্রথম প্রথম কামাউ নাকি একা একা কুটিরের ভিতর মুঙ্গুর পুজো করত। করে সে নাকি দৈবশক্তি পায়। আমাদের জাতের কেউ কাছে যেত না, আমল দিত না। পরে যখন ওর দাপট বাড়ল, গ্রামে কোনো বড় উৎসব হলে ও মুলুকে নিয়ে আসত নাচ-গানের আসরে। প্রথম দিকে কেউ কেউ বলেছিল, ওর দেবতার সামনে আমরা নাচব কেন? কিন্তু বেশির ভাগ ওর দলে। কামাউকে তাদের দারুণ বিশ্বাস। তাছাড়া লোকটা ভয়ঙ্কর। ঠাকুমা বলত, ও নাকি বাণ মারতে জানে। তোমার ওপর কোনো কারণে চটে গেছে, রাত্তিরে তুমি ঘুমোত গেলে, কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। ওমা, সকালে সবাই দেখবে মরা কাঠ হয়ে আছ।
হুম্। তোমার ঠাকুমা দেখছি অনেক গল্প বলেছে।
মামাবাবুর মন্তব্যে উৎসাহিত হয়ে টোটো বলল, ঠাকুমা যে কত গল্প জানত! সব মনে ছিল।
বেশ শুনব আর একদিন। মামাবাবু চিন্তান্বিতভাবে তাঁবুতে ঢুকে যান।
রাত্রে মামাবাবু বললেন, এতক্ষণে বুঝলাম কামাউয়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কেন সর্দার আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল। ফন্দিটা এঁটেছিলাম বটে, কিন্তু রীতিমতো সন্দেহ ছিল। কতটা খাটবে। নিজেদের দেবতা হলে খুব সম্ভব ছেলের প্রাণ গেলেও সর্দার ধর্মের আইনকানুন ভাঙত না। আমাদের মূর্তি দেখতে দিত না। কিন্তু ও তো কামাউয়ের দেবতা। কাজেই ছেলের প্রাণ বাঁচাতে নিয়ম বদলানো যেতে পারে।
ঐ জন্যে কামাউয়ের সঙ্গে সর্দারের অত তর্ক হচ্ছিল। সুনন্দ বলল, উঃ! কী ক্ষেপেছিল ওঝাটা, কিছুতেই দেখতে দেবে না। শেষে সর্দার জোর করে অর্ডার দিল তবে–
প্রথমবার মুঙ্গুদর্শনের পর চতুর্থ দিন।
আমি ও সুনন্দ বনপথে আসছি হঠাৎ সর্দারের সঙ্গে মুখোমুখি। দুজন সঙ্গী নিয়ে সে আসছিল। সর্দারকে দেখে সুনন্দ হেঁকে বলল, এই যে সর্দার, কোত্থেকে? তারপর তোমাদের নৌকো আবার ওপারে যাচ্ছে কবে?
দিন পনের-ষোল পরে।
বেশ বেশ। যাবার দিন দুই আগে আমাদের খবর দিও কিন্তু। একেবারে শেষ সময়ে বললে হু করে বেরনো মুশকিল। গোছগাছ করতে হবে, সংসার পেতে বসেছি।
সুনন্দের উচ্ছ্বাসে সর্দারের কিন্তু বিন্দুমাত্র ভাবান্তর দেখা গেল না। বলল, তোমরা এখন যাবে না।
অ্যাঁ! সে কি! কথাটা যেন বিশ্বাস হয় না। বোধহয় শুনতে ভুল করেছি।
তোমাদের এখন যাওয়া হবে না। সর্দার পুনরুক্তি করে।
তবে কবে যাব? আমাদের ওষুধ তো শেষ হয়ে যাবে দিন পনেরোর মধ্যে। তারপর এখানে থাকব কী করতে?
নতুন ওষুধ বানাও। এদেশ থেকে যখন এই ভীষণ রোগ একদম চলে যাবে, আর একটা লোকও হোমার অপদেবতার কবলে পড়বে না, তখন তোমাদের ছুটি। আমাদের অভিশাপ মুক্ত করে দাও, তোমাদের সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।
কিন্তু সর্দার ওষুধ বানাব কী করে? সেসব মালমশলা এদেশে পাব কোথায়? দেশে যাই, অনেক ওষুধ তোমাদের বানিয়ে দেব। আমরা নিজেরা ওষুধ নিয়ে এসে রোগ একেবারে তাড়িয়ে দেব দ্বীপ থেকে।
না, এখন যাওয়া চলবে না। আগে কাঁপুনিরোগ সারুক। সর্দার দৃঢ় স্বরে বলে।
কী মুশকিল, ওষুধ পাব কোথায়? বানাও।