এবার রতন আমার প্রস্তাবে যোগ দিল। সে বলল, আমারও যাওয়া দরকার, কারণ আমারও বংশী কামারের সঙ্গে দরকার আছে। প্রতাপের কৌতূহল ঐতিহাসিক হিসাবে, আমার কৌতূহলটা জিওলজিস্টের। আমি জানতে চাই বংশী লোহার সঙ্গে কী ধাতু মিশিয়ে ইস্পাত তৈরি করে, এবং কোত্থেকে সে এই ধাতু পায়।
ডাকু ভেবে বলল, বেশ, পরশু চল জগন্নাথপর। কীসে যাবি? বাসে, না প্রাইভেট গাড়িতে?
বাসে নয়, বলল রতন, কাকার গাড়িটা আমি ম্যানেজ করব।
.
রামচন্দ্রপুর ছাড়িয়ে কিছুটা গিয়ে বাঁ-ধারে মাইলখানেক দূরে জগন্নাথপুর গ্রাম। পিচ রাস্তা থেকে একটা গোরুর গাড়ি চলার মেঠো রাস্তা চলে গেছে গ্রামের দিকে। ওপথে মোটর যাবে না। তাই ঠিক হল, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বড় রাস্তার ধারে অপেক্ষা করুক।
আমরা পায়ে হেঁটে চললাম গ্রামে।
গ্রামের সীমানায় আমাদের অভ্যর্থনা জানাল এক দঙ্গল ছোট ছেলেমেয়ে। সর্বাঙ্গে ধুলো। বিস্ফারিত দৃষ্টি। নির্বাক অভ্যর্থনা।
ডাকু বলল, সোজা চল, একটা বড় বটগাছের ধারে বংশীর ঘর।
রাস্তার পাশে এক বাড়ির দাওয়ায় কয়েকজন লোক বসে ছিল। তারা হাঁ করে আমাদের দেখতে লাগল। বটগাছ দেখলাম! সত্যি বিরাট। ডাল থেকে প্রচুর ঝুরি নেমেছে মাটিতে। যেন জটাজুটধারী মুনি একজন। গাছের ধারে ধারে কয়েকটি কুটির। ডাকু দেখাল, ওইটে বংশীর বাড়ি।
দুঃখের বিষয়, বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। বুঝলাম বংশী কোথাও বেরিয়েছে। এদিক সেদিক চাইতে দেখি পাশের বাড়ির দরজা দিয়ে একটা মুখ উঁকি মারছে। ডাকু ডাকল তাকে–শুনুন। লোকটি যেন ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এল। অস্থিচর্মসার ছোটখাটো মানুষটি। বয়স বোঝা ভার। ডাকু জিজ্ঞেস করল, বংশী নেই দেখছি। কখন আসবে বলতে পারেন?
লোকটি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমাদের লক্ষ করছিল। এবার সে যে প্রশ্নটি ছাড়ল, তার জন্য আমরা একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। তীব্র খ্যানখ্যানে গলায়–আজ্ঞে আপনারা কি পুলিশের লোক?
সে কি! আমাদের পুলিশ ঠাওরাবার কারণ?
রতন বলল, না আমরা পুলিশ নই। বংশীর কাছে এসেছি একটা কাজে। একটা লোহার জিনিস গড়াব, তাই।
ও। লোকটি যেন হাঁফ ছাড়ল। সে কাছে এগিয়ে এল।
তা আপনারা আসছেন কোত্থেকে?
ডাকু বলল, কেওঞরগড়। আমি ওখানেই থাকি। এঁরা দুজন কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছেন। বংশীর খুব প্রশংসা শুনেছেন, তাই তার কাজ দেখতে চান।
অ্যাঁ কলিকাতার লোক? লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আজ্ঞে আমিও কলিকাতা ছিলাম চার বছর। হোটেলে কাজ করতাম। অসুখে ভুগলাম খুব তাই দেশে চলে এসেছি হয় মাস হল। লোকটি এতক্ষণ ওড়িয়ায় কথা বলছিল। এবার সে বাংলা-ওডিয়ার জগাখিচুড়ি ছাড়ে। বলল, আজ্ঞে আমার নাম কার্তিকচন্দ্র পণ্ডা। তা বংশীদাকে খোঁজ করছিলেন কিনা তাই ভাবিলাম আবার বুঝি পুলিশ এসেছে।
ডাকু বলল, বংশীর কাছে বুঝি পুলিশ এসেছিল?
হ্যাঁ।
কেন?
