আমি আর রতন আগে বেরিয়ে পড়লাম। দুজনেরই মনটা খারাপ হয়েছিল, কারণ আমার পক্ষে কেল্লাপাহাড়ের বিশেষত্বের অভাব বেশ হতাশজনক। আর রতনও মাত্র মাস ঘণ্টার মধ্যে খনিজ সম্পদ আবিষ্কারের আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছে। এক ডাকু যদি এর মধ্যে কোনো শিকার জোটাতে পারে তবে তার দিক থেকে হয়তো অভিযানটি একেবারে মাঠে মারা যাবে না।
পুবদিকের সিঁড়ি দিয়ে নেমে জানোয়ার চলার পথ ধরে খানিক এগিয়ে যেতে বনরাজ্যের শোভা দেখতে দেখতে মন কিছুটা ভালো হয়ে গেল। এদিকের জঙ্গল পশ্চিম দিকের চেয়ে বেশি ঘন। কিন্তু আধ ঘণ্টা চলার পরও একপাল বাঁদর ছাড়া আর কোনো জানোয়ার চোখে পড়ল না। পাখি আর পোকামাকড় ছাড়া আর কেউই দর্শন দেবে না এমন একটা ধারণা যখন মনে দানা বেঁধে এসেছে, এমন সময় আমাদের সামনে কিছুদূরে হলদে রঙের কী একটা জিনিসকে নড়তে দেখে দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম।
কোনাকুনিভাবে বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে এগিয়ে চলেছে জিনিসটা। আমরা দুজনে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। একটা লাল গাছের গুঁড়ি ছাড়িয়ে কয়েক পা এগোতেই হাত পঞ্চাশ দূরে প্রাণীটিকে দেখতে পেলাম। ও হরি, জানোয়ার নয় মানুষ। শুধু তাই নয়, এ মানুষ আমাদের চেনা। ইনি মিস্টার চন্দ্রজিৎ সিং। এই হলদে রঙের শার্টপরা অবস্থাতেই আমরা কাল এঁকে দেখেছিলাম।
ওকে ফলো করব।–ফিসফিস করে বলল রতন, দেখি লোকটা কোথায় যায়।
শুকনো পাতা বাঁচিয়ে পা ফেলে আমরা দুজনে মিস্টার সিং-এর পিছনে ধাওয়া করলাম।
সামনের গাছপালার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে ওদিকের পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছি। আরো কিছুদুর গেলেই কালকের সেই খাদের কাছে পৌঁছে যাব। একবার মনে হল মিস্টার সিং থামলেন। পিছন পিরে দেখলেন কি? ঠিক বোঝা গেল না।
একটা লাল ফুলে ভরা প্রকাণ্ড শিমুল গাছ পেরোতেই আমাদের থেমে যেতে হল।
চন্দ্রজিৎ সিং উধাও।
হয় মোড় নিয়েছে, না হয় ঢালে নেমেছে, নয় গর্তে পড়েছে। মোটকথা তাকে আর দেখা দেখা যাচ্ছে না। সিং যে মতলবেই এসে থাকুন, তার পিছনে আর সময় দেওয়া যায় না ভেবে আমরা দুজনে আবার এগোতে লাগলাম।
ঢালে মিনিট খানেক নামার পর হঠাৎ একটা ঘরঘর শব্দ পেয়ে ঘরে উপরে চাইতেই এক মুহূর্তের জন্য আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। কেল্লাপাহাড়ের গা বেয়ে একটা প্রকাণ্ড পাথর গড়াতে গড়াতে আমাদের দিকে ধাওয়া করে আসছে। রতন আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিতেই পাথরখানা আমাদের প্রায় গা ঘেঁষে নিচের দিকে নেমে চলে গেল। পরমুহূর্তে ধড়াম করে আছড়ে পড়ল তলায়। বন্ধ করা নিশ্বাসটা ছেড়ে রতনের দিকে ফিরে বললাম, ব্যাপার কী বলতো? এটা কি প্রকৃতির কীর্তি না মানষের?
একটা কান ফাটানো বন্দুকের গর্জনে রতনের উত্তর চাপা পড়ে গেল। পর পর এতগুলো অস্বাভাবিক ঘটনায় দুজনেই বেশ ঘাবড়ে গেলাম। কোত্থেকে এল এ বন্দুকের শব্দ? ডাকু কোনো জানোয়ারকে ধরাশায়ী করল নাকি? রতন হঠাৎ আমার আস্তিনটা খামচে ধরে বলল, ওই দেখ।
দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখি পাহাড়ের গা দিয়ে উধ্বশ্বাসে নেমে আমাদের উলটো দিকে ছুটে চলেছেন স্বয়ং চন্দ্রজিৎ সিং।
দেখতে দেখতে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল! আশ্চর্য, ওঁর মুখে এমন আতঙ্কের ভাব দেখলাম কেন! বন্দুকই বা ছুড়ল কে?
এই যে ব্রাদার।
বোসদার গলা। তিনিও পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে আসছেন, এবং দ্রুত নামার চেষ্টায় মাঝে মাঝে পা হড়কে রীতিমতো বেসামাল হয়ে পড়ছেন। মাথার ওপরে তোলা তার ডান হাতে বন্দুক আঁকড়ে ধরা রয়েছে।
কী ব্যাপার বোসদা? আমি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
বোসদা আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ব্রাদার টাইগার! জলজ্যান্ত টাইগার! গাছের ফাঁক দিয়ে দেখলাম তার হলদে রঙ রোদে ঝলমল করছে। ইস্–একটুর জন্যে মিস্ হয়ে গেল।
সব্বনাশ। রতন বলল।–আপনি যে মানুষ খুনের দায়ে পড়তেন। ওটা বাঘ নয়, মিস্টার চন্দ্রজিৎ সিং।
অ্যাঁ। বোসদার চোখ কপালে। বলো কী। ভাগ্যিস নার্ভাস হয়ে গিছলুম, তাই গুলিটা ওপর দিয়ে চলে গেল।
দিন,–ওটা আমাকে দিন।
রতন বোসদার হাত থেকে বন্দুকটা নিয়ে নিল। তারপর তার নিজের লাঠিটা বোসদাকে দিয়ে বলল, সাপ মারতে–লাঠিই যথেষ্ট।
এবার আমরা তিনজনে এগোতে শুরু করলাম।
মিনিট পাঁচেক যেতেই আমরা খাদের ধারে পৌঁছে গেলাম।
ওরা কারা হে রতন? পঞ্চার গ্যাঙের লোক নয়তো?
বোসদা সামনের দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করলেন। খাদের ওপারে দক্ষিণের পাহাড়ের গায়ে খানিকটা সমতল জায়গা, তার মধ্যে ছোট বড় পাথর সাজানো রয়েছে। তারই মধ্যে দুটো। বড় পাথরের মাঝখানে ফাঁকে দুটো লোক দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ করছে।
কে, ওরা!
রতন বন্দুকটা বাগিয়ে ধরল। আমরা তিনজনে ওদিকে চললাম।
আদিবাসী বলে মনে হচ্ছে। রতন চাপা গলায় বলল। সেটা আমারও মনে হয়েছিল, কিন্তু আমাদের সম্বন্ধে তাদের কৌতূহল কী কারণে তা বুঝতে পারছিলাম না।
ভারি থ্রীলড লাগছে ব্রাদার। বোসদা ফিসফিসিয়ে তার চাপা উত্তেজনা প্রকাশ করলেন, একেবারে পুরোপুরি জাঙ্গল অ্যাডভেঞ্চার।
আরো খানিক এগোতেই লোক দুটো পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কী ব্যাপার। সবাই কি এভাবে দুরে থেকে দেখা দিয়ে চলে যাবে? নাকি যেখানে রহস্য নেই সেখানেও রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছি আমরা?