- বইয়ের নামঃ শেবা
- লেখকের নামঃ জ্যাক হিগিনস
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য,রোমাঞ্চকর, গোয়েন্দা কাহিনী
শেবা
০১. বার্লিনে বৃষ্টিঝরা মার্চের শেষ বিকেল
শেবা / মূল : জ্যাক হিগিনস / ভাষান্তর : কাজী আখতারউদ্দিন
অনুবাদকের উৎসর্গ
আমার সহধর্মিণী হাবিবা খান-কে
বাতাসের ঝাপটায় মুখ ঢেকে রাখা কাপড়টা সরে যেতেই খোলা মুখের চামড়ায় জ্বলন্ত সুর্যের তেজ কেটে বসেছে। তারপর আবার সে মুখ থুবড়ে বালুতে পড়ে গেল, আবার জামাল তাকে টেনে তুলল।
এবার সে জামালের চওড়া কাঁধে এলিয়ে পড়ল। সে ভ্রু কুঁচকে মাথা ঝাঁকাল, চেষ্টা করল পরিষ্কারভাবে সবকিছু ভাবতে, কিন্তু কোন কাজ হলো না। এখন আর কোন কিছুই ভাল নেই। সে অন্ধকার একটা তাপের শূন্যতার মাঝে সেঁধিয়ে একটু একটু করে তার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলল।
তার মুখে বালু ঢুকেছে। সে আর হাতের আঙুল দিয়ে মাটি আঁচড়াতে লাগল। কিন্তু এবার কোন শক্ত হাত থাকে ধরে টেনে তুলল না। এবার সে সম্পূর্ণ একা।
.
খ্রিষ্টপূর্ব ২০ অব্দে রোমান সেনাপতি এলিয়াস গ্যালাস, দক্ষিণ আরব জয়ের চেষ্টা করেছিলেন। তবে সেই অভিযানে ‘রাভ আল খালি’ নামে এক ভয়ংকর শূন্য এলাকায় তার সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সেনাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যালেক্সিয়াস নামে এক দুঃসাহসী গ্রিক দলপতি। ১০ম লিজিয়নের একশো সেনার এই দলপতি সেই মরুভূমি থেকে হেঁটে ফিরে আসেন, বয়ে নিয়ে আসেন প্রাচীন জগতের এক লুক্কায়িত বিষয়। বাদশাহ সোলায়মানের গুপ্তধনের মতো এটিও একটি অত্যাশ্চর্য নিদর্শন, যা দুহাজার বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর…
.
বার্লিন, মার্চ ১৯৩৯
০১.
বার্লিনে বৃষ্টিঝরা মার্চের শেষ বিকেল। একটি কালো মার্সেডিস লিমোজিন উইলহেমস্ট্রাস দিয়ে নতুন রাইখ চ্যান্সেলারির দিকে যাচ্ছে। ওই ভবনটি জানুয়ারিতে উদ্বোধন করা হয়েছে। এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করার জন্য হিটলার এক বছর সময় দিয়েছিলেন। তবে সময়সীমা শেষ হওয়ার দুসপ্তাহ আগেই তার নির্দেশ পালিত হয়। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী–এবহোয়ের চিফ, এডমিরাল উইলহেম ক্যানারিস একটু ঝুঁকে গাড়ির জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিলেন, যাতে তিনি ভবনটি ভালভাবে দেখতে পারেন।
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘অবিশ্বাস্য ব্যাপার, বুঝতে পেরেছো হান্স, ভস-স্ট্রাসের দিকে শুধু সামনের দিকটাই সিকি মাইল লম্বা।
পাশে বসা তার সহকারী হান্স রিটার একজন লুফটওয়াফ ক্যাপ্টেন। আয়রন ক্রস সেকেন্ড ও ফার্স্ট ক্লাস প্রাপ্ত সুদর্শন যুবকটি মুখ ফেরাতেই তার ডান গালে একটি বিভৎস ক্ষত চিহ্ন চোখে পড়ল; আর তার পায়ের কাছে দেখা গেল একটি পায়ে ভর দেবার লাঠি পড়ে রয়েছে। স্পেনিশ সিভিল ওয়ারে যখন সে জার্মান কনডর লিজিয়নে উড়ছিল তখন একজন আমেরিকান ভলান্টিয়ার পাইলট গুলি করার ফলে তার এই দুর্দশা হয়েছে।
