সর্দার বলল, এ-অভিশাপ দ্বীপে আগে ছিল না। মাত্র বছরখানেকের আমদানি। কয়েকজন উপকূল থেকে ঘুরে এসে এই হোমা অর্থাৎ কাঁপুনি-জ্বরে পড়ে। ক্রমে আজ দ্বীপের অধিকাংশ লোককে এই রোগ ধরেছে। সহজে মরে না কেউ, কিন্তু দিন দিন দুর্বল করে দিচ্ছে আমাদের। আমার নিজেরও একবার জ্বর হয়েছিল। জ্বর ছেড়ে গেল দুদিনে। কিন্তু ওঃ, পরে সাত দিন ধরে পা টলত, মাথা ভনভন করত। টোটো বলছে, তোমাদের ওষুধ খেয়ে নাকি অল্পক্ষণেই জ্বর সেরে গেছে, আর এক রাতেই তাজা হয়ে উঠেছে। তাই তো ডাকলাম। কী যে করি এই নিয়ে! কামাউ বলে, দুষ্ট্র অপদেবতা ভর করেছে। অনেক পুজো-টুজো তো দিচ্ছি, কিন্তু তাড়াতে পারছি না।
প্রায় দুঘণ্টা পর।
দেখি একটা বড় দল ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে। সর্দার সামনে। সেই রুগী দুজনও রয়েছে। হেঁটে আসতে পারছে, অর্থাৎ জ্বর কমেছে। আমরা গম্ভীর মুখে অপেক্ষা করি।
রুগী দুজন সামনে এসেই সটান শুয়ে পড়ল, জয় বাবা মাহিন্ডি! কী দাওয়াই দিয়েছ। জাদু!
সর্দার বলল, আশ্চর্য ওষুধ তোমাদের। এতদিন কামাউ-এর ওষুধ খেয়েছি। কিন্তু এ অদ্ভুত ব্যাপার কোথায় শিখলে?
সুনন্দ চাল মেরে বলে, হুঁ হুঁ বাবা, এ কি যে-সে জিনিস! মন্ত্রপূত করা। কামাউ এ-বস্তু পাবে কোথা? গুরুর কাছে শিখতে হয়।
মাহিন্ডিদের অসামান্য শক্তি দেখে সবাই ভক্তিতে গদগদ।
মামাবাবু বললেন, আবার কারো জ্বর হলে খবর দিও, বা এখানে পাঠিও। না-না, পাঠানোর দরকার নেই, আমরাই যাব। প্রত্যেকদিন সকালে ঐ কুটিরে।
রুগীরা দুটো বড় বড় ডাব নিয়ে এল। ডাক্তারের ফি!
সবাই খুশি, শুধু একজন ছাড়া। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে, কপালে ভ্রুকুটি, হিংস্র চাউনি। সে কামাউ।
.
০৮.
ঘটনাটায় আমাদের দ্বীপের জীবনযাত্রা এক নতুন পথে মোড় নিল।
প্রত্যেকদিন সকালে একবার গ্রামের হাসপাতালে হাজির হই, দু-একটি রুগী মজত থাকে প্রত্যেকদিন।
দ্বীপের প্রত্যেকটি লোকের মধ্যেই বোধহয় ম্যালেরিয়ার জীবাণু সংক্রামিত হয়েছে। শিশু ও বালক-বালিকারাই ভোগে বেশি। এদের জীবনীশক্তি খুব জোরালো। তাই দু-এক ডোজ ওষধ খেয়েই গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু এভাবে কতদিন যাবে? সাময়িকভাবে প্রতিরোধ করে কী লাভ! বারবার জ্বর হয়ে প্রাণশক্তি যে ক্ষয় হয়ে যাবে। মামাবাবু বললেন, ফিরে গিয়ে স্বাস্থ্যদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ওষুধপত্র নিয়ে দল পাঠাতে হবে। ডিডিটি ছড়িয়ে ম্যালেরিয়ার বিষবাহী মশা ধবংস করতে হবে, নইলে এরা মরবে।
আমাদের খাতির এখন দেখে কে?
নাচ-গানের আসরে সর্দারের পাশেই আমাদের আসন নির্দিষ্ট হয়েছে। তাদের সঙ্গে নাচে যোগ দিতে আমাদের সাধাসাধি করে। তাল বুঝে সুনন্দ একদিন লাফিয়ে উঠে নাচ শুরু করে দিল। আধঘণ্টা নেচে-কুঁদে বেদম হয়ে সে বসে পড়ে। সকলে খুব তারিফ কল, তোমার হবে। কদিন অভ্যেস করলেই হবে। ফার্স্ট ক্লাস নাচিয়ে হয়ে যাবে। শুনে সুনন্দের কী গর্ব!
