মনের আনন্দে লেকচার দিচ্ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল, রতন শুনছে না। সে ডাকুকে লক্ষ করছে। ডাকু দেখি কার্তিকের সঙ্গে বংশীর উঠানে বেড়াচ্ছে। একবার কানে এল পঞ্চার নাম। ওর মাথায় দেব-বাড়ির ডাকাতি ঘুরছে নাকি?
এই যে পেল্লাদ এসেছে। কার্তিক ডাকল, আয় আয়।
কার্তিক কুড়ি বাইশ বছরের একটি যুবককে আমাদের সামনে হাজির করল। যুবকের স্বাস্থ্য ভালো। শান্ত মুখশ্রী। কঁচুমাচু ভাবে এসে দাঁড়াল প্রহ্লাদ।
আমি বললাম, তুমি বংশীর সঙ্গে কাজ করো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমি এবার প্রহ্লাদকে বললাম, বংশীর লোহার কাজের খুব নাম শুনেছি, তাই এসেছিলাম দেখতে। কিছু জিনিস গড়াতে। তা বংশী গেছে কোথায়, জানো?
প্রহ্লাদ আমতা আমতা করে বলল, এখনও ফেরেনি বংশীজ্যাঠা। হয়তো কেল্লাপাহাড়ে গেছে। তবে তো ফিরতে দেরি হবে।
ডাকু বলল, কেল্লাপাহাড়? সে কোথায়?
ওই দিকে একটা ছোট পাহাড় আছে। প্রহ্লাদ পশ্চিমে মহাগিরি রেঞ্জের দিকে দেখায়। সেই পাহাড়ের মাথায় আছে একটা পুরনো ভাঙা কেল্লা। ওই পাহাড়কে আমরা বলি কেল্লাপাহাড়। এখান থেকে তিনক্রোশ পথ। পলাশবুনি গাঁয়ের পাশ দিয়ে যেতে হয়। বংশীজ্যাঠা মাঝে মাঝে যায় ওই পাহাড়ে।
কেন?
জ্যাঠা বলে ওই পাহাড়ে নাকি তার পূর্বপুরুষ থাকত, তাই দেখতে যায়। আর–প্রহ্লাদ হঠাৎ চুপ করে গেল।
আর কী? জিজ্ঞেস করলাম।
প্রহ্লাদ একটু ইতস্তত করে বলল, আর বংশীজ্যাঠা পাহাড় থেকে এক রকম পাথর আনে।
রতন বলল, পাথর? কী পাথর?
সে পাথর আমি চিনি না। একবার মাত্র দেখেছি।
লোহা-পাথর?
না। প্রহ্লাদ ঘাড় নাড়ে।
ওই পাথর দিয়ে কী করে বংশী? বলল রতন।
ঠিক জানি না। তবে মনে হয় লোহার সঙ্গে মেশায়। তবে কীভাবে মেশায় দেখায়নি কখনো। প্রহ্লাদ উত্তর দেয়।
হন গেছো কখনো ওই পাহাড়ে পাথর আনতে? রতন জানতে চায়।
না। আমি কখনো যাইনি কেল্লাপাহাড়ে। বলল প্রহ্লাদ।
বংশীর ছেলে গেছে? এবার ডাকুর প্রশ্ন।
হ্যাঁ তা গেছে। আমি যাইনি।
সেই পাথর আছে এখানে? দেখাতে পারো। রতন বলে।
এত প্রশ্নের মুখে প্রহাদ কেমন ঘাবড়ে যায়। আড়ষ্টভাবে বলে, না নেই। কাজ হয়ে গেলে বংশজ্যাঠা ওই পাথরের টুকরো দূরে ফেলে দিত। বেশি পাথর তো আনত না। শেষবাব এনেছিল বছরখানেক আগে। আর যায়নি। প্রহ্লাদ জানাল, কেল্লাপাহাড়ে গেলে বংশীজ্যাঠার ফিরতে রাত হয়ে যায়।
আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করলাম। নাঃ, বংশী এখন ফিরবে না। অগত্যা আর একদিন আসব বলে বাড়িমুখো রওনা দিলাম। মন খারাপ। আজকের অভিযান ব্যর্থ হল! ডাকু রতনও চুপচাপ।
মাত্র মাইল দুই গেছি। হঠাৎ দুম! মোটরের টায়ার ফাটল।
কী ঝামেলা। বাড়তি টায়ার অবশ্য আছে সঙ্গে। আমরা নামলাম। ডাইভার নতুন টায়ার লাগানোর তোড়জোড় করে। জায়গাটার বাঁ-পাশে পথের ধারেই এক ছোট পাহাড়।
ডাকু বলল, চ, ততক্ষণ পাহাড়ে বেড়িয়ে আসি।
উত্তম প্রস্তাব। ডাকু বন্দুক নেয়–যদি বনমোরগ পাওয়া যায় শিকার করব।
পাহাড়ে উঠছি। এদিক সেদিক ঘুরছি। এক জায়গায় পাহাড়ের ঢাল খাড়া নেমে গেছে অনেকখানি। আমি কিনারে গিয়ে নিচে তাকাতেই চমকে উঠলাম।
সোজা নিচে পাহাড়ের ওপর একটি মানুষের দেহ পড়ে আছে চিৎ হয়ে। কয়েক সেকেণ্ড, লক্ষ করে বুঝলাম–নিশ্চল। তার দেহের অদ্ভুত-ভঙ্গি দেখে সন্দেহ হল মরে গেছে নাকি?
