টোটো একদিন সকালে এল না, দুপুরেও এল না, এল রাত্রে। তাঁবুর কাছে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সতর্কভাবে দেখল, তারপর গুটিগুটি তাঁবুর গা ঘেঁষে ছায়ায় বসল। কী ব্যাপার?
শুনলাম, কামাউ তাকে ধমকেছে, এই ছোঁড়া, মাহিভিগুলোর কাছে অত ঘুরঘুর কীসের? শুনছি ওখানে অখাদ্য-কুখাদ্য গিলিস। খবরদার ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। বিদেশিদের সঙ্গে অত ভাব চলবে না।
কী হিংসুটে লোক! কিন্তু পেটুক টোটোকে ভয় দেখিয়ে আটকানো যায়নি। তবে বলে গেল দিনের বেলায় আর আসবে না। রাত্তিরে আসবে। সবাই যখন নাচ-গানের জন্য তৈরি হচ্ছে, তখন লুকিয়ে।
এই দ্বীপের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে আমরা কিছু কিছু জেনেছি।
দ্বীপের জনসংখ্যা একশোর বেশি নয়। এরা চাষবাস ভালোবাসে না। সামান্য ভুট্টা, রাঙাআলু ও দু-এক রকম শস্য ফলায়। জীবনধারণের প্রধান উপায় শিকার ও মাছধরা। গরু ও ছাগল পোষে। মাংসের অভাব মেটে। আধুনিক জগতের সঙ্গে যোগাযোগ তাদের খুবই কম। পারতপক্ষে মহাদেশের মাটিতে পা দেয় না। নৌকো এদের মহামূল্যবান সম্পদ। নৌকো চুরি করতে গিয়ে আমাদের মাঝিদের কী হাল হয়েছিল তা তো আগেই বলেছি। সামান্য কয়েকটি লোহার হাতিয়ার সম্বল করে অনেক কষ্টে গাছের গুঁড়ি কেটে নৌকো বানায়।
ছোট আর মাঝারি ডিঙিগুলো কাছাকাছি মাছ ধরার জন্য। কয়েকটা বড় ছিপ নৌকো আছে দূরে পাড়ি দেবার উদ্দেশ্যে।
মামাবাবু প্রত্যহ দ্বীপের সান্ধ্য আসরে যোগদান করে এদের আচার-ব্যবহারের খুঁটিনাটি লক্ষ করতেন। নোট করে রাখতেন। এমন চমৎকার গবেষণার ক্ষেত্র পেয়ে মাফিয়া না, যেতে পারার শোক তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন।
.
০৭.
দ্বীপবাসের পঞ্চম দিন। সন্ধেবেলা। আমি ও সুনন্দ তাঁবুর ভিতর বসে রাতের খাবারের আয়োজন করছি। মামাবাবু তার নিজের কামরায়। সারাদিনের সংগ্রহ নমুনাগুলি সাজিয়ে। গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত। টোটো যথারীতি হাজির। তাঁবুর পাশটিতে উবু হয়ে বসে। কেমন, চুপচাপ। কথাবার্তা বলছে না। হঠাৎ সে সটান মাটিতে শুয়ে পড়ল।
কী হল, কী হল?
তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখি খুব জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে।
আমাদের ডাক শুনে মামাবাবু বেরিয়ে এলেন। টোটোর জিভ, চোখ ইত্যাদি পরীক্ষা করে বললেন, , যা ভেবেছি, ম্যালেরিয়া। আগুনের ধারে অসুস্থ লোকগুলোকে দেখেও আমার এই সন্দেহ হয়েছিল।
এ্যাঁ, এখানে ম্যালেরিয়া? আমরা দুজন অবাক। এটা তো জানতাম আমাদের দে পেটেন্ট অসুখ। অন্য দেশেও ম্যালেরিয়া আছে?
