- বইয়ের নামঃ প্রেতচক্র
- লেখকের নামঃ অনীশ দাস অপু
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
প্রেতচক্র
অতৃপ্ত প্রেতাত্মা
আমি ডুবে যাচ্ছি! আমি ডুবে যাচ্ছি!
পানিতে ছিটকে পড়ার সাথে সাথে আতঙ্কিত হয়ে উঠল চেলসি এমারসন। মনে মনে আকুতি করে উঠল, আমি মরতে চাই না।
কিছুক্ষণ আগে, ন বছরের মেয়েটি তার বাবা-মার চল্লিশ ফুট লম্বা সেইল বোট সী ইয়ার ডেকে শুয়ে সূর্যস্নান করছিল। বোট নোঙর করা ছিল ওয়াকার্স বে তে, এটা বাহামার ছোট একটা দ্বীপ থেকে সিকি মাইল দূরে। চেলসি সাঁতার প্রায় জানেই না, ওর লাইফ জ্যাকেট পরে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ডেকে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল চেলসি। ঘুম ঘুম চোখে জেগে ওঠে ও, ভেষ্ট গায়ে চাপানোর বদলে হাতে ধরে রেখেছিল।
ইয়টের পেছনে, ডেকের ওপর হাঁটতে হাঁটতে কতগুলো পেলিক্যান পাখির উড়ে যাওয়া দেখছিল চেলসি। লক্ষ্য করেনি কোনদিকে যাচ্ছে। ডেকে গুটিয়ে রাখা রশিতে পা বেঁধে হোঁচট খায় ও, মাথাটা দারুণভাবে ঠুকে যায় ডেক ঘিরে রাখা রেইলিং-এ, প্রায় জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা হয় চেলসির। হাত থেকে খসে পড়ে লাইফ জ্যাকেট, টলতে টলতে কয়েক পা এগিয়েছিল চেলসি, তারপর রেইলিং থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যায় ক্যারিবিয়ানের নীল-সবুজ পানিতে।
পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডুবে গিয়েছিল চেলসি। বুঝতেই পারেনি কী ঘটছে। নাকে পানি ঢুকতে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল ও, বাঁচার তাগিদে পানিতে দ্রুত হাত চালাতে লাগল ওপরে ভেসে ওঠার জন্যে। পানির ওপরে ওঠো, নিজেকে নির্দেশ দিল চেলসি। বাতাস দরকার তোমায়। না হলে মরে যাবে। পা চালাও চেলসি, পানিতে লাথি মারো! ভুস করে ভেসে উঠল ও, মুখ হাঁ করে বাতাস টানতে লাগল হাঁপাতে হাঁপাতে। কিন্তু সাহায্যের জন্যে চিৎকার করার আগে আবার পানির নিচে ডুবে গেল চেলসি।
ভেসে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করল মেয়েটা, আতঙ্কে তালগোল পাকিয়ে গেল মাথা। পানিতে পড়লে কীভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে সে কথা একদম ভুলে গেল। শান্ত থাকতে পারছে না ও… চিৎ হয়ে শ্বাস বন্ধ করে থাকলে আপনা আপনি ভেসে উঠবে সারফেসে, এ কথা মনেই নেই। চেলসি শুধু বুঝতে পারছে ও পানির তলায় তলিয়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যু অবধারিত।
হঠাৎ করেই কোত্থেকে যেন শরীরে শক্তি ফিরে পেল চেলসি। জানে হাতে সময় কম। সাগরের সাথে যুদ্ধে হেরে যাবার আশংকাই বেশি। শেষ চেষ্টা করল ও। ওপরে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিল বাঁচাও! বাঁচাও! বলে। কিন্তু সে চিৎকারে জোর নেই। ইয়টে ঘুমিয়ে থাকা চেলসির বাবা-মার কানে পৌঁছুল না মেয়ের মরণ আর্তনাদ।
