পঞ্চা গুহায় ঢুকেছিল কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এই গুহামুখ দিয়ে ঢোকেনি পঞ্চা। বলেছি তো এটা সুড়ঙ্গ। পঞ্চা সুড়ঙ্গের অন্য মুখ দিয়ে এসেছিল। সেই মুখটা হল আমাদের তাঁবুর সামনে, দুর্গ-বাড়ির ভিতরে।
তুই বঝেছিলি পঞ্চা এর মধ্যে ঢুকেছে? রতন বলল।
পঞ্চা কেল্লাপাহাড়ে এসেছে সেটা সন্দেহ করেছিলাম। তাই প্রাণপণে খুঁজছিলাম পাহাড়ের গোপন জায়গাগুলি। তারপর বোসদাই আমাকে আসল ক্লু-টা দিলেন!
আমি!-বোসদা বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ওঠেন। বলছ কী ব্রাদার!
আরো বলছি, ডাকু বলে চলল, জগন্নাথপুরেই প্রহ্লাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে পঞ্চা হয়তো কেল্লাপাহাড়ে যেতে পারে লুকোতে। বংশীর সূত্রে এ কেল্লার অন্ধিসন্ধি পঞ্চার চেনা, সুতরাং লুকোবার পক্ষে আইডিয়াল জায়গা। তারপর কাল এই পাহাড়ে এসে পেলাম একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট, ওই ব্রান্ডের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখেছি বংশীর বাড়ির উঠোনে। জেনেছিলাম পঞ্চার ওই সিগারেট। অতএব আমার ধারণা আরো দৃঢ় হল। আজ সকালে বোসদা বললেন তিনি রাত্তিরে অদ্ভুত কান্নার মতো শব্দ শুনেছেন। দুগর মধ্যে থেকে। তোরা চলে যেতেই কৌতূহলী হয়ে ঢুকলাম ওই ঘরগুলোর ভেতর। খানিক সন্ধান করতেই চোখে পড়ে গেল খোলা সুড়ঙ্গ-মুখ। ইনস্পেক্টরও বলেছেন পঞ্চা এদিকে এসেছে। অতএব প্রস্তুত হয়েই ঢুকলাম সুড়ঙ্গে। কান্নাটা ছিল ভাল্লকের, সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। খোলা সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেসে এসেছিল আওয়াজ। সুড়ঙ্গের ভিতর আবিষ্কার করলাম ভাল্লুকের কীর্তি। তারপর ধোঁয়া দিয়ে ভাল্লুক তাড়ালাম।
আমাদের দৃষ্টি আবার চলে গেল পঞ্চার মৃতদেহের দিকে। কী ভয়ংকর! বলে উঠলেন বোসদা।
ভয়ংকর ছাড়াও অবিশ্যি এর আরেকটা দিক আছে।
ডাকুর কথাটা শুনে তার দিকে চাইতেই সে একটু হেসে পঞ্চার দেহ পাশ কাটিয়ে গুহার ভিতর খানিকটা ঢুকে গেল। তারপর একটা ফাটলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল। একটা মূর্তি। রতন আর আমার মুখ দিয়ে একসঙ্গে একটা কথা বেরিয়ে পড়ল–
দেববাড়ির বিগ্রহ!
ডাকু মাথা নাড়ল। পঞ্চা এটাই লুকোতে চেয়েছিল সুড়ঙ্গে। সে বোধহয় সুড়ঙ্গের এই মুখটা পাথর সাজিয়ে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। ভাল্লুক তখন ছিল না গুহাতে। তারপর বাসায় ফিরে ভাল্লুক অতর্কিতে পঞ্চাকে আক্রমণ করে। এই মূর্তি পেয়েছি অনেক ভিতর দিকে–সুড়ঙ্গের এক কুলুঙ্গিতে।
বিগ্রহ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে পরীক্ষা করলাম আমরা। কিছু অলঙ্কার জোর করে খুলে নেওয়া হয়েছে বটে, তাতে মূর্তির কোনো ক্ষতি হয়নি। এই প্রাচীন কারুশিল্পের নমুনার দিকে অবাক হয়ে দেখছি, এমন সময় খেয়াল হল ডাকু বিড়বিড় করে কথা বলছে
ব্যবসা করব। একজন আমায় পার্টনার করবে বলেছে। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে চালান দেবার ব্যবসা…আর মনের সুখে জঙ্গলে ঘুরব।
সত্যিই তো! ডাকু যে তিন হাজার টাকা পাচ্ছে সেটা খেয়াল হয়নি। আশ্চর্যভাবে ডাকুর একটা হিল্লে হয়ে গেল।
এবার তোমার ক্রোম আবিষ্কারের কথাটা ডাকুকে বলে দাও, বোসদা রতনকে বললেন।
তুই ক্রোম পেয়েছিস? ডাকু উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল। চল, বাইরে গিয়ে সব শুনব। এই অন্ধকারে আর ভালো লাগছে না।
শুধু তাই নয়, বোসদা বলে উঠলেন, বারোটা বাজে। মনে আছে, দুটোর মধ্যে পলাশবুনি পৌঁছবার কথা আমাদের?
