দেবমশাই ডাকুর হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে কারুকার্যটি দেখলেন। তারপর বললেন, খেয়াল-খুশিমতো নকশা করেছে হয়তো। কিংবা কারিগরের নিজস্ব ছাপ হতে পারে, মানে ট্রেডমার্ক।
ও। ডাকু ছুরি রেখে দিল একটু অন্যমনস্কভাবে।
ওই সামান্য ছুরি সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কত বড় বড় অদ্ভুত আকৃতির অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে, সেগুলোর ওপরই আমাদের বেশি নজর।
ঘণ্টা দুই পর আমাদের মিউজিয়াম দেখা শেষ হল। ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় কাকাবাবু বললেন, দেবমশাই আপনাদের মন্দিরের বিগ্রহটি একবার দেখাবেন? খুব নাম শুনেছি।
দেবমশাই থমকে দাঁড়ালেন। তার মুখ বিমর্ষ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে বললেন, খবরটা বোধহয় আপনাদের ওদিকে পৌঁছায়নি এখনো। সমস্ত অলংকার সমেত আমাদের বিগ্রহটি চুরি গেছে।
সে কী? কবে? কাকা বলে উঠলেন। আমরাও অবাক।
মাত্র দ-দিন আগে। চুরি নয়, ডাকাতি। চার-পাঁচজন লোক এসেছিল রাতে। মিন্দরের প্রহরীকে অতর্কিতে আঘাত করে বেঁধে ফেলে, মন্দিরের দরজা ভেঙে ঢুকে ভিতরের যাবতীয় দামি জিনিস লট করেছে। গৃহ-দেবতা বিগ্রহ হারিয়েই বেশি কষ্ট পেয়েছি। পুলিশ অনুসন্ধান করছে। তিন হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছি শুধু বিগ্রহের জন্যে। এখন ভাগ্য।
তিন হাজার টাকা, শুধু বিগ্রহের জন্যে? ডাকু চোখ বড় বড় করে বলে।
হ্যাঁ। যদি কেউ উদ্ধার করে দেয়। গৃহ-দেবতাকে ফিরে পাওয়াই আমার সবচেয়ে বং কামনা।
আমরা মনে মনে লজ্জিত হলাম। সত্যি, ভদ্রলোক একবারও বুঝতে দেনান যে এত মন খারাপ। দিব্যি হাসিমুখে সব দেখালেন।
মিস্টার দত্ত বললেন, ছি ছি, এখন আপনাকে বিরক্ত করা উচিত হয়নি। জানতাম না কিছু।
ভদ্রলোক যদিও কথাটা উড়িয়ে দিলেন, আমরা তার মনের আসল ভাবটা আন্দাজ করে তাঁকে আর বিরক্ত না করে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
.
০২.
শহরে পৌঁছে আমরা ডাকুর বাড়িতে নামলাম, কাকাবাবু গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। খিদেটা পেয়েছিল বেশ চনচনে, তাই দোকান থেকে চা আর গরম আলুর চপ আনিয়ে জমিয়ে বসলাম।
একটা বড় বাড়ির একতলায় একটা মাঝারি সাইজের ঘর নিয়ে ডাকু থাকে। আমরা দুজন সতরঞ্চি বিছানো তক্তপোশে বসেছি, ডাকু একটা হাতল-ভাঙা কাঠের চেয়ারে। গরম চপে একটা বেপরোয়া কামড় দিয়ে মুখটাকে একটু বিকৃত করে ডাকু হঠাৎ বলল, কোনো মানে হয় না।
কীসের কোনো মানে হয় না? রতন জিজ্ঞেস করল।
তিন হাজার টাকা। পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। তারা যদি বামাল সমেত চোর ধরে ফেলে তাহলে তো টাকাটা মাঠে মারা যাবে।
আমি বললাম, তাই বলে তুই পুলিশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তদন্ত শুরু করবার তাল করছিস নাকি? তিন হাজার টাকা কি সকলের কপালে থাকে রে? তাও যদি বা কোনো ক থাকত।
আমার ইচ্ছে ছিল যেখানে বিগ্রহটা ছিল সে জায়গাটা একবার দেখে আসি। তোরা এমন তাড়াহুড়ো করে চলে এলি!
ভালো কথা,–রতন বলে উঠল–তোর হঠাৎ ওই ছুরিটার ওপর চোখ গেল কেন?
