–বস মানে দত্ত সাহেব বললেন, আপনাদের একটু ঘুরিয়ে-টুরিয়ে দেখাতে, হেল্প করতে। তারপর রতনের মুখের পানে তাকিয়ে–আপনি বুঝি দত্ত সাহেবের ভাইপো?, হুঁ ঠিক। চেহারায় ভারি মিল।
এমন হুড়মুড়িয়ে কথা বলছিলেন ভদ্রলোক যে রতন থতমত খেয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি?
আমি? আমি নন্দদুলাল বোস।
ভদ্রলোক আমাদের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জরিপ করতে করতে বেশ সজোরে বিড়বিড় করে চললেন–হুঁ, পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি নয়…এ্যাট লিস্ট দশ বছরের সিনিয়ার হব…অতএব ব্রাদার এবং তুমি! কি, আপত্তি আছে?
খানিকক্ষণ সময় লাগল হেঁয়ালি বোধগম্য হতে। তারপর বলে উঠলাম, না, না, আপত্তির কি? নিশ্চয় তুমি বলবেন। ভদ্রলোক খুশিতে উজ্জ্বল হন। রতন মিটমিটিয়ে দুষ্টু হেসে বলল, আর আমরা যদি ডাকি বোসদা, আপত্তি আছে?
সার্টেনলি নট।
বোসদার সঙ্গে দারুণ জমে গেল। পরে জেনেছিলাম উনি কেওঞ্ঝরগড়ে এসেছেন মাত্র দু-বছর। বিয়ে করেছেন বছর তিনেক, তবে ফ্যামিলি, মানে স্ত্রী, থাকেন দেশের বাড়ি বর্ধমানে। বোসদা এখানে থাকেন একা।
জায়গাটা সত্যি সুন্দর। পুরনো আমলের ছোট্ট শহর। দেশীয় রাজার রাজধানী ছিল। শহরের চারপাশ পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা। কলকাতা থেকে এসে ভারি আরাম লাগে।
মিস্টার দত্তর গল্প করার ধাত নয়, তবে নজর ঠিক আছে। একদিন চা খাচ্ছি, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কেমন বেড়াচ্ছ? বোস সব দেখাচ্ছে তো?
বললাম, নতুন আর পুরনো দুটো রাজপ্রাসাদ দেখেছি। এবার জগন্নাথ মন্দির দেখতে যাব। ধারে-কাছে নাকি অনেক প্রাচীন মন্দির আছে?
মিস্টার দত্ত বললেন, আছে বৈকি। উড়িষ্যা হচ্ছে মন্দির আর মূর্তির দেশ। পুরী, কোনারক, ভুবনেশ্বরের কথা ছেড়ে দিলেও আমি ঘুরতে ঘুরতে দেখেছি কত অজানা ছোট্ট গ্রামে কী সুন্দর মন্দির আর বিগ্রহ। মাঠে-ঘাটে পাওয়া যায় কত মূর্তি। বিশেষ করে পাথরে তৈরি! সামান্য দামে লোকে সে সব বেচে দেয়। আমার ড্রইংরুমে যে পাথরের যক্ষমূর্তিটা রয়েছে ওটা এক ওভারসিয়ার আমায় প্রেজেন্ট করেছে। কী সুন্দর না?
.
সেই দিনই গেলাম জগন্নাথ মন্দির দেখতে। কে জানত সেখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে এক চমক।
আমি ও রতন মন্দির দেখছি। দেওয়ালের গায়ে মূর্তি দেখতে দেখতে ঊর্ধ্ব মুখে মন্দিরকে পাক দিচ্ছি। ঠিক একই ভাবে আর একজন ঘাড় উঁচু করে এলো উলটো দিক থেকে। তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। রঙ কালো। বেশ লম্বা। কেঁকড়া চুল, সার্ট ও ফুলপ্যান্ট পরনে, জোয়ান চেহারা।
সে মখ ফেরাতেই চমকে রতনকে খোঁচা মারলাম–দেখ, ডাকু।
আগন্তুকের কানে আমার কথা গিয়েছিল। সে পিটপিটিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে দেখল কয়েক সেকেন্ড। তারপর লাফাতে লাফাতে এসে–অ্যাঁ, তোরা? বলে জাপটে ধরল দুজনকে।
উঃ কী গায়ে জোর। দম বন্ধ হবার যোগাড। বলি–ছাড় ছাড। তুই এখানে কোত্থেকে?