আর বলবেন না মশাই। গতকাল পুলিশ এসেছিল পঞ্চার খোঁজে! বংশীদাকে কি হয়রানিটাই না করল।
পঞ্চা কে? আমি জিজ্ঞেস করি।
বংশীদার ছেলে। ইস অমন ভালো মানুষটা! ছেলের জন্যে মান-ইজ্জত সব গেল।
ডাকু বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ–বংশীর এক ছেলে আছে, বলেছিল সেদিন। তা পঞ্চা কী করেছে?
ডাকাতি মশায়!কার্তিক গলার স্বর একটু নামায়।দেব-বাড়ির ডাকাতির কেসে পুলিশ ওকে খুঁজছে। এ নাকি ওর দলের কাজ। দেব-বাড়ির মন্দির ভেঙে ভীষণ ডাকাতি হয়েছে। সাংঘাতিক ছেলে মশাই পঞ্চা। গুণ্ডা বদমাশ। আগে একবার মাস দুই জেলও খেটেছে। এবার ধরা পড়ে সারাজীবন জেলের ঘানি টানুক। শিক্ষে হোক বেটার।
দেব-বাড়ির ডাকাতি ও বংশীর ছেলে!–এ তো অদ্ভুত যোগাযোগ। আমি বললাম, বংশীর ছেলে বুঝি লোহার কাজ করত না?
কেন করবে না, বলল কার্তিক, আগে করত। বেশ কাজ শিখেছিল। তারপর কুসঙ্গে, পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। বংশীদা ওকে কত বুঝিয়েছে। বকেছে! কিন্তু ও ছেলে কি শোনার পাত্র। নেহাত মা-মরা একমাত্র ছেলে, নইলে বাড়িতেই ঢুকতে দিত না বংশীদা। এখন আট-দশ দিন পঞ্চা হাওয়া। তারপর কাল এল পুলিশ।
পঞ্চার কথা শুনতে আমার উৎসাহ হচ্ছিল না। বংশী কখন আসবে? কার্তিক জানাল, ভোর থেকেই দেখছি বংশীদার ঘরে তালা মারা। কোথায় গেছে, কখন আসবে হয়তো পেল্লাদ বলতে পারে।
কে পেল্লাদ?
আজ্ঞে বংশীদার অ্যাসিস্টান্ট। ভারি ভাল ছেলে।
পেল্লাদের সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে? বললাম আমি।
নিশ্চয়। পেল্লাদ এ গাঁয়েই থাকে।–ওরে এই ছোঁড়া। যা তো পেল্লাদকে ডেকে নিয়ে আয়। বল কলিকাতার বাবুরা ডাকছেন। কার্তিক একটা ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিল।
আমি লক্ষ করেছিলাম বটতলায় অনেকগুলো উনুন। ওগুলো লোহা গালাবার চুল্লি। সবই ভাঙা। শুধু একটা আস্ত আছে। চুল্লি শক্ত মাটিতে তৈরি। তলাটা গোল। প্রায় তিন ফুট ব্যাস। তলা থেকে ওপরে গম্বুজের মতো সরু হয়ে গেছে। চুল্লির তলায় দুটো ফুটো! মাথাতেও ফুটো। রতনকে দেখিয়ে বললাম–
এই হচ্ছে দেশি কামারদের আদিম চুল্লি। অবশ্য এর চেয়ে ছোট বা বড়ও হয়। তলার একটা ফুটো দিয়ে গলানো লোহার খাদ বেরিয়ে যায়। অন্য ফুটোটা দিয়ে চামড়ার হাপর চালিয়ে পাম্প করে হাওয়া ঢোকানো হয়, আগুনের তাত ভোলার জন্য। আর মাথার ফুটো দিয়ে লোহার আকর এবং কাঠকয়লা ফেলা হয় চুল্লির ভিতর জ্বলন্ত কাঠের ওপর। কয়েক ঘণ্টা প্রচণ্ড আঁচে লোহা-পাথর গলে যায়। তখন ভারী ধাতু লোহা নিচে জমা হয় এবং ওই পাথরে মেশা অন্য ধাতু বা খাদ ওপরে ভাসতে থাকে। সেগুলো বেরিয়ে যায় ফুটো দিয়ে। তারপর গলিত লৌহপিণ্ড বের করে হাতুড়ি দিয়ে বেশ করে পেটালে বাকি খাদ ঝরে গিয়ে থাকে প্রায় বিশুদ্ধ লৌহপিণ্ড। আর ইস্পাত বানাতে হলে ওই রকম খাঁটি লোহাকে আবার গলিয়ে তার সঙ্গে মেশানো হয় গুঁড়ো কাঠকয়লা অর্থাৎ কার্বন, তৈরি হয় কার্বন-স্টিল।