- বইয়ের নামঃ খুনের দায়
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ মাসুদ রানা
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অপরাধ, রোমাঞ্চকর গল্প, গুপ্তচর
খুনের দায়
১
ভারী জুতোর গটমট শব্দ তুলে কামরায় ঢুকল লোকটা। ফাইল থেকে চোখ তুলে একনজর দেখেই চিনতে পারল রানা। বেশ লম্বা-চওড়া, বয়স কম-বেশি পঞ্চাশ, খেলোয়াড়ি একটা ভাব আছে চেহারায়, মাথাজোড়া বিশাল টাক, নীল চোখ, পরনে ভাল দরজির তৈরি দামি পোশাক। ‘মিস্টার মাসুদ রানা, ছোট্ট একটা কাজ নিয়ে এসেছি আপনার কাছে। আমাকে মনে আছে তো? লইয়ার অ্যাডাম ক্লিপটন-ও-ও-ই যে, বছর খানেক আগে সেই পাগলি অলিভা-র কেসে মাফিয়া ডন মারিয়ো মারকাস আর সলিসিটার হাওয়ার্ড ব্লেচারের পক্ষে লড়েছিলাম…’
‘কিন্তু জিততে পারেননি, জেল খাটতে হয়েছে ওদেরকে।’ হাসিমুখে বলল রানা, ‘আপনার তো কোনও কাজে আমার কাছে আসার কথা নয়, মিস্টার ক্লিপটন।’
‘আপনার যোগ্যতাই টেনে এনেছে আমাকে, মিস্টার রানা। অতীতের কোনও কথা মনে রাখি না আমি,’ বলে রানার চেয়ারের পাশে দাঁড়ানো বড়জোর সাড়ে চার ফুট লম্বা, কালো, পাটকাঠির মত শুকনো লোকটার দিকে ভ্রূ কুঁচকে চাইল লইয়ার। ‘এই পিওনটাকে এখান থেকে ভাগানো যায়? একটা গুরুত্বপূর্ণ…’ রানাকে মাথা নাড়তে দেখে থেমে গেল সে।
‘না,’ বলল রানা দৃঢ়কণ্ঠে। ‘ইনিই নিউ ইয়র্ক শাখার বর্তমান চিফ। ইনি থাকবেন। যা বলতে এসেছেন, এঁর সামনেই বলুন।’ আবছা ইঙ্গিতে দু’জনকেই বসতে বলল রানা।
‘ডেঁড়িয়ে থাকতেই ভাল্লাগচে, সার!’ বলল বত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পনড়ব বেঁটে লোকটা। ক্যালক্যাটা থেকে বাংলাদেশে মাইগ্রেট করা দাগী চোর ছিল সে একসময়। জেল খেটেছে জীবনের বেশিরভাগ সময়। সব ছেড়ে রানার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে মানুষটা একসময় ভালবাসার বাঁধনে। রানাকে এতই ভক্তি করে যে ওর সামনে কিছুতেই চেয়ারে বসবে না গিলটি মিয়া। ‘কিচু মনে করবেন না, সার। সেই সক্কাল থেকে তো বসেই আচি…’
আর একবার গিলটি মিয়ার উপর অসন্তুষ্ট দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে রানার সামনের চেয়ারে বসল লইয়ার ক্লিপটন। বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘একজন লোককে খুঁজছি আমি। এটাই কাজ।’
‘এই কাজ নিয়ে আমাদের কাছে এসেছেন কেন? পুলিশকে জানান। কিংবা কোনও প্রাইভেট আই-কে দিন কাজটা।’
‘এটা পুলিশের কোনও ব্যাপার নয়, মিস্টার রানা,’ যেন রানার নিরাসক্তি হতাশ করেছে ওকে। ‘কী ব্যাপার, কাজ দরকার নেই নাকি আপনাদের?’
‘কাজের অভাব নেই, আবার তেমন একটা চাপও নেই। আসল কথা, এটা আমাদের লাইনের কাজ নয়।’
‘যা চাইবেন সেই ফি পেলে কি আপনি…’
‘আমাদের ফি সম্পর্কে ধারণা আছে আপনার?’
