সূর্য ডোবার আগে দ্বীপের সবাই ঘরে ফিরল। তাদের আহ্বানে আমরা গ্রামে গেলাম। মাঝিরা যেতে চাইল না। প্রথমত দ্বীপবাসীদের সঙ্গে মেশার কোনো আগ্রহ তাদের নেই। দ্বিতীয়ত আহত সঙ্গী দুজন রয়েছে।
দেখলাম চত্বরের মাঝখানে এক অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। সবাই জড়ো হয়েছে চারপাশে। সর্দার এবং কামাউ বসেছে দুটো উঁচু পাথরের আসনে। আগুনের আঁচে ঝলসানো হচ্ছে মাংস, মাছ। একটু পরেই বড় বড় ঢাকে পড়ল কাঠির ঘা। ধ্বনিত হয়ে উঠল আকাশ-বাতাস। তৎক্ষণাৎ একদল উঠে শুরু করল নাচ। একদল ধরল গান। ক্রমে বাজনার লয় বাড়ে, নাচের তাল দ্রুততর হয়। আগুনের লালচে আভায় সঞ্চরমান সুগঠিত কৃষ্ণবর্ণ মূর্তিগুলি কেমন অপার্থিব বোধ হচ্ছিল। সে-ধ্বনি সুন্দর, সে-দৃশ্য কেমন ঘোর লাগায়। আমরাও মাথা নেড়ে তাল ঠুকি।
ছেলে ও মেয়ের দল পালা করে নাচল। কখনো যৌথ নৃত্য। নানারকম নাচ। জন্তু জানোয়ারের অঙ্গভঙ্গি নকল করে নাচ। উদ্দাম সমর-নৃত্য, কত কী!
দিব্যি আছে এরা। ভবিষ্যতের ভাবনা নেই। অতীতের জন্য আক্ষেপ নেই। শুধু বর্তমান। প্রত্যক্ষ জীবনধারণের তাগিদে কঠোর সংগ্রাম আর অনাবিল আনন্দ।
ঘণ্টা দুয়েক পর নাচ-গান থামল। আরম্ভ হল যথেচ্ছ পানভোজন। আমরাও এক-এক টুকরো মাংস এবং এক পাত্র মাংসের কাথ মেশানো ভুট্টার সুরুয়া পেলাম। স্যুপটা মন্দ নয়, কিন্তু আধপোড়া মাংস মুখে রুচল না। খাবার ভান করে লুকিয়ে ফেললাম।
পেটপুরে ভোজন করে সবাই টইটুম্বুর। কেউ কেউ আগুনের ধারেই সটান শুয়ে পড়ে নাসিকা গর্জন শুরু করল। কেউ কেউ উঠে গেল কুটিরে। আমরাও সুযোগ বুঝে নিঃশব্দে উঠে পড়ি।
.
০৫.
দ্বীপটাতে শুছিয়ে বসলাম।
মেয়াদ অবশ্য বেশিদিন নয়, মাত্র দশদিন। সর্দার বলেছে আমরা যেদিন দ্বীপে এসেছি তারপর ঠিক এগারো দিনের দিন ময়োজিমাকুবা অর্থাৎ পূর্ণিমা। আকাশে সেদিন মস্ত গোল চাঁদ উঠবে। পূর্ণিমার আগের দিন তাদের নৌকো যাবে ওপারে। আমাদেরও তখন সঙ্গে নিয়ে যাবে।
সূচনায় বেঘোরে প্রাণ যাবার উপক্রম হলেও পরের ব্যাপারটা মন্দ দাঁড়াচ্ছে না। বরাতে শিকে ছিঁড়ে খাসা একটা অ্যাডভেঞ্চার জুটে গেছে। দশটা দিন তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। অতএব প্রাণভরে এই হঠাৎ-পাওয়া রোমাঞ্চের স্বাদ উপভোগ করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমাদের থাকার ব্যবস্থাটি ভালোই হয়েছে। আর খাওয়ার ভাবনা মামাবাবু সুনন্দের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন, কারণ রান্নার ব্যাপারে সুন্দর দারুণ উৎসাহ।
ঠিক করা হল প্রথমে দ্বীপটা সার্ভে করা যাক।
