.
০৪.
ক্রমে চড়াইয়ে উঠি। পাহাড়ের পাদদেশে ঘন বাঁশ বন আর বাবলা গাছ। বড় বড় পাথরের খণ্ড ছড়িয়ে পড়ে আছে। কয়েকটা তেঁতুল আর বুনো আমগাছ দেখলাম।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা সিঁড়ি পড়ল। যেটা পাহাড়ের পায়ের কাছ থেকে শুরু হয়ে, পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে। ডাকু বলল এটাই নাকি কেল্লার সািড়। আমরা উঠতে শুরু করলাম সিঁড়ি দিয়ে।
আমাদের ঘিরে ঘনবদ্ধ জঙ্গল। মোটা মোটা লতা দুলছে বিশাল বনস্পতিকে আকড়ে ধরে। শাল, কেন্দু, মহুয়া, নিম, জাম, আরও কত কী গাছ। পাতা ও শাখার আবরণে যেন চন্দ্রাতপ সৃষ্টি হয়েছে মাথার ওপরে।
যেতে যেতে চোখে পড়ল ময়ুর, বনমোরগ, আরও রকমারি পাখি। নানা অজানা গন্ধ পাই তরুলতার। এক জায়গায় কয়েকটা শিমুলগাছ দেখলাম। উজ্জ্বল রক্তবর্ণ ফুলের সমারোহে গাছ যেন অগ্নিশিখা। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর সামনে দেখলাম প্রাচীর। অর্থাৎ কেল্লায় পৌঁছেছি।
অন্তত দশ ফুট উঁচু পাথরের চওড়া প্রাচীর পাহাড়ের অনেকখানি জায়গা ঘিরে রয়েছে। সিঁড়ি শেষ হল প্রাচীরের গায়ে, এক ভাঙা তোরণের সামনে। সামনেই দেখলাম কেল্লা।
ভিতরের জমি মোটামুটি সমতল। প্রাচীরঘেরা অংশ প্রায় দুশো ফুট চওড়া। লম্বা কতটা বোঝা যাচ্ছিল না। প্রাচীর অদৃশ্য হয়েছে গাছপালার ভিতরে। আমাদের মুখোমুখি পাঁচিল-ঘেরা একটি একতলা বাড়ি। ঝোঁপ ও আগাছা পাথরের ঘরগুলিকে গ্রাস করেছে। ভিতরে ঢোকে না বোধহয় কেউ। কেল্লার উঠোন পাথরে বাঁধানো। কোথাও পাথর সরে। মাটি বেরিয়ে পড়েছে, সেখানে জন্মেছে উদ্ভিদ। তবে কেল্লার ভিতরের অংশে বড় গাছ বেশি নেই।
সামনের পাঁচিল-ঘেরা বাড়িটা দেখে মনে হল এটা ছিল বন্দিশালা। উঁকি মেরে দেখলাম–ভিতরে ছোট ছোট অনেক ঘর। জানলা নেই। শুধু ঘুলঘুলি। কপাটহীন ফটক ৪ দরজাগুলি হাঁ করে আছে। একটা অশ্বখগাছ লম্বা শিকড় ও ডালপালা বিস্তার করে বাডিটার। ঘাড়ে চেপে বসেছে।
ভিতরে বুনোজন্তু বা সাপ থাকতে পারে, তাই ঢুকলাম না ঘরের মধ্যে।
দক্ষিণদিকে একটু ঢালু। প্রায় একশো গজ লম্বা প্রাচীরের সীমানা ক্রমে বেঁকে গেছে। এই অংশেও একটা বাড়ি। লম্বা লম্বা পাঁচটি ঘর। সঙ্গে কয়েকটি ছোট ঘরও রয়েছে। এটা বোধহয় সৈন্যাবাস ছিল। দুর্গের কোথাও কোনো কারুকার্য নেই। চৌকো চৌকো প্রসব তৈরি।
কাছেই এক ঝরনা। এক কুণ্ড থেকে স্বচ্ছ ক্ষীণ জলধারা উপচে পড়ে বয়ে চলে অগভীর পাথুরে খাতের মধ্য দিয়ে। তারপর পশ্চিম প্রাচীরের গায়ে এক ফুটোর ভিতর দিয়ে গিয়ে কেল্লার বাইরে পাহাড়ের ঢালে নেমেছে। ঝরনার কাছে এক মস্ত শালগাছ। সেখানেই তাঁবু ফেলা স্থির হল।
বোসদা তখুনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁবু টাঙাতে। আমরাও হাত লাগালাম। ঝোঁপ কাটা, খুঁটি পোতা, তাঁবু খাটানো, জিনিস গোছ-গাছ করা ইত্যাদি করতে ঘণ্টা দুই সময় লাগল। এরপর ঝরনার জলে চান করলাম সবাই। চমৎকার ঠাণ্ডা জলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল যেন। দুপুরের খাওয়া সঙ্গেই এনেছিলাম, পাঁউরুটি ও মাংস। তাঁবুর সামনে সতরঞ্চি পেতে সবাই খাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি বোসদা বিস্ফারিত চোখে ওপর দিকে চেয়ে আছেন।
পরমুহূর্তেই শুকনো কাঁপা কাঁপা গলায় কথা এল, ব্রাদার, এ তো ডেঞ্জারেস জায়গা। এখানে তাঁবু ফেলা কি ঠিক হল?