ঠিক ও-রকম একটা ছুরি একবার আমার প্রায় হাতে এসে গেসল, তাই।
ডাকু বেপরোয়া ডানপিটে হতে পারে, কিন্তু বাজে গুল মারার অভ্যাস নেই সেটা আমরা জানি। কাজেই কথাটা শুনে আমরা দুজনেই বেশ অবাক। বললাম, কী ব্যাপার একটু খুলে বলতো।
ডাকুর কথা থেকে যা বেরোল তা মোটামুটি এই–
বছর দুয়েক আগে বর্ষার মুখটাতে ডাকু একা মহাগিরি রেঞ্জে শিকার করতে গিয়েছিল। শিকার শেষে পাহাড় থেকে হেঁটে ফিরছিল রামচন্দ্রপুরে বাস ধরবে বলে। পথে বৃষ্টি নামে, ডাকু দৌড়ে গিয়ে কাছের একটা গ্রামে এক বুড়োর ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সে বুড়ো নাকি কামার, এবং ভারি ভাল লোক! সেই বুড়োর ঘরের দেয়ালে ঝোলানো একটা ছুরির ওপর ডাকুর চোখ যায়। দেবদের অস্ত্রাগারে দেখা পদ্মমার্কা ছুরির প্রায় ডুপ্লিকেট। সেই রকম সাইজ, সেই রকম ফলা কেবল হাতির দাঁতের বদলে কাঠের হাতল। কিন্তু হাতলে অবিকল সেই রকম পদ্মচিহ্ন। ডাকু নাকি ছোরাটা অনেক করে কিনতে চেয়েছিল, কিন্তু বুড়ো কামার রাজি হয়নি। সে বলেছিল যে এই ছুরির ফলার ইস্পাত লোহার সঙ্গে এক রকম বিশেষ। ধাতু মিশিয়ে তৈরি করেছে, এবং এই মেশাবার কায়দা নাকি ওই বুড়ো কামারেরই এক পূর্বপুরুষ দৈবাৎ আবিষ্কার করে। এই সব ইস্পাতের জিনিস আগে বুড়োর পূর্বপুরুষরা বানাত, রাজা জমিদার, সেনাপতি–এই সব বড়লোকদের জন্য। এখন এ সবের কদর নেই, চাহিদা নেই, তাই বানানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ওই একটি ছুরি তাই অতি যত্নে রেখে দিয়েছে কামার।
ডাকুর এই বর্ণনা আমাদের দুজনেরই কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল–অবিশ্যি সেটা দুটো আলাদা কারণে। ডাকু থামলে পর আমিই প্রথম প্রশ্ন করলাম।
গ্রামের নামটা মনে আছে তোর? বাঃ, মনে থাকবে না? ডাকু বেশ জোরের সঙ্গেই বলে উঠল কথাটা–জগন্নাথপুর। কেন, তোর কি যাবার শখ হয়েছে? ও ছুরি দেবে না বুড়ো।
আমি ডাকুর কথা অগ্রাহ্য করে আরেকটা প্রশ্ন করলাম–আর বুড়ো কামারের নাম?
বংশীধর পাত্র। আরো কিছু জানতে চাস?
না, জানতে চাই না। যেতে চাই জগন্নাথপুর। তবে ছুরি হাত করতে নয়। ছুরিটা কীভাবে বানিয়েছিল বংশীধর পাত্র, সেটা জানতে। ভারতীয় ইস্পাত একদিন পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল। শুধু তাই নয়–ইস্পাত তৈরির কৌশল প্রথমে ভারতেই আবিষ্কার হয়। অনেকে বলেন, ভারতীয় ইস্পাতের সাহায্যেই প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের কঠিন পাথরের মন্দিরের গায়ে চিত্রলিপি ও মূর্তি খোদাই করেছিল। প্রাচীন যুগের কথা ছেড়ে দিলেও–ধর, এই একশো বছর আগেও সিপাই বিদ্রোহের পর সিপাইদের কাছ থেকে যে সব ছুরি, তলোয়ার ইতাদি পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো পরীক্ষা করে ইংরেজরা অবাক হয়ে যায়। শেষে কলকারখানার যুগ আরম্ভ হওয়ায় এই সব কামাররা মার খেয়ে যায়। কিন্তু এই সব কামারদের মধ্যে একজনেরও যদি সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাহলে তার কাছ থেকে ইস্পাত তৈরির আশ্চর্য সব তথ্য পাওয়া যেতে পারে। বল ডাকু–জগন্নাথপুর নিয়ে যাবি?