বতন ও ডাকুকে দেখালাম। তারপর তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম ঘুরে। কাছাকাছি গিয়েও ডাক প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে–একি, এ যে বংশী!
.
০৩.
বংশী মারা গেছে সন্দেহ নেই। মাথার চুলে চাপ চাপ রক্ত জমাট বাঁধা। খুলির এক জায়গা হাঁ হয়ে গেছে। আর কোনো আঘাতের চিহ্নই নেই দেহে। বোঝা যায় বংশীর মৃত্যু হয়েছে। অনেকক্ষণ।
কিন্তু মরলো কী করে?
ডাকু বলল, খাদের ওপর থেকে পড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া আর তো কোনো কারণ মনে। হচ্ছে না। কিন্তু পড়ল কেন? এরা পাহাড়ে চড়তে অভ্যস্ত। সহজে তো পা ফসকায় না। তবে মদ খেয়ে মাতাল হলে বেসামাল হতে পারে। হয়তো খাদের ধারে ধারে যাচ্ছিল কিংবা ঢালের গায়ে ওই মহুয়া গাছটায় চড়েছিল পাকা মহুয়ার লোভে, তারপর বেটাল হয়ে পড়ে গেছে। ইস, কী স্যাড় ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত বংশীর সঙ্গে এভাবে দেখা হবে, কে জানত।
বংশীর মৃতদেহের পাশেই একটি ছোট ঝুলি পড়েছিল। রতন সেটা তুলে দেখল। ভিতরে একটা হাতুড়ি। মাটিতে ছেনি বাটালি ইত্যাদি কয়েকটা জিনিস ছড়িয়ে পড়ে আছে। রতন সহসা কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ডাকু এই দেখ।
রতনের হাতে একটা ছুরি। কাঠের খাপে পোরা। কাঠের হাতলে খোদাই করা পদ্ম। ঠিক মিউজিয়ামের ছুরির মত।
ডাকু খাপ থেকে ছুরি টেনে বার করল। ছুরির ফলা একটু বাঁকানো। বলল, এই সেই ছুরি। দু-বছর আগে এটাই আমি দেখেছিলাম বংশীর কাছে। বংশী ছুরিটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল আজ।
রতন ছুরিটা চেয়ে নিল ডাকুর কাছ থেকে। তারপর গম্ভীরভাবে বলে, এ ছুরি আমি নিলাম।
সে কি! আমরা অবাক।
রতন বলল, হ্যাঁ। কারণ এ ছরিতে বংশীর আর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার আছে। বংশী কী ধাতু মেশাত এই ইস্পাত বানাতে তা বংশীর মুখে থেকে আর কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না। তাই ছরিটা নিচ্ছি; অ্যানালিসিস করে দেখতে চাই, কী কী আছে এতে।
রতন এমন দৃঢ়স্বরে বলল কথাগুলো যে আমরা আর প্রতিবাদ করতে পারলাম না। এদিকে মৃতদেহের ব্যবস্থা করা দরকার। বংশীর গ্রামে খবর দিতে হবে। রতন বলল, ডাকু, তুই জগন্নাথপুর চলে যা। গাড়ির টায়ার নিশ্চয় এতক্ষণে বদলানো হয়ে গেছে। আমি আর প্রতাপ থাকছি এখানে।