নিশ্চয়। মামাবাবু বললেন, আফ্রিকা হচ্ছে ম্যালেরিয়ার ডিপো। এখান থেকে পথিনী বহু জায়গায় ম্যালেরিয়া ছড়িয়েছে। ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ে এই মহাদেশে বহু উপজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। মাফিয়ায় যেখানে যাচ্ছিলাম, সেখানেও খুব ম্যালেরিয়া হচ্ছিল। হাইন তাই আমাকে বেশ কিছু ম্যালেরিয়া-প্রতিরোধক ট্যাবলেট নিয়ে যেতে লিখেছিলেন। যাক ওষুধগুলো কাজে লেগে যাবে। সুনন্দ আমাদের বড় প্যাকিং-বাক্সটার মধ্যে দেখবে একটা হলুদ রঙের প্যাকেট রয়েছে। নিয়ে এসো তো!
ওষুধ মুখে নিয়ে টোটো থু থু করে ফেলে দিল। আমরা বোঝাই, খেয়ে নাও ভাই, দেখবে অসুখ সেরে যাবে। লক্ষ্মী ছেলের মতো খেলে তবে অনেকগুলো বিস্কুট পাবে। বিস্কুটের লোভেই বোধহয় সে মুখ বিকৃত করে, বড়ি কটা গিলে ফেলল। তাকে তাবর। মধ্যে শুইয়ে দিয়ে দুটো কম্বল ঢাকা দিয়ে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর কমেছে।
ঘণ্টাতিনেক পর টোটো উঠে বসল। গরম চা-বিস্কুট খেল। সে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। সত্যি মাহিন্ডিদের ওষুধের আশ্চর্য গুণ। এই হোমা অর্থাৎ কাঁপুনি-জ্বর তার আগেও হয়েছে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কখনো ভালো হয়নি। আর জ্বরের পর এত চাও কখনো বোধ করেনি। প্রতিবারই ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছে।
বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে সে বিদায় নিল।
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। সেদিন আর দ্বীপের সান্ধ্য আসরে গেলাম না! মামাবাবু বললেন, সঙ্গে তো মশারি আছে, এবার বের করো। জেনেশুনে ম্যালেরিয়া বাধিয়ে কাজ নেই।
পরদিন ভোরবেলা। সবে ঘুম ভেঙেছে। একজন লোক এসে তাঁবুর সামনে বেজায় হাঁকাহাঁকি শুরু করে দিল।
সর্দার ডাকছে, জলদি।
হঠাৎ সর্দারের তলব কেন?
তা জানি না। বলে দিয়েছে সেই দাওয়াই নেবে।
দাওয়াই? ওষুধ? কীসের? ঐ যে টোটোকে খাইয়েছিলে। সেই ওষুধ।
ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ আঁচ করি। সর্দার কি চটেছে? তার অগোচরে বিদেশি ওষুধ খাওয়ানো কি অপরাধ হয়ে গেল? পরোপকার করতে গিয়ে নতুন ফ্যাসাদ বাধালাম না তো? টোটোও আচ্ছা পেট আলগা, কী দরকার ছিল জানানোর? অবশ্য আমরাও তাকে বারণ করিনি বলতে।
অগত্যা তিনজনে দূতের সঙ্গে চললাম। দুরু দুরু বক্ষে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যাই। হুকুম মাফিক কিছু ম্যালেরিয়ার ট্যাবলেটও নিলাম।
গ্রামের ডাক্তারখানা। সেই ছোট্ট কুটির।
সর্দার তার দলবল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। যেতেই কুটিরের ভিতরে আঙুল দেখিয়ে বলল, এদের ওষুধ দাও, জ্বর হয়েছে। কাল যেমন টোটোকে দিয়েছ, তেমনি–
টোটো সামনে ছিল। দাঁত বের করে হাসল। বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। যত নষ্টের মূল।
কুটিরের ভিতর দুজন লোক শুয়ে জুরে কাঁপছিল। মামাবাবু ভিতরে ঢুকলেন। পরীক্ষা। করে বললেন, হুঁ-ম্যালেরিয়া। ট্যাবলেট দিলেন। সর্দারকে বললেন, পরে আমায় খবর দিও গা গরম কমেছে কী না।