খানিকক্ষণ বসে থেকে মনটা ভারি স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। কথা কইতে ইচ্ছে করে না। কান পেতে শুনি প্রকৃতিরাজ্যে নানান আনন্দধ্বনি। কতরকম কীটপতঙ্গ ডাকছে মনের খুশিতে। আর অবিশ্রান্ত জলরাশির আনন্দ উচ্ছ্বসিত কলধ্বনি।
চুপচাপ দুজনে বসে থাকি।
ফিরে আসতে মামাবাবু বললেন, আজ জমজমাট ব্যাপার। কী ঢাক বাজছে! শুনলাম, ওদের মুঙ্গু অর্থাৎ দেবতাকে আজ বের করবে। জানো তো, সোয়াহিলি ভাষায় মুঙ্গু মানে দেবতা। চলো দেখে আসি।
সুনন্দ বলল, আমি যাব না। তার বিরক্তি কাটেনি।
আমার মনটা কিন্তু উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। দ্বীপের আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু সুনন্দকে ফেলে যাই কী করে? অতএব আমিও বললাম, থাক, আজ যাব না। তখন মামাবাবু একলাই গেলেন।
রাত্রে আবার কিছুক্ষণ সমুদ্রতীরে এসে বসি। তরঙ্গের কলরোল ছাপিয়ে সমানে কানে আসছে ঢাকের দুম দুম দুম…। মাঝে মাঝে অট্টরোল। কুটিরবাসী মুঙ্গুকে এরা সহজে বের করে না। চোখেই দেখিনি তাকে! ইস, সুনন্দ না বেঁকে বসলে যাওয়া যেত।
বিকেলে দেখেছি নাচিয়েরা নানারকম সাজপোশাক করে প্রস্তুত হচ্ছে। কত রকম মুখোশ, বিদঘুঁটে সাজ।
তাঁবুতে ফিরে এসে শুয়েছি। ঢাকের বাদ্যিতে ঘুম আসা দায়। সুনন্দ তো দিব্যি নাক ডাকাতে লাগল। এপাশ ওপাশ করছি, হঠাৎ দেখি মামাবাবু ফিরে এলেন।
তিনি শুলেন না। তাঁবুর মধ্যে একটু খুটখাট করেই আবার বেরিয়ে গেলেন। কী দরকার কে জানে! তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
পরদিন মামাবাবুকে কিঞ্চিৎ গম্ভীর দেখলাম। অন্যমনস্কভাবে কী জানি ভাবছেন।
অবশ্য দৈনন্দিন প্রোগ্রামে কোনো বদল হয়নি। যথারীতি সকালে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করেছেন। তারপর বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দুপুরে বই পড়েছেন। স্পেসিমেন সাজিয়েছেন। তবে কথাবার্তা বলছেন কম।
তার এই ভাবটা সুনন্দরও চোখে পড়েছিল। বলল, কী ব্যাপার রে?
বললাম, কিছু বুঝছি না।
পরদিন মামাবাবুর মুড ঐ একই খাতে বইল।
একটা নতুন জিনিস লক্ষ করলাম, তার বই পড়ার সময় বেড়েছে। ব্যস্তভাবে এ-বই সে-বই ঘাঁটছেন।
সাধারণত প্রাণিবিজ্ঞানের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে তিনি সুনন্দর সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু এ দুদিন সুনন্দকে তিনি মোটেই আমল দিলেন না।
আমার মন বলছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে!