মাথা নাড়ল লইয়ার। ‘বলুন, কত দিতে হবে আপনাকে?’ গিলটি মিয়ার দিকে ফিরল রানা। ‘শোনাও দেখি, কত পেলে করবে তুমি কাজটা?’
লোকটার উপর চোখ বুলাল গিলটি মিয়া। মনে মনে বলল, ‘নাহ্! এ-লোককে এট্টুও পচোন্দ হচ্চে না আমার!’ মুখে বলল, ‘সব কতা না শুনে, কদ্দিনের কাজ না জেনে নিদ্দিষ্ট কিচু তো বলা যাচ্চে না, সার। একটা ধারণা দিতে পারি বড়জোর। আমাদেরকে লিলে পেত্যেক দিনের লেগে দু’ থেকে পাঁচ হাজার টাক-, থুড়ি, ডলার মজুরি গুনতে হবে। আগাম দিতে হবে দু’দিনের ফিশ।’
কথাগুলো অবশ্য বাংলায় বলেনি ও, নিউ ইয়র্কের সাদা লোকগুনো বাংলা বোজে না। তাই ইংরেজি-বাংলা-হিন্দি- জার্মান-ফ্রেঞ্চ-ইটালিয়ান, মোটকথা পৃথিবীর তাবৎ ভাষা মিলিয়ে কাজ চালানোর মত নিজের একটা বুলি তৈরি করে নিয়েছে ও। আর আশ্চর্য হলেও সত্যি, ওর কথা বুঝতে কারও অসুবিধে হয় না, সবাই কী করে জানি বুঝে নেয় ওর বক্তব্য। এই লোকও বুঝেছে।
‘অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে না?’ ফি-র বহর শুনে ভিরমি খেল লইয়ার। ‘শুনে তো মনে হচ্ছে, আইন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে এরকম একটা অফিস নিয়ে বসলেই ভাল করতাম।’
‘আপনাকে আঁটকাচ্চে কে? সেইটেই করুন না, মিশটার,’ একগাল হেসে নিষ্পাপ চোখ মেলে বলল গিলটি মিয়া।
‘আপনার এই কেস লিয়েই আরাম্ব কত্তে পারেন গোয়েন্দাগিরি।’ গিলটি মিয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে রানার মুখের দিকে চাইল ক্লিপটন। ‘ঠিক আছে, উপযুক্ত ফি দিতে রাজি আছি আমি। ব্যাপারটা হয়েছে কী…’
‘প্লিজ, ওর সঙ্গে যান। ওর অফিসে বসে কাজটা বুঝিয়ে দিন। খাতায় নোট নিতে হবে ওর, অগ্রিম টাকা নিয়ে রসিদও দেবে ও-ই। আমার ধারণা, দু’দিনের বেশি লাগবে না ওর এই কাজে।’
‘কিন্তু আপনি শুনবেন না…’
‘শুনব। এই ঘর থেকে আপনাদের সব কথাই শোনা যাবে।’ দেয়ালে বসানো স্পিকার দেখাল রানা ইঙ্গিতে। ‘কাজটা ও-ই করবে, তবে কাজ শুরু হওয়ার পর প্রয়োজনে আমার পরামর্শ নেবে। যান।’
মাস দুয়েকের জন্য গিলটি মিয়াকে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির নিউ ইয়র্ক শাখার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে ঢাকা থেকে। যদিও এই দেশটা ওর পচোন্দো নয়, রানার নির্দেশে আসতেই হয়েছে বাদ্য হয়ে। ক্লিপটনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কামরায় ফিরে বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে বসল সে রিভলভিং চেয়ারে। আইনজীবী বসল সামনের গদিমোড়া চেয়ারে। বার দুই দোল খেয়ে নিয়ে বেল টিপল গিলটি মিয়া। জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবেন, মিশটার আদম? চা না কপি?’