লোকটাকে কিন্তু সুবিধের মনে হল না। সুনন্দ বলে।
হ্যাঁ। মামাবাবু চিন্তান্বিত স্বরে বললেন। যাহোক ভালোয় ভালোয় ফিরতে গেলে ওকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে।
টেনেটুনে নৌকোটা সোজা করলাম। আমাদের মালপত্র পাটাতনের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা ছিল, তাই খুলে পড়ে যায়নি। এক এক করে প্যাকেটগুলো খুলে দেখতে থাকি।
হালকা ঠুনকো সমস্ত জিনিস ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। তবে টিনের খাবার, জামা-কাপড়, তাঁবু, বইপত্র, ওষুধের বাক্স, স্টিলের বাসন ইত্যাদি অনেক কিছু মোটামুটি অক্ষত রয়েছে। সুনন্দ বলল, ভাগ্যিস ক্যামেরাটা আমার কাঁধে ছিল। তাই বালিতে পড়ে বেঁচে গেছে।
মামাবাবুর নজর বইয়ের দিকে। যাক বইগুলো রক্ষে পেয়েছে। অল্প ভিজেছে, কিন্তু ছেড়ে-টেড়েনি।
জিনিসগুলো বের করে পরীক্ষা করছি, এমন সময় এক কাণ্ড ঘটল। দ্বীপবাসীরা এতক্ষণ আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে চোখ গোল গোল করে বিদেশিদের সম্পত্তি দর্শন করছিল। হঠাৎ একজন একটা মোজা হাতে তুলে নিল। দেখাদেখি অন্যরাও টপাটপ যে যা পারে হাতাতে শুরু করল।
মহা মুশকিল। বারণ করতে ভরসা হচ্ছিল না, কিন্তু যে রেটে হাতছাড়া হচ্ছে তাতে আমাদের সম্পত্তির আর কিছু বাকি থাকলে হয়! একজন সুনন্দের সিগারেট লাইটারটা ছোঁ মারল। ব্যস, সুনন্দের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। লাইটারটা সুনন্দের এক জাপানি বন্ধু তাকে প্রেজেন্ট করেছিল।
তবে রে! সে খপ করে লোকটার হাত থেকে লাইটার কেড়ে নিয়ে খচ্ করে তার মুখের সামনে আগুন জ্বালল। বলা নেই কওয়া নেই, নাকের কাছে অগ্নিশিখা লাফিয়ে উঠতে দেখে সে তত বাপরে বলে মারল পিছনে এক লম্ফ। অন্যদেরও আক্কেলগুড়ুম। ঘাবড়ে গিয়ে হুড়মুড় করে কয়েক পা হটে গেল। কয়েকজন নারী ও শিশু দিল দৌড়। জাদু, বিদেশি জাদু–মুজিমা ইয়া মাগেনি বলতে বলতে লোকগুলো মহা সোরগোল করে যে যা নিয়েছিল সব ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগল। সুযোগ পেয়ে মামাবাবু বোঝালেন, সাবধান, হাত দিও না, সব মন্ত্র দেওয়া আছে। ভীষণ বিপদে পড়বে।
এই ঘটনাটায় আমাদের মহা উপকার হয়েছিল। দ্বীপবাসীদের ধারণা হয়ে গেল বিদেশিদের জিনিস মন্ত্রপূত বিপজ্জনক। কখন কোনটা থেকে অগ্নিদেব ফোঁস করে উঠবেন কে জানে! ভবিষ্যতে নিজে থেকে না দিলে আমাদের জিনিসে এরা কক্ষনো হাত দেয়নি। সেধে দিতে গেলেও কি আর সহজে নেয়! অনেক করে বোঝাতে হয়েছিল, মন্ত্র-ট সরিয়ে নিয়েছি। নির্ভয়ে গ্রহণ কর বৎস।
একখানা প্লাস্টিকের থালায় দুটো রুমাল, কয়েকটা চকচকে বোতাম, একটা লাল টাই, ইত্যাদি সাজিয়ে নিয়ে আমরা সর্দারের সামনে নিবেদন করলাম–উপঢৌকন।
সর্দার হাত বাড়িয়েই টেনে নিল। আমাদের মুখপানে একটু সন্ত্রস্তভাবে তাকাল। মামাবাবু অভয় দিলেন, ভয় নেই।