তৃতীয় দিন চা-পানের পর। এবার আমাদের দৈনিক ডিউটি দ্বীপের হাসপাতালে যাওয়া। যদি কোনো রুগী থাকে।
সেদিন মামাবাবুর গাত্রোত্থানের কোনো লক্ষণ দেখলাম না। বেশ নিশ্চিন্ত মনে গাছের তলায় পা ছড়িয়ে খুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বসে বই পড়ছেন।
আমাদের কী? যাই, নৌকো চাপি। গুটিগুটি উঠছি, একজন লোক এসে দাঁড়াল।
লোকটাকে চিনি, সর্দারের এক পার্শ্বচর। বলল, শীগগির চলো। সর্দারের ছেলের হোমা হয়েছে। গা তেতে, পুড়ে যাচ্ছে। সবাই তোমাদের জন্য সেই কুটিরের সামনে অপেক্ষা করছে। যাচ্ছ না দেখে সর্দার আমায় ডাকতে পাঠাল। চলো চলো–
আমি ও সুনন্দ দাঁড়িয়ে পড়ি। দূর ছাই অযাত্রা কোথাকার! মামাবাবু একা যাবেন, না আমাদেরও সঙ্গে যেতে হবে ভাবছি, এমন সময় মামাবাবুর গম্ভীর গলা শুনতে পেলাম, যাইনি, কারণ গেলে কোনো লাভ হত না। আমাদের ওষুধে সর্দারের ছেলে বা অন্য কোনো কাঁপুনি রুগীই আর সেরে উঠবে না।
তার মানে? লোকটির চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে যায়।
মানে ওষুধের গুণ নষ্ট হয়ে গেছে। ওষুধ যখন বানানো হয় তখন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত করা হয়। সেই সময় পেরিয়ে গেলে ওষুধ হয়ে পড়ে প্রাণহীন, অকেজো। আমাদের ওষুধে কাল অবধি শক্তি ছিল, আজ ঐ বড়িগুলোর শক্তি মৃত। বড়িতে আবার নতুন করে শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। পুজো-আর্চা করতে হবে। অনেক সরঞ্জাম চাই। সেসব এখানে পাব কোথায়? তুমি সর্দারকে বলো, ছেলের জন্যে কামাউকে ডাকতে। আমার দ্বারা হবে না।
লোকটা এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল।
আমরা দুজন হতভম্ব। এ কী কাণ্ড! মামাবাব হাঁডিপানা মখ করে বসে আছেন। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না। দেখা যাক কী ঘটে।
দূরে দেখা গেল সর্দার আসছে। সদলবলে হন্তদন্ত হয়ে।
সে এসেই উত্তেজিত স্বরে বলল, কী ব্যাপার? শুনলাম নাকি ওযুধ দেবে না? ওষুধের শক্তি শেষ হয়ে গেছে! পুজোটুজো করতে হবে?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ।
তবে বসে আছ কেন, পুজো লাগাও। কী কী লাগবে বলো, কটা বলি? এক্ষুনি আনিয়ে দিচ্ছি। মন্ত্র-টস্ত্র তোমাদের জানা আছে তো?
হ্যাঁ, তা আছে কিন্তু যে বস্তুটি নইলে হাজার মন্ত্র পড়েও কাজ হবে না, ওষুধে একফোঁটা শক্তিও ফিরিয়ে আনা যাবে না, সে জিনিসটি এখানে কই?
কী সে জিনিস?
একটি দৈবশক্তিসম্পন্ন পাথর। সেটা আছে আমাদের দেশে। সেরকম পাথর না পেলে শুধু মন্ত্র পড়ে কী হবে? বরং কামাউয়ের ওষুধ খাওয়াও তোমার ছেলেকে।
ধুত্তেরি! এ কামাউয়ের কম্ম নয়। ভীষণ জ্বর, ওর সাধ্য নেই এমন রুগীকে সারায়। এত জ্বরে কামাউয়ের ওষুধ খাওয়ানো হলে দেখেছি রুগী প্রায়ই সারেনি। মরে গেছে। তোমরা যাহোক কিছু ব্যবস্থা করো।
কী আর করব? মামাবাবু হতাশ কণ্ঠে জানান।
অমন জাঁদরেল সর্দার হাউমাউ করে প্রায় কেঁদে ফেলল, ওঃ, কী হবে! আমার অমন জোয়ান ছেলেটা বেঘোরে মরবে নাকি? ও যে আমার সেরা ছেলে। কী কব্জির জোর! কী বর্শার তাক! উৎসবের দিন থেকে জ্বর হয়েছে। আমাকে বলেনি। ওষুধ খায়নি। বন্ধুদের বলেছিল, ও আপনি সেরে যাবে। এখন উঠতে পারছে না। চোখ দুটো রক্তের মতো লাল, শুধু গোঙাচ্ছে, ছটফট করছে। থরথর করে কাঁপছে। ধরে রাখা যাচ্ছে না। গায়ে হাত দেওয়া যায় না, এত তাত! ওঃ! ওঃ!।