আশ্চর্য হালকা ও উৎফুল্ল মন নিয়ে আমরা তাঁবুর দিকে রওনা দিলাম। অভিযান সার্থক। বিদায় কেল্লাপাহাড়! আর কখনো এখানে আসা হবে কিনা জানি না। যদিও আসার ইচ্ছে রইল। আসন্ন গ্রীষ্মের ছোঁয়াতে ডালে ডালে নবীন পাতার আবির্ভাব ঘটেছে। আবার বসন্তের রেশটুকুতে প্রকৃতি কী মধুর। এত কাণ্ড যে ঘটে, প্রকৃতি-রাজ্যে কোনো ক্ষেপ নেই যেন। কে বলবে এই পাহাড়-জঙ্গলে মানব ইতিহাসের বিচিত্র সব পর্ব অভিনীত হয়েছে যুগ যুগান্তর ধরে। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা লোভ লালসায় প্রকৃতি সর্বদাই বুঝি এমনিই নির্বিকার, উদাসীন!
.
পরদিন বিকেল। মিস্টার দত্তর বৈঠকখানায় চারজন জমায়েত হয়েছি। গতকাল ফিরে এসে প্রথমে এক চোট ধমকের পর আমাদের খবর শুনে যে ধরনের অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম, তা অন্তত আমার ভাগ্যে আর কখনো জোটেনি। রতনের কাকা কাকিমা আমাদের অভিযানের সমস্ত বিবরণ খুঁটিয়ে শুনলেন। মিস্টার দত্ত দুর্গ ও সুড়ঙ্গ সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করলেন। কাকিমার আগ্রহ দেখলাম সব চেয়ে বেশি সেই ভয়ংকর শঙ্খচূড় সাপটা সম্বন্ধে। রাতের বেলায় সেই রহস্যময় শব্দ অর্থাৎ ভাল্লুকের কান্নার কথা শুনে তিনি বড় বড় চোখ করে বললেন, কে জানে বাপু ওটা কীসের আওয়াজ ছিল। রাত্তিরে যে আবার বাহাদুরি করে দেখতে বেরোওনি তাই রক্ষে। যা ডানপিটে সব।
গতকাল ফেরার পথে রামচন্দ্রপুর থানায় থেমে দারোগাবাবুর হাতে বিগ্রহ সমর্পণ করে। তাকে ক্রোমের ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম (নিকেল সম্বন্ধে অবিশ্যি কিছুই বলিনি)। চন্দ্রজিৎ সিং-এর কথা শুনে দারোগাবাবু স্পষ্টই বললেন যে ওই পাহাড়ে সিং-এর কোনো মাইনিং রাইট নেই, এবং এই বেআইনি কারবার তিনি অচিরেই ঘুচোবেন। বিগ্রহর ব্যাপারে এই কিছুক্ষণ হল খবর এসেছে যে বাবু খগেশ্বর দেব দু-একদিনের মধ্যে নিজেই এসে ডাকর হাতে টাকাটা তুলে দেবেন।
আমরা চারজন গল্পগুজব করছি এমন সময় চাকর এসে খবর দিল যে রতনের ফোন এসেছে, ত্রিপাঠী সাহেবের কাছ থেকে। ফোন সেরে রতন একগাল হাসি নিয়ে ফিরে এসে বলল, পেয়েছে। ওই ছাইরঙা পাথরে নিকেল পেয়েছে ত্রিপাঠী।
আমি ও ডাকু লাফ দিয়ে উঠে রতনকে জড়িয়ে ধরলাম।
থ্রি চিয়ারস্ ফর দা হিরো! ডাকু চেঁচিয়ে উঠল।
রতন বলল, কেন বাপ, আমি একা কেন? তোরা দুজনই বা কীসে কম?
কথাটা খুব ভুল বলেনি রতন। ডাকু দেব-বাড়ির বিগ্রহ উদ্ধার করেছে, আর আমি প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানবের গুহাগৃহ আবিষ্কার করেছি। সত্যিই। আমরা তিনজনেই তো হিরো।
বোসদা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার শুনলাম তাঁর গলা খাক্রানি। কিছু বলবেন কি? আমরা তিনজনেই তার দিকে চাইলাম। কফির পেয়ালাটা হাত থেকে নামিয়ে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বোসদা গম্ভীর গলায় বললেন, আমার কথা ভুলে যেও না ব্রাদার। আমিও যে একজন হিরো! অবিশ্যি তোমাদর বৌদির কাছে। কিন্তু তাঁর কাছে হিরো হওয়াটা যে কত বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট সে তো তোমরা বুঝবে না! আজ সকালেই বারো পাতার একখানা চিঠি দিয়েছি তাকে, আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের বর্ণনা দিয়ে। আর বাকিটা শোনাব সামনের মাসে ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলে।
রতন এবার জয়ধ্বনি দিল–থ্রি চিয়ারস ফর কেল্লাপাহাড়!
আমরা বাকি তিনজনে হুঙ্কার ছাড়লাম–হিপ হিপ হুর-রে!