সর্দার আড়ম্বর সহকারে প্রণামী গ্রহণ করলেন। মুখ দেখে মনে হল খুশি হয়েছে।
এরপর কিছু উপহার দেওয়া হল কামাউকে। উপহার সে বিনা বাক্যব্যয়ে টেকস্থ করল, কিন্তু মুখে কোনো সন্তোষ প্রকাশ করল না।
যতটা সম্ভব জিনিস বেঁধে-ঘেঁদে কাঁধে তুলে আমরা দ্বীপের মধ্যে উপজাতিদের গ্রামে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। রীতিমতো শোভাযাত্রা করে আমরা বনপথ দিয়ে এগোলাম।
আহত দু-জনকে আমরা ডাল দিয়ে তৈরি স্ট্রেচারে বয়ে নিয়ে চললাম। মামাবাবু তাদের যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ দিয়েছিলেন। যাতে নড়াচড়ায় বেশি কষ্ট না হয়।
প্রায় আধ মাইল চলে আমরা একটা খোলা জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম। মস্ত গোল প্রাঙ্গণ। গাছ কেটে আগাছা সাফ করে পরিষ্কার সমতল করা হয়েছে। চারধারে বাঁশঝাড়ের বেড়া। চত্বরের সীমানা ঘেঁষে ছোট-বড় দশ-বারোটি কুটির। কুটিরের দেয়াল বাঁশের ওপর কাদা লেপে তৈরি। চালে ঘাস-পাতা চাটাইয়ের ছাউনি। এই হচ্ছে আদিবাসীদের গ্রাম।
আমরা ঘাড় থেকে জিনিস নামিয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। তিনটে নারকেল দু-আধখানা করে ভেঙে আমাদের দেওয়া হল খেতে। চমৎকার টাটকা শাঁস। খিদের মুখে স্বাদ লাগল। যেন অমৃত।
আমাদের পৌঁছে দিয়ে পুরুষরা আবার বেরিয়ে গেল তাদের দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহের ধান্দায়।
একটা ডেরা বাঁধতে হয়। আপাতত যে-কটা দিন এখানে থাকতে হবে, মাথা গোঁজার। আশ্রয় চাই। ওদের কুটিরে ওদের সঙ্গে তো আর থাকা চলে না! সুতরাং তাঁবু খাটালাম।
তবু পাতলাম চত্বরের ভিতরে নয়, গ্রাম থেকে একটু দূরে। সমুদ্রতীরের কাছে। এধারে গাছপালা তেমন ঘন নয়, কিন্তু পরে দেখেছি দ্বীপের অন্য পাশে বেশ ঘন।
আমাদের তাঁবুটা বেশ বড়। মাঝখানে একখানা ক্যানভাস ঝুলিয়ে দিতেই দুটো কামরা হয়ে গেল। একটায় থাকবেন মামাবাবু, অন্যটায় আমি ও সুনন্দ। বাকি সমস্ত দিনটা কেটে গেল ক্যাম্প খাটাতে।
মাঝিদের তাঁবুটি পড়ল আমাদের থেকে কিছু দূরে। মামাবাবু আহতদের যথাসম্ভব সেবাশুশ্রূষা করলেন। ওষুধ দিলেন। শক্ত করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। বললেন, আশা করছি কয়েকদিন রেস্ট নিলেই ভালো হয়ে উঠবে।
দ্বীপের বালখিল্যের দল এবং অল্পবয়সী কিছু ছেলে-মেয়ে কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও আমাদের সঙ্গ ছাড়ে নি। আমাদের রকম-সকম, তাঁবু খাটানো, জিনিস গোছানো, সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহে দেখছে এবং অনর্গল বকর বকর করে নিজেদের মধ্যে আমাদের সমালোচনা করছে। তবে সর্বদাই তারা বেশ খানিকটা নিরাপদ ব্যবধান বজায় রেখেছিল–বিদেশি জাদুর ভয়ে।