থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। রতন চোখে দুরবিন লাগিয়ে খুঁজতে লাগল লোক দুটোকে। হঠাৎ সে দূরবিন নামিয়ে কেমন উত্তেজিতভাবে বলল–চল ওপারে।
আড়চোখে চেয়ে দেখি তার চোয়াল শক্ত, চাহনি গম্ভীর। তার দৃষ্টি রয়েছে সোজা পাথরগুলোর দিকে, যেদিকে আমরা এখন চলেছি।
খাদ পেরিয়ে ওপারে সমতল জায়গাটায় পৌঁছুলাম। আর ক-ঘণ্টা মেয়াদ আমাদের। ঘড়িতে দেখি প্রায় এগারোটা বাজে।
প্রতাপ।
রতন আমার হাত চেপে ধরেছে। আমরা এখন একটা খোলা চত্বরের মতো জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। চারদিকে কালচে পাথরের স্তর।
এগুলোই কি ক্রোম পাথর? আমি প্রশ্ন করলাম।
নিঃসন্দেহে। কিন্তু এটা কী?
কালচে ক্রোমের গায়ে গায়ে আর এক রকম পাথর। হালকা ছাই রঙের। রতন সেই পাথরের কয়েকটা টুকরো তুলে নিল।
এটাতে নিকেল আছে নাকি? আমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
আমার তাই বিশ্বাস।
আমি বললাম, তাহলে তো কেল্লাফতে। আর যদি নিকেল নাই বা থাকে অন্তত ক্রোম তো আবিষ্কার করা গেছে। তাই বা কম কী।
বটে ব্রাদার, এই মতলবে আসা হয়েছে তোমাদের? আর আমার কাছে সব চেপে যাওয়া হয়েছিল?
বোসদার গলা শুনে চমকাই। কখন যে তিনি আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। একটু অপ্রস্তুত হই। তারপর স্বীকার করি–হ্যাঁ এটাই আমাদের অভিযানের আসল উদ্দেশ্য। তবে কথাটা গোপন রেখেছিলাম বাধ্য হয়ে।
বোসদা রাগ দেখিয়ে বললেন, কেন, আমি জানলে কি তোমাদের গোপন কথা ফাস করে দিতাম। না ভয় ছিল আবিষ্কারটা আগে করে ফেলে ক্রেডিট নিয়ে নেব?
আমরা লজ্জিতভাবে মাথা চুলকোই।
যাক বোসদা সত্যি মোটেই রাগেননি। বরং খুশিতে উজ্জ্বল তাঁর মুখ। জায়গাটা ভালো করে দেখছি, হঠাৎ বোসদা বললেন কিন্তু এতেও কি নিকেল আছে ব্রাদার?
বোসদা কী যেন একটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছেন। তিনি সেটা দু-আঙুলে তুলে ধরলেন। একটা আধপোড়া চুরুট।
রতন একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, যিনি পথের কাঁটা তদারক করতে এসেছিলেন, তিনিই ওটা ফেলে গেছেন।
এখান থেকে যে পাথর কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার প্রমাণ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। বড় বড় এবড়ো-খেবড়ো গর্ত আর ইতস্তত ছড়ানো নুড়ি-পাথর।
আমি বললাম, একটা বেআইনি কারবারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না রে রতন?
রতন মাথা নেড়ে সায় দিল। আমি বাজি ফেলতে পারি মিস্টার সিং বিনা লাইসেন্সে এখান থেকে ক্রোম পাথর সরাচ্ছেন। আজ গোপনে এসেছিলেন তার সাকরেদদের কাছে। বোধহয় আমরা কী করছি, তার খবর নিতে।
তাই সিং আমাদের তাড়াতে চাইছিল।
ন্যাচারেলি। পাগলা হাতির গল্পে কাজ হল না তাই তোক লাগিয়ে মৌচাকে ঢিল মেরেছিল। ওই বোধহয় ওপর থেকে পাথরটা গড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের খতম করার মতলবে।
ইসস! বোসদা আক্ষেপ করে উঠলেন। সব শুনে-টুনে মনে হচ্ছে গুলিটা যদি অন্তত লোকটার ঠ্যাঙে-ট্যাঙে লাগতো তাহলে মন্দ হত না।
আমরা তিনজনে ফেরার পথ ধরলাম।
এবার খাদের কাছে এসে আবিষ্কার করলাম দিব্যি একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামছি। এমন সময় হঠাৎ কানে এল এক অদ্ভুত শব্দ। বোসদা থমকে থেমে ধরা গলায় বললেন, ভাই প্রতাপ–এ কান্না কাল রাতেও শুনেছি আমরা!
আমিও তাই ভাবছিলাম। ঠিক সেই একই অমানুষিক বীভৎস কান্নার শব্দ! কিন্তু এবার অনেক স্পষ্ট।
আমরা তিনজনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পাথরের আড়াল থেকে রুদ্ধশ্বসে খাদের দিকে চেয়ে রইলাম।
.
০৬.
মনে হল কান্নার রব আসছে খাদের ওপারে কেল্লাপাহাড়ের গায়ে কোনো গুহার ভিতর থেকে। প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট গভীর খাদ দুই পাহাড়ের মাঝখানে। এই খাদের ওপরের দিকে কেল্লাপাহাড়ের গায়ে দু-তিনটে পাশাপাশি বড় বড় গুহা। গুহাগুলির সামনে খানিকটা বারান্দার মতো জায়গা। তারপরই খাদের ঢল নেমেছে খাড়াই। সবিস্ময়ে দেখলাম, একটা গুহার ভিতর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে গলগল করে, আর সেই সঙ্গে কান্নার স্বর আরো বেড়ে গেল।
এবার হতভম্ব হয়ে দেখলাম, যে-গুহা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল, সেই গুহা থেকে বেরিয়ে এল এক কালো ভাল্লুক, আর তার পিছনে পিছনে দুটো ছানা। বাচ্চা দুটো তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। কী আশ্চর্য–এদের কান্নাই শোনাচ্ছে মানুষের মতো!
ভাল্লুক ফ্যামিলি আস্তে আস্তে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে গেল।
এবার ধোঁয়া একটু কমে এল। পরক্ষণেই সেই গুহার মুখে বন্দুক হাতে ডাকুর আবির্ভাব ঘটল। যেন ভোজবাজি। আমরা থ। ডাকু আমাদের দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকল–চলে আয়, কোনো ভয় নেই। ভাল্লুক পালিয়েছে।
সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে ঠিক অমনি আর একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডাকুর কাছে পৌঁছলাম।
রতন বলল, কী ব্যাপার। এ সব কী?
ডাকু বলল, ব্যাপার অনেক। ভিতরে আয়, দেখতে পাবি।
এই গুহার ভিতর?
হ্যাঁ, তবে এটা সাধারণ গুহা নয়,সুড়ঙ্গ।
আমরা চারজনে সেই প্রায় অন্ধকার গুহার মধ্যে ঢুকলাম।
ঢকে বঝলাম গভীর গহুর। গুহার মুখে কতগুলো বড় বড় পাথর একটার ওপর একটা সাজানো। কিছু পাথর মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ডাকু টর্চ জ্বালল। তারপর একটু এগিয়ে গিয়েই বলল, সাবধান। সামনে দেখ।তার টর্চের আলো মাটিতে শায়িত এক মনুষ্যদেহের ওপর পড়ল।
এক যুবকের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ।
ডাকু বলল–এই হচ্ছে পঞ্চা। মরেছে ভাল্লুকের হাতে।
বোসদা আমার গায়ে ঘেঁষে দাঁড়ালেন।