এটাও বলে দিলেন রতনের কাকা যে আমরা যেন তিন চার দিনের বেশি না থাকি, আর সঙ্গে যেন বন্দুক অবশ্যই থাকে।
অবাক করলেন বোসদা।
আড্ডা দিতে এসে শুনলেন আমাদের অভিযানের সংকল্প, আর ধাঁ করে বলে বসলেন, ব্রাদার, আমিও যাব। এই আবদারের পিছনে কারণটাও অবিশ্যি তখনই বলে দিলেন।
বুঝলে কিনা ব্রাদার, ছোটবেলা থেকে আমি অ্যাডভেঞ্চারের ভক্ত। প্রচুর বই পড়েছি অ্যাডভেঞ্চারের। কল্পনা করেছি গভীর জঙ্গলের মধ্যে তাঁবুর পাশে রাতে আগুন জ্বেলে বসে আছি, যেমন থাকত চাঁদের পাহাড়-এর শঙ্কর। কিন্তু লাক খারাপ। কোনো সত্যি অ্যাডভেঞ্চার জোটেনি ভাগ্যে। এবার সুযোগ যখন পেয়েছি ছাড়ছি না কিছুতেই।
বললাম, আপনার কষ্ট হবে।
আরে কষ্ট করতেই তো যাব। কষ্ট পাব, ভয় পাব, তবে তো! বুঝলে ব্রাদার, তোমাদের বউদি বড় খোঁচা দেয় আমায়। বলে, তুমি বেজায় কুনো। বসে বসে কেবল বই পড়ো। জঙ্গলে থেকেছ কখনও এক রাত্তির? এবার তার মুখ বন্ধ করে দেব। আমাদের ইতস্তত করতে দেখে বোসদা বললেন, আমি তোমাদের ভার হব না ব্রাদার। আমি নেব তোমাদের কিচেনের ভার। জানো, অফিসের পিকনিকে সব রান্না এই শর্মা এক হাতে সামলায়।
রতন অগত্যা বলল, ঠিক আছে, চলুন।
বোসদা চলে যেতে রতন বলল, উনি গেলে ভালোই হবে। তবে আমাদের অভিযানের আসল উদ্দেশ্য মানে নিকেলের ব্যাপারটা, ওঁকে জানানো চলবে না। যদি খালি হাতে ফিরি, লোকে ওর কাছেই জানবে আমরা শুধু দুর্গ দেখতে গিয়েছিলাম। তাছাড়া রান্নার হ্যাঁঙ্গামা নেবেন বলছেন। আমরা বেশি সময় পাব খুঁজতে।
রতনের কাকিমা বোসদা যাবেন শুনে খুব খুশি। কাকা নিজেই বোসদার ছুটির ব্যবস্থা করে দিলেন। বোধহয় ভাবলেন, ভালোই একজন গার্জেন রইল সঙ্গে।
যাবার দিন ডাকু বলল, জানিস ওই পাহাড়টার একটু বদনাম আছে শুনলাম।
–মানে ভূত-টুত নাকি? জিজ্ঞেস করি।
–হ্যাঁ ওই আর কি। যুদ্ধ হয়েছে। অনেক লোক মরেছে ওখানে, তাই! স্থানায় সে নাকি কেউ ও পাহাড়ে রাতে থাকে না।
বললাম, এ খবর বোসদাকে দিসনি। শেষে ভয় পাবেন অনর্থক।
.
আবার সেই কেওক্ষর-জাজপুর রোড। ভোরের আলো সবে ফুটছে। মোটর চলেছে। হু-হুঁ করে। বোসদা সমানে কথা বলছেন–বাঃ, কী দৃশ্য দু-পাশের! আচ্ছা ডাকু, পাহাড় কত উঁচু হবে? পাহাড়ে খুব জঙ্গল নাকি?…
আনন্দপুরে এক চায়ের দোকানে থামলাম আমরা। চা খাচ্ছি, এমন সময় আর একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল কাছে। আরোহী একা চালক, মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। লম্বা, ফরসা, রোদে পোড়া চেহারা। পরনে কালো ফুলপ্যান্ট ও হলুদ বুশ সার্ট। হাতে জ্বলন্ত চুরুট। আগন্তুক কৌতূহলভরে আমাদের লক্ষ করে গাড়ির মাথায় বাঁধা মোটঘাট দেখে ইংরেজিতে করলেন, শিকারে চলেছেন বুঝি?