কেউ সাহায্য না করলে বাঁচতে পারবে না এতক্ষণে বুঝে গেছে চেলসি। আবার পানির নিচে তলিয়ে গেল ও, দম বন্ধ করে রইল। কিন্তু কতক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে থাকা যায়? ফুসফুসে যেন আগুন ধরে গেল। আর পারব না আমি। সব শেষ। এবার সত্যি মারা যাচ্ছি আমি। লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা বাদ দিল হতাশ চেলসি।
হঠাৎ, ভোজবাজির মতো কে যেন চেলসির টি-শার্ট ধরে টানতে লাগল, ওকে উপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পানিতে ভেসে ওঠার পরে বেদম কাশতে লাগল চেলসি। মুখ হাঁ করে বাতাস টানছে। ফুসফুসের আগুন নিভে গেল নিশ্বাস নিতে পেরে। ওহ্, থ্যাঙ্ক গুডনেস, কেউ আমাকে বাঁচিয়েছে। বিদ্বস্ত এবং প্রচণ্ড রকম দুর্বল চেলসি শুধু কোনোমতে বলতে পারল আমাকে ছেড়ে চলে যেয়ো না, তারপর ঘুরল ও। দেখবে কে তার রক্ষাকর্তা। যাকে দেখল তাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না চেলসির।
কোনো মানুষ নয়- ওটা একটা তামাটে রঙের জার্মান শেফার্ড কুকুর। টি শার্ট কামড়ে ধরেছিল কুকুরটা। ছেড়ে দিল। চেলসি পাগলের মতো ওটার পেছনের একটা পা চেপে ধরল। জোরে জোরে পা দিয়ে স্ট্রোক মেরে মেরে ধীরে ধীরে সাঁতার কাটতে শুরু করল কুকুর, চেলসিকে নিয়ে এগোল তীরের দিকে।
অগভীর পানিতে পৌঁছে কুকুরটাকে ছেড়ে দিল চেলসি, হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পড়ল তীরে, একটা পাথরের স্তূপের পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান ফিরল জার্মান শেফার্ডের জিভের স্পর্শে। ওর মুখ জিভ দিয়ে চাটছে কুকুরটা।
চেলসি জড়িয়ে ধরল কুকুরটার গলা। বারবার বলতে লাগল, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। প্রত্যুত্তরে লেজ নেড়ে সরে গেল কুকুর। তাকাল সী ইয়ার দিকে। উঁচু গলায় ডাকতে লাগল। চেলসি এখনো হাঁপাচ্ছে। বালুতে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকল ও। কুকুরটার ঘেউ ঘেউ থামার পরে উঠে বসল। দেখল চলে গেছে শেফার্ড। চারদিকে চোখ বুলাল ও। কোথাও চিহ্ন নেই ওর রক্ষাকর্তা কুকুরের।
এদিকে, সেইলবোটে, চেলসির বাবা-মা কেন এবং অ্যালেন ঘুম ভেঙে দেখলেন তাদের কন্যা লাপাত্তা। ডেকের ওপরে, নিচে মেয়েকে কোথাও না পেয়ে– তারা উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন, চেলসি! চেলসি! কোথায় তুমি?
হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন কেন। ষ্টার্নে চেলসির জ্যাকেট আছে শুধু। ও নেই।
মেয়ে আমার পানিতে পড়ে যায়নি তো! আঁতকে উঠলেন এলেন। তাঁরা এবার উন্মাদের মতো ডাকাডাকি শুরু করলেন মেয়ের নাম ধরে।
সাগর তীর বসে চেলসি শুনতে পেল ওদের ডাক। হাত উঁচু করে সে চেষ্টাতে শুরু করল, এই যে আমি এখানে!
ওই তো চেলসি! আনন্দে অ্যালেনের কেঁদে ফেলার জোগাড়। সাগর তীরে। ও গড। ও বেঁচে আছে!