মাহঙ্গা অর্থাৎ ওঝা কামাউ দ্বীপের বদ্যি। তার নির্দেশে অন্যরা লোকগুলিকে ধরে ধরে নিয়ে একটি ছোট কুটিরের মধ্যে ঢোকাল।
কৌতূহলী হলেও প্রথমে কী ডাক্তারি হচ্ছে দেখার সুযোগ পাইনি। দ্বিতীয় দিনে উঁকি মেরে লক্ষ করলাম।
দেখি কুটিরের মধ্যে এক চুলি জ্বলছে! রুগীরা আগুনের পাশে শুয়ে পড়ল। তাদের গায়ের ওপর কয়েকটা জানোয়ারের ছাল চাপিয়ে দেওয়া হল। তারপর কামাউ এসে দু-চারটে মন্ত্র আউড়ে খানিকটা তরল পদার্থ প্রত্যেক রুগীকে খাইয়ে দিল। অতঃপর তাদের সেখানে রেখে অন্যরা ফিরে এল।
এই দেশি টোটকায় খুব উপকার হয় বলে বিশ্বাস হয়নি। কারণ, দেখছি লোকগুলি সে-রাতে আর উঠতে-বসতে পারেনি। জুরে অচেতন হয়ে রয়েছে।
তবে রোগ মারাত্মক নয়। কারণ পরে দেখেছি তাদের, আবার চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। দুর্বল দেহ, চোখে-মুখে শ্রান্ত অবসন্ন ভাব। বোধহয় জ্বর নেই বা কমে গেছে। কে জানে কী ব্যারাম!
আগেই বলেছি এখানে আমাদের কিছু অনুরাগী জুটেছিল। একদল বালক-বালিকা। তারা সর্বত্র ছায়ার মতো আমাদের অনুসরণ করেছে। লক্ষ্য করেছে আমাদের হাবভাব। পুরো দেড়দিন আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি।
ক্রমে তাদের বিদেশিদের প্রতি উৎসাহ কমে গেল–শুধু একজন ছাড়া।
ছেলেটিকে আমরাও নজর করেছিলাম, বয়স সতেরো-আঠারো। যেন কষ্টিপাথরে কোঁদা শরীর। চোখাচোখি হলেই দু সারি মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হাসত। আমাদের সম্বন্ধে তার কৌতূহল অদম্য।
তৃতীয় দিন ভোরে দেখি–ইতিমধ্যে ছেলেটি এসে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সুনন্দ বলল, ছোঁড়া পেটুক। দেখেছিস যখনই আমরা খেতে বসি, এসে আমাদের খাওয়া দেখে। জিভ চাটে।
দুগ্ধহীন কফি ও বিস্কুট সহযোগে প্রাতরাশ সারছি, ছেলেটি যথারীতি কাছে এগিয়ে এল।
সুনন্দ একটা বিস্কুট বাড়িয়ে সোয়াহিলিতে ডাকল, ভিতরে এস, ভয় নেই। খাবে?–টাকা কুলা?
সে তৎক্ষণাৎ খানিক দূরে সরে গিয়ে মাথা নাড়াতে লাগল। জাদুমন্তর জানা বিদেশিদের বড় ভয়।
আমি ও সুনন্দ খুব ডাকাডাকি করতে থাকি, অভয় দিই। বারবার দেখিয়ে দেখিয়ে বিস্কট খাই এবং হাত বাড়িয়ে অফার করি, খাও খাও, লজ্জা কী?
