প্রথম প্রতিশ্রুতি প্রখ্যাত ভারতীয় লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীর একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসটির বিষয়বস্তু অবলম্বনে একটি সিনেমাও তৈরী করা হয় এবং প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসটির জন্য আশাপূর্ণা দেবী সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। প্রথম প্রতিশ্রুতি বইটি আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৬৪ সালে প্রকাশ করেন। সুরতাং আর দেরি না করে এখনি বিখ্যাত এই উপন্যাসটি পড়া শুরু করুণ।
প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাস বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ প্রথম প্রতিশ্রুতি
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. সত্যবতীর গল্প
ভূমিকা
বহির্বিশ্বের ভাঙাগড়ার কাহিনী নিয়ে রচিত হয় বিগত কালের ইতিহাস। আলো আর অন্ধকারের পৃষ্ঠপটে উচ্চকিত সেই ধ্বনিমুখর ইতিহাস পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চিত রাখে প্রেরণা, উন্মাদনা, রোমাঞ্চ। কিন্তু স্তিমিত অন্তঃপুরের অন্তরালেও কি চলে না ভাঙাগড়ার কাজ? যেখান থেকে রং বদল হয় সমাজের, যুগের, সমাজ মানুষের মানসিকতার। চোখ ফেললে দেখা যায়। সেখানেও অনেক সঞ্চয়। তবু রচিত ইতিহাসগুলি চিরদিনই এই অন্তঃপুরের ভাঙাগড়ার প্রতি উদাসীন। অন্তঃপুর চিরদিনই অবহেলিত। বাংলাদেশের সেই অবজ্ঞাত অন্তঃপুরের নিভৃতে প্রথম যাঁরা বহন করে এনেছেন প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর, এ গ্রন্থ সেই অনামী মেয়েদের একজনের কাহিনী।
তুচ্ছ দৈনন্দিনের পৃষ্ঠপট আঁকা এই ছবি যদি বহন করে রাখতে পেরে থাকে বিগত কালের সামান্যতম একটি টুকরোকে, সেইটুকুই হবে আমার শ্রমের সার্থকতা।
–লেখিকা
॥ এ গ্রন্থে বর্ণিত চরিত্রগুলির পরিচয় ॥
মূল চরিত্র – সত্যবতী
রামকলী – সত্যবতীর বাবা
জয়কালী – ঠাকুর্দা
কুঞ্জ – জ্যাঠামশাই
জটা—পিসির ছেলে
নবকুমার—স্বামী
নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে—শ্বশুর
সাধন—ছোট ছেলে
সরল—ছোট ছেলে
ফেলু বাঁড়ুয্যে—রামকালীর শ্বশুর
রাসবিহারী—কুঞ্জর বড় ছেলে
নেড়ু—কুঞ্জর ছোট ছেলে
ভবতোষ—নবকুমারের শিক্ষক
নিতাই—নবকুমারের বন্ধু
লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুয্যে—পাটমহলের জমিদার
শ্যামাকান্ত—ঐ জমিদার-পুত্র
রাখহরি ঘোষাল—ঐ প্রতিবেশী
দয়াল মুখুয্যে
নগেন—কাটোয়র যুবক
বিদ্যারত্ন—রামকালীর ভক্তিভাজন পণ্ডিত
গোবিন্দ গুপ্ত—আশ্রয়দাতা
পটলী ঘোষাল
বিপিল লাহিড়ী—প্রতিবেশী
মুকুন্দ মুখুয্যে—সৌদামিনির স্বামী
তুষ্ট—গোয়ালা
রঘু—তুষ্টুর নাতি
বিন্দে—ওঝা
গোপেন–রাখাল
সরল–চ্ছোট
ভুবনেশ্বরী–সত্যবতীর মা
দীনতারিনী — ঠাকুমা
কাশীশ্বরী
মোক্ষদা– পিসঠাকুর
শিবজায়া
নন্দরানী – জ্ঞাতিঠাকুমা
নিভাননী
সুকুমারী – মামী
এলোকেশী–সত্যবতীর শাশুড়ী
পুণ্যি— সত্যবতীর সমবয়সী পিসি
খেঁদি–বাল্যবান্ধবী
সুবৰ্ণ – মেয়ে
সেজ পিসি – জটার মা
শশীতারা–কুঞ্জর বোন
অভয়া–স্ত্রী
সারদা–রাসুর বৌ
পটলী–রাসুর দ্বিতীয় স্ত্রী
শঙ্করী (কাটোয়ার বৌ)– কাশীশ্বরীর নাতবৌ
বেহুলা–শ্যামাকান্তের স্ত্রী
ভাবিনী–নিতাইয়ের স্ত্রী
মুক্তকেশী–এলোকেশীর সইয়ের মেয়ে
সৌদামিনী–এলোকেশীর ভাগ্নী
সুহাস–শঙ্করীর মেয়ে
সাবিপিসি, রাখুর মা, নাপিত-বৌ, দত্তগিন্নী ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ ইত্যাদি।
০১.
