- বইয়ের নামঃ নদী দিকহারা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. বৌভাতের রাত্রে
নদী দিকহারা – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
ব্যাপারটা ধরা পড়ল দীপকের বৌভাতের রাত্রে। যখন সারা বাড়ি নিমন্ত্রিত অভ্যাগতে গমগম করছে, যখন কোথাও কোনখানে এক ফালি অন্ধকারের আড়াল না রেখে আপাতমস্তক আলোর অলঙ্কারে ঝকমকাচ্ছে নতুন রং করা পুরনো বাড়িটা, আর নতুন শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা বেঁধে হাঁপিয়ে এবং দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন জয়াবতী। ঠিক সেই সময় জয়াবতীর বড় ননদের মেয়ে মহাশ্বেতা ওঁকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে কপালে হাতচাপড়ে খবরটা দিল।
প্রচলিত অনেক কথার মতই জয়াবতী যখন তখন অকস্মাৎ বজ্রাঘাত কথাটা ব্যবহার করে থাকেন, এটা যে অর্থবহ কথা তা বোধকরি কখনও খেয়ালও করেন না, বোধকরি আজই প্রথম টের পেলেন কথাটার যথার্থ অর্থ কি?
আকাশের বজ্র সত্যিই এসে মাথায় পড়লে তো বরং এর থেকে ভালই ছিল, তাতে কাঠ হয়ে গিয়ে কাঠ হয়েই থাকতে পেতেন জয়াবতী, আবার তখুনি কিংকর্তব্য চিন্তা করতে বসতে হত না।
চাপা-গলায় দাঁতে পিষে উচ্চারণ করলেন জয়াবতী, ওরে মহাশ্বেতা, এ কী ভাগ্য আমার! শাস্তি দিয়ে দিয়েও কি আশ মিটছে না ভগবানের!
মহাশ্বেতা বলল, ও কথা পরে ভেবো মামী, এখন কি করবে তাই বল।
তা বটে। ভাগ্য আর ভগবান এই দুই আসামী এখন হাজতে থাক, তাদের বিচার পরে, আপাতত বর্তমান আততায়ীর হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে।লোকচক্ষু নামক আততায়ীর দলে যে আজ বাড়ি বোঝাই।
সেই বোঝাই বাড়ি থেকে আততায়ীদের চোখ এড়িয়ে জয়াবতী মেয়ে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করলেন। কিন্তু দরজা বন্ধ করেও মাথা খোঁড়বার উপায় নেই, টু শব্দটি না ওঠে। শুধু যে। লোক জানাজানির ভয়ে তাও নয়, একটা হুলস্নাড়ে নিমন্ত্রিতের খাওয়া-দাওয়ার যে বিঘ্ন ঘটবে। এত খরচ করা বিপুল আয়োজন পণ্ড হবে শেষটা!
দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ের হাত ধরে বসে রইলেন জয়াবতী, মহাশ্বেতা মাথায় জল দিয়ে বাতাস করতে লাগল তাকে।
হ্যাঁ মহাশ্বেতা ঘরে আছে, তাকে না নিলে চলবেই বা কেন? একা জয়াবতীর সাধ্য কি যে এই উন্মাদিনীকে সামলায়? তাছাড়া মহাশ্বেতাই তো আগে দেখেছে, আবিষ্কর্তার গৌরব তো তারই। তবু যাই ভাগ্যিস দেখেছিল, নইলে হঠাৎ যদি বাইরের কারও চোখে পড়ত! আঃ, তাহলে কি হত সেই কথা ভেবে জয়াবতী আর একবার নিঃশব্দে কপাল চাপড়ালেন।
মহাশ্বেতা মৃদুস্বরে আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করে, তুমি অত ভেঙে পোড়োনা মামী, হিস্টিরিয়াও হতে পারে।
হতে পারে! আশ্বাসে নিশ্চয়তার সুর নেই।
জয়াবতী বললেন, আমার কপালে তা হয়ে রেহাই যাবে না রে মহা, ও যা ভাবছি তাই। নইলে বরফে কখনো আগুন ধরে?