ডাক আবার টর্চটা জ্বালল আমাদের পথ দেখাবার জন্য। আলো দেয়ালে পড়তেই আমার দৃষ্টি একটা জায়গায় আটকে গেল। কয়েকটা লাল রঙের রেখা।
ডাকুর হাত থেকে টর্চ নিয়ে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম।
পাথর মসৃণ করা হয়েছে। তার উপর সাধারণ রেখা নয়, রেখাচিত্র। এ তো আদিম মানবের হাতে আঁকা ছবি! ছবিগুলি ভালো বোঝা যাচ্ছিল না। বেশির ভাগই মুছে গেছে। একটিকে মনে হল মানুষ।
রতনরা অবাক হয়ে আমায় লক্ষ করছিল। ডাকু বলল–কী ব্যাপার?
বললাম, মনে হচ্ছে এ সব প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের আঁকা ছবি। এ গুহা নিশ্চয় খুব প্রাচীন। আদিম যুগে মানুষের বাস ছিল এ গুহায়।
ডাক বলল, হতে পারে। এ অংশটা ন্যাচারাল কেভ্। প্রাচীন গুহা। তবে কিছুদুর গিয়ে গুহাটা মানুষের তৈরি এক সুড়ঙ্গে পরিণত হয়েছে। কেল্লা থেকে গোপনে বেরিয়ে আসার জন্যে এই সুড়ঙ্গের সৃষ্টি।
আমি বেরিয়ে পাশের গুহাতে ঢুকলাম। হা ঠিক যা ভেবেছি। এ গুহার দেওয়ালেও অনেক রেখাচিত্র। লাল রঙে আঁকা। আঁচড় কেটে আঁকা। দুটো মানুষ এবং একটা শিংওলা পশুর ছবি। আর সন্দেহ নেই। এ সব প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা-মানুষের শিল্পচর্চার নিদর্শন।
এরপর আমি খাদে নামলাম। ডাকু বন্দুক হাতে পাহারায় রইল ভাল্লুকের আশঙ্কায়। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে জানি, কিন্তু তাতে আমার ভ্রূক্ষেপ নেই। আবিষ্কারের নেশায় তখন আমার মাথা ভো ভো করছে।
বেশিক্ষণ খুঁজতে হয়নি। পনেরো মিনিটের মধ্যেই আমার প্রত্নতাত্ত্বিকের চোখ আবিষ্কার করল তিনটি বিচিত্র প্রস্তরখণ্ড, পাথরগুলির সামনের দিক ছুঁচলো পিছন দিক হাতলের মতো। যেন বড় ছোরা বা কুঠারের ফলা। এ বস্তু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। মানুষের হাতে গড়া পাথুরে অস্ত্র। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গুহা থেকে নিচে পড়েছে।
পাথুরে অস্ত্রগুলি হাতে নিয়ে উঠে এলাম। রতনকে বললাম, এই অস্ত্র বা গুহাটি পরীক্ষা করলে অভিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাদের সময় স্থির করতে পারবেন। তবে আমার মনে হচ্ছে প্যালিওলিথিক যুগের শেষ ভাগ, অর্থাৎ প্রায় দশ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগেকার মানবগোষ্ঠীর চিহ্ন এগুলি। ভারতের অনেক জায়গায় এমনি অতি প্রাচীন গুহা-মানবের চিহ্ন আবিষ্কার হয়েছে। এই গুহাগুলোর মেঝে খুঁড়লে আরও বহু চিহ্ন পাওয়া যাবে।