ব্রাদার! ও প্রতাপ! বোসদার গলা!
কী ব্যাপার। উঠে বসলাম।
বোসদা বললেন, শোনো কীসের আওয়াজ। ওই দিক থেকে আসছে।
বোসদার মুখ ফ্যাকাসে। তিনি কেল্লা-বাড়ির দিকে দেখান।
সত্যি-বিচিত্র একটা শব্দ হচ্ছে থেকে থেকে। যেন কান্নার আওয়াজ। আর্তনাদ। খুব ক্ষীণ।
এ কীসের শব্দ?
তাঁবুর বাইরে উঁকি দিলাম। তাঁবুর সামনে কাঠ জ্বেলে রাখা হয়েছে যাতে বুনোজন্তু না আসে কাছে। সেই আগুনের স্বল্প আভার পিছনে গাটু আঁধার।
একটু গা শিরশির করছিল। মনে পড়ল এ পাহাড় ভালো নয়। রাতে কেউ থাকে না এখানে। বহু বন্দী যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুবরণ করেছে কারাগারে। একি কোনো জীবন্ত প্রাণীর আর্তনাদ? না কোনো অতৃপ্ত আত্মার ক্রন্দনধ্বনি?
মনের ভয় মুখে প্রকাশ করলাম না। বললাম, ও কিছু না। বোধহয় কোনো পাখির বাচ্চা কাঁদছে। কাল জিজ্ঞেস করব ডাকুকে। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ুন।
একটু পরেই বোসদার নাসিকা গর্জন শুনতে পেলাম। আমার কিন্তু অনেকক্ষণ ঘুম এল চোখে।
.
০৫.
পরদিন সকালে উঠে আমি আর রতন ঠিক করলাম যে আজ আমরা ক্রোম-পাথরের সন্ধানে কেল্লাপাহাড়ের পুবদিকে ঘুরে দক্ষিণে গিয়ে খাদের ওদিকটা দেখব। ডাকুর পাথরে ইনটারেস্ট নেই। সে বলল একাই বেরোবে।
বোসদা বললেন, একটা বন্দুক আমার জন্যে রেখে যেও ব্রাদার। আমিও যদি পারি অন্তত কেল্লাটা একবার ঘুরে দেখে নেব।
সবে কফি বিস্কুট সহযোগে প্রাতরাশ শেষ করেছি এমন সময় সিঁড়ির মুখে এক মূর্তির আবির্ভাব ঘটল। শ্যাম চিক্কণ দশাসই চেহারা, পরনে খাকি হাফপ্যান্ট ও শার্ট। কোমরে বেল্ট, মাথায় টুপি। নিঃসন্দেহে পুলিশ অফিসার।
পিছনে আরও দুটি লোককে আবার দেখা গেল–তারা বোধহয় কনস্টেবল।
অফিসারটি সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে হেঁড়ে গলায় বললেন, আমি রামচন্দ্রপুর থানার ওসি শ্রীবলরাম দাস। মিস্টার দত্ত আপনাদের খোঁজ করতে বললেন।
কী ব্যাপার? রতন প্রশ্ন করল।
বলরাম দাস পকেট থেকে ডিবা বের করে খুলে দুটি পান নিয়ে মুখে পুরে একগাল হেসে বললেন, দেখে মনে হচ্ছে আপনারা দিব্যি আছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনাদের আর এখানে থাকা হবে না।
থাকা হবে না? রতন অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করল।
আজ্ঞে না। আপনাদের গাড়ি আসবে পলাশবুনি গ্রামে দুপুর দুটো নাগাদ। আপনারা দয়া করে সেই গাড়িতে ফিরে যাবেন। মিস্টার দত্তর হুকুম।
কিন্তু কেন? আমি আর রতন প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম।
জায়গাটা মোটেই নিরাপদ নয়। বলরামবাবু পান চিবোতে চিবোতে বললেন।
আপনি কি পাগলা হাতির কথা বলছেন?
প্রশ্নটা এল ডাকুর কাছ থেকে। হাতির কথাটা আমারও কাল থেকেই অনেকবার মনে হয়েছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেটার কোন লক্ষণ দেখিনি বলে ও নিয়ে আর ভাবছিলাম না।
বলরামবাবু প্রশ্নটা শুনে ভুরু কুঁচকে বললেন, পাগলা হাতি? কই না তো। পাগলা হাতির কথা কে বলল আপনাদের?
চন্দ্রজিৎ সিং-এর নাম শুনে ভদ্রলোক একটা অত্যন্ত অবজ্ঞাসূচক ভাব করে বললেন, ও লোকটাকে মোটেই পাত্তা দেবেন না। খুব সন্দেহজনক চরিত্র। অঢেল পয়সা; কিন্তু কীভাবে করেছে তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না।…না, পাগলা হাতি নয়। আমি মানুষের কথা বলছি। আপনারা তো বংশীর মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিলেন? সেটা খুব সম্ভব অ্যাকসিডেন্ট নয়, খুন। আর বংশী খুন হয়েছে তার নিজেরই ছেলে পঞ্চার হাতে।
নিজের ছেলের হাতে বংশীর মৃত্যু হয়েছিল? কী ভয়ংকর ব্যাপার!
বললামবাবু বলে চললেন, দেব-বাড়ির বিগ্রহ চুরির কথা নিশ্চয় শুনেছেন। যারা চুরি করেছিল সেই গ্যাঙের দুজন ধরা পড়েছে। তারা বলেছে যে তাদের লিডার পঞ্চা বিগ্রহ নিয়ে নাকি এই দিকেই পালিয়ে এসেছে। বংশী যেদিন মারা যায় সেই দিনই সকালে পলাশবুনির একজন তোক ওই পাহাড়ে পঞ্চাকে দেখেছিল বংশীর সঙ্গে উত্তেজিতভাবে কথা বলতে। বংশী কী জানি বোঝাবার চেষ্টা করছিল, আর পঞ্চা ক্রমেই খেপে উঠছিল। যে লোকটি ঘটনাটা দেখেছিল সে জানত পঞ্চা অতি বেপরোয়া গুণ্ডা। তাই সে বেশিক্ষণ সেখানে থাকেনি। আমার ধারণা বংশী পঞ্চাকে বিগ্রহ ফিরিয়ে দিতে বলছিল এবং পঞ্চা তাতে রাজি হচ্ছিল না। সেই থেকেই কথা কাটাকাটি এবং তারই ফলে সম্ভবত ছেলের হাতে বংশীর মৃত্যু। পঞ্চা বোধহয় তাকে উঁচু থেকে ফেলে দিয়ে মেরেছে। ওই পাহাড়ের এক গুহায় পঞ্চার গ্যাঙের একটা আস্তানা আবিষ্কার হয়েছে। বংশী নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছিল পঞ্চা ডাকাতি করে এসে ওখানে লুকিয়েছে। তাই দেখা করতে গিয়েছিল। যাই হোক, পঞ্চা এখন এ তল্লাটেই কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছে। আমরা তার অনুসন্ধান চালাচ্ছি, কিন্তু আপনারা দয়া করে আর এখানে থাকবেন না।
কেন? ডাকু প্রশ্ন করল।
কারণ যদি পঞ্চা ভাবে আপনারা তার পিছু নিয়েছেন তাহলে বিপদে পড়বেন।
রতন গোমড়া মুখে বলল, পঞ্চার খবর কাকাকে কে দিল? আপনি বুঝি?
বলরাম দাস হেসে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। কাল কেওঞ্ঝরগড়ে মিস্টার দত্তর সঙ্গে দেখা হল। উনি বললেন, আপনারা কেল্লাপাহাড়ে গিয়েছেন। তখন বললাম পঞ্চার কথা।
দারোগা তো চলে গেলেন কনস্টেবল সমেত, কিন্তু আমাদের সকলেরই উৎসাহে বেশ খানিকটা ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়ে গেলেন। রতন হতাশার সুরে বলল, আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ। ব্যাটা পঞ্চার জন্যে আমাদের অভিযানটা ভণ্ডুল হয়ে গেল। যাক, হাতে আর মাত্র ঘন্টা চারেক সময় আছে। এর মধ্যে যতটা পারি ঘুরে দেখে নিই।