তা তুলনাটা বোধকরি খুবই ঠিক দিলেন জয়াবতী, বেশি নভেল নাটক না পড়লেও, আর অনেক কথা জানা না থাকলেও, প্রাণ ফেটে বেরিয়ে এসেছে কথাটা।
অমিতার মত মেয়ের পক্ষে উন্মত্ততা, বরফে আগুন লাগার মতই ভয়ঙ্কর বিস্ময়। এত শান্ত, এত স্তব্ধ, এত সভ্য আর এত মৃদু মেয়ে এ যুগে কটা দেখতে পাওয়া যায়?
ভাগ্য তাকে মেরে রেখেছে, কিন্তু সেই মার খাওয়ার পর থেকে, একদিনের জন্যেও কেউ দেখেছে ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে সে? যেদিন থেকে জেনেছে–অতঃপর সারাজীবনটাই তার পিত্রালয় বাস যোগ, সেদিন থেকেই মা বাপের সংসারের সমস্ত দায় মাথায় তুলে নিয়েছে সে। আর সে দায়িত্ব পালন করে চলেছে নিঃশব্দে হাসিমুখে।
এই যে পিঠোপিঠি ছোট ভাই দীপকের বিয়ের ব্যাপার-এর তন্ত্রধারক কে? ওই অমিতা। দীপক যখন এম. এ. পড়তে পড়তে প্রেমে-ট্রেমে পড়ে একাকার করল, কার কাছে এসে জানাল সেই ভয়ঙ্কর সুখ আর ভয়ঙ্কর বিপদের বার্তা? ওই অমিতাকেই তো। আবার মা-বাপের মত করানোর মত দুরূহ কাজটাও ছোড়দির ওপর দিয়েই গেল। ছোড়দিই যে তার আজীবনের বন্ধু, সঙ্গী, সুহৃদ।
অমিতা বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়াতে সবচেয়ে নিঃসহায় হয়ে পড়েছিল দীপকই। তা অবিশ্যি বেশিদিন সে অবস্থা রইল না, আবার পুরনো কেন্দ্রে ফিরে আসতে হল অমিতাকে।
প্লেন ক্র্যাশ হয়ে মারা গেল অমিতার বর, কায়রো পর্যন্ত এসে!
বিয়ে করেই বিলেত চলে গিয়েছিল জামাই, সবে ফিরছে। অনেক উপঢৌকন, অনেক আকুলতা, আর অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল সবাই। পরিকল্পনা চলছিল কে কে দমদমে যাবে ফুলের মালা নিয়ে। সবকিছুই স্তব্ধ হয়ে গেল।
পরিকল্পনা অমিতাকে নিয়েও চলল কিছুদিন। সে কি তবে আবার এম. এ.-টা পড়বে? না কি যতটা বিদ্যে আছে ততটা নিয়েই কোন কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে? নাকি মহারাজজীর চরণেই ধরে দেওয়া হবে ওকে, যা করো ঠাকুর বলে?
কিন্তু পরিকল্পনা আর কাজ এক নয়, শেষ পর্যন্ত সবই ধামাচাপা পড়ে গেল। অবশ্য অমিতার শিথিলতাও চাপা পড়ে যাবার একটা বড় কারণ। ও যদি নিজের সম্পর্কে কিছু একটা স্থির করে ফেলতে পারত, তাহলে হয়তো সে ব্যবস্থাটা হতই। কিন্তু অমিতা অন্তঃপুরের অন্ধকার কোণটাই বেছে নিল।
অতএব সংসার নিয়ে জয়াবতীর গতর খরচ বাঁচল, ছোট ছেলে দুটোর প্রাইভেট টিউটরের খরচ বাঁচল, সমস্ত পরিবারের দরজির খরচ বাঁচল। যতদিন বিয়ে হয় নি পড়া ছিল, গান শেখা ছিল, সিনেমা দেখা এবং গল্পের বই গেলা ছিল, আর ছিল ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখা। অতগুলো কাজের একটাও যখন আর রইল না, অফুরন্ত সময় কেন থাকবে না অমিতার হাতে?