সে বলল, “ঐ পিলারগুলো আর মার্বেল ইত্যাদিসহ এটাকে প্রাচীন যুগের একটি অত্যাশ্চর্য নিদর্শন মনে হচ্ছে, হের এডমিরাল।
‘তার মানে নতুন যুগের একটি নিদর্শনের বদলে?’ ক্যানারিস কাঁধে একটা কঁকি দিয়ে জানালার কাঁচটা উঠিয়ে দিলেন। সবকিছু এক সময়ে চলে যায় হান্স, এমনকি থার্ড রাইখও। যদিও আমাদের প্রিয় ফুয়েরার আমাদেরকে এক হাজার বছরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি কেস থেকে একটা সিগারেট বের করতেই রিটার তার লাইটার দিয়ে সেটা ধরিয়ে দিল। প্রবীন লোকটির কথার সুরে প্রচ্ছন্ন উপহাসের আভাস পেয়ে সব সময়ের মতো সে একটু শঙ্কিত হল।
‘তা আপনি যা বলেন, হের এডমিরাল।
কী এক উদ্ভট ভাবনা তাই না? হয়তো একদিন, টুরিষ্টরা এই চ্যান্সেলারির ভগ্নাবশেষের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখবে, যেরকম তারা মিশরে লুক্সর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখে বেড়ায়; আর মন্তব্য করবে, ‘ভাবছি কি ছিল জিনিসটা?
মার্সিডিসটা গিল্টি করা চকচকে গেট পেরিয়ে সোজা সামনের বিশাল প্রবেশ পথের সিঁড়ির দিকে এগোলো৷ রিটার একটু অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। ‘হের এডমিরাল যদি অনুগ্রহ করে আমাকে একটু আভাস দিতেন কেন আমাদের এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে?
‘এ সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তাছাড়া উনি কেবল আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, তোমার সাথে নয়, হান্স। আমি তোমাকে সাথে এনেছি যদি অস্বাভাবিক কোন কিছু ঘটে যায়, সে কারণে।
‘আমি কি গাড়িতে অপেক্ষা করব?’ গাড়িটা সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছাতেই রিটার জিজ্ঞেস করল।
‘না তুমি রিসিপশনে অপেক্ষা করতে পার। জায়গাটা বেশ আরামপ্রদ আর সেখানে তুমি থার্ড রাইখের নতুন শিল্প কর্মগুলো দেখতে পারবে, সময়টাও বেশ কেটে যাবে।
তার ড্রাইভার, ক্রেগম্যারিন পেটি অফিসারটি ঘুরে এসে দরজা খুলে ধরল। ক্যানারিস গাড়ি থেকে বের হয়ে রিটারের জন্য অপেক্ষা করলেন। তার যথেষ্ট বেগ পেতে হল গাড়ি থেকে নামতে। সার্জিক্যাল নকল বাম পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াবার পর সে হাতের লাঠির সাহায্যে বেশ স্বচ্ছন্দে এগিয়ে গেল। তারপর দুজনে একসাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।
এস এস গার্ডরা ছিল লেইবস্টান্ডার্ট এডলফ হিটলারের বাহিনীর অধীনে। এদের ইউনিফর্ম কালো আর বুকে সাদা চামড়ার বর্ম। ক্যানারিস আর রিটার ভেতরে ঢুকতেই এরা চৌকশ স্যালুউট করল। চমৎকার হলঘরটির মেঝেটা মোজাইকের, দরজাগুলো সতেরো ফুট উঁচু আর দরজার গায়ে নখে স্বস্তিকা আঁকড়ে ধরা ঈগলের বিশাল প্রতিকৃতি। সোনালি রঙের ডেস্কে ড্রেস-ইউনিফর্ম পরা একজন তরুণ হটস্টার্ন-ফুয়েরার বসে রয়েছে। দুজন আর্দালি তার পেছনে দাঁড়ানো রয়েছে। সে এক লাফে উঠে দাঁড়াল।