ডাকুর সঙ্গে এমন যোগাযোগ হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। ওর সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার আশাই মুছে গিয়েছিল মন থেকে। ও ছিল ইস্কলে একটানা পাঁচ বছর ধরে আমাদের দুজনের সহপাঠী। পড়াশুনায় মাঝারি, কিন্তু দারুণ ফুটবল খেলত, আর ডানপিটেমিতে ছিল এক নম্বর ওস্তাদ। ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে ও স্কুল ছেড়ে দেয়। কারণ ওর বাবার আকস্মিক মৃত্যু। তখন ডাকুরা সব ভাইবোন মা-র সঙ্গে কলকাতা ছেড়ে ওদের দেশের বাড়ি মেদিনীপুরে চলে যায়। আর দেখা হয়নি। প্রথমে কয়েকবার চিঠিপত্র লেখালেখি হয়েছে। ক্রমে তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
রতন বলল, হ্যাঁ রে তুই আছিস কেমন? এখানে কী করছিস?
ডাকু ম্লানমুখে বলল, আছি এক রকম। টিকে আছি। এখানে এসেছি চাকরি করতে।
কী চাকরি? কদিন হল?
সামান্য চাকরি ভাই। কেরানিগিরি। দুমাস কেওঞ্ঝরগড়ে এসেছি। উড়িষ্যায় আছি পাঁচ বছর। আগে ছিলাম জাজপুরে। এখানে কোম্পানি একটা নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছে, তাই ট্রান্সফার হয়ে এসেছি। বুঝলি, স্কুল ফাইনালের পর আর তো লেখাপড়া এগুল না। আমার গাঁয়ের কাছে কলেজ নেই। শহরে হোস্টেলে থেকে পড়া সম্ভব নয়। তাই দেশেই ছিলাম। যা। সামান্য জমিজায়গা আছে, চাষ-বাস দেখতাম। কিন্তু তাতে কি সংসার চলে? তখন আমার এক আত্মীয় এই চাকরিটা জুটিয়ে দিল। মাইনে কম বলে দুঃখ নেই, কিন্তু বসে বসে একঘেয়ে হিসেব কষতে অসহ্য লাগে। ছোটবেলায় ভাবতাম বড় ফুটবলার হব, হল না। ভাগ্যে। স্কুল ফাইনাল পাস করে নেভিতে ঢুকতে চাইলাম, বাড়িতে কান্নাকাটি করে দিলে আটকে। এখন এই করছি।–
বড় কষ্ট হল। জানি তো কী ছটফটে প্রাণশক্তি ভরা দুরন্ত ছেলে ছিল ডাকু। বেচারা।
ডাকু একটু হেসে বলল, তবে একদম ঘেঁতিয়ে যাইনি। সুযোগ পেলেই শিকার করি। বাবার বন্দুকটা আছে। কয়েকটা বড় জানোয়ারও মেরেছি।
তিনজনে ফিরলাম। বোসদা ডাকুর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, ব্রাদার ইটি
রতন বলল, শ্রীযুক্ত শান্তসুবোধ শাসমল ওরফে ডাকু। আমাদের ইস্কুলের বন্ধ। এখানে চাকরি করে।
ডাকু কেন? বোসদা জানতে চাইল।
অসম্ভব ডানপিটে ছিল কিনা, তাই স্কুলে ওই খেতাব পায়। বলল রতন।
বোসদা ডাকুর দিকে চেয়ে বললেন, হুঁ, চেহারাটা কিঞ্চিৎ গুণ্ডে গুণ্ডো বটে। কিন্তু ব্রাদার, এ ব্যক্তি লোক খারাপ নয়। হাসিটি ভারি মিষ্টি।
আরও দুটো দিন ডাকু আমি আর রতন প্রাণভরে আড্ডা দিলাম। মাঝে মাঝে বোসদাও যোগ দেন। পুরনো দিনের কত গল্প হয়। কত মজার ঘটনা, দুষ্টুমির কথা। কাছাকাছি কী কী দেখতে যাব প্ল্যান করি। এমনি করেই হয়ত আমাদের বাকি দিনকটা কেটে যেত, যদি না রতনের কাকা দেব-বাড়ির মিউজিয়ামের কথা শোনাতেন। কারণ সেই মিউজিয়াম দেখতে গিয়েই আবিষ্কার হল এক রহস্যের সূত্র, যার ফলে জড়িয়ে পড়লাম এক দারুণ রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারে।