মামাবাবু কলমটা পকেটে গুঁজলেন। সযত্নে বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ অঙ্কিত জ্যোতিষচর্চার নিদর্শন কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন, তারপর গালে হাত দিয়ে উদাস হয়ে বসে রইলেন।
দাবার গুটি বোর্ড সুনন্দ ইতিমধ্যে গুছিয়ে ফেলেছিল।
দেখি, কামাউয়ের মুখ আক্রোশে বিকৃত হয়ে উঠেছে। মুঙ্গুর সম্মান রক্ষা করতে সে বদ্ধপরিকর।
সর্দার দ্বিধাগ্রস্ত। ধর্মবিশ্বাস ও প্রিয় ছেলের প্রাণ, এই দোটানায় দুলছে তার হৃদয়। সর্দার কামাউয়ের দিকে এগিয়ে গেল। সমস্ত ভিড়টা তাদের ঘিরে ধরল।
সর্দার ও কামাউয়ের মধ্যে কথা আরম্ভ হল। বুঝলাম, কামাউ সম্মতি দিলেই সর্দার আমাদের মুঙ্গুর সাক্ষাতে হাজির করবে।
প্রথমে নিচু স্বরে কথাবার্তা হচ্ছিল, কিন্তু ক্রমে দুজনের গলাই চড়তে থাকে। কামাউয়ের এক কথা বার বার কানে আসছিল, আপানা আপানা, অর্থাৎ না না।
সর্দারের মেজাজও গরম হচ্ছিল।
অন্যদের হাবভাব দেখে মনে হল তারাও সর্দারের পক্ষে। অসুস্থ ছেলেটি তাদের পরম প্রিয়। তার প্রাণ বাঁচাতে তাদের আগ্রহ বেশ বোঝা যাচ্ছিল। তাছাড়া মুঙ্গুর মেজাজ শান্ত করতে যে দাওয়াই মামাবাবু বাতলেছেন সেটাও তাদের মনে ধরেছে। কামাউয়ের চেয়ে আমাদের শক্তির ওপরই তাদের বেশি আস্থা।
মিনিট দশেক পর সর্দার গটগট করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর স্বরে বলল, আমি আদেশ দিচ্ছি, যাও তোমরা মুঙ্গুর সামনে পুজো আরম্ভ করো। কেউ বাধা দিতে এলে তার মাথাটা আর ধড়ের ওপর আস্ত থাকবে না, মনে রেখো।
মুখ ঘুরিয়ে সর্দার কামাউ এবং তার গুটিকতক ভক্তকে ক্রুদ্ধ চোখে দেখে নেয়।
কামাউ তখন রাগে ফুলছে। চিৎকার করে অভিশাপ দিচ্ছে, সবংশে নিপাত যাবি।
মুঙ্গু কাউকে রক্ষা রাখবে না। শয়তান বিদেশিগুলোকে এখুনি খতম কর। কী, তোরা দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? বাধা দে।
কিন্তু কেউ বাধা দিল না। প্রতিবাদ করল না। কামাউয়ের দুই চেলা ত্যাড়া-বাকা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। কিন্তু তারাও এগোলো না।
উঃ অসহ্য! নিষ্ফল ক্রোধে ফুলতে ফুলতে কামাউ দ্রুত পায়ে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেল।
সর্দার বলল, কী কী দরকার বলো, আনিয়ে দিচ্ছি।
মামাবাবু বললেন, থাক, আমরা নিজেরাই জোগাড় করে নেব! তারপর গলা নামিয়ে আশ্বাসের সুরে বললেন, কিছু ঘাবড়িও না। মুত্যুকে আমি ঠিক ম্যানেজ করে দেব। চটবে না।
সুনন্দ শীগগির বেশ কিছু নারকেল ছোবড়া জোগাড় করো। আর একটা পাত্র। ধোঁয়া দিতে হবে।
কার বুদ্ধির গোড়ায় কে জানে! আমার কানে ফিসফিসিয়ে কথা কটা বলে সুনন্দ, এই যাচ্ছি মামাবাবু! বলে একলাফে এগোলো।
মুঙ্গুর মন্দিরের দরজায় চাপা কাঠের তক্তাটা আগে থাকতেই ভোলা ছিল। মন্দিরের কাছে পৌঁছে মামাবাবু অর্ডার দিলেন, এবার ছোবড়ায় আগুন লাগাও। খুব ধোঁয়া হয় যেন।
একটা হাতলওলা স্টিলের ডেকচি ঠেসে নারকেল ছোবড়া ভরা হয়েছিল। সুনন্দ লাইটার জ্বেলে আগুন দিল। তারপর দুজনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করে ফেললাম।
মামাবাবু হঠাৎ হাঁ রে রে রে বলে বিকট এক হুঙ্কার ছাড়লেন। তারপর দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমাদের বললেন, আমি ভিতরে ঢুকছি। তোমরা দরজার মুখে বসে পড়ো। খুব ধোঁয়া ওঠাও আর যা ইচ্ছে মন্ত্র আওড়াও। জোরে জোরে।
মন্ত্র! কীসের মন্ত্র?
আহা, ঐ কবিতা-টবিতা যা হয় কিছু। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত যা মনে আসে। থামবে । এই বলে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে মুজুর মুখোমুখি হলেন।
একনজরে একবার দেখে নিলাম মুঙ্গুকে।
ঘরটার সামনে তখন সমস্ত দ্বীপের বাসিন্দা এসে জড়ো হয়েছে। থমথমে আবহাওয়া। মুহূকে বিদেশি চর্মচক্ষে দেখল–না জানি কী অঘটন ঘটবে। বজ্রপাত না ভূমিকম্প! এক অজানিত আশঙ্কায় তাদের হৃদয় আচ্ছন্ন। মুখগুলো বিবর্ণ। চোখে ভয় বিস্ময়।
বুঝছি যে সমস্ত ব্যাপারটায় এক বিরাট প্যাঁচ খেলছেন মামাবাবু। কিন্তু কেন? উদ্দেশ্য কিছু ধরতে পারছি না। জিজ্ঞেস করারও উপযুক্ত সময় নয় এটা। অতএব প্রতীক্ষা করা যাক। ধীরে ধীরে সব রহস্যই উঘাটিত হবে।
সুনন্দকে বললাম, আমি বাংলা চালাচ্ছি, তুই দেবভাষা ঝাড়।
অলরাইট! সংস্কৃতে আমার লেটার ছিল ম্যাট্রিকে, শুনবি?
দুজনে আচমকা এমন বিটকেল হেঁড়ে গলায় আওয়াজ ছাড়লাম যে সামনের লোকগুলো চমকে সাত হাত পিছিয়ে গেল। দুটো তালপাতার পাখা দিয়ে প্রাণপণে ধোঁয়া ওড়াই আর মুঠি পাকিয়ে কী ভীমবিক্রমে কাব্যপাঠ। বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল কারণ ভিতর থেকে মামাবাবুর চাপা স্বর শুনলাম, একটু আস্তে।
ঝাড়া পনেরো কুড়ি মিনিট চিৎকার করে গলাটা আমার ধরে এল। দম নিতে থামলাম।
মামাবাবু কী করছেন? কৌতূহলী হয়ে পিছনে তাকালাম।
ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম তিনি সেই অদ্ভুতদর্শন বিগ্রহের পরে ঝুঁকে পড়েছেন। হাতে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। গ্লাসে চোখ লাগিয়ে কী দেখছেন। একেবারে তন্ময়। পাশে মাটির ওপর খোলা একখানা সাদা কাগজ, কী সব ছবি আঁকা। একটা পেন্সিল মাটিতে পড়ে।
একটা নিচু মাটির বেদির ওপর শিলের মতো একখণ্ড কালচে পাথর চিৎ করে শোয়ানো। পাথরের ওপর খোদাই করা এক মূর্তি। প্রায় হাতখানেক লম্বা। মানুষের মূর্তি নয় এটুকু বুঝলাম। কোনো জন্তু বা কোনো কাল্পনিক বস্তু। অদ্ভুত আকৃতি।