ডাকু চলে গেল। একটু পরেই মোটরের ইনজিনের আওয়াজ পেলাম।
ডাকু প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এল, সঙ্গে ছ-সাত জন গ্রামের লোক। কার্তিকও এসেছে। কার্তিক তো হাউমাউ করে একচোট কান্না জুড়ে দিল প্রাণহীন বংশীকে দেখে। যাহোক ওরা চটপট গাছের ডাল দিয়ে একটা মাচা বানিয়ে তার ওপর বংশীর দেহ চাপিয়ে নিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেল। আমরাও ফিরলাম কেওঞ্ঝরগড়।
.
কেওঞ্ঝরগড়ে পৌঁছবার পরদিনই রতন ছুরিটা পাঠিয়ে দিয়েছিল ধাতুবিদ ডক্টর ত্রিপাঠীর কাছে অ্যানালিসিসের জন্যে। পাঁচদিন পরে ডক্টর ত্রিপাঠী রতনকে ফোন করলেন।
অ্যানালিসিস্ হয়ে গেছে। বিকেলে আসুন।
আমি ও রতন গেলাম।
ডক্টর ত্রিপাঠী সাহেবি কেতার মানুষ। ছোটখাটো শীর্ণকায়, ফরসা। মুখে সর্বদা পাইপ। আমরা বসতেই কফির অর্ডার দিয়ে বললেন, এ ছুরি কোত্থেকে পেয়েছেন?
রতন বলল, একজন দেশি কামারের কাছ থেকে।
স্ট্রেঞ্জ। ত্রিপাঠী বিস্ময় প্রকাশ করেন। আমি জানতাম দেশি কামার বড়জোর কার্বনস্টিল তৈরি করতে পারে। কিন্তু লোহার সঙ্গে অন্য ধাতু মেশায়, এই প্রথম জানলাম।
কেন, কী কী পেয়েছেন? রতন উত্তেজিত।
পেয়েছি অনেক কিছু। খুব ভালো কোয়ালিটির স্টিল। এতে আছে প্রায় টেন পারসেন্ট ক্রোম, ওয়ান পারসেন্ট নিকেল, সামান্য ম্যাঙ্গানিজ। কার্বন, সিলিকন ইত্যাদি। এবং বাকিটা আয়রন।
ক্রোম, নিকেল! ত্রিপাঠীর কথা শেষ না হতেই রতন চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে।
তার মানে বংশী ক্রোম আর নিকেল মেশাত লোহার সঙ্গে।
কে বংশী? ত্রিপাঠী জিজ্ঞেস করলেন।
ওই কামারের নাম, যে ছুরি তৈরি করেছে। বলল রতন।
সে কোথায় থাকে?
রামচন্দ্রপুরের কাছে এক গ্রামে। কিন্তু সে নেই। মারা গেছে।
বংশী ক্রোম আর নিকেল পেত কোত্থেকে? জানেন আপনি?
ত্রিপাঠী ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেন।
সঠিক জানি না। আন্দাজ করছি। রতন থতমত খেয়ে বলে, খবর পেয়েছি, বংশ মহাগিরি রেঞ্জের এক পাহাড় থেকে কিছু ধাতু পাথর আনত গোপনে। সেই পাথর লোহার সঙ্গে মেশাত। আমার ধারণা ওই পাহাড়ে ক্রোম আর নিকেলের ডিপোজিট আছে। হয়তো একই জায়গায়। কাছাকাছি। বংশী নিশ্চয় এই দু-রকম পাথরই আনত। এই রকম ইস্পাত বানাবার কায়দা ওর এক পূর্বপুরুষ নাকি আবিষ্কার করেছিল। অবশ্য কোন ধাতুর কী গুণ আলাদা করে নিশ্চয় তারা বুঝত না। আপনি কী বলেন?
বুঝলাম রতন ত্রিপাঠীর কাছে কেল্লাপাহাড় বা জগন্নাথপুরের নাম চেপে যেতে চায়।
ত্রিপাঠী কয়েক সেকেণ্ড ভেবে বললেন, হয়তো ক্রোম আনত–কিন্তু নিকেল ইমপসিবল। উড়িষ্যায় নিকেল কোথাও নেই।
তাহলে নিকেল এলো কী করে? রতন জানতে চাইল।
খব সোজা। উল্কাপিণ্ড থেকে। উল্কাপিণ্ডে লোহার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ নিকেল থাকে। দেশি কামার অনেক সময় পাহাড়-জঙ্গলে পড়ে থাকা উল্কাপিণ্ড ভেঙে নিয়ে আসে লোহার প্রয়োজনে। অনেক প্রাচীন জিনিসে নিকেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই নিকেল এসেছে। উল্কাপিণ্ডের লোহার সঙ্গে।
রতন বলল, তা হতে পারে। কিন্তু উড়িষ্যায় নিকেল যে নেই, তার প্রমাণ কী?