সত্যবতীর গল্প আমার লেখা নয়। এ গল্প বকুলের খাতা থেকে নেওয়া। বকুল বলেছিল, একে গল্প বলতে চাও গল্প, সত্যি বলতে চাও সত্যি।
বকুলকে আমি ছেলেবেলা থেকে দেখছি। এখনও দেখছি। বরাবরই বলি, বকুল, তোমাকে নিয়ে গল্প লেখা যায়। বকুল হাসে। অবিশ্বাস আর কৌতুকের হাসি। না, বকুল নিজে কোনদিন ভাবে না—তাকে নিয়েও গল্প লেখা যায়। নিজের সম্বন্ধে কোন মূল্যবোধ নেই বকুলের, কোন চেতনাই নেই।
বকুলও যে সত্যিই পৃথিবীর একজন এ কথা মানতেই পারে না। বকুল। সে শুধু জানে, সে কিছুই নয়, কেউই নয়। অতি সাধারণের একজন, একেবারে সাধারণ–যাদের নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কিছুই লেখবার থাকে না।
বকুলের এ ধারণা গড়ে ওঠার মূলে হয়তো ওর জীবনের বনেদের তুচ্ছতা। হয়তো এখন অনেক পেয়েও শৈশবের সেই অনেক কিছু না পাওয়ার ক্ষোভটা আজও রয়ে গেছে তার মনে। সেই ক্ষোভই স্তিমিত করে রেখেছে তার মনকে। কুণ্ঠিত করে রেখেছে তার সত্তাকে।
বকুল সুবৰ্ণলতার অনেকগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে একজন। সুবৰ্ণলতার শেষদিকের মেয়ে।
সুবৰ্ণলতার সংসারে বকুলের ভূমিকা ছিল অপরাধীর।
অজানা কোন এক অপরাধে সব সময় সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবে বকুলকে, এ যেন বিধি-নির্দেশিত বিধান।
বকুলের শৈশব-মন গঠিত হয়েছিল তাই অদ্ভুত এক আলোছায়ার পরিমণ্ডলে। যার কতকাংশ শুধু ভয় সন্দেহ আতঙ্ক ঘৃণা, আর কতকাংশ জ্যোতির্ময় রহস্যপুরীর উজ্জ্বল চেতনায় উদ্ভাসিত। তবু মানুষকে ভাল না বেসে পারে না বকুল। মানুষকে ভালবাসে বলেই তো—
কিন্তু থাক, এটা তো বকুলের গল্প নয়। বকুল বলেছে, আমার গল্প যদি লিখতেই হয় তো সে আজ নয়। পরে। জীবনের দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসে বুঝতে শিখেছে বকুল, পিতামহী প্রপিতামহীর ঋণশোধ না করে নিজের কথা বলতে নেই।
নিভৃত গ্রামের ছায়ান্ধকার পুষ্করিণীই ভরা বর্ষায় উপচে উঠে নদীতে গিয়ে মিশে স্রোত হয়ে ছোটে। সেই ধারাই ছুটে ছুটে একদিন সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। সেই ছায়ান্ধকারের প্রথম ধারাকে স্বীকৃতি দিতে হবে বৈকি।
আজকের বাংলাদেশের অজস্র বকুল-পারুলদের পিছনে রয়েছে অনেক বছরের সংগ্রামের ইতিহাস। বকুল-পারুলদের মা দিদিমা পিতামহী আর প্রপিতামহীদের সংগ্রামের ইতিহাস। তারা ংখ্যায় অজস্র ছিল না, তারা অনেকের মধ্যে মাত্র এক-একজন। তারা একলা এগিয়েছে। এগিয়েছে খানা ডোবা ডিঙিয়ে পাথর ভেঙে কাটাঝোঁপ উপড়ে। পথ কাটতে কাটতে হয়তো দিশেহারা হয়েছে, বসে পড়েছে নিজেরই কাটা-পথের পথ জুড়ে। আবার এসেছে আর একজন; তার আরব্ধ। কর্মভার তুলে নিয়েছে নিজের হাতে। এমনি করেই তো তৈরী হল রাস্তা। যেখান দিয়ে বকুল-পারুলরা এগিয়ে চলেছে। বকুলরাও খাটছে বৈকি। না খাটলে চলবে কেন? শুধু তো পায়ে চলার পথ হলেই কাজ শেষ হল না।