রতন বলল, শিকার না। যাচ্ছি একটা পুরনো কেল্লা সার্ভে করতে।
পুরনো কেল্লা? কোথায়?
একটা পাহাড়ের ওপরে। এখানে পাহাড়টাকে বলে কেল্লাপাহাড়।
বুঝেছি। ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে বলেন, তা আপনারা কি আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্টের লোক?
রতন উত্তর দিল।–না। আমাদের মধ্যে এই প্রতাপ অবশ্য আর্কিওলজিস্ট। বাকি আমরা যাচ্ছি শখ করে। একটা আউটিং বলতে পারেন। আপনি?
ও হো, দেখুন দিকি নিজের পরিচয় দিতে ভুলে গেছি। আর প্রশ্ন করে চলেছি। মাপ করবেন, বন-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বুনো হয়ে গেছি! আমার নাম চন্দ্রজিৎ সিং। উড়িষ্যায় ব্যবসা করি। কেল্লাপাহাড় আমি চিনি। ওই দিক থেকেই আসছি। ও জায়গায় যাওয়া কিন্তু এখন সে নয়।
কেন? প্রশ্নটা একই সঙ্গে আমাদের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
কারণ একটা হাতি। হাতিটার মেজাজ বিগড়েছে। আর কেল্লাপাহাড়ের কাছেই ঘোরাফেরা করছে। জানেন তো, নিঃসঙ্গ খ্যাপা হাতি কী ভয়ংকর জীব। কেল্লাপাহাড়ের কাছে এক পাহাড়ে আমি কাঠ কাটার ইজারা নিয়েছি। সেই কাজে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যেতে পারিনি। ফিরে এলাম।
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। দলে শিকারী বলতে তো একমাত্র ডাকু। সে দেখি ভুরু কুঁচকে চুপ করে আছে। এমন সময় রতন বলে উঠল, বেরিয়েছি যখন, যাই। তেমন বিপদ বুঝলে ফিরে আসব। কি রে ডাকু?
ডাকু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল–হুঁ।
আচ্ছা। গুডলাক্। চন্দ্রজিৎ সিং আমাদের হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে লম্বা পা ফেলে একটা দোকানের দিকে চলে গেলেন।
আমি বললাম, রতন, তোর কথা ভদ্রলোকের পছন্দ হয়নি। হয়তো ভাবলেন–ছেলেগুলো অতিরিক্ত ঠ্যাটা।
রতন বলল, ভাবুক গে।
আমরা আবার রওনা দিলাম। হাতির কথায় মনে একটু ভাবনা ঢুকিয়ে দিল যাহোক।
জগন্নাথপুরের কাছে গিয়ে গাড়ি জাজপুর রোড ছেড়ে ডান দিকে এক পাহাড়ি রাস্তা ধরল। প্রায় শুকনো নালার পাশে পাশে পাথুরে রাস্তা। এ জায়গা টোমকা এবং মহাগিরি পর্বতমালার মধ্যবর্তী অংশে। ডানদিকে দূরে দেখা যাচ্ছে ঢেউয়ের মতো পর্বতপুঞ্জ। নীলাভ অস্পষ্ট। বাঁ-দিকে কাছেই অল্প উঁচু এক পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে উদ্ভিদের ঘন সবুজ প্রলেপ।
ডাকু বলল, ওই বোধহয় কেল্লাপাহাড়।
প্রায় মাইল চার যাবার পর একটি গ্রাম পেলাম। ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম। গ্রামের নাম পলাশবুনি। গ্রামে খোঁজ করে জানলাম–হ্যাঁ এই বাঁ-পাশের পাহাড়ই হচ্ছে কেল্লাপাহাড়। তবে পাহাড় অবধি গাড়ি যাবে না। মাইল খানেক হাঁটতে হবে পাহাড়ে পৌঁছতে। অতএব গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মোটঘাট কাঁধে তুলে আমরা পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম কেল্লাপাহাড় লক্ষ্য করে।