সকালে একবার সপারিষদ সর্দার এসেছিল খোঁজ নিতে। আসা মাত্র সুনন্দ তাকে একটা পেন-নাইফ প্রেজেন্ট করল। ছুরিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সর্দার মহাখুশি। এখন তাদের ব্যবহার বেশ সহজ, বন্ধুত্বপূর্ণও বলা যায়। শুধু ঐ কামাউ হল ব্যতিক্রম। সেও এসেছিল, কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। মামাবাবু এগিয়ে তাকে নমস্কার জানালেন–জাম্বো বানা। কিন্তু তার সন্দিগ্ধ আচরণ কিছু সরল হল বলে মনে হল না। যাক বাবা মিশতে না চায় ক্ষতি নেই, কোনো বাগড়া না করলেই বাঁচোয়া।
সর্দার সুনন্দকে অনুরোধ করল, মাহিন্ডি, তোমার জাদুটা একবার দেখাও তো। সেই যে। হঠাৎ অগ্নির আবির্ভাব, ছোট্ট একখানা নীল বাক্স থেকে।
সনন্দ গেরামভারি চালে পকেট থেকে লাইটার বের করল। দেখেই জনতা সাত হাত তফাতে সরে গেল।
সুনন্দ বার কয়েক হিংটিং-ছট মন্ত্র আউড়াল, শূন্যে বহু আন্দোলিত করল, তারপর খ করে লাইটার টিপল।
মোটো, মোটো–আগুন, আগুন,ভীত বিস্মিত দর্শকদের মধ্যে থেকে কোলাহল ওঠে। বিদেশি ভারতীয়দের জাদুর মাহাত্ম নিয়ে জোর একচোট আলোচনা হয়।
এই ফাঁকে সুনন্দ আমাদের দেশে ফেরার কথাটা তোলে।
সর্দার বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ যাবে বইকি! তবে ক-দিন অপেক্ষা কর। আমরা যখন-তখন সমুদ্রযাত্রা করি না। ওপারের দেশ ভালো নয়। ওখানে আমাদের অনেক শত্রু। শিকো কুমি অর্থাৎ দশ দিন অপেক্ষা কর।
তাদের ভালোমতো লোভ দেখালে বা জেদাজেদি করলে হয়তো আগেই আমাদের পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা হতে পারত, কিন্তু এ নিয়ে আমরা বেশি চাপাচাপি করলাম না। ক-টা দিন এই অজানা দ্বীপে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার আকর্ষণ কম নয়।
সর্দার দলবল নিয়ে চলে গেলে আমরাও বেরলাম। স্থির হল সমুদ্রের ধারে ধারে গোটা। দ্বীপটা চক্কর দিয়ে আসব। একজন দ্বীপবাসীকে সঙ্গে নিলাম পথ দেখাতে।
যেতে যেতে লোকটির মুখে শুনলাম এ-দ্বীপে বড় হিংস্র জন্তু নেই। বন্য বড় জন্তু বলতে আছে কেবল শুয়োর। তবে সংখ্যায় বেশি নয়। প্রায়ই তাদের শিকার করা হয় কিনা! আমাদের সঙ্গে বন্দুক-টন্দুক ছিল না, কাজেই সংবাদটা শুনে আশ্বস্ত হলাম।
লোকটি বলল, অবশ্য ছোট জানোয়ার বা সাপখোপের অভাব নেই। খটাসগুলো আকারে ছোট, কিন্তু শয়তানিতে বড় জন্তুকে হার মানায়। প্রায়ই তাদের পোষা ছাগলছানা মারে।
খটাস বা ছোট জন্তু নিয়ে আমরা মাথা ঘামালাম না। তবে কিছুদূর গিয়েই এক দৃশ্য দেখে আমাদের টনক নড়ল। বুঝলাম দুশ্চিন্তার কিছু কারণ আছে বটে।
দেখি একটি লোক বল্লমের ডগায় একটা প্রকাণ্ড মরা সাপ বিধিয়ে ঝুলিয়ে আনছে। লম্বায় সাপটা অন্তত সাত ফুট হবে। মামাবাবু দেখে বললেন, গ্রিন মাম্বা। অতি বিষাক্ত। গোখরো-কেউটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।