আমার বাবা নাচার শখ নেই! তবে ওদের নাচের তালে পা আপনি নেচে ওঠে। তখন চুপ করে বসে থাকা যায় না। আমি তাল ঠুকি। টিনের কৌটো বাজাই। মামাবাবুকেও দেখেছি ঘাড় নেড়ে তাল দিচ্ছেন।
নাচ এদের রক্তে। ছেলে-বুড়ো মা-মেয়ে সবাই নাচের নামে পাগল। থুথুরে বুড়ো, বয়সের ভারে বেঁকে গেছে, সেও পা ঠোকে। হাততালি দেয় নাচের সাথে। এদের সমস্ত সুখ-দুঃখের প্রকাশ নাচের মাধ্যমে।
সমুদ্রে একটা বড় মাছ উঠল। অমনি তীরে যারা ছিল একপাক নেচে নিল। শুয়োর মারা হয়েছে, ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আজ, ব্যস, নাচ চলবে দু-গুণ। আবার একজন বুড়ো মরল, তার শ্রাদ্ধেও দেখি সবাই নেচে নেচে শোক প্রকাশ করছে।
সর্দার নাচে। কামাউও নাচে। চত্বরের একটু বাইরে এদের এক মন্দির আছে। উঁচু টিলার ওপর ছোট্ট ঘর। দেয়াল ও মাথার ছাউনি অন্য ঘরের মতো। কোমর সমান উঁচু এক প্রবেশপথ। তার ওপর তক্তা দিয়ে বন্ধ থাকে। কামাউ প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা সেই দরজা খুলে ভিতরে দেবতার উদ্দেশে মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে। সেই দেবতার চেহারা আমরা দেখিনি। কামাউ একা যায়, অন্য কেউ যায় না। বিশেষ উৎসবে নাকি দেবতাকে বের করা হয়। আমাদের দেবভক্তি তেমন প্রবল না হওয়ায় ও-বিষয়ে মাথা ঘামাইনি।
তবে যে-কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম তা হল, কামাউয়ের পুজোর পদ্ধতি।
দু-চার লাইন মন্ত্রপাঠ। তারপর সে মন্দিরের চারপাশে বারকয়েক নেচে নেচে ঘুরবে। পুজো শেষ। এইবার সে আসবে চত্বরে। মজলিসে যোগ দেবে। সেখানেও সে নাচে। তবে রোজ নয়, বিশেষ উপলক্ষে। তার নাচের বিশেষত্ব আছে।
সে নাচবে একা। অন্যরা তখন ওঠে না। ঢাক আর ডামের আওয়াজ চতৃর্তণ হয়ে ওঠে। কী সমস্ত সাংঘাতিক অঙ্গভঙ্গি ও মুদ্রা, তেমনি বিকট মেকআপ! মুখে বুকে হাতে পায়ে লাল কালো সাদা হলদে রঙের ছড়াছড়ি। হঠাৎ দেখলে বুক ধড়াস করে ওঠে। কী বাবা ওটা? মানুষ না রাক্ষস?
ভাঁটার মতো চক্ষুতারকা ঘুরছে। গায়ে হাড়ের গয়নায় খটাখট আওয়াজ। মাথায় লম্বা লম্বা পালকের মুকুটে ঝোড়ো কাপন। থেকে থেকে হুহুঙ্কার।
ভূতপ্রেত অপদেবতা বশ করা হচ্ছে কিনা, তাই এইসব ভয়ঙ্কর কলাকৌশল।
সুনন্দ আপসোস করে, ইস একটা মুভি ক্যামেরা থাকলে যা হত! কোথায় লাগত হলিউডের ছবি!
আমাদের তাঁবু উপহারে ভরে যেতে লাগল। আমরা সর্দারের প্রিয়পাত্র, তাদের মহা উপকারী বন্ধু, সবাই চায় আমাদের সন্তুষ্ট করতে। উপহার যা আসে বেশির ভাগই খাদ্যবস্তু। মাছ, মাংস, পাখি, কচ্ছপের ডিম, কাঁকড়া। ফলটলও আসে। একরকম শিম আসত, দেশি শিমের মতো স্বাদ। আর আসত কাড়িকাড়ি নারকেল ও জল-ভরা কচি মিষ্টি ডাব।