এই টোপেই কাজ হল। গুটিশুটি এগিয়ে এসে ছেলেটা টপ করে সুন্দর হাত থেকে বিস্কুট নিয়ে ফের দূরে সরে গেল।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিনিসটা পরীক্ষা করল। শুকল। তারপর ভয়ে ভয়ে এক টুকরো কামড়াল।
খানিকক্ষণ সে চোখ বন্ধ করে মুখ কুঁচকে বস্তুটির আস্বাদ নিল। তারপরই ফিক করে হাসি! বাঃ, খানা, গ্র্যান্ড! মুজুরি সানা।
সঙ্গে সঙ্গে বাকিটুকু মুখে পুরে কামড়িয়ে চিবিয়ে আবার হাত পাতল, ইঙ্গিনে মোজা। অর্থাৎ আর একটা।
তার নামটি জেনে নিই। বলল, জেনা ইয়াঙ্গু টোটো। অর্থাৎ আমার নাম টোটো।
টোটো ফের হাজির। ঘড়ি ধরে ঠিক বারোটায় বোধহয় সারা সকালটা সে তার ছায়ার ওপর দৃষ্টি রেখে এই মাহেন্দ্রক্ষণটির প্রতীক্ষা করছিল। এখন তার লজ্জা-ভয় কমে গেছে। একবার ডাকতেই তাঁবুর মধ্যে ঢুকে এককোণে উবু হয়ে বসল।
আমাদের সঙ্গে চাল ছিল। ফেন-ভাত বেঁধেছিলাম, সঙ্গে মাখন ও টিনের মাংস।
প্লেটে অল্প মাংস দিয়ে টোটোর সামনে রাখলাম। কচ্ছপের মাংস, সামান্য মশলা দেওয়া। একবার গরম করে নিলেই খাসা খেতে। সুনন্দ বলল, দেখ হে টেস্ট করে। তোমাদের তো যত ঝলসানো আর আধপোড়ার কারবার, এ-বস্তুর মর্ম বুঝলে হয়!
টোটো দেখল, শুকল, চাটল, তারপর সন্তর্পণে একটু মুখে পুরল। আধ মিনিট তার চক্ষুমোদা, সমস্ত ইন্দ্রিয় স্বাদগ্রহণে তন্ময়। চোয়াল অল্প অল্প নড়ছে। হঠাৎ চোখ খুলল! মুহূর্তে বাকি মাংস নিঃশেষ এবং প্লেটসহ হস্ত প্রসারিত, মুফা–আরও দাও।
আধ টিন মাংস শেষ করার পর আমরা বাধ্য হয়ে তাকে আর পরিবেশন করতে নারাজ হলাম।
ব্যস, এরপর থেকে সে আমাদের নিয়মিত অতিথি বনে গেল। যেখানেই থাকুক খাবার সময় তার হাসিমুখটি ঠিক তাঁবুর দরজায় উঁকি মারবে।
টোটোর সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়ে গেল। দ্বীপের সোয়াহিলি বুঝতে আর এখন আমাদের তেমন কষ্ট হয় না। মামাবাবু একদিন ঠাট্টা করে বললেন, কেন মাথা খাচ্ছ। ছেলেটার? তোমরা তো দুদিন পরে চলে যাবে, তখন? দেশি রান্না কি আর ওর মুখে রুচবে?
সুনন্দ বলল, সে আমি ভেবে রেখেছি। অনেকগুলো মাছ-মাংসের সোজা সোজা রান্না আমি টোটোকে শিখিয়ে দেব। তারপর যেদিন উপকূলে ফিরব, ওকে সঙ্গে নেব। ওখান থেকে প্রচুর টিনফুড আর দরকারি মশলাপাতি কিনে দেব। মাটির হাঁড়ি-কুড়ি ওরা বানাতে পারে! মাছ-মাংসের অভাব নেই। যখন ইচ্ছে খুশিমতো মুখ বদলাবে।
টোটোকে আমি জিজ্ঞেস করেছি, এ-দ্বীপে তোমরা কতদিন এসেছ?
অ-নে-ক-দিন। আমার জন্ম তো এখানে।
আগে কোথায় থাকতে?
আগে ছিলাম এ-মহাসাগর, বাহারিকু, এই সমুদ্র পেরিয়ে ওপারের দেশে। বালিসানা–অনেকদূরে-পাহাড়-জঙ্গলের রাজ্যে।
সুনন্দ বলল, আচ্ছা এখন সবার সঙ্গেই আমাদের বেশ ভাব-সাব হয়েছে, কিন্তু কামাউ-এর ব্যাপারটা কী? আমাদের সঙ্গে কথা বলে না, কাছে আসে না, কেন?
কামাউ কোনো বিদেশিকেই পছন্দ করে না। আর সাদা মানুষদের ওপর তো ভীষণ চটা।
কেন?
শুনেছি, কামাউ যখন ছোট ছিল, একদল শয়তান সাদামানুষ তাকে দূর দেশে ধরে নিয়ে যায়। খুব অত্যাচার করে। অনেক কষ্টে কামাউ পালায়। সেই থেকে তার রাগ। মাহিন্ডি বলে বেঁচে গেছ, সাদাদের বাগে পেলে ও খুন করতে পারে।