আমরাও সকলে বোসদার দৃষ্টি অনুসরণ করে ওপর দিকে চাইতে, ব্যাপারটা বুঝলাম। শালগাছের গায়ে এক বিরাট মৌমাছির চাক।
ডাকু অভয় দিল–বিরক্ত না করলে কিছু বলবে না ওরা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তবে উনুনটা দূরে করুন।
ভরসা পেয়ে খাওয়া সেরে বোসদা কাঠ-কুটো সংগ্রহ করতে লেগে গেলেন। রাতের রান্নার জন্য উনুন জ্বালাতে হবে।
ডাকু বলল, আমি বেরোচ্ছি। দেখি যদি ছোটখাটো শিকার পাই খাবার মতো।
রতন বলল, মনে আছে তো ক্রোম-পাথর চিনিয়ে দিয়েছি। ওই রকম পাথর কোথাও দেখলেই স্যাম্পল নিয়ে আসবি। নিকেল মেশানো পাথর তো বাইরে থেকে চেনা যায় না। অ্যানালিসিস্ করে তবে জানা যায়, নিকেল আছে। কিন্তু আমার ধারণা ক্রোম পেলেই তার কাছে নিকেল থাকবে, মানে ক্রোম যদি পাই, তার ধারে-কাছের পাথর নিয়ে পরীক্ষা করলে হয়তো নিকেলের সন্ধান পাব। তাই ক্রোমের ওপর লক্ষ রাখব সবাই। তাছাড়াও যদি দেখি কোথাও পাথর খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন, সেখান থেকে স্যাম্পল নিয়ে যাব।
ডাকু বন্দুক ঘাড়ে চলে গেল।
বোসদা বললেন, আমি ভাই আজ টায়ার্ড। কাল বেরোব। রান্নাটা করে ফেলব। তোমরা দজনে ঘুরে এসো। তবে তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু সন্ধ্যার আগেই। তিনি সতরঞ্চি বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন।
আমি রতনকে বললাম, পনেরো মিনিট অপেক্ষা কর। কেল্লাটা একটু ঘুরে দেখে নিই। হাজার হোক, সার্ভে করব বলে এসেছি যখন। তারপর তোর সঙ্গে যাব ক্রোমের খোঁজে।
অল্প সময়ে যতটুকু পারি দেখলাম কেল্লা। কেল্লার দুটি অংশ। দুর্গ প্রাচীরের পিছনে পাহাড়ের ঢাল খাড়াই নেমেছে অন্তত কুড়ি হাত। কোথাও স্বাভাবিক পাহাড়ের ঢাল। কোথাও বা পাথর কেটে ঢাল বানানো হয়েছে, কেউ যাতে সহজে উঠে আসতে না পারে। পব-পশ্চিমে দুটি সিঁড়ি নেমে গেছে কেল্লা থেকে। সিঁড়ির মুখে ভাঙা তোরণ। সাত্য এ দর্গের কোনো বিশেষত্ব নেই। নেহাত সাধারণ। শত্রুর আক্রমণ ঠেকাবার পক্ষেও মোটেই সুরক্ষিত নয়। ঝোঁপ-ঝাড় ভেদ করে দুর্গের ঘরগুলির ভিতরে ঢোকার আর উৎসাহ হল না।