ত্রিপাঠীর মুখে বক্ৰহাসি ফুটে ওঠে। বলেন–প্রমাণ হচ্ছে, এখনও কেউ তার সন্ধান পায়নি। থাকলে নিশ্চয় পেত। দেখুন, আপনার অনুসন্ধিৎসু মনের প্রশংসা করি। কিন্তু এসব হচ্ছে, অল্প বয়সের রোমান্টিক কল্পনা।
রতন তেতে ওঠে। বলে–আমার ধারণা একেবারে উড়িয়ে দেবার কারণ নেই। আগে তো অনেকে ভাবতেন, উড়িষ্যায় ক্রোম নেই। কিন্তু পরে তো পাওয়া গেছে। তেমনি নিকেলও থাকতে পারে।
ত্রিপাঠীর মুখ লাল হয়ে উঠল। বললেন, বেশ তো, দেখুন না খুঁজে। যদি নিকেল পেয়ে যান তাহলে তো ইউ উইল বি এ হিরো।
তাঁর কণ্ঠের প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ আমাদের কান এড়ালো না।
.
বাড়ি এসে রতন অনেকক্ষণ গুম মেরে বসে রইল।
তারপর হঠাৎ আমাকে বলল, জানিস প্রতাপ ছোটকাকার বন্ধু জিওলজিস্ট মিস্টার পট্টনায়ক একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন–উড়িষ্যার এই অঞ্চলে, এই পাহাড় বনরাজো কত প্রাকৃতিক গুপ্তধন, কত খনিজ পদার্থ লুকিয়ে আছে। তাদের সামান্যই আবিষ্কার হয়েছে। আমরা যে কিছু খুঁজে পাব না তা কেউ বলতে পারে?
আমি বললাম, তোর কী মতলব বলতো?
রতন আর ভণিতা করল না।
কেল্লাপাহাড়ে যাব–নিকেল খুঁজতে। বাড়িতে বলব কেল্লা সার্ভে করতে যাচ্ছি, তাহলে কাকা আপত্তি করবে না। নিকেল খুঁজতে যাচ্ছি বললে কাকা আবার ত্রিপাঠীকে ফোন করে বসবে, তখন ও লোকটা বাগড়া দিয়ে সব ভণ্ডুল করে দেবে।
একা যাবি? আমি প্রশ্ন করলাম।
রতন বলল, কেন–তুই তো আর্কিওলজির লোক। তোর পুরনো কেল্লায় কোনো ইন্টারেস্ট নেই বলতে চাস?
একশোবার আছে। আর ডাকু? ডাকু যাবে না?
আলবৎ। ডাকু হবে আমাদের গাইড।
বিকেলে গেলাম ডাকুর ঘরে। গিয়ে দেখি শ্রীমান বন্দুক পরিষ্কার করছে। বলল, ভাবছি শিকারে যাব দু-একদিনের জন্য।
মতন বলল, শিকার-টিকার বাদ দে। তোকে কেল্লাপাহাড়ে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।
হঠাৎ?
রতন আসল কারণটাই বলে ফেলল। ডাকু বলল, ভালোই হল। আমিও ওদিকটায় যাবার প্ল্যান করছিলাম। যদি কিছু পাওয়া না যায়, একটা অ্যাডভেঞ্চার তো হবে।
রতনের কাকা সহজেই অনুমতি দিলেন। তবে এটাও বললেন যে আমরা যেন খুব বিেশ কিছু আশা না করি। যা শুনেছি, দুৰ্গটা খুব সাধারণ। আসলে ওটা ছিল এক সামন্ত রাজার জেলখানা। কিছু সৈন্যও থাকত। রাজা যুদ্ধে হেরে গেলে ওটা শত্রুরা ধ্বংস করে দেয়। তবে সুড়ঙ্গ-টুড়ঙ্গ নাকি আছে।